যোগীর
সাথে যোগাযোগ : ‘‘যোগাৎ
চিত্ত-বৃত্তি নিরোধ’’ –তপন দাস
বর্তমান
পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বললেন, “যোগী মানেই বুঝবেন—যে যুক্ত, যার
যোগ আছে অর্থাৎ কিছু বা কাহাতেও টান
আছে,—এক-কথায় আসক্ত, কোন-কিছু বা কাহাতেও আসক্ত। আসক্তি থাকলে ভাবা, করা, কওয়ায় মানুষের
যেমন-যেমন যা’-যা’ হয়, তাই করাই হচ্ছে যোগী বা যুক্ত বা অনুরক্ত মানুষের লক্ষণ। ……তাই, শাস্ত্রে যেখানেই
যোগ বলে কথা আছে সেখানেই বুঝতে হবে, সে-কথা বাস্তব কিছুতে যুক্ত হওয়ারই কথা। আর,
এই যোগ হলেই মানুষের চিত্তবৃত্তিনিরোধ হতে সুরু করে, কারণ, যাতে আমার টান যত বেশী,
আমার সাধারণ প্রবৃত্তিই হয় আমার সমস্ত বৃত্তি দিয়ে তাকে উপভোগ করি—আর তার বাধা
যেগুলি, সেগুলিকে এমনতরভাবে বিনিয়ে আমার এই উপভোগের পথের কোনরকম বাধা না সৃষ্টি
করে বরং তার সাহায্য করে এমনতরভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে একটা স্বতঃ-উৎসারিত ঝোঁক
আমাদের থাকেই। তাই
শাস্ত্রে আছে “যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ’’। (কথাপ্রসঙ্গে, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৩)
আধ্যাত্মিক চেতনায় একনিষ্ঠ না হলে যোগের
সাথে নিত্য-যুক্ত থাকা যায় না। সে বিষয়েও শ্রীশ্রীঠাকুর আমাদের সচেতন করার জন্য
বললেন, ‘‘গীতায় আছে, ‘তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তির্বিশিষ্যতে’………একভক্তি
না হলে হবে না । পঁচিশ ঠাকুর করলেই মুস্কিল, বহু-নৈষ্ঠিক
যারা তাদের জীবনে কোন সঙ্গতি থাকে না, তারা আস্তে আস্তে পাগলাটে হয়ে ওঠে । বহু-নৈষ্ঠিক মানে মূলতঃ তার
কিছুতেই নিষ্ঠা নেই, নিষ্ঠা আছে রকমারি
প্রবৃত্তি-স্বার্থে, তাই আত্মনিয়ন্ত্রণ বলে
জিনিসটা তাদের জীবনে ঘটে ওঠে না, ফলে অভিজ্ঞতা
বা জ্ঞানের উন্মেষ হয় না । ভক্তি ছাড়া,
একানুরক্তি ছাড়া জ্ঞান ফোটে না । …..একভক্তি যার আছে… তার
জ্ঞানের নাড়ী হয়
টনটনে । কথায় বলে প্রহ্লাদমার্কা ছেলে. ……আগুনে, জলে,
পাহাড়ে, পর্ব্বতে, অন্তরীক্ষে কোথাও ডরায় না
।…. তাই ভক্তির চাইতে বড় কামনার বস্তু আর
নেই ……।’’ ( আ. প্র. ২য় খন্ড, ২০. ১২. ১৯৪১)
নিজেকে যোগযুক্ত রাখতে
শ্রীশ্রীঠাকুর সর্বদা সচেতন থাকতেন। একদিন একটা সুপুরীর টুকরো মুখে দিতে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নীচে পড়ে
যায়। ঠাকুর খাট থেকে নেমে সুপুরীর টুকরোটাকে খুঁজে পিকদানিতে ফেলে
হাত ধুয়ে খাটে উঠে বসেন। আর একটা সুপুরীর টুকরো
মুখে দেন। সামান্য এক টুকরো সুপুরী, তা-ও আবার
খুঁজে নিয়ে ফেলে দিলেন। এই সামান্য কাজটা তো যে কেউ করতে
পারত, তার জন্য খাট থেকে নেমে কষ্ট
করে সুপুরী খুঁজতে গিয়ে অমূল্য সময় নষ্ট
করার পেছনে কোন লাভজনক যুক্তির খোঁজ না পেয়ে উপস্থিত যুক্তিবাদীরা অনুযোগ করলে
ঠাকুর বলেছিলেন, তোমাদের হিসাবে আমি
বেকুব, আমার হিসাবে আমি কিন্তু চালাক। আমার হাতের সাথে মুখের স্নায়বিক যোগসূত্র ছিন্ন
হবার ফলে আমি যোগভ্রষ্ট হই, সুপুরীটা নীচে পড়ে যায়।
প্রারব্ধ কর্মফলে ওই অপারগতা যাতে যোগ না হয় তাই একটু সময় নষ্ট করে নিজের ত্রুটি
নিজেই সংশোধন করে নিলাম।
যোগ বোঝাতে গিয়ে ঠাকুর একদিন
গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, এক গোয়ালার অনেকগুলো গোরু ছিল। ওই গোরুগুলোর দুধ এবং
দুগ্ধজাত ছানা, দৈ, ঘোল, মাখন, ঘি নিজেরা খেত, পাড়াপড়শীদেরও দিত। গোয়ালার বয়স
হওয়াতে ছেলেকে একদিন একটা পাঁচন হাতে দিয়ে গোরু চরাবার ভার দেয়। ছেলে মাঠে নিয়ে
গোরুগুলোকে চরতে দিয়ে দেখল, একটা পাঁচনের লাঠি দিয়ে কিছুতেই গোরুগুলোকে বাগে আনতে
পারছে না। এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে।
তাই সে ভাবল, একটা পাঁচন দিয়ে সব গোরু সামলানো যাবে না। সে তখন একমনে এক-একটা গোরুর জন্য আলাদা আলাদা পাঁচন
বানাতে শুরু করলো। পাঁচন বানানো শেষ করে গোরু সামলাতে গিয়ে দেখে নির্দিষ্ট স্থানের
কাছাকাছি গোরুগুলো নেই, চরতে চরতে অনেক দূরে দূরে জঙ্গলে চলে গেছে। ওদিকে বেলা
গড়িয়ে গোধূলি-প্রায়। ছেলে নিরুপায় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে গিয়ে সব কথা খুলে বললে
বাবা কোন তিরস্কার না করে ছেলেকে বুঝিয়ে বলেন, “বাপু, এক পাঁচনেই লাখ গোরু ঠেকানো
যায়। যার যেমন দরকার, তেমনতর ঠক্কর মারলেই তো হয় ! তোমার এই অতিবুদ্ধি সব বেসামাল
করে ফেলেছে।’’ (কথাপ্রসঙ্গে, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৪) অবশেষে বাবার কাছ থেকে গোরুর
বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ঠক্কর মারার কায়দা শিখে
ওই এক পাঁচনের সাহায্যেই গোরুগুলোকে বাগে আনতে শিখে যায়।
ওই ঠোক্কর মারার কায়দা যিনি শেখাতে পারেন তিনিই ঠাকুর, তিনিই
যোগসিদ্ধ গুরু। যোগসিদ্ধ গুরুর কাছ থেকে কাকে, কখন, কতটুকু ঠোক্কর কিভাবে মারতে
হবে সেই কায়দা একবার শিখে নিতে পারলে আমাদের বিশৃঙ্খল ইন্দ্রিয়গুলোকে একমুখী
আসক্তির সাথে যুক্ত করে যোগ-কে উপলব্ধি করা যায়। তাহলে পালের গোরুগুলো পালেই
থাকবে, বেশী কায়দা করতে গেলে গোরুগুলো পালছাড়া হয়ে যাবে।
যোগসিদ্ধ গুরু শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তাঁর নিত্যলীলায়
যোগশাস্ত্রে বর্ণিত আসন-মুদ্রাদি তিনি কোন কালেই অভ্যাস করেন নি। তিনি ছোটবেলা থেকেই
নামধ্যান করতেন।
তিনি তাঁর ভাগবত আন্দোলন কীর্তন দিয়ে শুরু করেছিলেন। কীর্তন করতে করতে সমাধিস্থ
হতেন। সেই সময় যোগশাস্ত্রে বর্ণিত সকল ধরণের আসন-মুদ্রাদি অবলীলায় করতেন। তিনি কীর্তনের মাধ্যমে
অনেকানেক পালছাড়াদের পালে ভেড়ালেন। তারা আবার যাতে পালছাড়া না হয়ে পড়ে তারজন্য
কাজে মাতিয়ে দিয়ে গড়ে তুললেন ভারতীয় আর্য্য ভাবধারার নিদর্শন স্বরূপ এক আদর্শ
প্রতীকী রাষ্ট্র—হিমাইতপুর সত্সঙ্গ আশ্রমে। ব্যক্তি, দম্পতি, গৃহ, সমাজ
ও রাষ্ট্র জীবনকে শুদ্ধ-বুদ্ধ-পবিত্র করে এক যোগে বাধতে দীক্ষা, শিক্ষা, বিবাহ,
কৃষি ও শিল্পের নবীকরণ করলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাগবত আন্দোলনের কীর্তনযুগের সাধকেরা কীর্তনের
এবং নামের শক্তি সঞ্চারণা করে রোগ-শোক-ব্যাধি-জরা-য় জর্জরিত, প্রবৃত্তি-পীড়িত
মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে অধিষ্ঠিত করে অমৃতের সন্ধান দিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে তাণ্ডবনৃত্যে
কীর্তন, আর নিয়ম করে নামধ্যান করতে পারলে নিজেকে এবং পরিবেশকে সবদিক দিয়ে যে সুস্থ
রাখা সম্ভব, তা বলাই বাহল্য।
জীবাত্মাকে পরমাত্মার সাথে প্রতিনিয়ত
যোগযুক্ত রাখতে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর অনুগামীদের একটা ছোট্ট নিদেশ-বাণীতে সব বুঝিয়ে
দিলেন।
ঊষা-নিশায় মন্ত্রসাধন
চলাফেরায় জপ
যথাসময়ে ইষ্টনিদেশ
মূর্ত্ত
করাই তপ।
মন্ত্র সাধনের জন্য সকাল-সন্ধ্যায় নিয়ম করে ধ্যানাভ্যাস করা। প্রতিবার ধ্যানান্তে ‘আমি অক্রোধী, আমি
অমানী’ ইত্যাদি স্বতঃ-অনুজ্ঞার অর্থগুলোকে আয়ত্ত করতে পারলে
প্রবৃত্তির নিগ্রহ থেকে সহজেই মুক্তি লাভ করা যায়। ধ্যান
করার পর দিগন্তের দিকে, সবুজের দিকে তাকালে চক্ষুর দৃষ্টি ভাল থাকে। চলাফেরায়,
কাজেকর্মে, শয়নে-স্বপনে ইষ্টে অনুরাগ সমন্বিত হ’য়ে নামজপ করার অভ্যাসে
পরমাত্মিক শক্তির স্বারূপ্য লাভ হয়। নিয়মিত শবাসন করলে হৃদরোগ হবার আশঙ্কা
থাকে না। নিয়মিত থানকুনি পাতা খেলে শরীর
বিধানের রেচনক্রিয়া সুস্থ থাকে। সত্তাপোষণী নিরামিষ আহার, মাসান্তে
কমকরে একটি দিন, হবিষ্যান্ন গ্রহণ, পাতিত্য কর্ম থেকে ত্রাণ পেতে শিশু প্রাজাপত্য,
প্রাজাপত্য এবং মহাসান্তপন ব্রত পালনে শরীর-মনের অসঙ্গতি দূর হয়, শরীর নিরোগ থাকে।
নাম জপ করা প্রসঙ্গে
শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন—নাম করলে অনেক সময় জ্বর কমেও যায়। কারণ, ব্যাকটেরিয়াগুলি
পুড়ে যায়। রোগীর শরীর ছুঁয়ে নাম করলে তাতেও রোগ ভাল হয়। ঐ জন্য কুষ্টিয়াতে একটা
দালানে ত্রিশটা bed (শয্যা) ছিল। রাধারমণ প্রভৃতি ছিল। রোগী
আসলে শুশ্রূষা করত, ছুঁয়ে নাম করত। ডবল নিউমোনিয়া ৩/৪ দিনে,
এমনকি রাতারাতি সেরে যেত।
(সুত্র—আলোচনা প্রসঙ্গে ১৮ খণ্ড)
আমাদের আর্য্যহিন্দু-শাস্ত্র
এবং যোগশাস্ত্র অনুসারে সূর্যোদয়ের পর শয্যাত্যাগ করলে পাতিত্যদোষে দুষ্ট হতে হয়। এবং
প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ উপবাসী থাকার নিদেশ দেওয়া আছে। শ্রীশ্রীঠাকুর আমাদের ওই
পাতিত্যদোষ থেকে মুক্ত করে নিয়ত যোগযুক্ত রাখতে দিনচর্যার এক সহজ নিদেশ দিলেন
অনুশ্রুতি গ্রন্থের বাণীতে।
ঊষার
রাগে উঠবি জেগে শৌচে শীতল হবি,
সন্ধ্যা–আহ্নিক জপ সাধনায় ঈশের আশিস লবি।
কুতুহলে
পড়শি ঘুরে দেখবি সযতনে,
আছে
কেমন কোথায় কে জন মন দিবি রক্ষণে।
তারপরেতে
বাড়ী এসে শৌচে যথাযথ,
গৃহস্হালীর
উন্নয়নী অর্জ্জনে হ’ রত।
স্নানটি
সেরে আহ্নিক করে ক্ষুধামতন খাবি,
একটু
চলে বিশ্রাম নিয়ে আগুয়ানে ধাবি।
এমনি
তালে সচল চালে চলে সন্ধা এলে,
শৌচে
শুদ্ধ হয়ে করিস আহ্নিক হৃদয় ঢেলে।
উন্নয়নের
আমন্ত্রনী গল্প-গুজব শীলে,
হৃষ্টমনে
আলোচনায় কাটাস সবাই মিলে।
পড়শী
দিগের অভাব-নালিশ থাকেই যদি কিছু,
তার
সমাধান যেমন পারিস করিস লেগে পিছু।
করন-চলন
ধরন-ধারন যজন যাজন কিবা,
সকল
কাজেই ইষ্টস্বার্থে চলিস রাত্রি-দিবা।
আদর-সোহাগ
উদ্দীপনী কথায় কাজে ঝুঁকে,
স্বার্থ-কেন্দ্র
সবার হবি ধরবি ইষ্টমুখে।
বিশ্রামেরই
সময় গা-টি ঘুমল হয়ে এলে,
ইষ্ট-চলন মনন নিয়ে ঘুমে গা দিস ঢেলে।
(অনুশ্রুতি গ্রন্থ থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর
অনুকূলচন্দ্রের বাণী)
শ্রীশ্রীঠাকুর
আহ্বানীসহ পূর্ণাঙ্গ প্রার্থনা মন্ত্রে আচমন, বাংলা সমবেত প্রার্থনা ও বাংলা সমবেত
প্রার্থনার অবশিষ্টাংশ সন্দর্ভে কতগুলো সহজ আসন এবং প্রাণায়ামের নিদেশ রেখে গেছেন। সেই নিদেশ মেনে আমরা যদি
সঠিক অনুশীলন করতে পারি তাহলে সহজ-যোগে ব্যাধিমুক্ত হয়ে পরমাত্মার সাথে যোগযুক্ত
থাকতে পারব। (দ্রঃ ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য প্রণীত
অনুসৃতি, যতি-ঋত্বিক শ্রীশরত্চন্দ্র হালদার প্রণীত যুগবাণী এবং সত্সঙ্গ পাব্লিশিং
কর্তৃক প্রকাশিত প্রার্থনা শিরোনামের গ্রন্থাবলী।)
শ্রীশ্রীঠাকুরের এক
অনন্য দৈবী অবদানের নাম ইষ্টভৃতি। ইষ্টের
প্রীতির জন্য কাউকে পীড়িত না করে, নিজে পীড়িত না হয়ে, বর্ণানুগ
কর্মের সেবার মাধ্যমে, বৃহত্তর
পরিবেশে, ঘটে ঘটে ইষ্ট
স্ফূরণের বা মঙ্গল প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত থাকার বিনিময়ে অযাচিত প্রাপ্ত অর্থ বা
সম্পদকে বলা হয়েছে অনুগ্রহ অবদান । ওই অনুগ্রহ
অবদানকে ঠাকুর
‘দিন গুজরানী আয়’ অভিধায় ভূষিত করেছেন। ওই ‘দিন গুজরানী আয়’-এর
অগ্রভাগ প্রতিদিন পানাহার করার পূর্বে ইষ্ট-নীতি ভরণের শপথ করে নিবেদন করার নাম
ইষ্টভৃতি মহাযজ্ঞ। যা নিখুঁতভাবে পালন করলে
শরীর-মন-আত্মার অসঙ্গতি দূর হয়। আর্য্যকৃষ্টির সদাচার এবং
বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষিত হয়।
শ্রীশ্রীঠাকুরের আর একটি অনন্য দৈবী অবদানের নাম স্বস্ত্যয়নী ব্রত।
প্রবৃত্তির সব বিপাক এবং গঞ্জনা থেকে মুক্ত করে আমাদের স্মৃতিবাহী চেতনায় সমৃদ্ধ
রাখতে প্রবর্তন করলেন পঞ্চনীতি সমন্বিত স্বস্ত্যয়নী ব্রতের। জড়-পদার্থে
নির্মিত মন্দিরের পরিবর্তে নিজ-নিজ দেহটাকেই শ্রীবিগ্রহ মন্দির জ্ঞানে পবিত্রতার
সাথে রক্ষা করতে নিদেশ দিয়েছেন এই ব্রতের মাধ্যমে, যেহেতু এই দেহের মধ্যেই রয়েছে
পরমাত্মার আবাসস্থল। ভোগ,
দুর্ভোগ, উপভোগ, মুক্তি, পরামুক্তি, পরাগতি সবকিছুই এই দেহের মধ্যেই।
যা নাই ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে এই দেহভাণ্ডে। আমাদের
আর্য্য শাস্ত্রাদিতেও একথার উল্লেখ রয়েছে। শ্রীশ্রীঠাকুর
জীবাত্মার মধ্যে সুপ্ত পরমাত্মাকে জাগাতে বলেছেন নামের মাধ্যমে। ৫টি
কর্মেন্দ্রিয়, ৫টি জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন, বিবেক, জীবাত্মা, পরমাত্মাদির সমন্বয়ে
সৃষ্টি এই দেহমন্দিরকে পবিত্র রাখার, সুস্থ-স্বস্থ রাখার ভাগবত-বিধির পালন-পদ্ধতি
সহজভাবে বিধায়িত করেছেন শ্রীশ্রীঠাকুর এই ব্রতের মাধ্যমে।
শ্র্রীশ্র্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রবর্তিত যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি,
স্বস্ত্যয়নী, সদাচারাদি নিখুঁতভাবে পালন করার নাম ইষ্টকর্ম।
ইষ্টকর্ম ব্যতীত কর্ম অনিষ্টকর্ম। সেই ইষ্টকর্মে যুক্ত থাকলে
সহজেই যোগসিদ্ধ হওয়া যায়।
কাম-আবেশে স্ত্রী-পুরুষে
যেমন করে উপভোগ,
ইষ্টকাজে বাস্তবতায়
তেমনি হলে তবেই য়োগ।
সব প্রবৃত্তি রত থাকে
ইষ্টকর্ম লয়ে,
সেই তো যোগী, সে-ই সন্ন্যাসী
কাল নত যার ভয়ে।
কালাধীশ ঠাকুরের চাহিদামত ইষ্টকর্ম করে একবার যোগী হতে পারলে
চিরতরে নিশ্চিন্ত, কালের কবলে পড়ে ভীত হতে হবে না, কাল হবে যোগীর অধীন।
পরিশেষে জীবনপিয়াসী মানুষদের কাছে, ইষ্টপ্রাণ দাদা ও মায়েদের কাছে
পরমপিতার এই দীন সন্তানের কাতর আবেদন, আমরা যেন নিত্য ইষ্টকর্মের মাধ্যমে পরমপিতার
সাথে যোগযুক্ত থেকে পরিবেশের সব্বাইকে জীবনের জয়গানে যুক্ত করে নিতে পারি। সবাই
যেন মুক্তকণ্ঠে বলতে পারে, ‘আমি সবার, আমার সবাই।’
।। ‘আর্য্য মহাসভা’ নামে সর্বজনীন রাজনৈতিক দল কেন প্রয়োজন ।।
নিবেদনে—তপন দাস
—————————————————————————————
।। আর্য্য মহাসভা নামের প্রেক্ষাপট ।।
সব্বাইকে যথাবিধি শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানিয়ে সবিনয় নিবেদন,
মানবসভ্যতার এক পরম বিস্ময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র জ্ঞান গরিমায়
গরবিনী আর্য্য ভারতবর্ষের অখণ্ডতা রক্ষার কথা জনে জনে বলেছিলেন। মুসলিম
লীগ ও হিন্দু মহাসভার নেতাদের সাথে কথা বলেছিলেন সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধি
নিরসনের জন্য।
“১৯৩৯ সালে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন পাবনা আশ্রমে। তিনি ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেন কীভাবে মুসলিম লীগের ভারতবিভাগের পরিকল্পনাকে বানচাল করা যায় বলুন।ঠাকুর তাঁকে বলেন—হিন্দু মহাসভার বদলে নাম রাখুন আর্য্য মহাসভা। মুসলমানরাও আর্য্য। তাদেরও আপনাদের সভ্য করুন। কোরাণ ভাল ক‘রে পড়ুন। আরবী শিখুন। রসুল যে আপনাদেরও জন্য প্রেরিত তা‘ হিন্দুদের শেখান। লীগ যদি কোরাণবিরোধী কোন পদক্ষেপ নেয়, আর্য্য মহাসভারসভ্য হিসেবে আপনারা কোর্টে শত শত কেস করুন যে আপনাদের প্রফেট ও কোরাণকে বিকৃত করা হ‘চ্ছে। আমি নির্ঘাৎ জানি-—রসুল এসেছিলেন সর্বমানবের মঙ্গলের জন্য, সংহতির জন্য, শান্তির জন্য। রসুল ও কোরাণের দোহাই দিয়ে দেশকে খণ্ডিত করার পরিকল্পনা বানচাল ক‘রে দেন। আমি তো বুঝি খাঁটি হিন্দু, খাঁটি মুসলমান, খাঁটি খ্রীষ্টান, খাঁটি বৌদ্ধ এদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। আর একটা বুদ্ধি বাতলে দিচ্ছি। সারা ভারতে হিন্দুর সংখ্যা মুসলমানের তুলনায় অনেক বেশী। আপনারা হিন্দুগরিষ্ঠ অঞ্চল থেকে পঁচিশ লাখ পরিবার এনে বাংলায় বসান, প্রত্যেক পরিবারে পাঁচ জন ক‘রে লোক থাকলে নতুন সওয়া কোটি লোক হবে। তখন নতুন ক‘রে census করুন। এতে বাংলা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হ‘য়ে দাঁড়াবে। বাংলা ভাগ হবে না। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও এই কাজ করুন। ওদিকটাকেও হিন্দুগরিষ্ঠ ক‘রে তুলুন। ওদিকটাও ঠিক থাকবে। দেশভাগ হ‘লে পাকিস্তান ও ভারত পরস্পর পরস্পরের ক্যানসার স্বরূপ হ‘য়ে দাঁড়াবে। কারও ভাল হবে না। ধর্মের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোন সম্পর্ক নেই। প্রেরিতদের মধ্যে বিভেদ করাই একটা ধর্মবিরুদ্ধ ব্যাপার। Conversion (ধর্মান্তর) জিনিষটাই একটা treachery (বিশ্বাসঘাতকতা)।“
(স্মৃতি-তীর্থে, পৃঃ ৮৮, প্রফুল্ল কুমার দাস)
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ওই দৈবী-আবেদনে আমরা সাড়া দিতে পারিনি, ব্যর্থ হয়েছিলাম। ফলে সাম্প্রদায়িকতা সঙ্ঘর্ষের আকার ধারণ করেছিল।
১৩৫৩ সালের প্রথম দিকে (১৬ আগস্ট, ১৯৪৬) মুসলিম লীগের ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে‘ ঘোষিত হবার সাথে সাথে কলকাতায় যে পৈশাচিক হত্যালীলা হয়েছিল সে সংবাদ শুনে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন ঠাকুর। দেশ-নেতাদের আগাম সতর্ক করা সত্ত্বেও, প্রতিরোধী-ব্যবস্থাপত্র দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। বিপন্ন দেশবাসীদের রক্ষা করতে না পারার বেদনায় বিপর্যস্ত তিনি। বেড়ে গেল রক্তচাপ, হয়ে পড়লেন অসুস্থ। খবর শুনে পাবনার বিশিষ্ট মুসলমান নেতৃবৃন্দ ঠাকুরকে দেখতে আসেন, পাবনায় সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াতে দেবেন না বলে আশ্বস্ত করেন। একটু সুস্থ বোধ করেন, আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঠাকুরের প্রিয় কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ গুপ্ত প্রয়োজনীয় ঔষধ এবং সম্পূর্ণ বিশ্রামের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে যান। বাঁধের ধারে নিভৃত নিবাসের মনোরম পরিবেশে ঠাকুরের বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন ঋত্বিগাচার্য্য। চাপমুক্ত রাখতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ করে দেন। কিন্তু ঠাকুর রাজী হন না। মনের কথা, প্রাণের ব্যথা নিয়ে যারা যারা আসবে, তাদের তিনি কিছুতেই ফেরাতে নারাজ। আগন্তুকদের দুঃখ-বেদনার কথা শুনতে শুনতে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। সংবাদ পেয়ে ডাঃ গুপ্ত আসেন, ঠাকুরকে দূরে কোথাও বায়ু পরিবর্তনের জন্য নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। শ্রীশ্রীঠাকুর ১৯৪৬ খৃঃ ২রা সেপ্টেম্বর চলে আসেন দেওঘরে।
শ্রীশ্রীঠাকুরের দেওঘর আগমনের সংবাদ জানতে পেরে, নিরাপত্তার কারণে, পূর্ববঙ্গের অনেক সৎসঙ্গী পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে ঠাকুরের শরণাপন্ন হন। ওদিকে, ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির থাবায় ১৯৪৭ এর ১৫ আগষ্ট দ্বিজাতি-তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে দেশবিভাগের ফলে আরো ছিন্নমূল সৎসঙ্গী পরিবারের দল দেওঘরে চলে আসেন। দেওঘরে ঠাকুর নবাগত। নিজেই পরিবার পরিজনদের নিয়ে প্রভূত কষ্ট স্বীকার করে ভাড়া বাড়ীতে থাকেন। নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যেও প্রশাসন বা সমাজসেবী সংস্থাদের কাছ থেকে কোন সাহায্য না নিয়ে, কাউকে বিব্রত না করে, শরণার্থীদের আশ্রয়দান ও ভরণপোষণ করেছিলেন।
‘‘চেষ্টা করেছিলাম প্রাণপণ যাতে হিমাইতপুর না ছাড়তে হয়, কিন্তু অত্যাচারিত হলাম ভীষণ, পারলাম না কিছুতেই। বাড়ী আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল, মানুষ খুন করে ফেল্ল। ওখানকার সব লোকের বিরুদ্ধতার জন্য পারলাম না। সকলের ভাল করতে গিয়ে আমি একেবারে জাহান্নামে গেলাম।’’ ‘‘আমরা হিন্দুরাই পাকিস্তানের স্রষ্টা। আমরা আরো চেষ্টা করেছি, যাতে আমরা সকলে মুসলমান হয়ে যাই। আমরা মুসলমান মেয়ে বিয়ে করতে পারি না। কিন্তু মুসলমানরা হিন্দুর মেয়ে বিয়ে করতে পারে। আমরা materialise করেছি তাই যাতে পাকিস্তান হয়, আর materialise করি নাই তা যাতে পাকিস্তান না হয়।….. কিন্তু আগে যদি হায়দ্রাবাদের দিক থেকে বাংলায় হিন্দুদের নিয়ে আসা যেতো, তবে পাকিস্তান হতো না। কিন্তু তা তো হলো না। পাকিস্তান হওয়ায় হিন্দু মুসলমান উভয়েরই কী ভীষণ ক্ষতিই না হল। …….. ’’
ওই নিদারুন সঙ্কটকালে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর কাছে আত্ম সমর্পিত সর্বহারাদের যোগ্যতাহারা হতে দিলেন না। সবাইকে আদর্শকে আঁকড়ে ধরে জীবনবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দিয়েছিলেন।
“বাস্তুহারা হওয়া নিদারুণ
কিন্তু যোগ্যতাহারা হওয়া সর্বনাশা,
এই যোগ্যতাকে সর্ব্বাঙ্গসুন্দর ক‘রে
অর্জ্জন করতে হলেই
আদর্শে কেন্দ্রায়িত হতেই হবে সক্রিয়তায়,
…তাই আজ যারা বাস্তুহারা
সর্ব্বনাশের ঘনঘটা যাদের
চারিদিকেই ঘিরে ধরেছে
আগ্রহ আকুল কণ্ঠে তাদের বলি…..
সাবধান থেকো,
যোগ্যতাকে হারিও না,
এই যোগ্যতা যদি থাকে
লাখ হারানকে অতিক্রম ক‘রে
বহু পাওয়ার আবির্ভাব হতে পারে
বিধিমাফিক শ্রমকুশল
সৌকর্য্যে……”
(সূত্রঃ মহামানবের সাগরতীরে ১ম/১৫)
সেদিন যারা ঠাকুরের উক্ত নিদেশ অমান্য করে খয়রাতি সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন, তারা হয়েছিলেন সংকুচিত, আর, যাঁরা ঠাকুরের নিদেশ মেনে চলেছিলেন, তাঁরা জীবনের কল্যাণপ্রবাহকে প্রসারিত করতে পেরেছিলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আদর্শ অনুসরণ করে ব্যক্তিগতভাবে অনেকে সমৃদ্ধ হলেও, সেই থেকে আজ পর্যন্ত, এতদিন ধরে, আমরা, সমষ্টিগতভাবে তাঁর ঈপ্সিত পরমরাষ্ট্রিক সমবায় গঠনের প্রথম ধাপ ‘আর্য্য মহাসভা’ গঠন করে সম্প্রদায় নিরপেক্ষ ধর্মপ্রাণ রাষ্ট্র নির্মাণের পথে অগ্রসর হতে পারিনি। এ আমাদের অপারগতার ব্যর্থতা! তথাপি, আর্য্যকৃষ্টি অনুশাসিত মনুষ্যত্বের গুণ-সমৃদ্ধ মানব-সভ্যতাকে টিঁকিয়ে রাখার স্বার্থে যুগ-পুরুষোত্তমের ঈপ্সিত ইষ্ট প্রতিষ্ঠার মাঙ্গলিক যজ্ঞ বাস্তবায়িত করার জন্য জীবনপিয়াসী সব্বাইকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করছি।
* * *
।।চুম্বকেআর্য্যকৃষ্টি, ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দর্শন ।।
আর্য্যস্থান – পিতৃস্থান
উচ্চ সবার – পূর্য্যমান।
অমর রহুক – আর্য্যবাদ
জাগুক উঠুক – আর্য্যজাত।
ফুলিয়ে তোল – দুলিয়ে তোল
তাথৈ তালে – আর্য্যরোল।
আর্য্যকৃষ্টির – যা ব্যাঘাত
খড়্গে তোরা – কর্ নিপাত।
* * *
ARYA–ITS MEANING
“The meaning of the word
‘Arya’ is–
to go, to cultivate, to achieve.”
ARYANS
“People
who are prone to cultivate
and achieve
the clue to the philosophy
of life and becoming–
are Aryans
as I think.”
ARYAN CULTURE
“He who adopts a culture
of life and growth–
is Aryan.”
(The Message, Vol. IX by Shree Shree Thakur Anukulchandra)
* * *
রাজনীতি বলে তা’য়
পূরণ-পোষণ প্রীতিচর্য্যায়
সংহতি আনে যা’য়।
রাজশক্তি হাতে পেয়েও
সতের পীড়ক যা’রাই হয়,
দেশকে মারে নিজেও মরে
রাষ্ট্রে আনে তারাই ক্ষয়।
* * *
“Politics is that which protects, nurtures and fulfills the uphold of existence..”
“When the elite are selfish, inert and non-coperating villain rises and rules.”
* * *
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন, ……….. ভালো বংশের মানুষ চাই যারা শয়তানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। আমি ধৰ্ম্ম ছাড়া politics (পূৰ্ত্তনীতি) বুঝি না। ধৰ্ম্ম মানে ধৃতি, বাঁচাবাড়ায় চলা। বাঁচতে গেলে পরিবেশের দরকার। পরিবেশ বাঁচবে না, আমি বাঁচব, তা’ হয় না। তোমরা প্রত্যেকে মরছ মানে আমি মরছি। একটা মানুষ গেল তার মানে আমার বাঁচার উপকরণ গেল। মানুষ টাকার দাম বোঝে। মানুষের দাম বোঝে না। কিন্তু মানুষই তো যা’ কিছু সৃষ্টি করে। তাই মানুষ বাদ দিয়ে, মানুষের যোগ্যতা বাদ দিয়ে রাজনীতির দাম কী? ………………. (শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, আঃ প্রঃ ত্রয়োবিংশ খণ্ড, পৃঃ ৬৩)
———————————————————————————————–
।। অবতরণিকা ।।
ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসন ক্ষমতা অধিকার করার জন্য অনেক রাজনৈতিক দল থাকা সত্বেও “আর্য্য মহাসভা” নামের রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রয়োজন রয়েছে কেন, তার সমর্থনে আমাদের বক্তব্য।
আমরা সাধারণ জনগণেরা পলিটিক্যাল সায়েন্স বা রাষ্ট্র বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব ও তথ্য বিষয়ে পারদর্শী না হলেও এটুকু অন্ততঃ বুঝি, যে নীতিবিধি বা অনুশাসনের সাহায্যে রাষ্ট্রের জনগণ দুটো খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে নিরাপদে বসবাস করতে পারে তার জন্যই রাজনীতি। সেই রাজনীতির নিয়ামক মানুষ। ভারত রাষ্ট্র সেই মানুষদের প্রজা নামে পরিচিত করিয়েছেন বলেই আমরা গণ প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের নাগরিক বা প্রজা হিসেবে পরিচিত। আমাদের ভারতবর্ষে এই প্রজারাই রাষ্ট্র নির্মাণের একক। ভারতের নিজস্ব সংবিধান, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে।
‘‘সুখস্য মূলম্ ধর্মঃ।
ধর্মস্য মূলম্ অর্থঃ।
অর্থস্য মূলম্ রাষ্ট্রম্।
রাষ্ট্রস্য মূলম্ ইন্দ্রিয়-বিজয়ম্।
ইন্দ্রিয়-বিজয়স্য মূলম্ জ্ঞানবৃদ্ধসেবয়া।
জ্ঞানবৃদ্ধসেবয়া বিজ্ঞানম্।।”
অর্থাৎ, সুখের মূলে ধর্ম (যে নীতিবিধি অস্তিত্বের, ধারক, পালক, পোষক।)। ধর্মের মূলে অর্থ। অর্থ বলতে এখানে শুধু টাকাপয়সার কথা বলা হয়নি, পুরুষার্থের চতুর্বর্গ—বর্ণাশ্রম এবং চতুরাশ্রমধর্ম পালন করার বিষয়ে বলা হয়েছে। প্রজাদের পরমার্থ লাভের বিষয়ে অবহিত করার জন্য রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। রাষ্ট্রের কাজ হলো প্রজাদের ধর্মপথে, অর্থাৎ ন্যায়ের পথে পরিচালিত করা। তাই, রাষ্ট্র গঠন করতে হবে ইন্দ্রিয়বিজয়ী প্রজাদের দ্বারা। যেহেতু, ইন্দ্রিয়জাত অনিয়ন্ত্রিত লোভ, কাম, ক্রোধ, হিংসা ইত্যাদি ন্যায়ের পরিপন্থী। আধ্যাত্মিক অনুশাসন ব্যতীত ইন্দ্রিয়বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয়। আর ইন্দ্রিয়বিজয়ী হতে হলে জ্ঞানবৃদ্ধের সেবা করতে হবে, অনুশাসন মেনে চলতে হবে। ইন্দ্রিয়ের ওপর আধিপত্য বা নিয়ন্ত্রণ যাঁর আছে, তিনিই জ্ঞানবৃদ্ধ। সদগুরু হলেন সেই জ্ঞানবৃদ্ধ। সদগুরুর দীক্ষা নিয়ে আদর্শানুগ জীবন যাপন করতে পারলেই বিশেষ জ্ঞান লাভ হবে। জড় ও চৈতন্য (matter and spirit) বিষয়ক বিজ্ঞান জানা যাবে।
জ্ঞানবৃদ্ধ প্রদত্ত অনুশাসন পালন করে প্রকৃষ্ট জাতক বা ‘প্রজা’ সৃষ্টির প্রবহমানতাকে রক্ষা করে চলাই ছিল আর্য্য ভারতের আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্য। প্রায়োগিক বিন্যাসের ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে আমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি। কোন উপলক্ষ্যই যেন সেই লক্ষ্যকে ম্লাণ করতে না পারে সে বিষয়ে রাষ্ট্র-নির্মাতাদের সচেতন করার জন্যই আমাদের এই অভিযান। নাগরিক অধিকার নিয়ে দেশের আপামর জনগণ সচেতন হলেও নাগরিক কর্তব্য পালন বিষয়ে আমরা অনেকটাই উদাসীন। ‘উত্তিষ্ঠতঃ জাগ্রত’ মন্ত্রে আবার আমাদের জেগে উঠতে হবে। ‘ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’—সেই গন্তব্যে পাড়ি জমাতে।
গন্তব্যে পাড়ি জমাবার সোপান-পথকে আরও সুগম করে দিলেন বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। উপরোক্ত প্রাচীন সংবিধানের বিধানকে নবীকরণ করে দিলেন বিধান-বিনায়ক গ্রন্থের বাণীতে।
তোমার রাষ্ট্রই বল,
সমাজই বল,
আর, গণ-ব্যষ্টিই বল,
ধর্ম্মের ভিত্তিতে যদি তা’ গড়ে না তোল,—
আবার, সে-ধর্ম্ম যদি
বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মাণ আদর্শ বা ইষ্টের
বাস্তব জীবনে জীয়ন্ত হ’য়ে না ওঠে—
প্রাজ্ঞ, পরিদর্শী, অন্বিত সার্থক সুকেন্দ্রিকতায়,
যা’ই কর আর তা’ই কর.
ঐক্য. সংহতি ও সম্বর্দ্ধনা
সুদূরপরাহত সেখানে,
আর, ধর্ম্ম মানেই হল—
সেই নীতি-বিধি জীবনে প্রতিপালন করা,—
যাতে মানুষ বাঁচে, বাড়ে
ব্যষ্টি ও সমষ্টি-সহ। ২৯
——-
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ চায় সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে। শুধু মানুষ কেন, গাছপালা, পোকামাকড়, জন্তু-জানোয়ার—সবাই বেঁচে থাকতে চায়, বৃদ্ধি পেতে চায়। যে যে নিয়ম পালন করলে সুস্থভাবে বাঁচা যায়, বৃদ্ধি পাওয়া যায় সেই প্রক্রিয়ার নাম জীবনের ধর্ম পালন করা। কিন্তু বাস্তবে তো সবাই চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে না, একদিন-না-একদিন সবকিছুর মায়া কাটিয়ে এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিতেই হবে। এই পিণ্ডদেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে জেনেও, বুদ্ধিমান মানুষ অন্যায়, অধর্ম করে, বিবেক-বিরোধী কর্ম করে ধন-সম্পত্তি অর্জন করতে গিয়ে অসুখ, অশান্তিকে আবাহন করে, এটাই সবচাইতে আশ্চর্যের।
মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণীরা সহজাত প্রবৃত্তি মাধ্যমে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, মানুষ বুদ্ধি দ্বারা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। অরণ্যবাসী, গুহাবাসী মানুষ একসময় কাঁচা ফলমূল, মাংস ইত্যাদি খেয়ে প্রাণ ধারণ করত। ক্রমে আগুনের ব্যবহার, পশুপালন, কৃষিকাজ শিখে আস্তানা তৈরি করে, গৃহ নির্মাণ করে ক্রমোত্তরণের সিঁড়ি বেয়ে আজকের আধুনিক যুগের সভ্যতার সভ্য হতে পেরেছে।
বেঁচে থাকার প্রশ্নে মনুষ্যেতর প্রাণীরা এই আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগেও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। যেমন, পরিযায়ী পাখিরা অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে টিঁকে থাকতে নদনদী, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে জৈবিক তাগিদ পূরণের প্রয়োজনে।—আবার ফিরে যায় ‘চরৈবেতি’-র পথ ধরে। ওদের জন্য কোন রাজনৈতিক দল, কোন সরকার, কোন সংগঠন নির্দিষ্ট রুট ম্যাপ, আশ্রয়-শিবির, খাদ্যের ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিছুই করে কি-না আমার জানা নেই। তবে আমার জানা মতে, প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে ওরা জীবন যাপন করে বলেই তেমন একটা অসুখী নয়, অকালমৃত্যুও হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের মত কিছু সভ্য মানুষদের অসভ্যতার জন্য ওদের সুখ-শান্তি ব্যহত হয়।
অপরপক্ষে, তথাকথিত ধর্ম পালনের নামে, ‘ভোলেবাবা পার করেগা’ ধ্বনি সহযোগে যে-সব মানুষেরা বাঁকে করে জলঘট নিয়ে বিশেষ-বিশেষ লগনে শিবালয়ের শিবলিঙ্গে জল নিবেদন করতে যান, তাঁদের সেবা দেবার জন্য প্যাণ্ডেল করে, মাইক বাজিয়ে, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় সংগঠনগুলো কতইনা তৎপর থাকেন! শ্রাবন মাসে রাস্তার ধারে ধারে প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে ছয়লাপ হয়ে যায়! সেবার ডালি দিয়ে কে কাকে টেক্কা দেবে সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়! যারা চাক্ষুস করতে চান, একটু কষ্ট করে শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার বি. টি. রোড ধরে ডানলপ থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলেই উপলব্ধি করতে পারবেন। শ্রীরামপুরের মাহেশের রথের মেলাতে গেলেও সেবার প্রতিযোগিতা অবলোকন করতে পারবেন। সত্যিই, না দেখলে বোঝা যেত না যে, মানুষ মানুষের জন্য কত সেবা-ই না করতে পারেন!
মানুষকে সুখে-শান্তিতে রাখার জন্য (নিন্দুকেরা বলেন, ভোট পাবার জন্য।) রাজ্য সরকার ‘দুয়ারে সরকার’-এর মাধ্যমে খয়রাতি সাহায্যের বিভিন্ন নামের প্রকল্প চালু করেছেন। তথাপিও কেন জানি সরকার সব মানুষদের সুখে, শান্তিতে রাখতে পারছেন না! অসুখ, অশান্তি, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হিংসা প্রভৃতি সমস্যায় জেরবার হয়ে জনগণ থানা, পুলিশ, কোর্ট, হাসপাতাল, রাজনৈতিক নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে বাধ্য হচ্ছে! এসব সমস্যার কারণ কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত প্রবৃত্তি। মানুষের দেহে বিরাজমান বন্ধুরূপী শত্রু লোভ, কাম, ক্রোধ, মদ, মোহ, মাৎসর্য ইত্যাদির লাগামহীন পরিচর্যা। সব অশান্তির মূল কারণ ষড়রিপু। সেই ষড়রিপুর মুখে লাগাম পড়াবার মতো কোন প্রকল্প রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করছে না। করতে পারলে মানুষকে সৎ-এর বা সত্তার পথে পরিচালিত করে আত্মনির্ভর হতে শেখানো যেত। মানুষকে সুখী করা যেত। লাগামহীন ভোগের চাহিদায় সুড়সুড়ি দিয়ে মানুষকে কখনোই সুখী করা যায় না। অথচ দেখুন, সুকুমার রায়ের কালজয়ী রচনা ‘রাজার অসুখ’-এর চালচুলোহীন ভিখারীটা কেমন চাহিদাশূন্য হয়ে নিজেকে রাজার চাইতেও সুখী প্রমাণ করে ছেড়েছেন।
সুখের বিপরীতে বাস করে দুঃখ। চাওয়াটা না পাওয়াই দুঃখ। সব দুঃখের কারণ কিন্তু প্রবৃত্তি-পোষণী চাহিদার বাড়বাড়ন্ত। যাকে আমরা অভাব বলতে অভ্যস্ত। হাজার চাহিদা পূরণ করেও মানুষের অভাবজনীত দুঃখ দূর করা যায় না,—যতক্ষণ না মানুষ ওই অভাবের ভাবটাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবে। কোন রাজার বা রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়া ছাড়াই রাজার অসুখের ভিখারিটা মন থেকে অভাবের ভাবটাকে তাড়াতে পেরেছিলেন বলেই তিনি প্রকৃত সুখী হতে পেরেছিলেন।
যাইহোক, মানুষ মানুষকে সুখী করার জন্য, সুখী দেখার জন্য এখনো ভাবে। নইলে ‘ভাল থাকবেন’ বলে যবনিকা টানতেন না আলাপচারিতার অন্তে, বিদায় লগ্নের প্রাক্কালে। ভাল থাকার ইচ্ছে আছে বলেইনা ‘হ্যাভ এ গুড ডে’, ‘সী ইউ অ্যাগেইন’ ইত্যাদি শুভেচ্ছা সম্বোধনগুলো আমরা আয়ত্ত করেছি।
সরলার্থ—সকলে সুখী হোন, নিরোগ হোন এবং শান্তি লাভ করুন, কেউ যেন দুঃখ ভোগ লাভ না করে।।
মন্ত্র সমৃদ্ধ মঙ্গলাচারণের শুভেচ্ছাবার্তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
* * *
কে চায় না? সবাই তো সুখি হতে চায়, সবাই তো শান্তি চায়, সবাই তো নীরোগ থাকতে চায়। কিন্তু অ-সুখকে পাশ কাটিয়ে সুখি কিভাবে হতে হয়, অশান্তিকে পাশ কাটিয়ে কিভাবে শান্তি পেতে হয়, দুষ্ট মনকে শিষ্ট করে কিভাবে নীরোগ থাকতে হয়, তা হয়তো সকলে জানেন না।
উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, অঋণী, অপ্রবাসী, দিনান্তে একবার যে শাকান্ন খেয়ে জীবন ধারণ করেন, সে-ই প্রকৃত সুখী। শুধু কথার কথা নয়, নবদ্বীপের পণ্ডিত রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত, যাঁকে সবাই বুনো রামনাথ বলে জানতেন। তিনি তো প্রয়োজনে তেঁতুলপাতার ঝোল, আর মোটা চালের ভাত খেয়েই বিনে মাইনেতে শিক্ষকতা করতেন, সংস্কৃতে গ্রন্থ রচনা করতেন, কোন দান বা খয়রাতি সাহায্য না নিয়েই বেশ নীরোগ দেহ নিয়ে সুখে, শান্তিতে জীবন কাটিয়ে বোদ্ধা সমাজে অমর হয়ে আছেন।
মহাভারতে ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা নামক পর্বাধ্যায়ে বর্ণিত সুখের বিষয়টা আরও আরও বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহাবীর অর্জুনকে যে সুখের সন্ধান দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, নিম্নোক্ত শ্লোক বর্ণিত জ্ঞানের মাধ্যমে।
नास्ति बुद्धिरयुक्तस्य न चायुक्तस्य भावना। न चाभावयतः शान्तिरशान्तस्य कुतः सुखम्।। 2.66।। “নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা।” ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম্।। —অর্থাৎ, পরমপিতার সাথে যোগযুক্ত নয় এমন অযুক্তের বুদ্ধি হয় না, ফলে বাঁচার ভাবনা ভাবতে পারে না, শান্ত হতে পারে না, শান্তি পায় না, (কোন অবস্থায় সাম্যহারা না হওয়াই শান্তি।) আর অশান্ত যে, সে সুখের সন্ধান পাবে কোত্থেকে?
এই শ্লোকের মাধ্যমে আমরা সুখের রাজ্যে পৌঁছবার একটা সিঁড়ির সন্ধান পেলাম। বুদ্ধি থাকলেই হবে না। বুদ্ধি কোন উচ্চ আদর্শে যোগযুক্ত হলেই বাঁচার ভাবনা ভাবতে পারে, ফলে শান্ত হয়, শান্তি পায়, যার ফলে প্রকৃত সুখ আস্বাদন করতে পারেন। এথেকে বোঝা গেল যে, স্থিতধীসম্পন্ন না হলে সুখী হওয়া যায় না। স্থিতধীসম্পন্ন হতে গেলে ভালো বুদ্ধিদাতার শরণাপন্ন হতে হয়। সেই বুদ্ধিদাতা ছিলেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ।
আমরা, বুদ্ধিমান মানুষেরা প্রচলিত অনেক মতবাদ না মানলেও ধর্মগ্রন্থ হিসেবে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে কিন্তু স্বীকৃতি দিয়েছি। কোন মন্দিরে, কোন আশ্রমে নয়, কুরুক্ষেত্র নামের বিস্তৃত ধর্মক্ষেত্র প্রাঙ্গনে যার উদ্ভব। কুরু-পাণ্ডবদের রাজ্য-বিবাদ বা রাজনীতির টানাপোড়েনের চরম মীমাংসার পথ খুঁজে নেয় দুর্যোধন, যুদ্ধের মাধ্যমে। যুদ্ধ যাতে না হয় বৃষ্ণিবংশীয় শ্রীকৃষ্ণ নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে মীমাংসা করার চেষ্টা করেছিলেন। পঞ্চ পাণ্ডবদের বসবাসের জন্য মাত্র ৫ খানা গ্রাম চেয়েছিলেন। রাজী হননি কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধন। পণ করেছিলেন, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। যার ফলস্বরূপ ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের প্রাঙ্গনে যুদ্ধের আয়োজন হয়েছিল।
কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যুযুধান কৌরব ও পাণ্ডব দুইপক্ষের সৈন্য সমাবেশ হয়েছে। পাণ্ডব পক্ষের প্রধান যোদ্ধা তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন, তাঁর রথের সারথী শ্রীকৃষ্ণকে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে রথ স্থাপন করতে বললেন। শ্রীকৃষ্ণ রথটি চালিয়ে নিয়ে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে রাখলেন। অর্জুন, কৌরব পক্ষের সেনাদলের মধ্যে পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, শ্বশুর, মিত্র ও শুভাকাংক্ষীদের দেখতে পেয়ে, শুধু রাজত্ব ফিরে পাবার জন্য তো নয়ই, ত্রিভুবনের বিনিময়েও আপনজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজী নয়, স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন শ্রীকৃষ্ণকে। প্রমাদ গুনলেন শ্রীকৃষ্ণ। যার ওপর ভরসা করে ধর্ম সংস্থাপন করার পরিকল্পনা করেছেন, সেই মহাবীর অর্জুন কিনা শেষমেষ যুদ্ধবিমুখ! তীরে এসে তরী ডোবাতে চাইছে! পরিস্থিতি সামাল দিতে পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বর্ণাশ্রমানুগ ক্ষাত্রধর্ম পালন করতে উৎসাহিত করার জন্য বলেন, এই ঘোর সংঙ্কটময় যুদ্ধস্থলে যারা জীবনের প্রকৃত মূল্য বোঝে না, সেই সব অনার্যের মতো শোকানল তোমার হৃদয়ে কিভাবে প্রজ্জ্বলিত হল? এই ধরনের মনোভাব তোমাকে স্বর্গলোকে উন্নীত করবে না, পক্ষান্তরে তোমার সমস্ত যশরাশি বিনষ্ট করবে। এই সম্মান হানিকর ক্লীবত্বের বশবর্তী হয়ো না৷ এই ধরনের আচরণ তোমার পক্ষে অনুচিত। এই যুদ্ধে নিহত হলে তুমি স্বর্গ লাভ করবে, আর জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করবে৷ অতএব যুদ্ধের জন্য দৃঢ়সংকল্প হয়ে উত্থিত হও।—এইসব তত্ত্বকথা বিফল হবার পরে শ্রীকৃষ্ণ বলতে বাধ্য হলেন, আসলে তোমার বুদ্ধি বিপর্য্যয় হয়েছে বলে তুমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছ, তোমার অশান্ত হৃদয় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
যুদ্ধক্ষেত্রে রথে উপবিষ্ট হয়ে উপরোক্ত (২/৬৬) শ্লোকের মাধ্যমে দ্রোণাচার্য্য, কৃপাচার্য্য নামের বিখ্যাত শিক্ষাগুরুদের শিষ্য, মহাবীর, মহারথী, মহা-সংযমী, ব্রহ্মচারী অর্জুনকে অস্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন বললেন, ভগবানের সাথে যোগযুক্ত নয় বলে!—ভাবা যায়! আর যোগযুক্ত হতে হলে গুরুকরণ করতে হবে। মহাবীর অর্জুনের অনেক শিক্ষাগুরু থাকলেও ইষ্টগুরু কিন্তু ছিল না।
“(ইষ্ট)গুরুই ভগবানের সাকার মূর্তি, আর তিনিই absolute (অখন্ড)।”
বর্তমান ইষ্টগুরু শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলছেনঃ
শিক্ষাগুরু থাক না অনেক
শিখো যেমন পার
ইষ্টগুরু একই কিন্তু
নিষ্টাসহ ধর।
জীবনচলনার জাগতিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনে যিনি বা যাঁরা সাহায্য করেন তারা হলেন শিক্ষাগুরু। পিতামাতা থেকে স্বভাব পাই বলে তাঁরা হলেন স্বভাবগুরু। আর স্থূল হতে সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম হতে স্থূল (matter to spirit, spirit to matter), জীবননদীর ঘুর্ণিপাক থেকে বাঁচাবার কৌশল যিনি শেখাতে পারেন অর্থাৎ অন্তর্যামীকে উপলব্ধি করাতে যিনি পারেন তিনি ইষ্টগুরু বা সদগুরু। এই গুরুই হলেন ভগবানের সাকার মূর্তি। তিনিই absolute (অখণ্ড)। ইষ্টগুরু গ্রহণ করলে মানুষ স্থিতধী হয়ে ব্যক্তিসত্তার অখণ্ড বিন্যাসকে বজায় রেখে নিজসত্তাকে উপলব্ধি করতে পারে। তখন শান্তি এবং সুখ দাস হয়ে সেবা করে। মহাবীর অর্জুন সদ্-দীক্ষার মাধ্যমে ইষ্টগুরুর সাথে যোগযুক্ত ছিলেন না বলেই শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বর্ণিত অনুশাসন বা সম্যক-বিধানের মাধ্যমে প্রকৃত সুখের পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যদি ধর্মগ্রন্থ হয়, তাহলে বলতে হয়, ধর্মনীতিই অর্জুনকে প্রকৃত রাজনীতি শিখিয়েছিল। তাই নয় কি?
মনুষ্য দেহধারী পরমপিতা, পুরুষোত্তম, সদগুরু, বা ভগবানের সাথে যোগযুক্ত না হয়ে যেমন ধর্ম পালন করা সম্ভব নয়, তেমনি রাজনীতি শেখাও সম্ভব নয়। সনাতন ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ঈশ্বর এক, ধর্ম এক, প্রেরিতপুরুষগণ সেই এক-এরই বার্তাবাহী। এই তত্ত্বজ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করতে হলে শ্রীকৃষ্ণরূপী জীবন্ত সদগুরুর চিরন্তনী নিদেশ—
সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥ (গীতা ১৮ অধ্যায় ৬৬তম শ্লোক)
অর্থাৎ, জীবনকে ধারণ করার জন্য ধর্মের নামে প্রচলিত সব নীতিবিধি পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবো। এই বাণী মেনে চলতে হবে।
মানবজাতির মনুষ্যত্বের প্রবহমানতাকে সমৃদ্ধ করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতা গ্রন্থের ৪র্থ অধ্যায়ের ৭ম থেকে ৯ম শ্লোকে সকল-যুগের সকল মনুষ্যদের জন্য এক স্পষ্ট নির্দেশিকা, গাইডলাইন দিয়ে বলেছেন—
যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে সাধুদের পরিত্রাণ করতে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে অবতীর্ণ হই। যিনি সাধনা দ্বারা আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানতে পারেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুণরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধাম লাভ করেন।
উপরোক্ত বাণী সকল যুগের মানুষদের জন্য চূড়ান্ত পথ নির্দেশ। যখন যে রূপে পুরুষোত্তমের আবির্ভাব হবে, তখন সেই নররূপ পরিগ্রহকারী সর্বোত্তম পরিপূরণকারী পুরুষোত্তমের শরণাপন্ন হতে হবে, তাঁর ভজনা করতে হবে।—এই হলো প্রকৃত ধর্মের পথে চলে ঈশ্বরপ্রাপ্তির গন্তব্যে পৌঁছাবার সিঁড়ি, সোপান, লিফট্……. সকলের জন্য—‘নান্যপন্থাঃ বিদ্যতে হয়নায়’।
যখন যিনি পুরুষোত্তমরূপে অবতীর্ণ হন, তিনিই তখনকার সময়ের জন্য জীবন্ত বেদ, সংহিতা, পুরাণ। ওই সূত্র অনুসারে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, যীশুখ্রীস্ট, হজরত রসুল, চৈতন্যদেব, শ্রীরামকৃষ্ণদেব সকল গুরুদের গুরু সদগুরুরূপে স্বীকৃতি পান। অর্থাৎ স্থান-কাল-পরিবেশ অনুযায়ী যখন যিনি যেখানেই অবতীর্ণ হন না কেন, তাঁর মধ্যে পূর্ব পূর্ব গুরুদের জীবন্ত অনুভব করা যাবে। পূর্ববর্তীদের প্রকৃত আদর্শ খুঁজে পাওয়া যাবে। যাকে আমরা বর্তমানের সফটওয়ারের ভাষায়, অ্যাপ্লিকেশন বা অ্যাপস্-এর ভাষায় আপডেট বলি। যারমধ্যে অ্যাপ্লিকেশনের সূত্রপাত থেকে শুরু করে সর্বশেষ সংস্করণের নবীকরণের তথ্য মজুত থাকে। আমি যদি আমার মোবাইলের অ্যাপ্লিকেশনগুলো আপডেট না করি তাহলে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারব না। যারা আপডেটেড্, তারাই লক্-ডাউনের সময় অন-লাইন কাজকর্ম করে অনেক কিছু সামাল দিতে পেরেছেন। সবকিছু সামাল দিতে গেলে আপডেটেড হতে হবে সবক্ষেত্রে। ব্যাকডেটেড থেকে কিছু সামাল দেওয়া যায় না। অথচ আমরা অজ্ঞতাবশে নিজেদের ধারণ করার প্রশ্নে, অর্থাৎ ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে ব্যাকডেটেড হয়ে আছি। তাই তো বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনকূলচন্দ্র আমাদের সচেতন করে দিতে বললেন—“ভারতের অবনতি (degeneration) তখন-থেকেই আরম্ভ হয়েছে, যখন-থেকে ভারতবাসীর কাছে অমূর্ত্ত ভগবান অসীম হ’য়ে উঠেছে—ঋষি বাদ দিয়ে ঋষিবাদের উপাসনা আরম্ভ হয়েছে।
ভারত! যদি ভবিষ্যৎ-কল্যাণকে আবাহন করতে চাও, তবে সম্প্রদায়গত বিরোধ ভুলে জগতের পূর্ব্ব-পূর্ব্ব গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হও—আর তোমার মূর্ত্ত ও জীবন্ত গুরু বা ভগবানে আসক্ত (attached) হও,—আর তাদেরই স্বীকার কর—যারা তাঁকে ভালবাসে। কারণ, পূর্ব্ববর্তীকে অধিকার করিয়াই পরবর্ত্তীর আবির্ভাব।” (সত্যানুসরণ)
কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনকূলচন্দ্র বললেন—“বর্ত্তমান যিনি, তাঁকে ধরলেই তাঁর মধ্যে সব পাওয়া যায়। ………. রামচন্দ্রকে যে ভালবাসে সে যদি শ্রীকৃষ্ণকে না ধরে তবে বুঝতে হবে তার রামচন্দ্রেও ভালবাসা নেই, ভালবাসা আছে তার নিজস্ব সংস্কারে।”
(আঃ প্রঃ ২১ খণ্ড, ইং তাং ৩১-১২-১৯৫২)
* * *
ইষ্টগুরু নিদেশিত সদাচার এবং বর্ণাশ্রমধর্মকে অগ্রাহ্য করে তথাকথিত ধার্মিক হতে চাওয়া সখা অর্জুনকে প্রকৃত ধার্মিকে রূপান্তরিত করার জন্য পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন বিষাদ যোগ, সাংখ্য যোগ, কর্ম যোগ, জ্ঞান-কর্ম-সন্ন্যাস যোগ, কর্ম-সন্ন্যাস যোগ, আত্ম-সংযম যোগ, জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ, অক্ষর-পরব্রহ্ম যোগ, রাজ-বিদ্যা-রাজ-গুহ্য যোগ, বিভূতি যোগ, বিশ্বরূপ-দর্শন যোগ, ভক্তি যোগ, ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগ যোগ, গুণত্রয়-বিভাগ যোগ, পুরুষোত্তম যোগ, দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগ যোগ, শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ যোগ ও মোক্ষ-সন্ন্যাস যোগ ইত্যাদি নামাঙ্কিত অষ্টাদশ প্রকৃতির যোগ-এর সাহায্যে পরমাত্মিক শক্তির সাথে যোগযুক্ত করেন।
মহাবীর অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে সখাজ্ঞানে ভালবাসতেন, ভরসা করতেন, কিন্তু তাঁর ‘মানুষীতনুআশ্রিতম্ ভূত-মহেশ্বর’ রূপের পরিচয়, পুরুষোত্তমীয় শক্তির পরিচয় তিনি অনুভব করতে পারেন নি। অনুভব যদি করতে পারতেন, পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর রথের সারথী হতে বলতে পারতেন না। আর তিনি যদি অর্জুনের সারথী না হতেন, আমরা, জগৎ-সারথী প্রোক্ত সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকার চাবিকাঠি-স্বরূপ মানব জীবনের প্রকৃত সংবিধান শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পেতাম না। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার জ্ঞান পেয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ইষ্টগুরু রূপে বরণ করে তাঁর আদর্শ মেনে কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। ক্ষাত্র জনোচিত স্বধর্ম বা বৃত্তিধর্ম পালন করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। জয়লাভ করতে পেরেছিলেন জীবনযুদ্ধে—বর্ণাশ্রমধর্ম মেনে। তাইতো শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রার্থনা মন্ত্রে “সদাচারা বর্ণাশ্রমানুগজীবনবর্দ্ধনা নিত্যং পালনীয়াঃ।” মেনে চলতে নিদেশ দিলেন। অতএব, প্রবৃত্তিপরায়ণতার বুদ্ধি যতক্ষণ না ইষ্টগুরুর আদর্শের সাথে যোগযুক্ত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত সুখি হওয়া যে সম্ভব নয় তা প্রমাণিত সত্য, যদি শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা গ্রন্থকে আমরা মান্য করি।
* * *
সম্মানীয় পাঠক, এতক্ষণে বেশ বিরক্ত হয়েছেন বুঝতে পারছি। হয়তো ভাবছেন, রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে আমি ধর্মচর্চা শুরু করে দিয়েছি! ধর্ম আর রাজনীতিকে এক করে ফেলতে চাইছি!
আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যদি ধর্মগ্রন্থ হয়, তাহলে তার উৎপত্তি কি রাজনীতিকে কেন্দ্র করে নয়? কৌরব-পাণ্ডবদের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্যই তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়েছিল। ওই যুদ্ধক্ষেত্রকে কেন্দ্র করেই তো শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উৎপত্তি। আবার ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে মানেন, সেই রাজনীতির প্রেরণা ছিল শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার আদর্শ। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ-এর বন্দে মাতরম্ স্তোত্র-ও কিন্তু শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার আদর্শের অনুসরণে সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের কাছে একটা করে গীতা গ্রন্থ থাকত। তাই, ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে নতুন করে রাজনীতি করার পূর্বে একটু ভেবেচিন্তে করাটাই ভাল।
ভুললে চলবে না যে, ‘‘কর্ম্মণ্যেবাধিকারেস্তু মা ফলেষু কদাচন।…….’’ ––কর্মেই তোমার অধিকার ফলে নয়। ––শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই বাণীর অনুপ্রেরণায় নবযুগের অভিমন্যু ক্ষুদিরাম, দেশরক্ষার ধর্ম পালন করতে গিয়ে ফাঁসির আসামী হয়েছিলেন। ‘‘ন জায়তে ম্রিয়তে কদাচিৎ…….বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়………নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।…….’’। …… ইত্যাদি ইত্যাদি বাণীর অমৃত আদর্শে স্থিতপ্রজ্ঞ, মৃত্যুঞ্জয়ী ক্ষুদিরাম হাসিমুখে ফাঁসির দড়ির মালা পড়েছিলেন গলায়। একটা ক্ষুদিরামের আত্মাহুতি জন্ম দিয়েছিল হাজারো ক্ষুদিরামের। ফাঁসির রজ্জু আর ইংরেজ রাজশক্তির বুলেটের আলিঙ্গনে জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে অকালে হাসিমুখে বিদায় নিয়েছিল আর্য্য ভারতের উত্তরাধিকারের স্বপ্নদেখা কতশত বীর ভারত-সন্তানেরা। অবশেষে একদিন গ্যালন গ্যালন রক্তের বিনিময়ে আমরা ফিরে পেয়েছিলাম আমাদের জাতীয় উত্তরাধিকার। অপূর্ণ, খণ্ডিত। তথাকথিত ধর্মের সুড়সুড়িতে দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারতবর্ষ হিন্দুস্তান, পাকিস্তান আখ্যা পেয়েছিল। কিন্তু পূর্ব পশ্চিমে প্রসারিত ভারতমাতার কর্তিত দুটো বাহুর ক্ষত আজও শুকলো না। সৃষ্ট হলো জাতীয় ম্যালিগন্যাণ্ট সমস্যার। সব কিছুর কারণ কিন্তু ধর্মকে আড়াল করে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাধান্য দেওয়া।
* * *
যারা পলিটিক্স নিয়ে মাথা ঘামান, তাদের জেনে রাখা উচিত, পলিটিক্স-এর প্রকৃত মর্ম।-
‘পলিটিক্স মানেই—
পূর্ত্তনীতি বা পূর্য্যনীতি
অর্থাৎ, যে-সৎনীতির অনুশাসন ও অনুসরণে
পূরণ ও পালন করা যায়—
এবং বিরুদ্ধকে আবৃত করে
নিরোধ করা যায়—
এ ব্যষ্টিতেও যেমন, সমষ্টিতেও তেমনি;
আর, যাতে তা হয় নাকো—
তা পূর্ত্তনীতি বা পূর্য্যনীতি নয়।’ (শাশ্বতী, বাণীসংখ্যা ১৭৫)
উপরোক্ত বাণী থেকে জানা গেল, পলিটিক্স বা রাজনীতি মানে পূর্তনীতি—সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির পথে চলার নীতি। যে নীতি সকলের অভাব পূরণ করে, সবাইকে অভীষ্ট মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় পোষণ দিয়ে সব্বাইকে প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ করে সংহতির প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ, সেই নীতির নাম রাজনীতি। সবাইকে প্রীতির বাঁধনে বাঁধতে গেলে একটা উচ্চ জীবন্ত-আদর্শ থাকতে হবে। সেই আদর্শের অভাব বলেই আজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বাসা! যারা জনগণের সেবা করবেন সেই জন প্রতিনিধিদের সেবা করার জন্য, মন্ত্রীদের সেবা করার জন্য, নিরাপত্তার দেবার জন্য যদি রাজকোষ থেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়! তাহলে কি জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগনের শাসন প্রক্রিয়ায় একটা প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিচ্ছে না! যিনি জনগণের সেবা করবেন তিনি যদি সবসময় নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকতে অভ্যস্ত হন, তাহলে অন্যদের নিরাপত্তা দেবেন কিভাবে? সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি করবেন কিভাবে? যেমন ধরুন, রেলমন্ত্রী যদি নিরাপত্তার ঘেরাটোপ ছেড়ে, ছদ্মবেশে সাধারণ যাত্রী সেজে মাঝে মাঝে সাধারণ ট্রেনগুলোতে যাতায়াত করতে পারেন, তাহলে প্রকৃত সমস্যা উপলব্ধি করে সমস্যার বাস্তব সমাধান করতে পারবেন। তবে সমস্যা কিন্তু বিরাজ করছে আমাদের শাসন-সংহিতায়। যোগ্য মানুষকে যোগ্য স্থানে কাজে লাগাবার ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানে যদি থাকত, তাহলে যোগ্যতার মাপকাঠিতে মন্ত্রী করা হতো। যেমন, রেলের চৌহদ্দি সম্পর্কে যার কোন ধারণা নেই, রেলের টেকনোলজির সাথে যার কোন পরিচয় নেই, তিনি হয়ে যান রেলমন্ত্রী! শরীর বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যার সাথে যার পরিচয় নেই, তিনি হয়ে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী! অথচ একজন সাধারণ নাগরিককে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রেল বিভাগে, স্বাস্থ্য বিভাগে নিয়োগ করা হয়! (নিয়োগ দুর্নীতি ব্যতীত।) আবার নির্বাচন কমিশন পুণর্নিবাচন, উপ-নির্বাচনের নামে দেশের অনেক অর্থ অপচয় করেন। ফলে সত্যমেব জয়তে-এর নীতিবাক্য বাস্তবে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে!
নির্বাচন কমিশনের হাতে সব ধরণের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার থাকা সত্বেও সঠিক নির্বাচন করাতে না পারাটাও তো অক্ষমতার পরিচয়! আর উপ-নির্বাচনের ক্ষেত্রে অক্টোবর ২০২১-এ অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গের একটা উপ-নির্বাচনের উদাহরণ দিলে জিনিসটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। যেমন, খড়দহ বিধানসভার প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে উপ-নির্বাচন হবে, তারজন্য কালীঘাটের বিধায়ককে পদত্যাগ করিয়ে তাকে খড়দহে প্রার্থী করা হলো, কালীঘাটে আর একটা উপ-নির্বাচন করানো হলো! আবার হবে, যে-সব বিধায়কদের পদত্যাগ করিয়ে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করা হবে, সেইসব শূন্যস্থান পূর্ণ করতে আবার উপ-নির্বাচন করা হবে! এই যে, নিষ্প্রয়োজনে, উপ-নির্বাচনের নিমিত্ত ব্যয়ভার বহন করা হয়, অর্থ অপচয় করা হয়, সেটা কি ‘‘Of the people, by the people, for the people—জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।’’ ব্যবস্থার সদর্থক উদাহরণ হতে পারে?—এর জবাব কে দেবে?
* * *
‘মেরা ভারত মহান’ শ্লোগান দিতে যে-সব দেশপ্রেমী জন-প্রতিনিধিরা গর্ব বোধ করেন, প্রাচীন ভারতের শাসনতন্ত্র প্রসঙ্গে তাঁদের একটু জেনে রাখা ভাল।
প্রাচীন ভারতের শাসনতন্ত্র প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলছেন—আর্য্যদের যে কী জিনিস ছিলো তা’ কল্পনায়ই আনা যায় না। Cabinet formed (মন্ত্রীপরিষদ গঠন) হ’ত বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যদের প্রধানদের নিয়ে। প্রধানের প্রধান, তাদের প্রধান, এইরকমভাবে একটা সুন্দর gradation (পর্য্যায়) ছিলো। যারা যত বেশীকে পূরণ করতো তারা তত বড় প্রধান। প্রধান মন্ত্রী সর্ব্বদা ঠিক হ’য়েই থাকতো, উপযুক্ত লোক নির্ব্বাচন নিয়ে কোন গণ্ডগোল উপস্থিত হ’তো না। অন্যদেশ ভারতবর্ষকে আক্রমণ করার সাহসই পেতো না। সব জাতটা দারুণ compact (সংহত) থাকতো। অনুলোম বিয়ে থাকার দরুন সারা জাতটা যেন দানা বেঁধে থাকতো, আর এতে evolution–এর (ক্রমোন্নতির) সুবিধা হ’তো—যথাক্রমে পাঁচ, সাত ও চৌদ্দপুরুষ ধরে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের ভিতর যদি Brahmanic instinct (ব্রহ্মণ্য-সংস্কার) দেখা যেতো—তাদের বিপ্র ক’রে দেওয়া হ’তো। উন্নতির পথ সব দিক থেকে খোলা ছিল। আগের কালে টাকা দিয়ে একজনের সামাজিক position (অবস্থান) ঠিক করা হ’তো না। কারও হয়তো ৫০ লাখ টাকা আছে, কিন্তু কেউ হয়তো পাঁচ টাকায় সংসার চালাচ্ছে—অথচ instinct (সহজাত-সংস্কার) বড়—সে-ই বড় ব’লে গণ্য হ’তো। Instinct, habit, behaviour, activity (সংস্কার, অভ্যাস, ব্যবহার ও কর্ম)—এইগুলিই ছিল মাপকাঠি। Learning (লেখাপড়া)-কে কখনও শিক্ষা বলা হ’তো না। চরিত্রগত না হ’লে তথাকথিত পাণ্ডিত্যের কোন মূল্য দেওয়া হ’তো না। সব সময় লক্ষ্য ছিল—জ্ঞান, গুণ যাতে জন্মগত সংস্কার ও সম্পদে পরিণত হয়। বর্ণাশ্রমধর্ম্ম এত সূক্ষ্ম, উন্নত ও বৈজ্ঞানিক ব্যাপার যে অনেকে এর অন্তর্নিহিত তথ্য বুঝতে না পেরে একে বৈষম্যমূলক বলে মনে করে—এর চেয়ে বড় ভুল আর নেই। যারা বিজ্ঞানসম্মত বর্ণাশ্রমধর্ম্মকে বিপর্য্যস্ত করবার উদ্দেশ্যে generous pose (উদারতার ভঙ্গী) নিয়ে inferior (অসমর্থ)-দের ক্ষেপিয়ে তোলে, তারা সমাজের মহাশত্রু। শ্রীরামচন্দ্র শম্বুকের প্রতি কঠোর হয়েছিলেন—কারণ, শম্বুকের movement (আন্দোলন)-টা বর্ণাশ্রম-ধর্ম্মের বিরুদ্ধে একটা passionate raid (প্রবৃত্তি-প্ররোচিত অভিযান) বই আর-কিছু নয়। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড, ৩২শে জৈষ্ঠ্য, বৃহস্পতিবার, ১৩৪৬, ইং ১৫। ৬। ১৯৩৯)
* * *
ইদানীংকালে ভারতের রাজনীতির অঙ্গন ‘রাম’ নামের জয়ধ্বনিতে মুখরিত। রামমন্দিরে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে আমরা ভারতীয় প্রজাগণ আর্য্যকৃষ্টির রামরাজত্বকে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। এবার তাহলে অসৎ-নিরোধী তৎপরতার সাথে দুর্নীতিপরায়ণ রাবনদের বিনাশ করা সম্ভব হবে। সেই রামচন্দ্রের রাজ্য শাসন প্রণালী সম্পর্কে সামান্য কিছু কথা জেনে নিলে পাঠক অনেকটাই সমৃদ্ধ হবেন আশাকরি।
বনবাসে থাকার সময় রামচন্দ্র ভরতকে রাজকার্য পরিচালনা বিষয়ে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন—“….. তুমি গুণী ও যোগ্য ব্যক্তিকে বহু-মান প্রদর্শন করে থাক তো? বীর, বিদ্বান, জিতেন্দ্রিয়, সদ্বংশজ, ইঙ্গিতজ্ঞ লোকদের মন্ত্রীপদে প্রতিষ্ঠিত করেছ তো? তুমি তাদের সঙ্গে মন্ত্রণা কর তো? তোমাদের মন্ত্রণা লোকের মধ্যে প্রকাশ হয়ে পড়ে না তো? তুমি যথাসময়ে শয্যাত্যাগ কর তো? রাত্রিশেষে অর্থলাভের চিন্তা কর তো? তুমি সহস্র মূর্খ পরিত্যাগ করেও একজন বিদ্বানকে সংগ্রহ করতে চেষ্টা কর তো? অযোগ্য লোককে যোগ্যস্থানে ও যোগ্য লোককে অযোগ্য স্থানে নিয়োগ কর না তো? যে-সব অমাত্য উৎকোচ গ্রহণ করেন না, যাদের পিতৃপুরুষ যোগ্যতার সঙ্গে অমাত্যের কাজ করেছেন, যারা ভিতরে-বাইরে পবিত্র—সেই সব শ্রেষ্ঠ অমাত্যকে শ্রেষ্ঠ কাজে নিযুক্ত করেছ তো? রাজ্যমধ্যে কোন প্রজা অযথা উৎপীড়িত হয় না তো? শত্রুকে পরাস্ত করতে পটু সাহসী, বিপৎকালে ধৈর্য্যশালী, বুদ্ধিমান, সৎকুলজাত, শুদ্ধাচারী, অনুরক্ত ব্যক্তিকে সেনাপতি করেছ তো? বিশেষ নৈপুণ্য যাদের আছে, তাদের তুমি পুরস্কৃত ও সম্মানিত করে থাক তো? প্রত্যেকের প্রাপ্য বেতন সময়মত দিয়ে থাক তো? রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিবর্গ তোমার প্রতি অনুরক্ত আছেন তো? তোমার কার্য্যসিদ্ধির জন্য তাঁরা মিলিত হয়ে প্রাণ পর্য্যন্ত দিতে প্রস্তুত আছেন তো? বিদ্বান, প্রত্যুৎপন্নমতি, বিচক্ষণ এবং তোমার জনপদের অধিবাসীকেই দৌত্যকার্য্যে নিযুক্ত করেছ তো? স্বরাজ্যে ও পররাজ্যে প্রধান-প্রধান পদের অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য সংবাদ চরগণদ্বারা অবগত থাক তো? চরগণ পরস্পর-বিরোধী তথ্য পরিবেষণ করলে তার কারণ নির্ণয় করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করে থাক তো? প্রজাগণ সুখে আছে তো? তারা দিন-দিন স্ব-স্ব কর্ম করে সমৃদ্ধ হচ্ছে তো? তোমার আয় বেশী, ব্যয় কম হচ্ছে তো? ধনাগার অর্থশূন্য হচ্ছে না তো? অপরাধীদের ধনলোভে ছেড়ে দেওয়া হয় না তো? তুমি সাম, দান, ভেদ ও দণ্ডের প্রয়োগ যথাস্থানে করে থাক তো? তুমি ইন্দ্রিয়গণকে জয় করতে সচেষ্ট থাক তো? অগ্নি, জল, ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ ও মড়ক এই পাঁচ রকমের দৈববিপদের প্রতিকারের জন্য তুমি যত্নশীল থাক তো? সন্ধি-বিগ্রহাদি যথাস্থানে প্রয়োগ কর তো?… ইত্যাদি ইত্যাদি। (আঃ প্রঃ ৫ম খণ্ড, ইং তাং ২-৪-১৯৪৪)
উপরোক্ত বাণী-সংহিতাগুলো রাম রাজত্বের অনুশাসনবাদের কিয়দংশ মাত্র। তাই রাম-রাজত্ব প্রতিষ্ঠা-পিয়াসী জন-প্রতিনিধিদের উচিত হবে, রামচন্দ্রের সভার ন্যায় একজন আদর্শ সভাসদরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। এবং তা’ বাস্তবায়িত করতে হলে, আদর্শ প্রজাপালকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সরকারী কোষাগার থেকে সাধারণভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা যাবে না। শুনেছি, শ্রীরামচন্দ্রের শ্বশ্রুপিতা রাজর্ষি জনক নিজের জীবন ধারণের জন্য রাজকোষ থেকে এক কপর্দকও গ্রহণ করতেন না। বর্তমান শাসনতন্ত্রের পরিকাঠামো অনুযায়ী জন-প্রতিনিধিদের জন্য বরাদ্দ সুবিধা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে রাম-রাজত্ব প্রতিষ্ঠার চিন্তা অধরাই থেকে যাবে। জনগণকে স্ব স্ব আত্মমর্যাদায় সুখে রাখতে হলে জন-প্রতিনিধিগণদের বিলাস-ব্যসন সুখ-সুবিধার কথা ভুলতে হবে, নীতিপরায়ণ হতে হবে, সর্বোপরি যথার্থ ধার্মিক হতে হবে। সেদিকে দৃষ্টি দিলে তবে কাজের কাজ কিছুটা হবে। স্বমহিমায় বিরাজমান থাকবে ‘সত্যমেব জয়তে’-এর জাতীয় নীতি।
ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ব্যবস্থার গৌরবের প্রবহমানতাকে রক্ষা করতে হলে উপরোক্ত ওই বিধানসমূহকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
* * *
রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্য, মৈত্রী ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য যুগ-পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তাঁর অনুগামীদের বললেন, “কখনও নিন্দা কর না, কিন্তু অসত্যের প্রশ্রয় দিও না। নিন্দা করতে হয় তো করবে সাক্ষাতে।”
অর্থাৎ, অস্তিত্ব ধ্বংসকারী লোককে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, অথচ তার সম্পর্কে অন্যের কাছে নিন্দাও করা যাবে না। এই দুই এর মধ্যে এক মিলনসেতু রচনা করে বিরোধহীন দুর্বার নিরোধ গড়ে তুলতে বললেন। আর যদি এড়িয়ে, গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করি তা হলেও বিপদ। “তুমি তোমার, নিজ পরিবারের, দেশের ও দশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী।”—বাণীর মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। অথচ, বাস্তবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিগণদের প্রচারের মাধ্যমে, মিটিং-মিছিলে, আলোচনায় নিন্দামন্দের প্রতিযোগিতা দেখতে এবং শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নিন্দা-মন্দ ছাড়া, তারা যেন কথা বলতেও শেখেনি। “নিন্দা-কুৎসা ক’রে কা’রও/হয় না শুভ অনুষ্ঠান,/মিষ্টি কথায় শিষ্ট চালই/উদ্বোধনার উপাদান।”—এই শিক্ষা যার আছে, তিনি কখনও নিন্দার আশ্রয় গ্রহণ করবেন না। নীতিহীন রাজনীতির টানাপোড়েনে, পারস্পরিক নিন্দা-মন্দ দিয়ে আক্রমণের ফলে উত্তরোত্তর সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অবসান কি প্রয়োজন নেই ?
রাজনীতির ভিত্তি হ’ল ধৰ্ম্ম। ধর্ম্মের ভিত্তি হ’ল আদর্শ। আদর্শ থেকে
আসে কৃষ্টি। রাজনীতির ভিত্তি যদি ধৰ্ম্ম না হয়, তবে ধৰ্ম্মও থাকে না, কৃষ্টিও থাকে
না। প্রবৃত্তি শাসন করে। ব্রাহ্মণ ছিল রাষ্ট্রশাসনের বাইরে। প্রীতি-অবদান ছিল তাদের জীবিকা। চাকরী করলে এদের পাতিত্য হ’তো, কারণ এরা জনতার স্বাভাবিক প্রতিনিধি। আপনারা যদি এখনও না লাগেন তবে আপনি তো কষ্ট পাচ্ছেনই, আপনার থেকে inferior (হীন) যারা তারা শেষ হ’য়ে যাবে। আপনাকেও রেহাই দেবে না। আমরা প্রবৃত্তিতে অভিভূত হ’য়ে থাকি, কিন্তু সত্য যা, সত্তাপোষণী যা, তা’ করি না। আপনার যেমন টাইফয়েড হয়েছিল। তা কি আপনি চান? সামগ্রিক জীবনের ক্ষেত্রে আমাদের তেমনি টাইফয়েড ধ’রে আছে। অথচ তা’ থেকে রেহাই পাবার জন্য কোন চেষ্টা করছেন না। মৃত্যুকে যদি ভালবাসি, তবে জীবন পাব কি করে? অন্যায়ের প্রতি যদি হিংস্র না হই, তবে জীবনের প্রতি অহিংস হওয়া হবে না। আর, এই মরণ-নেশা ও সৎ-বিমুখতা শুধু আমাদিগেতেই নিবদ্ধ থাকে না, আমাদের পরবর্তী বংশধরেরাও affected (ক্ষতিগ্রস্ত) হয়। (আঃ প্রঃ খণ্ড ২১, পৃঃ ২২৩)
* * *
রাজনীতি বলে তা’য়
পূরণ-পোষণ প্রীতিচর্য্যায়
সংহতি আনে যা’য়।
রাজশক্তি হাতে পেয়েও
সতের পীড়ক যা’রাই হয়,
দেশকে মারে নিজেও মরে
রাষ্ট্রে আনে তারাই ক্ষয়।
লোকরঞ্জনী চর্য্যানীতি
স্বতঃস্রবা ব্যক্তিত্বে যা’র,
রাজনীতিজ্ঞ তা’কেই জানিস,
সাত্বত চৰ্য্যায় লক্ষ্য তা’র । ১।
রাজনীতির যা’রা বড়াই করে
অথচ জানে না ধর্মনীতি,
অপকর্ষী সে-সব নেতার
অপদম্ভ ঘটায় ভীতি । ২ ।
মত যদি তুই বাস্তবতায়
সত্তাসিদ্ধ করলি না,
মত কিন্তু মতই র’ল
অর্থে তা’কে আনলি না ৩।
থাকলে আদর্শে ব্যতিক্রম
জাতির ঘটায় মতিবিভ্রম। ৪ ।
নেতা যেথায় সাত্বত নয়,
সাত্বত স্বার্থ করেই ক্ষয়। ৫ ।
নেতার রইলে কু-ঊর্জ্জন,
ক্ষয়েই চলে দেশ ও জন । ৬।
আদর্শ না হ’লে মহৎ-শিষ্ট,
করেই জাতিকে কুট-নিকৃষ্ট । ৭।
শিষ্ট সঙ্গতি সমৃদ্ধ না হলে—
সেই আদর্শে কুফল ফলে । ৮।
আক্রোশদুষ্ট আদর্শ যে ধরে,
জাতি ও জন সে বসে করে। ৯ ।
পালন-পোষণ-চৰ্য্যাবিহীন
আদর্শ দেশকে করেই যে দীন । ১০।
অসৎ ধাওয়া, অসৎ পাওয়া,
অসৎ করায় বাহাদুরি,
ছারেখারে দেশটা পোড়ে
সত্তা-বিভব হরণ করি’। ১১।
(অনুশ্রুতি, ৪র্থ খণ্ড, রাজনীতি)
উপরোক্ত নিদেশ-বাণীর বাস্তবায়ন ব্যতীত রাজনীতিকে সার্থক করা প্রায় অসম্ভব!
এবার, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্ররাজনীতির ব্যর্থতা প্রসঙ্গে ইংরেজী ভাষায় কি বললেন একটু জেনে নেওয়া যাক।—
POLITICS WEEPS ALONG
When the sufferers, the distressed
and the misfortunated
are not managed
to get rid of
the heinous, foul breathing of evil
by the service and solace of the noble,
and are not obliged by them—
Politics weeps along !
(THE MESSAGE, VOL. I, by Shree Shree Thakur Anukulchandra)
* * *
যাঁরা ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে প্রচার মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তাঁদের জেনে রাখা উচিত, গণপ্রজাতন্ত্রী আধুনিক ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভের ধর্মচক্র আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ধর্মকে রক্ষা করে চলার কর্তব্যকে। আমাদের রাষ্ট্রীয় মন্ত্র মূণ্ডক উপনিষদ থেকে প্রাপ্ত ‘সত্যমেব জয়তে’ স্মরণ করিয়ে দেয় উপনিষদীয় আচার্য্য অনুসরণের শাশ্বত অবলম্বনকে। রাষ্ট্রের কর্ণধার রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রীবর্গ প্রত্যেকেই ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করে, ঈশ্বরের প্রতিভূ জীবগণের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হয়। ঈশ্বরের প্রতিনিধি স্বরূপ জাগতিক ন্যায়দণ্ডধারী বিচারকেরা ধর্মাধিকরণ পরিচয়ে বন্দিত। বিচারালয়কে বলা হয় ন্যায়ালয় বা ধর্মস্থান। এ থেকে বোঝা গেল, ন্যায় এবং ধর্ম দুটি শব্দ সমার্থক।
ভারতীয় রাজনীতির অনুশাসনের সাম, দান, ন্যায়, দণ্ড, নীতি ও ভেদ-এর রাজধর্ম রক্ষার পবিত্র কর্তব্যে যা’তে এতটুকু অন্যায়, অধর্ম প্রবেশ করতে না পারে তার জন্যই ওইসব মহাভারতীয় নীতির অনুসরণ। বিধিবৎ প্রকৃষ্ট-জাতক সৃষ্টি করে প্রজা পালনের স্বার্থেই ওই অনুশাসনকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে প্রজাপালনের পবিত্র দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাজনৈতিক দলেরা। সেই সুবাদে রাজনৈতিক দলের জন-প্রতিনিধিরা নিজেদের দেশসেবক বলে পরিচয় দেন। ভোটে জিতে দেশ সেবার অধিকার অর্জনের প্রতিযোগিতায় জিততে অনেক রাজনৈতিক দল আবার হিংসার আশ্রয় নেয়, রক্ত ঝরে, জনগণ ঘরছাড়া হয়! এ ধরণের নোংরা রাজনীতির অপসারণের জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
দেশের সেবা করতে হলে প্রথমেই যুগ পুরুষোত্তমের আদর্শ অনুযায়ী ব্যক্তি-চরিত্র নির্মাণের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ভালো মানুষ জন্মাতে হবে। ভালো মানুষ যদি না জন্মায়, দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের ভালো করবে কারা? রাষ্ট্রীয় পর্যবেক্ষণে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় যে বিধি মেনে, ভালো ফসল, ভালো ফল, ভালো গোরু, ভালো কুকুর জন্মানো হয়, মানুষের ক্ষেত্রে সেই বিধিকে অগ্রাহ্য করছে ভারতের সংবিধান! ২১ বছরের ছেলে হলেই ১৮ বছরের ঊর্দ্ধের মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে! জাতি, বর্ণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্বভাব-অভ্যাস-ব্যবহার ইত্যাদি কোন কিছুর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না! আমাদের রাষ্ট্রিয় কর্ণধারেরা অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড-এর মাধ্যমে উন্নত প্রজাতির পশু প্রজননের ওপর গুরুত্ব দিলেও সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন পর্ষদ মানুষের উন্নত প্রজাতি সৃষ্টি বিষয়ে উদাসীন! উদাসীন যদি না হতেন, তাহলে মানুষ জন্মানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারতেন না!
ভারতের আর্য্যকৃষ্টিতে বর্ণিত বিবাহ ও সুপ্রজনন বিধির সঠিক প্রয়োগ ব্যতীত উন্নত মানের মানুষ জন্মানো কিছুতেই যে সম্ভব নয়, তার সমর্থনে যুগ-পুরুষোত্তম ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনীষীদের কিছু মতবাদ উদ্ধৃত করলাম,—মানবসম্পদ উন্নয়ন পর্ষদ সহ জীবনপিয়াসী মানুষদের উদ্দেশ্যে।
।। বিবাহ ও সুপ্রজনন বিষয়ে প্রাথমিক পাঠ ।।
আর্য্যকৃষ্টি অনুসারে বিবাহ যৌবনের সংস্কার। ভারতীয় আশ্রমধর্ম অনুযায়ী কৃতি ব্রহ্মচারী স্নাতকেরাই এই সংস্কারের অধিকারী হতেন। উদ্বাহ করে গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশ করতেন। বিবাহ করে নারী, পুরুষ করে উদ্বাহ। একজন আদর্শ নারী বধূরূপে স্বামীর সত্তাকে বহন করে যৌন জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। রত্নগর্ভা হয়ে স্বামীর বংশধারাকে করে উন্নত। একজন আদর্শ স্বামী আচার্য্য অনুসরণে গৃহ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সত্তাসম্বর্দ্ধনার চাহিদা করে পূর্ণ। শিব-পার্বতির দাম্পত্য জীবন যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
“ইষ্ট টানে ছুটলে পুরুষ
প্রজ্ঞা অনুপমা
… স্বামীর ঝোঁকে ছুটলে নারী
শ্রেষ্ঠ ছেলের মা।”
(শ্রীশ্রীঠাকুর)
বিবাহের বন্ধনকে সার্থক করতে হলে বর্ণ, বংশ, চরিত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাত্স্যায়ন শ্রেণী বৈশিষ্ট্য এবং বয়সের সামঞ্জস্য অনুযায়ী পাত্রপাত্রী নির্বাচন করতে হয়। এবং খেয়াল রাখতে হবে পাত্রী যেন উল্লেখিত যোগ্যতায় পাত্রকে অতিক্রম না করে। প্রচলিত ধারণার বশবর্তী হয়ে লেনদেন, চাকুরি এবং জাগতিক প্রতিষ্ঠার বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিলে শোভন ও মনোবিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পাত্রপাত্রী নির্বাচন সম্ভব হয় না।
ভারতীয় বিবাহ ব্যবস্থায় পণের কোন স্থান নেই। যেহেতু ‘বর’ মানে বরিষ্ঠ, ‘কনে’ মানে কনিষ্ঠ। স্বাভাবিক নিয়মে বড় হয় দাতা, ছোট গ্রহীতা। অতএব পণ দেবার ক্ষমতাসম্পন্ন পাত্রী কখনই কনিষ্ঠ হতে পারে না। আর পণভূক স্বামীকে কোন স্ত্রী শ্রদ্ধা করতে পারবে না। শ্রদ্ধাহারা স্ত্রী সুসন্তানের জননী হতে পারবে না। ফলে দাম্পত্য অসুখে ভুগতে হবে সারা জীবন । সন্তান হবে সমতান হারা। ফলে ডাক্তার, উকিল, পুলিশ এবং দাদাদের ক্রীড়নক হয়ে চলতে হবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন, “বিয়ের প্রথম উদ্দেশ্যই হ’লো genetic enrichment ( জননগত সমৃদ্ধি)। এইটে হ’ল first and foremost (প্রথম এবং প্রধান)। তার পরের জিনিস হ’ল cultural enrichment (কৃষ্টিগত সমৃদ্ধি)। তাই বর-কনের বংশগত ও ব্যক্তিগত আচার, ব্যবহার, কর্মের সঙ্গতি আছে কিনা তা’ দেখা লাগে। আবার চাই physical enrichment (শরীরগত সমৃদ্ধি)। ….Genetic asset কার কেমনতর তা’না বুঝে বিয়ে থাওয়ার সম্বন্ধ করা ভাল নয়।”
Genetic assetকে গুরুত্ব না দেবার ফলেই বর্তমান পৃথিবীতে শতকরা প্রায়
40টি অকাল মৃত্যুর কারণ কিছু দুরারোগ্য বংশগত ব্যাধি। ওইসব দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে পরমপুরুষ নিদেশিত সুবিবাহ ও সুপ্রজনন বিধি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রজন্মের সুখশান্তি উত্থানপতন সবকিছুর মূলভিত্তি এই সংস্কার। সেই বিবাহ যদি শুধু যৌনলালসার এবং লিভটুগেদার-এর কেন্দ্রবিন্দু হয় তাহলে কোনদিনও অসুখবিসুখ অকালমৃত্যু, সন্ত্রাসবাদ, শোষণবাদ থেকে সভ্যতাকে স্বস্তি দিতে পারবে না ডাক্তার, উকিল, পুলিশ, মিলিটারি, জেলখানা, হাসপাতালের প্রচলিত ব্যবস্থাপনা। বিশ্বাসঘাতক মানুষদের সনাক্ত করতে শুদ্ধ জন্মের শংসাপত্র প্রাপ্ত ভাল জাতের কুকুর (pedigreed dog) আমদানি করতে আমরা আগ্রহী, অথচ শুদ্ধ মানুষ সৃষ্টি করার মহান আর্য্যবিধিকে উপেক্ষা করে যেমন খুশি তেমন বিয়ের অনুমোদন দিয়েছি! এই বোধ বিপর্যয়ের হাত থেকে আমাদের মুক্ত করলেন যুগ সংস্কারক শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। আর্য্য বিবাহবিধির সংস্কারকে নবীকরণ করে।
* * *
পাশ্চাত্ত্য মনীষিগণও আর্য্য বিবাহবিধির সপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন :
“Women should marry when they are about eighteen years of age, and men at seven and thirty; then they are in the prime of life and the decline in the powers of both will coincide. “In men the bodily frame is stunted if they marry while they are growing. Since the time of generation is commonly limited within the age of seventy years in the case of man, and of fifty in the case of a woman, the commencement of union should conform to these periods.” “Further, the children, if their birth takes place at the time that may reasonably be expected, will succeed in their prime when the fathers are already in the decline of life, and have nearly reached their term of three score years and ten.” (MARRIAGE GUIDELINE-by ARISTOTLE Translated by Jowth, source Nana-Prasange, part II, page, 76) * * *
“The various problems of marriage should be considered before actual marriage, viz. (1) the question of age (2) the question of health and heredity (3) the question of physical examination (4) the question of preparedness or preparation for marriage (5) the question of delayed procreation (6) the highly important question of compatibility physical or psychic, on which so often the happiness of marriage rests.” “Sometimes a young woman will, for a time, contemplate work out and the woman who has had such an idea seldom repents abandoning it. Lady Chatterlay can never be the happy wife of her peasant lover.” (EUGENICS AND MARRIAGE, By W. Grant Hague, M.D.) * * *
“The eugenic idea, practically applied to the institution of marriage, means that no unfit person will be allowed to marry. It will be necessary for each applicant to pass a medical examination as to his, or her, physical and mental fitness. This is eminently a just decree. It will not only be a competent safeguard against marriage with those obviously diseased and incompetent, but it will render impossible marriage with those afflicted with undetected or secret disease. Inasmuch as the latter type of disease is the foundation for most of the failures in marriage, and for most the ills and tragedies in the lives of women, it is essential to devote special consideration to it in the interest of the mothers of the race…
“When a girl marries she does not know what fate has in store for her, nor is there any possible way of knowing under the present marriage system. If she begets a sickly, puny child, assuming she herself has providentially escaped immediate disease, she devotes all her mother love and devotion to it, but she is fighting a hopeless fight, as I previously explained when I stated that one-half of the total effort of one-third of the race is expended in combating conditions against which no successful effort is possible. Even her prayers are futile, because the wrong is implanted in the constitution of the child, and the remedy is elsewhere. These are the tragedies of life, which no words can adequately describe, and compared to which the incidental troubles of the world are as nothing.” (EUGENICS AND MARRIAGE, by Dr. Hirschfeld) * * * “Most people pick their partners of life with less care than their partners in business-they utilise less caution in the selection of a husband or a wife than in the choice of a cook or in the purchase of a car or cow.”
“Both the man and woman should be carefully examined not only with regard to their health-not only with regard to their fitness to marry but whether they are fit to marry each other. One man’s meat is another man’s poison. The Jill that will make Jack the happiest mortal may make life a living hell for Tom….”
“I do not see how any sane young couple can risk the hazard of marriage, involving heavy responsibilities towards each other, their progeny, society without subjecting themselves to the tests provided by Chemistry, Biology and Psycho-Analysis.” (EUGENICS AND MARRIAGE,By Dr. Alexis Carrel, Nobel Laureate)
পাশ্চাত্ত্য মনীষি বার্লিনের যৌন বিজ্ঞানাগারের অধ্যক্ষ Dr. Hirschfeld বলেছেন,– ভবিষ্যত প্রজন্মের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে প্রত্যেক নারীপুরুষের জৈব-রসায়ন এবং মনোজগতকে বিশ্লেষণ করে বিবাহ হওয়া উচিত। একজন মানুষের রক্ত অন্য একজনের বিষক্রিয়ারও কারণ হতে পারে।”
এই উক্তির সত্যতা আমরা উপলব্ধি করতে পারি blood transfusion-এর ক্ষেত্রে। যেমন খুশি তেমন বিয়ের পক্ষপাতি তথাকথিত উদারপন্থীরা কি group, Rh factor, aglutinin, aglutinogen etc. না মিলিয়ে যেমন খুশি তেমন রক্ত আদানপ্রদান করতে পারবেন ? যদি পারেন তাহলে কোন কথা নেই, নচেৎ সুস্থ উত্তর প্রজন্ম জন্মানোর জন্য আর্য্য বিবাহ বিধি মেনে চলতে হবেই। নতুবা আপনার ওই অজ্ঞান-উদারতার জনন-বিপর্যয়ের ফলে আপনার পরিবারসহ সমাজ এবং রাষ্ট্র বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
নব-প্রজন্ম সৃষ্টি করার আগে আপনাকে একটু পরিকল্পনা করে নিতে হবে। একটা টবে ভাল ফুলগাছ লাগাতে গেলেওতো পরিকল্পনা করতে হয়। আর আমরা পরিকল্পনাবিহীনভাবে বাবা-মা হয়ে যাব সেটা কি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হবে ?
অতএব বুদ্ধি বিবেচনাকে কাজে লাগিয়ে পূর্বপুরুষদের গুণ ও কর্মের সামঞ্জস্য বিচার করে শ্রেয়ঘরে তুল্যবংশে মেয়েদের বিবাহ সম্বন্ধ হলে সবর্ণ অনুলোম বিবাহ সংগঠিত হয়। মেয়ের বর্গের তুলনায় উচ্চবর্গে হলে অনুলোম অসবর্ণ। বিপরীত হলে প্রতিলোম হয়, যা’ ধ্বংসের কারক।
এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন, “অনুলোম বিয়ে ছাড়া বর্ণগুলির মধ্যে মিল আনা দুরূহ । আর প্রতিলোম যেন-তেন-প্রকারেণ বন্ধ করা চাই। এক বর্ণের মধ্যেও বড় বংশের মেয়ে ছোট বংশের ছেলেকে দিলে তাতেও প্রতিলোম হয়। …..নীচু বংশের হয়েও একজন সদ্বংশজ হতে পারে আবার উঁচু বংশের হয়েও একজন অসদ্বংশজ হতে পারে । অসদ্বংশের প্রধান দোষ হলো– তারা কাউকে শ্রদ্ধা করতে পারে না। …..তাই মেয়ের বিয়ে দিতে গেলেই দেখতে হবে, ছেলে উঁচু সদ্বংশজ কিনা– এ না হলেই প্রতিলোম হলেই সর্বনাশ।”
(আলোচনা প্রসঙ্গে, ১ম খণ্ড/ ৭২)
এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন, “সদ্বংশের ধারাবাহিকতা যেখানে অক্ষুণ্ণ আছে তার আরও একটা বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবেন, in moment of upset বা anger, depression, disappointment, zealous enterprise বা crisis সে কিছুতেই ungrateful বা treacherous move নেবেই না–দাঁড়িয়ে মরবে, হয়তো অস্বাভাবিকভাবে সর্বনাশকেও আগলে ধরতে পারে কিংবা শয়তানী করে নানারকম ফন্দিবাজির ভিতর দিয়ে তা’কে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারে; কিন্তু betrayal-এ tamed হওয়া তার ধাতের আনাচে-কানাচেও নেই, আর ওসব proposal বরদাস্ত করতেও কমই পারে।” (নানা প্রসঙ্গে, ২য় খণ্ড/১২৯-১৩০)
* * *
ইদানীংকালে রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের প্রবৃত্তি-পোষিত, সব সর্বনাশের মূল জাগতিক আকাঙ্খা পূরণ করতে ব্যস্ত। মানুষের জিনগত সম্পদকে সংরক্ষণ করে শুদ্ধ প্রজন্ম সৃষ্টি বিষয়ে কোন পরিকল্পনা তাদের নেই। একমাত্র শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র এই মূল বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মূল চাহিদা ছিল মানবতায় সমৃদ্ধ এক-একটা শুদ্ধ মানুষ। যার প্রকাশ তিনি করেছিলেন, মহাগ্রন্থ পুণ্য-পুঁথির প্রথম বাণীতে, ‘‘আমি চাই শুদ্ধ আত্মা’’।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ওই চাহিদার পূর্তি করতে হলে চাই অপাপবিদ্ধ শুদ্ধ মনের এক-একটা সুস্থ মানুষ। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কথা সকলে না-ই মানতে পারেন কিন্তু বিজ্ঞানকে তো আর অস্বীকার করতে পারবেন না। বিজ্ঞানীরাও প্রকারান্তরে সীলমোহর দিয়েছেন শ্রীশ্রীঠাকুরের ওই চাওয়াটাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সুস্থ মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—
”Health is a state of complete physical, mental and social well-being, and not merely an absence of disease or infirmity.”
The Sign of Physical Health : “…………a good complexion, a clean skin, bright eyes, lustrous hair with a body well clothed with firm flesh, not too fat, a sweet breath, a good appetite, sound sleep, regular activity of bowels and bladder, and smooth, easy, coordinated bodily movements. All the organs of the body are of unexceptional size and function ‘normally’; all the special senses are intact; the resting pulse rate, blood pressure and excercise tolerance are all within the range of ‘normality’ for the individual’s age and sex….”
The Sign of Mental Health : “…….feel satisfied with himself. He feels happy, calm and cheerful. There are no conflicts within himself. He is well adjusted. He accepts criticism and is not easily upset. He understands the emotional needs of others, and tries to be considerate. He has good self-control; he is not overcome by emotion; he is not dominated by fear, anger, love, jealousy, guilt or worries. He faces problems and tries to solve them intelligently.”
The Sign of Social Health : “He is at peace with others and is able to feel himself as a part of a group and is able to maintain socialy considerate behaviour.”
Positive Health : “A person should be able to express as completely as possible the potentialities of his genetic heritage.”
(Source : Preventive and Social Medicine by PARK)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী শুধু বাহ্যিকভাবে নীরোগ বা ব্যাধিমুক্ত থাকাই নয়,—শরীরে, মনে, প্রাণে, সামাজিকভাবে এবং জিনগতভাবে স্বচ্ছ, স্বস্থ ব্যক্তিটিকেই সুস্থ বলা যাবে। যে ব্যক্তিটির প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জৈবিক ক্রিয়াশীলতা হতে হবে ত্রুটিমুক্ত। মানুষটিকে হতে হবে সদানন্দে পরিপূর্ণ বৃত্তি নিয়ন্ত্রিত এক ব্যক্তি। সে নিজেকে ছোটও মনে করবে না, বড় কেউকেটাও মনে করবে না। সে নিজেকে সমাজের এক অত্যাবশ্যক অংশ মনে করে সকলের সাথে মানিয়ে চলবে। সেই ব্যক্তি তার বংশগতিকে ক্লিষ্ট না করে সমৃদ্ধ করবে উত্তর প্রজন্ম সৃষ্টির মাধ্যমে।—এমন মানুষ কি আমরা চাই না! অবশ্যই চাই।
ওই ধরণের সুস্থ মানুষদের দ্বারা সুস্থ মানুষ সৃষ্টির প্রবহমানতা ঠিক রাখতে পারলেই সার্থক হবে প্রজাতন্ত্র।
প্রত্যক্ষভাবে দেখতে গেলে আমাদের ভালোমন্দ সব সৃষ্টির মূলে রয়েছে মননশীলতার প্রয়োগ।
সদা চঞ্চল এই মন প্রভাবিত হয় চিন্তার চিৎকণা দ্বারা। নিয়ন্ত্রিত হয় ইচ্ছাশক্তির দ্বারা। চিন্তাশক্তি এবং ইচ্ছাশক্তির পারস্পরিক সংযোগে সৎ এবং অসৎ দুই-ই জন্মলাভ করে। যেমন, কাশ্যপ ঋষির পত্নী দিতি-মায়ের অনিষ্ট চিন্তার ফসল ছিল হিরণ্যকশিপু। যিনি হরিভক্তি-পরায়ণ সন্তানকে পর্যন্ত মারতে নানা ফন্দী এঁটেছিলেন। আবার হরিভক্তি পরায়ণা স্ত্রী কয়াধুর সেবায়, সাহচর্য্যে, প্রেরণায়, উদ্দীপনায় হরি-বিদ্বেষী হিরণ্যকশিপুর হৃদয়ে ভক্তি ভাবের সঞ্চারণা করে প্রহ্লাদের মতো শুদ্ধাত্মাকে গর্ভে ধারণ করে রত্নগর্ভা হয়েছিলেন কয়াধু। এ থেকে বোঝা গেল যে, সৎ এবং অসৎ মননশীলতার জন্মদাত্রী একজন মা। মা মানে মেপে দেওয়া, পরিমাপিত করা। অনুশ্রুতির ছড়াবাণীতে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন—
যে ভাবেতে স্বামীকে স্ত্রী
করবে উদ্দীপিত
সেই রকমই ছেলে পাবে
তেমনি সঞ্জীবিত।
‘চলার সাথী’ গ্রন্থে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন—
‘‘নারী হইতেই জাতি জন্মে ও বৃদ্ধি পায়, তাই নারী যেমন ব্যষ্টির জননী তেমনই সমষ্টিরও ; —আর, এই নারী যেমন ভাবে আবিষ্ট থাকিয়া যেমন করিয়া পুরুষকে উদ্দীপ্ত করে পুরুষ হইতে সেই ভাবই নারীতে জন্মগ্রহণ করে ; তাই, নারী মানুষকে প্রকৃতিতে মূর্ত্ত ও পরিমিত করে বলিয়া জীব ও জগতের মা ; —তাহ’লেই বুঝিও—মানুষের উন্নতি নারীই নিরূপিত করিয়া দেয় ; তাই নারীর শুদ্ধতার উপরই জাতির শুদ্ধতা, জীবন ও বৃদ্ধি নির্ভর করিতেছে—বুঝিও, নারীর শুদ্ধতা জাতির পক্ষে কতখানি প্রয়োজনীয় ! ১৭৬ ।’’
‘নারীর পথে’ গ্রন্থে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র এক সুস্থ প্রজন্ম-সৃষ্টি-প্রকরণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে দিয়ে বললেন।—‘‘প্রত্যেক complex–এর (গ্রন্থির) সঙ্গে full (পূর্ণ আমি) থাকে। কোন গ্রন্থি বা বৃত্তি অভিহত হইলেই তাহা paralysed (অবসন্ন) হয়, তাহাতে full (পূর্ণ আমি) সেই অভিহত বৃত্তির বা গ্রন্থির reflection–এ (পরাবর্ত্তনে) dull (মূঢ়) হইয়া যায়। অর্থাৎ, নারী যেমনতর ভাবদ্বারা পুরুষকে উদ্দীপিত করে সেই ভাবই অনুপ্রাণিত হইয়া নারীতে জন্মগ্রহণ করেন, তা হলেই সেই উদ্দীপনা যেমনতর হইবে—সন্তানের জীবন ও চরিত্র temperamentally অর্থাৎ ধাতুগতভাবে বা প্রকৃতিগতভাবে তাহাই হইবে। তবেই দেখুন, নারী পুরুষের বৃত্তিগুলি যেমনভাবে পুষ্ট করিবে বা খিন্ন করিবে, সন্তান তাহার তেমনি পুষ্ট বা অপরিপুষ্ট প্রকৃতিযুক্ত হইবে। তাই, কেহ হয়ত অঙ্ক কিছুতেই বোঝে না—কেহবা অঙ্কই শুধু বোঝে আর-কিছু বোঝে না, কেহ হয়ত হিংসাপ্রবণ, দোষদৃষ্টিপরায়ণ, নিন্দুক—কেহ হয়ত উদার, দয়াপরায়ণ, দোষদৃষ্টিহীন—স্বভাবতঃই শ্রদ্ধা বা প্রশংসা-প্রকৃতিযুক্ত।’’
বর্তমান সমস্ত বিশ্বব্যাপী যেসব সমস্যা সভ্যতার সঙ্কটরূপে দেখা দিয়েছে, তার সব কিছুর মূলে রয়েছে অসুস্থতা এবং বিকৃত মানসিকতা। সেই অসুস্থতা এবং বিকৃত মানসিকতার বৃদ্ধি এবং বংশানুক্রমিক বিকাশে প্রতিরোধী লাগাম টেনে না ধরতে পারলে নিকট ভবিষ্যতে মনুষ্যত্বের মূল বুনিয়াদ বলে আর কিছু থাকবে না।
এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বহু পূর্বেই আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন—
শাসন-সংস্থা যেমনই হোক
যাতেই মাথা ঘামাও না
যৌন-ব্যাপার শুদ্ধ নাহলে
দেশের জীবন টিঁকবে না।
ওই যৌন-ব্যাপার শুদ্ধ করা বিষয়ে বিস্তারিতভাবে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, ‘‘সমাজের মূলে বিবাহ। বিবাহকে সংস্কার করতে না পারলে কোন সংস্কারই কোন কাজের নয়। Intercourse-এর সময়ে male ও female দুই জনেরই concentration যত বেশী হয় sperm ও ovum–এর উপর life impression তত বেশী হয়। সেই জন্য marriage based on real life হলে এই concentration possible হয় এবং life impression বেশী হয়। ………………আমাদের শরীর তৈয়ার করে মা। বাবা তৈরী করে মন। অবশ্য দুই-ই পরস্পর গূঢ়সম্বন্ধযুক্ত। শরীর ও মন দুর্বল হলে বোঝা যায় পিতামাতা পরস্পরের প্রতি অনুরাগবিহীন। আর শরীর ও মন উভয়ই সবল হলে বোঝা যায় পিতামাতা পরস্পরে খুব অনুরক্ত।
যেদেশে বিবাহপদ্ধতি দূষিত হয়ে পড়ে, সে দেশে শরীর ও মন দুর্বল নিয়েই সন্তান জন্মগ্রহণ করে। আবার সেই দেশে খুব বড় genius জন্মায় কেন ভেবে দেখতে হবে। Criminals, idiots প্রভৃতি যতকিছু জন্মায় তা সব বিবাহ পদ্ধতি দূষিত বলেই যে হয় তা বলাই বাহুল্য।
………. আবার দেখা যায় during the period of pregnancy যে ভাবে বা যার ভাবে সব সময় মাতাপিতা ভাবিত থাকে তদনুরূপ আকৃতি নিয়েই শিশু জন্মে। From the point of intercourse to birth মায়ের মানসিক ভাব সন্তানের শরীরের ও আকৃতির উপর ক্রিয়া করে। আবার আকৃতিকে mould করার জন্য মনকেও কিয়দংশে mould করে।
Intercourse-এর সময় খুব concentration হয়, তাই মনের মধ্য সবচেয়ে deeply impressed ideaটাই তখন spermatozoa–র ভিতর দিয়ে সন্তানে মূর্ত হয়ে উঠে।
Intercourse-এ দেখা যায়, concentration-এর একটা cessation আসে, ঠিক ধ্যানের মত। আর ধ্যানে যেমন subconscious strongest impression মূর্ত হয়ে উঠে, সন্তান জন্মাবার সময়ও ঠিক তেমনি হয়।’’
একটা সুস্থ মানবসভ্যতা গঠন করার জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর আদর্শ দীক্ষা, শিক্ষা, বিবাহ, কৃষি ও শিল্পের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার হিমাইতপুরে। সর্বোপরি আর্য্যকৃষ্টির বিবাহ নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার উপর জোর দিয়েছেন। আর্য্য বিবাহ নীতিকে যুগোপযোগীভাবে সংস্কার করার জন্য জনে জনে বলেছেন। ম্যারেজ-ব্যুরো গঠন করে সুবিবাহ ও সুপ্রজনন বিধিকে মানুষের মননশীলতায় প্রবেশ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছার পূর্ত্তি কতটা হয়েছে বা হয়নি সেই বিতর্কে না গিয়ে নিজের নিজের দায়ভারটাকে তো কাজে লাগাতে পারি! সামগ্রিকভাবে সেই দায়ভার বহন করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে আইন প্রণয়ন করা। আর সেই উদ্দেশ্য সাধনে প্রয়োজন আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক সংগঠনের।
* * *
যে রাষ্ট্র কৃষি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে, পশু উৎপাদনের ক্ষেত্রে উন্নত জাত, বংশ, গোত্র, বিচার করে; বিশ্বাসঘাতক সন্ত্রাসবাদী দমনে প্রভূত অর্থ ব্যয় করে শুদ্ধ জন্মের শংসাপত্র প্রাপ্ত পে-ডিগ্রীড অ্যালশেসিয়ান, জোবারম্যান, জার্মান শেফার্ড ইত্যাদি সমৃদ্ধ জাতের কুকুর আমদানী করে;—অসংখ্য স্ট্রীট ডগ্দের অবহেলিত, দলিত হিসেবে মর্যাদা না দিয়ে! সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থাই মানুষের জন্মটাকে অশুদ্ধ করার জন্য বর্ণাশ্রমানুগ শ্রেণীবিন্যস্ত ভারতীয় সমাজ বিধানকে অমর্যাদা করে যেমন খুশি তেমন বিয়ের এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের ছাড়পত্র দিয়ে জাতিকে ভয়ানক সর্বনাশের পথে এগিয়ে দিচ্ছে–-অথচ জাত-পাতের নামে সংরক্ষণ, ভাতা চালু রেখেছে! এই বিষয়গুলো যথার্থভাবে অবগত করাবার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
জনগণের জৈবিক তাগিদ পূরণের জন্য আর কিছু না হোক, অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের তো যোগান দিতে হবে। আর তারজন্য প্রথমেই প্রয়োজন বিশুদ্ধ, সুস্থ একটা পারিবারিক পরিবেশ। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী-সন্তান একটা ছাদের তলায় সুখে-দুঃখে মিলেমিশে একটা বিন্যস্ত পরিবার গড়ে তুলবে। বিন্যস্ত পরিবারগুলো একটা সুস্থ বিন্যস্ত সমাজ রচনা করবে। নানাভাষা, নানামত, নানা পরিধানের বিন্যস্ত সমাজ থেকেই গঠিত হবে অসৎ নিরোধে তৎপর এক শক্তিশালী রাষ্ট্র। দেশসেবকেরা বিষয়টি নিয়ে যদি ভাবতেন তাহলে সত্যের পরিপন্থী অসত্য, অন্যায়, অধর্ম, পিতা-মাতা-স্বামী-স্ত্রী-সন্তানদের মধ্যে বিচ্ছন্নতাবাদ প্রশ্রয় পেত না, প্রতিষ্ঠা পেত না। মহান নাগরিক সৃষ্টির গুরুত্বকে উপেক্ষা করে মহানগরের বিস্তারে প্রাধান্য পেত না। সবুজায়ন বিনষ্ট করে নগরায়নের বাড়বাড়ন্ত হতে পারতো না! সর্বত্র দূষণ বিস্তার লাভ করতে পারত না। এ বিষয়ে সকলকে অবগত করার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
বেঁচে থাকা নিয়ে আমরা যে যতই আস্ফালন করি না কেন, মূলতঃ, প্রকৃতির অকৃপণ দান বায়ু, জল, মাটি, সূর্যালোক প্রভৃতি মৌলিক অজৈব উপাদানের উপর আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। শুধু মানুষ নয়, প্রোটোভাইরাস, ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, প্যারাসাইট, শ্যাওলা, উদ্ভিদ থেকে শুরু করে মনুষ্যেতর প্রাণী সকলের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা ওই অজৈব উপাদান বা পঞ্চ মহাভূতের উপর নির্ভরশীল। তাহলে দেশসেবার প্রথম কাজ হবে অসৎ নিরোধী তৎপরতার সাথে জৈবাজৈব প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখা। (সেই কর্তব্য ভুলে, সভ্যতা বিস্তারের নামে প্রাকৃতিক উপাদানকে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে গিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে আহ্বান করছে অপরিণামদর্শী প্রবৃত্তিপরায়ণ জন-প্রতিনিধিগণ!) তারপর পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যার অনুশাসন মেনে নানাভাষা, নানামত, নানা পরিধানের মানুষের বৈশিষ্ট্য টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করা। মহান ভারতের রাজর্ষি জনক ওই বিধি মেনে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন (সূত্র : মহাভারত, বনপর্ব)। সে বিষয়ে সবাইকে অবগত করার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
।। বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বর্ণাশ্রমের ভূমিকা ।।
আর্য্য হিন্দু সমাজে বর্ণ সংখ্যা চার, জাতি প্রায় তিন হাজারেরও বেশী। প্রাচীন ভারতে নতুন কোন জাতির সন্ধান পাওয়া গেলে ঐ জাতির গুণ ও কর্ম অনুসারে উপযুক্ত বর্ণে স্থান করে দেওয়া হত। তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থায় কুলোচিত জীবিকার মাধ্যমে জাত্যুৎকর্ষে উন্নীত বা জাত্যাপকর্ষে অপনীত হওয়ার এক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল। নাগরিকদের বৈশিষ্ট্যের পালন এবং পোষণ করত রাষ্ট্র। সত্ত্বগুণে ব্রাহ্মণ, সত্ত্বমিশ্রিত রজোগুণে ক্ষত্রিয়, রজঃমিশ্রিত তমোগুণে বৈশ্য এবং তমঃ গুণাধিকারে শূদ্রাদি বর্গ নির্ণয়দ্বারা শ্রেণী-বিন্যস্ত সমাজ সংগঠন নির্দ্ধারিত হতো। সমাজ ব্যবস্থায় শূদ্রের কর্ম বা বৃত্তিধর্ম ছিল শিল্পকর্ম ও সেবা; বৈশ্যের কৃষি, বাণিজ্য, গোরক্ষা; ক্ষত্রিয়েরা সমাজকে, পরিবেশকে পোষণ, প্রীতিচর্য্যা, বাহুবল দিয়ে ক্ষত থেকে ত্রাণ করার রক্ষাধর্ম পালন করতেন এবং ব্রাহ্মণদের ব্রহ্মচর্য্য, তপস্যা, মন্ত্র ও সত্য নির্দ্ধারিত করা ছিল। রাজশক্তি বংশপরাস্পরায় সকল প্রজাদের বৃত্তিধর্মে নিয়োজিত করতেন। বৃত্তিহরণ স্বীকৃত ছিল না। ফলে অশিক্ষা, কুশিক্ষার বেকার সমস্যা ছিল না।
রাজর্ষি জনকের রাজ্যে কোন প্রজার কোনরূপ অভিযোগ ছিলনা রাজার বিরুদ্ধে। সকলেই গুণোচিত কর্মের এবং যোগ্যতার মর্যাদা পেতেন। দুষ্কর্মের জন্য দুষ্কৃতিরা উপযুক্ত শাস্তি পেত। সুকর্মের জন্য পুরস্কৃত হত।
ঠিক সেইভাবে, রাজর্ষি জনকের ন্যায় অসৎ নিরোধী তৎপরতার সাথে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করতে হবে। রাম-রাজত্ব না হোক, অন্ততঃ গৌরবময় গুপ্ত সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে আনতে হলে ভারতীয় শাসন সংহিতায় বা সংবিধানে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সম্প্রদায় নিরপেক্ষ ধর্মপ্রাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ করতে হবে। সংবিধানের প্রচলিত ধারা ধর্ম এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়কে একাকার করে ফেলে ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদ’,––অর্থাৎ রাষ্ট্র ধর্মের অনুবর্তী নয়’-এর মতবাদকে প্রতিষ্ঠা দেয়, তখন কি মনে হয় না যে, আমরা জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েও এক বিপর্য্যয়ী বোধ-দ্বারা পরিচালিত হয়ে পরস্পর বিরোধী আচরণ করে চলেছি ! যার ফলে ধর্মের নামে জীবন-বিরোধী অধর্মের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে রাষ্ট্রের অনুমোদন ক্রমে। এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
শাস্ত্র বা বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, যে নীতি-বিধি পদার্থের অস্তিত্ব রক্ষার সহায়ক তাই তো ধর্ম। অথবা বলা যায়, পদার্থের স্বকীয়তা ধারণ করে রাখে যা’ তাই ধর্ম। ধর্ম পালন করলেই পদার্থ টিঁকে থাকবে, নচেৎ থাকবে না। সেই ধর্মের অনুবর্তী না থাকার মানে, জীবন ধারণের শাশ্বত বিধিকে অস্বীকার করা। সংসদ প্রকাশিত ইংরেজী অভিধানে religion অর্থে বলা হয়েছে, ‘It is an action, one is bound to do.’ সেই ধর্মের আবার পক্ষ আর নিরপেক্ষ কি? ঈশ্বর যেমন এক এবং অদ্বিতীয়, ধর্মও তেমনই এক অদ্বিতীয়। এর কোন প্রকার হয় না। হিন্দুধর্ম, মুসলমান ধর্ম এগুলো সম্প্রদায়গত ধর্মীয় মতবাদ। প্রকৃত ধার্মিক তাঁরা, যাঁরা, মনুষ্যত্বের প্রকাশে এবং বিকাশে বিশ্বাসী, মানুষে-মানুষে পারস্পরিক হানাহানিতে নয়। বেদ, গীতা, কোরান, বাইবেল প্রভৃতি ধর্মীয় পুস্তকগুলিতে মনুষ্যত্বের উত্তরণের বিধান পরিবেশিত হয়েছে। রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, যীশুখ্রীষ্ট, হজরত রসুল প্রমুখ পুরুষোত্তমগণ কোথাও বিভেদ সৃষ্টি করে যান নি, সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির সুস্থ সমাবেশ গঠনের কথা বলেছেন।
বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যিক অজৈব উপকরণ বায়ু, জল, মাটি ইত্যাদির যদি ধর্ম থাকতে পারে, এবং তা’ যদি বিজ্ঞানের বইতে পাঠ্য হতে পারে, তাহলে মানুষের কি ধর্ম নেই? মনুষ্যত্ব প্রকাশের মাধ্যমেই তো মানুষ ধার্মিকতার পরিচয় দেয়। মানুষের মনুষ্যত্বের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার নীতিবিধি-সমন্বিত ভারতের নিজস্ব সংহিতাগুলোর বিধানসমূহ ভারতীয় শাসনতন্ত্রের সংহিতায় স্থান পাবে না কেন, প্রজাদের শিক্ষা দিতে পাঠ্য করা হবে না কেন? এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
।। হিন্দুধর্ম্ম বা সনাতন ধর্মের স্বরূপ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ।।
শ্রীশ্রীঠাকুর—হিন্দুধর্ম্ম নয়, আর্য্যকৃষ্টি। আর্য্যকৃষ্টি মানে that which Can be achieve through Culture (যা’ অনুশীলনের ভিতর-দিয়ে আয়ত্ত করা যায়)। মনকে চাষ দিতে-দিতে জানা যায়। পঞ্চবর্হি ও সপ্তার্চ্চি আর্য্যকৃষ্টির কতকগুলি স্তম্ভবিশেষ। স্বীকার করতে হবে যে ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। সবার অস্তিত্ব, চেতনা ও বৃদ্ধির মূলে তিনি। পূর্ব্বপুরয়মান সমস্ত ঋষিকেই আপন ব’লে স্বীকার করতে হবে। তাঁরা কিন্তু অভিন্ন তা’ যিনি যেখানেই থাকুনয়। আটলান্টিকেই থাকুন, হিমালয়েই থাকুন, এখানেই থাকুন আর আল্পস্ পর্ব্বতের গুহাতেই এসে থাকুন। তাঁরা কিন্তু এক, যারা তাঁদের মধ্যে বিভেদ করে, তারা কিন্তু ম্লেচ্ছ অর্থাৎ অসংস্কৃতমনা। Instinct অর্থাৎ সহজাত-গুণবৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন গুচ্ছ বা শ্রেণী আছে, যার উপর দাঁড়িয়ে গ’ড়ে উঠেছে বর্ণাশ্রম, সেটা মানতে হয়, যেমন একই আমের মধ্যে কত রকমারি আছে। প্রত্যেকটার স্বাদ আলাদা, গুণ-গঠন আলাদা। ঐ বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে জগৎ। বিয়ে- থাওয়াও এমনভাবে হওয়া দরকার যাতে বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে ও উৎকর্ষলাভ করে। বিয়ে-থাওয়ার বেলায় বর্ণাশ্রম বিধি মেনে চলা একান্ত দরকার। বিহিত সবর্ণ ও অনুলোম ভাল, কিন্তু প্রতিলোম বর্জ্জনীয়। বর্ত্তমানের আইন যাই বলুক, পরমপিতা ও প্রকৃতির বিধি ব’লে যা’ জানি, তাই বলছি আমি। আমাদের স্বীকার করতে হবে পিতৃপুরুষকে। তাঁদের প্রণাম ক’রে, আশীর্ব্বাদ প্রার্থনা ক’রে তর্পণ ক’রে তাঁদের গুণ অনুসরণ ক’রে আমরা ভগবানে পৌঁছাব। আর , সবার পরিপূরণী যুগপুরুষোত্তম যিনি, তাঁকে না মানলে আমরা dis-integrated (বিশ্লিষ্ট) হ’য়ে পড়ব। তাঁর মধ্যে পূর্ব্বতন সবারই জীবন্ত স্পর্শ পাওয়া যায়। আমরা খাঁটি হিন্দু, খাঁটি মুসলমান, খাঁটি বৌদ্ধ, খাঁটি খ্রীষ্টান হ’লে যুগপুরুষোত্তমের প্রতি আনতি নিয়ে স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এক হ’তে পারতাম। ( আঃ প্রঃ ১৪, পৃঃ ১৫৭)
ধর্ম প্রসঙ্গে বর্ণিত উপরোক্ত বাণীসমূহ কি কোন মানুষের জীবনবিরোধী কোন তাৎপর্য্য বহন করছে, না কোন ধর্ম প্রবক্তাদের, রাজনৈতিক-প্রবক্তাদের মতবাদের এতটুকু বিরোধিতা প্রকাশ করেছে ?
বর্তমান যুগ-পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সাধারণ জনদের বোঝাবার জন্য আরও সহজ ভাষায় বললেন, ‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে/ধর্ম বলে জানিস তাকে। ধর্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে/সম্প্রদায়টা ধর্ম না-রে।’ ওই সম্প্রদায় নিরপেক্ষ সমন্বয় বার্তাবহ বাণীকে গুরুত্ব না দিয়ে, রাষ্ট্র, ধর্মের নামে, শাস্ত্র বহির্ভূত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রবৃত্তি পরায়ণতার আস্ফালনকে, কতগুলো অনিত্য, অসার, অবৈজ্ঞানিক, পরিবেশ দূষক, পৌত্তলিকতার কু-সংস্কারকে যদি ‘ধর্ম’ নামে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়, তা’ কি বিচক্ষণতার পরিচায়ক হবে, না ভারতবর্ষের কৃষ্টির পরিপূরক হবে? ওই ভুলের বোঝা কি আমাদের চিরদিন বইতে হবে? আমাদের বুদ্ধি, বোধ কি নিরেটই থেকে যাবে?
রাষ্ট্রের সৃষ্টিই তো প্রজাদের অধর্ম বা দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে ধার্মিক, অর্থাৎ সু-নীতি পরায়ণ করে তোলার জন্য। সেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলো যদি ওই মহান কর্তব্য ভুলে তার প্রজাবর্গকে, তাদের পিতৃ-পিতামহের আদর্শ অনুসারী ধর্ম-পরায়ণ, কৃষ্টি-পরায়ণ হতে উৎসাহ না দিয়ে, প্রবৃত্তি-পরায়ণতায় উৎসাহ দেয়, সেটা ভারতবর্ষের জাতীয় উত্তরাধিকারত্বের অস্তিত্বকে বিপন্ন করার বার্তা ভিন্ন আর কিছু নয়। কারণ,—
‘‘প্রজা মানেই হচ্ছে—
প্রকৃষ্টরূপে জাত—
সর্ব্বসম্ভাব্য উদ্বর্দ্ধনী সার্থকতায় ;
আর প্রকৃষ্ট জন্ম পেতে হলেই চাই—
প্রজনন পরিশুদ্ধি—
সর্ব্ব-সম্ভাব্যতার বৈধানিক সংস্থিতিতে. …. ’’
(‘সম্বিতী’ গ্রন্থ থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বাণী)
* * *
।। গণ প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের সেকাল-একাল ।।
মূণ্ডক উপনিষদের পবিত্র মন্ত্র ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শকে সম্বল করে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট গণ প্রজাতন্ত্রী আধুনিক ভারতবর্ষের যাত্রা শুরু হলেও ‘‘Of the people, by the people, for the people—জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।’’-এর লক্ষ্যে রচিত কতগুলো বিধিবদ্ধ নিয়ম, শাসন সংহিতা বা সংবিধান ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী স্বীকৃতি লাভ করে, যে দিনটাকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
আর্য্যশাস্ত্র মুন্ডক উপনিষদ-এর প্রথম খণ্ড (3.1.6) থেকে গৃহীত মন্ত্র‘সত্যমেব জয়তে’ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় আদর্শ। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময় এই মন্ত্রটিকে জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে এসে জনপ্রিয় করেন। এটি ভারতের জাতীয় নীতিবাক্য হিসাবে গৃহীত হয়েছিল 26 জানুয়ারী 1950, যেদিন ভারত একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। ‘সত্যমেব জয়তে’-এর অর্থ হলো সত্যেরই জয় হয়। এটি ভারতীয় জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ-এর গোড়ায় দেবনাগরী লিপিতে খোদাই করা হয়েছে। সমস্ত ভারতীয় মুদ্রা এবং জাতীয় নথির একপাশে খোদাই করা আছে।
সত্যের আশ্রয়ে ‘আমরা করবো জয়’ এই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা, তারজন্য খোদাই করা হয়েছিল। (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া) ‘সত্যমেব জয়তে’-এর সীলমোহর হাতে পেয়ে অসত্যের পথে চলার জন্য নয়।
সত্য বিষয়ে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, “সত্যং ভূতহিতং প্রোক্তং ন যথার্থাভিভাষণম্।” অর্থাৎ যা প্রাণীদের পক্ষে মঙ্গলকর তাই সত্য। অহিতকর যথার্থ সত্য নয়।
‘সত্যমেব জয়তে’-র আধিকারিকেরা এই সত্য পথ অবলম্বন করে প্রকৃত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেই জয় হবে সত্যের। অর্থের লোভ, আত্মপ্রতিষ্ঠার মোহের কাছে ‘সত্যমেব জয়তে’-র সীলমোহর ধারকেরা যদি বিবেককে বন্ধক রেখে আত্মবিক্রয় করতে থাকে তাহলে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ভারতীয় কৃষ্টির ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে সব সত্তা প্রেমীদের।
সত্য মানে অস্তিত্ব। যার অস্তিত্ব আছে যার বিকাশ আছে তাই সত্য (real)। ঋষি প্রদর্শিত এই সত্যের পথই আর্য্য ভারতবর্ষের মূলধন। আমাদের আদর্শ ছিল– ‘আত্মানং বিদ্ধি’, নিজেকে জানো, know thyself, ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু, মাতৃবৎ পরদারেষু, লোষ্ট্রবৎ পরদ্রব্যেষু।’ সকলকে নিজসত্তার প্রতীক মনে কর, মেয়েদের নিজের মায়ের প্রতিরূপ ভেবে শ্রদ্ধা কর, অন্যের জিনিসকে মাটির ঢেলার মত দ্যাখ। ‘মা গৃধ’, লোভ কর না। তথাপি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রজাগণ কেন সত্যভ্রষ্ট হচ্ছে, ভেবে দেখার প্রয়োজন নেই?
আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, ‘প্রজা’ শব্দের অর্থ প্রকৃষ্ট জাতক। আর তন্ত্র মানে কতগুলো বিধিবদ্ধ নিয়ম বা system। প্রত্যক্ষভাবে প্রজার স্রষ্টা স্বামী এবং স্ত্রী। বিধিবদ্ধ নিয়ম মেনে জৈবিক তাগিদের জন্য আবশ্যিক আহার, নিদ্রা, অপত্যোৎপাদন ধর্ম বিন্যস্তভাবে পালন করার মাধ্যমেই প্রকৃষ্ট জাতক সৃষ্টি করা সম্ভব। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন স্বামী এবং স্ত্রী পরস্পরের পরিপূরক সম-বিপরীত সত্তারূপে সহাবস্থানে থেকে বিধিবদ্ধ নিয়ম বা সংস্কারের অনুবর্তী হয়ে চলা।
প্রজাতন্ত্রের মর্মার্থ হচ্ছে, যে তন্ত্র বা system মেনে আদর্শ প্রজা নির্মাণ, পালন, পোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষায় প্রযত্নশীল থেকে পরম রাষ্ট্রিক সমবায়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা যায়। ভারতের ব্রহ্মসূত্র, মহাকাব্য, বেদ, উপনিষদ, সংহিতা, আদর্শপুরুষ শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ বলে যা কিছু বর্তমান,—সবকিছুই ওই ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।
কতিপয় রাজনৈতিক নেতারা মহান ভারতের ওইসব বিধিকে আড়াল করে প্রবৃত্তি-পরিপোষিত শিক্ষায় প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের প্রজাদের শিক্ষিত করতে চাইছে। ফলে সন্ত্রাসবাদ, ভ্রষ্টাচার, যৌন-ব্যভিচার ক্রমবর্দ্ধমান। এর কারণ ‘সত্যমেব জয়তে’ কে বাস্তবে মূর্ত করে তোলার মত কোন ইন্দ্রিয়জয়ী সৎপুরুষের জীবন্ত আদর্শ অনুসরণ করছে না রাষ্ট্র। ফলে দেশে মহানগরের বাড়বাড়ন্ত হলেও মনুষ্যত্বের পরিচয় সম্পন্ন ‘পিতামাতার সুজননের সুসন্তান, সন্তানের সুমাতা-সুপিতা, সমাজের সুবন্ধু, রাষ্ট্রের সুনাগরিক’ এমন মহান নাগরিকের সংখ্যা ক্রমশঃ যেন অবলুপ্তির পথে।
ওই অবলুপ্তি থেকে সভ্যতাকে বাঁচাতে, যা-যা করণীয় তা যদি না করা হয়, ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
তাই, ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের প্রবহমানতা টিঁকিয়ে রাখতে হলে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে আদর্শ প্রজা সৃষ্টির মাধ্যম, সুবিবাহ ও সুপ্রজননের ওপর। সুপ্রজননের দায়িত্ব মূলতঃ মেয়েদের। মেয়েই তো মা হয়। মায়ের শুদ্ধতার ওপর নির্ভর করে সন্তানের শুদ্ধতা। বিধিমাফিক সেই মায়েদের শুদ্ধতা রক্ষা করার ব্যবস্থা না করতে পারলে শুদ্ধ প্রজা সৃষ্টি হবে না। বিপন্ন হবে প্রজাতন্ত্র! এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে আর্য্য মহাসভা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
যদিও বর্তমান পুরুষোত্তম এ বিষয়ে আমাদের সচেতন করতে বাণীর মাধ্যমে বললেন–
“দেশের অবনতির
প্রথম পদক্ষেপই হ’চ্ছে—
মেয়েদের উচ্ছৃঙ্খলতা,
পারিবারিক সঙ্গতির প্রতি
বিদ্রূপাত্মক অবহেলা,—
যা’ দেশের শুভদৃষ্টিটাও
ভেঙ্গেচুরে চুরমার করে
সর্ব্বনাশকে আমন্ত্রণ ক’রে থাকে;
তাই বলি,
মেয়েরা যেন
তাদের পবিত্রতা হ’তে
এতটুকুও স্খলিত না হয়,
ব্যবস্থা ও বিধানগুলি
এমনতরই বিনায়িত করে
তাদের ভিতর সঞ্চারিত করে তোল;
তুমি যদি দেশের স্বস্তিকামীই হও—
এদিক থেকে
তোমার দৃষ্টি ও কৃতিচর্য্যার
একটুও অবহেলা যেন না থাকে,
স্বস্তিই হ’চ্ছে
শান্তির শুভ আশীর্ব্বাদ,
আর, স্বস্তি মানেই হ’চ্ছে
সু-অস্তি—”
(বাণী সংখ্যা ৩৭৩)
* * *
প্রজা সৃষ্টি বা ব্যক্তি নির্মাণের সহজ উপায় প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন, “আর্য্যকৃষ্টির মধ্যে তো আছে তারই কলা-কৌশল। তার জন্য প্রথমে চাই good breeding (ভাল জন্ম)। ভাল জন্ম হ’তে গেলে পিতা-মাতার instinct (জন্মগত সংস্কার) ভাল হওয়া চাই এবং তাদের বিয়েও সব দিক দিয়ে মিল ক’রে হওয়া চাই। তারপর পারিবারিক চালচলন এমন হওয়া চাই, যাতে ছেলে-মেয়েরা গোড়া থেকেই সৎ দৃষ্টান্ত দেখে ভাল হওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। পারিবারিক শিক্ষা যদি ভাল না হয়, তাহ’লে পুঁথিগত শিক্ষা যতই হোক না কেন, তাতে মানুষের habits, behaviour (অভ্যাস, ব্যবহার) adjusted (সুনিয়ন্ত্রিত) হয় না।
তারপর চাই সদ্গুরুর কাছে দীক্ষিত হ’য়ে শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠাসহকারে তাঁর নির্দ্দেশ মেনে চলা।
শিক্ষা-ব্যবস্থাও এমন হওয়া দরকার, যাতে প্রত্যেকে তার বৈশিষ্ট্যের উপর দাঁড়িয়ে চৌকষ হ’য়ে উঠতে পারে। স্বতঃদায়িত্বে environment (পরিবেশ)-এর প্রয়োজন কে কতখানি পূরণ ক’রে চলতে পারে, অপরের জীবনীয় স্বার্থকে কে কতখানি বাস্তবে নিজের স্বার্থ ক’রে তুলতে পারে, মোট কথায় সেইটেই শিক্ষার বড় তকমা। আর জীবিকার ব্যবস্থা যথাসম্ভব বর্ণবৈশিষ্ট্যানুগ ও স্বাধীন হওয়া দরকার। উপার্জ্জনের অন্য যে-কোন পথই থাক, cottage-industry (কুটিরশিল্প) ও agriculture (কৃষি) সব পরিবারেই কিছু না কিছু থাকা চাই। আর চাই গো-পালন। জীবিকার জন্য যদি পরের দাসত্ব করতে না হয় বা dishonesty (অসাধুতা) করতে না হয়, তাহ’লে কিন্তু মানুষ অনেকখানি ঠিক থাকে।
আর চাই ভাল-ভাল ঋত্বিক্, অধ্বর্য্যু, যাজক। তারা তাদের উন্নত চরিত্র, সেবা ও যাজনের ভিতর-দিয়ে সারা দেশের মানুষকে সত্তাপোষণী চলনে অভ্যস্ত ক’রে তুলবে, ধর্ম্ম, ইষ্ট, কৃষ্টির ভিত্তিতে integrated (সংহত) ক’রে তুলবে। সঙ্গে-সঙ্গে দেখবে, অসৎ অর্থাৎ সত্তাপরিপন্থী রকমগুলি যাতে দানা বেঁধে উঠতে না-পারে। Simultaneously (যুগপৎ) এই সবগুলির দিকে নজর দিয়ে যদি চলা যায়, তাহ’লে দেশের আবহাওয়াই বদলে যাবে। তখন মানুষের ভাল হবার সম্ভাবনাই বেশী থাকবে। খারাপ যারা থাকবে, তারাও উপযুক্ত শাসন-তোষণ ও প্রেরণার ভিতর-দিয়ে অনেকখানি ঠিক হ’য়ে উঠবে।
Bad instinct (খারাপ সংস্কার)-ওয়ালা progeny (সন্ততি) যাতে সমাজে বাড়তে না পারে, তার ব্যবস্থা না করলেই নয়।
সেইজন্য আমি proper marriage (উপযুক্ত বিবাহ)-এর উপর অতো জোর দিই। ঐ জায়গায় হাত না দিলে সব programme (কর্ম্মসূচী)-ই fail করবে (অকৃতকার্য্য হবে)।
আমি মুখ্যু মানুষ, আমার কথার তো দাম নেই। কিন্তু দাসীর কথা বাসি হলি কামে লাগবি। (আলোচনা-প্রসঙ্গে, ষষ্ঠ খণ্ড, ২৩শে অগ্রহায়ণ, শনিবার, ১৩৫১, ইং ৯-১২-১৯৪৪)
যথার্থ মর্যাদায় প্রজাতন্ত্রকে বাস্তবায়িত করতে হলে যুগ-পুরুষোত্তমের আদর্শকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করার প্রয়োজন আছে। বর্তমান রাজনৈতিক দলের সাথে দেশপ্রেমী সচেতন ব্যক্তিবর্গ যাঁরা যুক্ত আছেন, তাঁরা কিন্তু পার্টির সব দুর্নীতি মেনে নিতে পারেন না। তাদের পথ দেখাতে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন আমার গুরুদেবের একটা বাণী। “রাজনীতি বলে তায়/পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যায়/সংহতি আনে যায়।” যে নীতি সকলের অভাব পূরণ করে, সবাইকে অভীষ্ট মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় পোষণ দিয়ে সব্বাইকে প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ করে সংহতির প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ, সেই নীতির নাম রাজনীতি। এ বিষয়ে প্রজাগণকে সচেতন করতে আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
জনগণের অভাব পূরণ যিনি বা যারা করবেন তাদের বৈশিষ্ট্যপালী হতে হবে। বৈশিষ্ট্য মানে বিশিষ্টতা। বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের নানাভাষা, নানামত, নানা পরিধানসমৃদ্ধ বিশিষ্টতার পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা সংহতির প্রতিষ্ঠা যিনি করতে পারবেন তিনি হতে পারবেন একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ।
যেমন, একজন গোপালক বা রাখাল বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের গোরু—ষাড়, বলদ, গাভী, দামড়া, বকনা নামের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের গোরুর পাল নিয়ে মাঠে চড়াতে যায়। একটা ছোট লাঠি বা পাচনের সাহায্যে সে গোরুর পাল্-কে পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা সংহত রেখে আবার গোধূলি বেলায় গোয়ালে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। যেমন, একজন চাষী তার বিভিন্ন জমির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য মেনে ভূমিকে কর্ষণ করেন বা চাষ দেন। জমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ‘জো’ বুঝে বীজ বপন করেন, চারা রোপন করেন। তারপর উপযুক্ত জলসেচ, সার, কীটনাশক, পাহারা দিয়ে পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা ফসল উৎপাদন করেন। দুঃখের বিষয় বর্তমানের রাজনীতির নেতারা সে বিষয়ে কোন গুরুত্ব আরোপ করছেন না। এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতে, বৈশিষ্ট্য মানে—তদনুপাতিক organic adjustment (বৈধানিক বিন্যাস)। তার আবার (group) গুচ্ছ আছে। এইগুলিকে বলা হয় বর্ণ, এর কোনটাই আমরা নষ্ট করতে চাই না। নষ্ট করা মানে যুগ যুগ ধরে, তিল তিল করে, যা গড়ে উঠেছে তা হারান। ন্যাংড়া আম আছে, ফজলি আম আছে আরো কত রকমের আম আছে। এর একটা জাত যদি নষ্ট করে ফেলি তাহলে তা’ আর ফিরে পাব না—হারাব চিরতরে। সেকি ভালো? ফজলি আমের মধ্যে তো আর ন্যাংড়া আমের স্বাদ পাব না। তাই যেন আমরা বুঝে চলি। (আলোচনা প্রসঙ্গে, ১৬শ খণ্ড, পৃঃ ১০৯)
আমাদের ভারতের গ্রামীন অর্থনীতি কৃষি ও গোপালনের উপর নির্ভরশীল। ভালো কৃষকেরা কখনোই যেমন খুশি তেমনভাবে, নিজের খেয়ালখুশি মত চাষ করেন না। সরকারী কৃষি বিভাগের পরামর্শ মেনে জমি অনুযায়ী উন্নত জাতের বীজ বপন করেন, চারা রোপন করেন। গোপালন ক্ষেত্রেও তাই। সরকারী পশু পালন বিভাগের বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মেনে গাভীর জাতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সম-বিপরীত উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ দিয়ে উন্নত জাতের সুস্থ, সবল বাচ্চা উৎপাদন করেন। অথচ, ওই পদ্ধতি মেনে সুস্থ মানব-শিশু সৃষ্টির বিষয়ে রাষ্ট্র উদাসীন। এ বিষয়ে সবাইকে অবগত করাবার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
আমরাও দৈনন্দিন জীবন-যাপনে সকলেই কিছু-না-কিছু বৈশিষ্ট্যের পালন-পোষণ করেই থাকি। সচেতন ব্যক্তি মাত্রেই বাজার থেকে ভালো জাতের বা কোয়ালিটির আলু, বেগুন, পটল, মুলো, আম, চাল, ডাল, চা কিনতে অভ্যস্ত। এমন কোন সুস্থ মানুষ নেই যে উদারতার নামে হিমসাগর আমের দাম দিয়ে আঁশযুক্ত টোকো আঁটিসার আম কিনে আনবেন? মিনিকীট, বাঁশকাঠি, গোবিন্দভোগ, দেরাদুন রাইসের দাম দিয়ে রেশন দোকানে প্রদত্ত মোটা চাল কিনে আনবেন?
এ থেকে প্রমাণিত হলো গাছপালা, পশুপাখি সবকিছুর জাত, বর্ণ আছে। জীব বিজ্ঞানের পুস্তকেও জাতি, প্রজাতি, বর্ণ, গোত্র-এর উল্লেখ আছে। তাহলে মানুষের কি নেই? অবশ্যই আছে। মানুষ তো সব জাতহীন হয়ে যায় নি? তবে হ্যাঁ, জাতের নামে বজ্জাতি কিন্তু চলছে—শিডিউলড্, আন-শিডিউলড্, ওবিসি, ট্রাইব প্রভৃতি নিয়ে পার্টিবাজি করতে গিয়ে সহজাত-সংস্কারের বৈশিষ্ট্যটাকে নাকাল হতে হচ্ছে! অন্যায়, অধর্ম করে, অন্যের বৃত্তি হরণ করে টাকা উপার্জন করতে গিয়ে এক অসম অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করে চলেছি আমরা। ফলে অর্থ, অনর্থ সৃষ্টি করে চলেছে ! এর অবসানের জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র এবং দারিদ্র সীমার নীচে ইত্যাদি অর্থনৈতিক মানদণ্ডে বিভাজিত। যার সাথে বর্ণানুগ কর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ফলে, তথাকথিত একজন নিম্ন বর্ণের মানুষও কালোয়ারী, দালালি, সিণ্ডিকেট, প্রমোটারী ইত্যাদি বৃত্তি মাধ্যমে প্রভূত টাকা রোজগার করার সুযোগ পাচ্ছে। উচ্চ-বিত্তধারী হয়ে অপরাপর উচ্চবর্ণকে চাকর রেখে, দরিদ্র অথচ গুণীজনদের দাবিয়ে রেখে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারছে! এক মেকী উদার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বংশানুক্রমিক গুণ ও কর্মের যোগ্যতার মানদণ্ডকে শিথিল করে সংরক্ষণ প্রথা মাধ্যমে এক পরস্পর বিরোধী শ্রেণী-বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা বর্ণাশ্রম না বুঝলেও সুবিধা আদায় করার লক্ষ্যে SC/ST/OBC বুঝতে শিখেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ‘ওয়ার্ক কালচার’ নষ্ট হয়ে এক অসম অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারী, বেসরকারী, সংগঠিত, অসংগঠিত কর্ম সংস্থানে আকাশ-পাতাল বৈষম্য। এর কারণ গোড়ায় গলদ! ব্যক্তিসত্তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ভুলে বড় হতে গিয়ে প্রকারান্তরে নিজেদের অস্তিত্বকে ম্যালিগন্যাণ্ট স্তরে বিপন্ন করে চলেছি। এর অবসান প্রয়োজন। এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। * * *
আর্য্যকৃষ্টির বর্ণাশ্রমধর্ম্মের বিধি-বিন্যাস অনুযায়ী যোগ্যতাসম্পন্ন ব্রাহ্মণেরা আচার্য্যপদে, উপাচার্য্যপদে অধিষ্ঠিত হয়ে অধ্যাপনা করতেন, শিক্ষাদানের মাধ্যমে ছাত্রদের সন্তোষ বিধান করতে পারলেই গ্রহণ করতেন শ্রদ্ধার্ঘ্যের দক্ষিণা। হাতীবাগান, হাওড়া, ভাটপাড়া, বারানসী, রাজস্থান এবং কাশ্মীরের কিছু কিছু পণ্ডিতেরা বর্তমানেও টোল বা গুরুকুল মাধ্যমে ওই প্রথা জীইয়ে রেখেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রবন্ধ এবং কালজয়ী ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শতাব্দীর মৃত্যু’ উপন্যাসে ভারতীয় শিক্ষার একাল-সেকাল বিষয়ক এক জীবন্ত চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
আর্য্যকৃষ্টির ভারতবর্ষে, শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণ দুইই ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধার উপরে প্রতিষ্ঠিত। “প্রণিপাতেন, পরিপ্রশ্নেন, সেবয়া”, –-আচার্য্য বা শিক্ষকের প্রতি প্রকৃষ্টরূপে আনতি প্রকাশ দ্বারা প্রশ্নের মাধ্যমে, সেবার মাধ্যমে অজানাকে জেনে নিজেকে সমৃদ্ধ করতেন। জানার তত্ত্ব এবং তথ্য ছিল, “অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যুর্মামৃতম্ গময়” – অসৎ হতে সৎ-এ অবস্থান করে, অন্ধকার থেকে আলোর লক্ষ্যে এগিয়ে, মৃত্যুময় জগতের মধ্যে থেকেও যেন অমৃত আহরণ করতে পারি। এই গন্তব্যের লক্ষ্যে পরিচালিত। ওই গন্তব্যে পৌঁছতে “আত্মবৎ সর্বভূতেষু, মাতৃবৎ পরদারেষু, লোষ্ট্রবৎ পরদ্রব্যেষু”––সকল প্রাণীকে নিজের মত করে ভালবাসব, সকল মেয়েদের নিজের মায়ের মত সম্মান করব, অন্যের জিনিসকে রাস্তায় পরিত্যক্ত ঢিলের মত মনে করব। “মা গৃধ”—লোভ সম্বরন করব।—ইত্যাদি ছিল ভারতীয় শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ‘মেরা ভারত মহান’ শ্লোগানে সমৃদ্ধ আধিকারিকেরা ‘সত্যমেব জয়তে’-র সীলমোহর দিয়ে ওই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাকে নষ্ট করে শিক্ষকদের মাস মাইনের চাকর করার ফলে শিক্ষা আজ ব্যবসায়ে পরিণত। শিক্ষাঙ্গনে ‘আমরা ওরা’ বিভেদের শিক্ষার সাথে পরিপোষিত হচ্ছে অসদাচার, ভ্রষ্টাচার, দুর্নীতি, হিংসার শিক্ষা! এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
*** প্রাচীন ভারতের আদর্শ রাজন্যবর্গ প্রজাগণকে বংশানুক্রমিক কৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে, কর্মানুগত শাসনে রেখে কর্মচ্যুত বা বেকারদের স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যানুপাতিক কর্মে নিযুক্ত করতেন। যাতে বর্ণাশ্রম ধর্ম বিনষ্ট হয়ে প্রজাগণ সঙ্করদোষে দুষ্ট না হয়। প্রজা সঙ্করদোষে দুষ্ট হলে সমাজে ভীষণাকৃতি, বামন, কুব্জ, স্থূল মস্তিষ্ক সম্পন্ন, ক্লীব, অন্ধ, বধির, অপরাধপ্রবণ মানুষের সৃষ্টি হয়। (দ্রঃ বিষ্ণুপুরাণ) ওই শিক্ষার ধারা লুপ্ত করার ফলে সমাজের পারস্পরিক সংহতি, শান্তি, সমৃদ্ধি লোপ পেতে শুরু করেছে।
বর্তমানে জীবিকা এবং পেশাগত শ্রেণী বিন্যাসের অন্তর্ভূক্ত বৃহদায়তন, মাঝারি, ক্ষুদ্র শিল্পপতি, বাণিজ্যজীবী, পাইকারী, খুচরা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ফেরিওয়ালা, আমলা, ডাক্তার, নার্স, আয়া, বিউটিশিয়ান, উকিল, ইঞ্জিনীয়ার, শিক্ষক, করনিক, এজেণ্ট, পাইলট, ড্রাইভার, মেকানিক, অপারেটরর্স, বাইণ্ডার, প্রিন্টার, কম্পোজিটর, ওয়েল্ডার, টার্নার, ফিটার, উইভার, ইলেকট্রিশিয়ান, ইলেক্ট্রনিকস্ ওয়ার্কার, কম্প্যুটার ওয়ার্কার, কার্পেন্টার, কন্ট্রাকটর, প্রমোটার, নির্মাণকর্মী, শ্রমজীবী ইত্যাদি আরো আরো অনেক বৃত্তিতে, কর্মে নিযুক্তরা বেশীরভাগই বর্ণাশ্রম অনুসারী বৃত্তিতে রত নয়। ফলে এক অসম অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থা রাষ্টে বিদ্যমান। কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত জন্মগত সংস্কার (instinct)কে উপযুক্ত মর্যাদা না দেবার জন্য সার্বিকভাবে কর্মসংস্কৃতিতে বিপর্য্যয় নেমে এসেছে। সমান কর্মে সমান মজুরী, সমান সম্মান না পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট জনেদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্ন হচ্ছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন, (আমাদের) বর্ণাশ্রমের মধ্যে un-employment (বেকার সমস্যা) বলে জিনিস ছিল না, তা’তে বৃত্তিহরণ ছিল মহাপাপ, প্রত্যেকে স্ব-স্ব বর্ণোচিত কর্ম করতো, প্রত্যেকে প্রত্যেকের সহযোগী ও পরিপূরণী হ’তো। (আঃ প্রঃ ১ম খণ্ড, পৃঃ ৭৯)
আমার মনে হয়, বর্ণাশ্রমটা যদি ঠিকভাবে জাগিয়ে তোলা যায়, তবে অনেক কিছু গোল চুকে যায়। (আঃ প্রঃ ১ম খণ্ড, পৃঃ ৭৯)
এ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন, “ভারতবর্ষের বর্ণাশ্রম ধর্ম মানবজাতিকে ঈশ্বরের দেওয়া শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলোর অন্যতম। …..এই বর্ণাশ্রম ধর্ম ভারতে আশ্চর্যকীর্তি স্থাপন করেছে এবং ভবিষ্যতেও ভারতবাসীকে পরম লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করবে।”
(নবপত্র প্রকাশনীর বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র পৃঃ ৬৭৯ থেকে সংগৃহীত।)
বর্ণাশ্রমকে মেনে চলার জন্য একটা সময়ে ভারতবর্ষের প্রতিটি গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। উপার্জনের জন্য পরিযায়ী হতে হতো না।
।। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রদত্ত বর্ণাশ্রমের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা ।।
শরৎদা জিজ্ঞাসা করলেন—‘চাতুর্ব্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকৰ্ম্মাবিভাগশঃ’–এর মানে কী। এটা কি গোড়া থেকে আছে ? শ্রীশ্রীঠাকুর—হ্যাঁ, ভিতরে যেমন instinct (সহজাত সংস্কার বা গুণ) থাকে, কৰ্ম্মও তদনুযায়ী হয়। দুনিয়ার দুটো জিনিস ঠিক অবিকল বা একরকম দেখতে পাবেন না। প্রত্যেকটি যা-কিছুর একটা বিশিষ্টতা আছে— তা যেমন রূপে তেমন গুণে। একই বাপ-মায়ের পাঁচটি সন্তান পাঁচরকম হয়। কারণ, উপগতির সময় নারী, পুরুষকে যখন যেমন প্রেরণা দেয়, পুরুষের ভিতরকার তেমনতর জিনিসই তখন বেরোয়। স্ব-অয়ন-স্যূত বৃত্ত্যাভিধ্যান তপস্যায় গতি ও অস্তি অধিজাত হয়েছে। সেখানে স্ব হচ্ছে যেন পুরুষ, sperm. (বীজ), বৃত্তি যেন প্রকৃতি ovum (ডিম্বকোষ), আর অভিধ্যান হলো cohesive affinity. (যোগাবেগ)। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রেরণায় একই পুরুষের ভিতর থেকে বিভিন্ন গুণের সৃষ্টি হ’লো। যত রকমের গুণই থাক না কেন, তার Grand division (প্রধান বিভাগ) ঐ চার বর্ণের মধ্যেই রয়েছে। শুধু মানুষের জন্যই নয়, জীব-জগতের সব স্তরেই চাতুর্ব্বর্ণ রয়েছে, সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই বর্ণ ঢুকে গেছে। প্রথম থেকেই তা instinct হিসাবে থাকে। Environment (পারিপার্শ্বিক) এর মধ্যে তা প্রকাশিত হয়। Generation after generation (বংশ পরম্পরায়) সেই ধারা চলে।
শরতদা— বর্ণ যদি প্রধানতঃ গুণগত ব্যাপার, তাহলে hereditary varna (বংশানুক্রমিক বর্ণ) মানবার প্রয়োজন কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর—তাহলে তো বেশ বুঝেছেন দেখছি! গুণটা আসছে কোত্থেকে? সেও তো ঐ জন্মসূত্র থেকে। আপনার জৈবী বিধানকে বাদ দিয়ে আপনার কোন গুণ বা কৰ্ম্মক্ষমতা নেই। হাওয়ার উপর কিছু দাঁড়ায় না। গুণ ও কৰ্ম্মক্ষমতা শরীর, স্নায়ু, কোষ chromosome, gene ইত্যাদিকে আশ্রয় করেই অবস্থান করে। সেগুলি বংশানুক্রমিকতার সূত্র বেয়েই তো নেমে আসে, যাকে বলে immortal neckless of germ-cell (বীজ কোষের অবিনশ্বর মালা।)
শরৎদা—বর্ণধৰ্ম্ম ঠিক ভাবে পালন করতে গেলে তো মানুষ বর্ণোচিত কৰ্ম্ম ছাড়া অন্য কাজ করতে পারবে না। কিন্তু কোন মানুষের অন্য বর্ণের কৰ্ম্মে যদি বিশেষ প্রতিভা থাকে এবং তা যদি সে না করতে পারে, তাহলে তো সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর—মানুষ জীবিকার বর্ণোচিত কৰ্ম্ম ছাড়া করতে পারবে না—এক আপদ্ধর্ম ছাড়া। তাছাড়া কোন কৰ্ম্মানুশীলনে মানুষের কোন বাধা নেই। বর্ণাতীত কৰ্ম্মে যার বিশেষ প্রতিভা থাকে, বর্ণোচিত কর্মেও সে অপটু হয় না। সেই কৰ্ম্ম দিয়ে জীবিকা আহরণ করে বাদবাকী সময় সে তার প্রতিভার স্ফূরণ এবং তদনুযায়ী লোক সেবায় ব্যয় করতে পারে। তার বিনিময় সে কিছু চাইবে না, কিন্তু তার সেবায় প্রীত হয়ে স্বতঃস্বেচ্ছ আগ্রহে প্রীতি অবদান স্বরূপ কেউ যদি তাকে কিছু দেয়, তা গ্রহণ করতে তার কোন বাধা নেই। কিংবা রাষ্ট্রের তরফ থেকেও যদি তাকে কোন পুরস্কার দেয় তাও সে গ্রহণ করতে পারে। প্রত্যেকে যদি বর্ণোচিত কর্মনিরত থাকে, কেউ কারও বৃত্তিহরণ না করে তাহলে বেকার সমস্যা জিনিসটাই আসতে পারে না। অযথা প্রতিযোগিতা জিনিসটাও বন্ধ হয়ে যায়। পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। বংশপরম্পরায় একই কৰ্ম্ম করার ফলে প্রত্যেকের দক্ষতা ও যোগ্যতাও বেড়ে যায়। প্রত্যেকে স্ব স্ব কৰ্ম্ম করায় সর্ব্বতোমুখী সুষম উৎপাদন ও সেবা পরিবেষণের একটা স্বাভাবিক ব্যবস্থা স্বতঃই গজিয়ে ওঠে। কোন বর্ণের বিশিষ্ট সেবার অভাবে, তারা এবং অন্যান্য বর্ণ অপুষ্ট থাকে না। সামাজিক শৃঙ্খলা অব্যাহতভাবেই এগিয়ে চলে। তাই আমাদের বাপ, বড়বাপ, ঋষি, মহাপুরুষরা যে বিধান করে গেছেন, তা একটু তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করবেন। অদূরদর্শিতা ও হীনত্ববুদ্ধি থেকে দুনিয়ার অনেক আন্দোলনই হয়েছে, কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান কিছু হয় নি, সব ব্যাপার মানুষের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং বার বার বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য্য হয়ে উঠছে। এর আছে সুসঙ্গত ব্যক্তিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানকে আশ্রয় করার মধ্যে। এই বিজ্ঞানের নামই বর্ণাশ্রম,এবং আমাদের ঋষি-মহাপুরুষরাই এই প্রাকৃতিক বেদবিজ্ঞানের দ্রষ্টা, আবিষ্কর্তা ও প্রতিষ্ঠাতা। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড / ১৭৩-১৭৪ পৃঃ)
শ্রীশ্রীঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে বললেন—যে যে-কোন ধৰ্ম্মাবলম্বীই হোক না কেন, তার বংশে যদি প্রতিলোম সংমিশ্রণ না হয়ে থাকে, তবে তার বংশানুক্রমিক জীবিকা, অভ্যাস, আচার, ব্যবহার অনুপাতিক তার বর্ণ নিরূপণ করে বর্ণাশ্রমের বিধি অনুযায়ী তাকে পরিচালিত করা যেতে পারে। বর্ণাশ্রম একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাপার; এটা সার্ব্বজনীন। সহজাত সংস্কার বিন্যাস এবং বৈধী বিবাহের ভিতর দিয়ে বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে ধারাবাহিকতায় অক্ষুণ্ণ রেখে বংশপরম্পরায় প্রগতিপন্ন করে তোলাই হচ্ছে এর মূল কথা। পৃথিবীর প্রত্যেকটি সমাজকে যদি এমন বিধিবদ্ধভাবে সাজিয়ে তোলা যায়—তাদের বৈশিষ্ট্যের আপূরণী করে, তবে বিহিত অনুলোমক্রমে পারস্পরিক পরিণয় নিবদ্ধও সৃষ্টি করা যেতে পারে। পূরয়মান এক আদর্শ ও অনুলোম বিবাহ যেমন একটা জাতকে একগাট্টা করে তোলে, তেমনি করে তা সমগ্র বিশ্বকেও সংহত ও ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে পারে—পারস্পরিক বৈশিষ্ট্যানুগ সংহতি নিয়ে। পরমপিতার দয়ায় বিশ্বশান্তির এই যা এৎফাক বের হয়েছে, এ একেবারে চরম এৎফাক, এখন তোরা মাথায় নিয়ে করলেই হয়। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড, পৃঃ ৮৯-৯০) আমাদের বুঝটাকে পাকা করে দিতে একই বিষয় তিনি নানাভাবে উপস্থাপনা করে গেছেন যাতে আমরা ‘না বোঝার’ অজুহাত না দিতে পারি। তাই তিনি অনুশ্রুতি-র ছড়াবাণীতে
বিষয়টাকে আরো একটু প্রাঞ্জল করে তুলে ধরলেনঃ বর্ণাশ্রমী নয়কো যা’রা আৰ্য্যকৃষ্টি মেনে চলে কিম্বা আৰ্য্যকৃত হ’য়ে বর্ণাশ্রম প্রার্থী হ’লে গুণ বঞ্চনা-সক্রিয়তায় বংশক্রমে ব্যক্তিগত অনুক্রমে যথাবর্ণে করবি তা’রে সুসংহত।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র উপরোক্ত বাণীর মাধ্যমে বাহ্য জাতিভেদ প্রথার মূলোৎপাটন করে মানুষকে ভারতীয় বর্ণাশ্রমানুগ বিধানে স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত করলেন। মানুষের জাত বা সহজাত সংস্কার এবং তাদের জৈবিক তাগিদগুলো প্রবৃত্তির কবলে পড়ে মনুষ্যত্বের অপলাপী কর্মে লিপ্ত যাতে না হতে পারে, বিধিবৎ নীতি প্রণয়ণ করে বিহিত ব্যবস্থায় মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষা করা, রাজনীতির নির্দিষ্ট কর্ম।—সে বিষয়ে উদাসীন রাজনৈতিক জন প্রতিনিধিগণ! এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
শান্তি-মৈত্রী-ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথ-নির্দেশ
নৃতাত্ত্বিক গঠনের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী মানুষকে আল্পাইন, ব্রাকিসেফাল, মেডিটেরিয়ান, মঙ্গোলয়েড, নর্ডিক, নিগ্রোয়েড প্রভৃতি নামে শ্রেণী বিভাজন করা হয়েছে। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সহজাত সংস্কার গুণ ও কর্মভিত্তিক বর্ণাশ্রম বিভাজনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন আর্য্য ঋষিরা। শাস্ত্রে গুণ এবং কর্ম দেখে বর্ণ নিরূপণ করার বিধান রয়েছে। সত্ত্ব গুণে বিপ্র, সত্ত্ব মিশ্রিত রজোগুণে ক্ষত্রিয়, রজোমিশ্রিত তমোগুণে বৈশ্য এবং তমোগুণাধিকারে শূদ্র চিহ্নিত করা হয়েছিল। এবং তদনুযায়ী কর্ম নির্ধারিত হয়েছিল। প্রাকৃতিক নিয়মে সকলেই স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান অধিকার করে আছে।
এ বিষয়ে একটা সুন্দর ছড়া আছে।
“শূদ্রই তো জাতির চাকা
বৈশ্য জোগায় দেশের টাকা,
ক্ষত্রিয়েরা রাজার জাত
সবার পূরণ বিপ্র ধাত।
বিপ্র যদি জাগত আবার
বিজয়গুরু মত্ততায়,
দেশটা কি আর চ’লত উধাও
সর্ব্বনাশা ব্যর্থতায় ?
ক্ষত্র যারা কায়েত হয়ে
চলছে বেভুল ঝিমিয়ে মাথা,
তা’রা যদি উঠত জেগে
চ’লত করা অসৎ যা তা’?
বৈশ্য বণিক বিশাল আয়ে
বিভব দেশে দিত যদি,
অভাব কি আর ঢুকত দেশে
হা-হুতাশে নিরবধি?
শুদ্র যদি শুচির গানে
সেবামুখর ধৃতিচর্য্যায়—
চ’লত, তবে রুখত কে তা’র
কৃতিমুখর কৃষ্টিসেবায়?
জাতিগত বৰ্ণই হ’ল
সংস্কারের গুণধারা
দুর্বল সবল যাই হোক্ না
সেই চলনে চলে তারা।
বিপ্র-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রের
বর্ণগত বিশেষ আচার
রুদ্ধ ক’রে ভাঙ্গেই যে-জন
ব্যতিক্রমী সত্তা তার।”
মানুষের বোধে উপরোক্ত সহজ-সাধারণ, অথচ প্রয়োগ ক্ষেত্রে অসাধারণ বিষয়গুলো প্রবেশ করাবার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, সমাজতত্ত্ববিদ্, মনস্তত্ত্ববিদ প্রমুখ পণ্ডিত ব্যক্তিদের বোঝাবার জন্য আরও বিস্তারিত ভাবে বললেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
” …… আর্য্য জাতির uphill motion-এর (উর্ধগামী গতির) acceleration (ত্বরান্বিত করা)-ই হ’চ্ছে front-(সম্মুখে) ব্রাহ্মণ আর back-এ (পিছনে) শূদ্র। চাতুর্বর্ণ্য বিভাগ কতকটা আমাদের body system-এর (শরীর বিধানের) মতন। শূদ্র হ’চ্ছে এই whole system-এর (সমুদয় বিধানের) carrier (বাহক) এবং supporter (সহায়ক), যা’র উপর ভর দিয়ে এই সমাজদেহ চলছে। বৈশ্যদের function (কর্তব্য) হ’ল সমাজদেহকে সুস্থ রাখা by the supply of proper nutrition and food (যথোপযুক্ত পুষ্টি এবং খাদ্য সরবরাহ দ্বারা)। বৈশ্যশক্তি এই function discharge (কর্তব্য সম্পাদন) করতে যেদিন পরাঙ্মুখ হ’ল, সেদিন এই সমাজদেহ ভেঙ্গে পড়লো। Stomach (পাকস্থলী) যদি boycott (অসহযোগ) করে, আমাদের body-system-এর (শরীর বিধানের) যে অবস্থা হয় তাই হ’ল। এই বৈশ্যশক্তি যদি আবার জাগে এবং legs, heart ও brain-কে (পা, হৃৎপিন্ড ও মস্তিষ্ককে) proper nutrition supply করে (উপযুক্ত পুষ্টি যোগায়), তবে আবার সমাজদেহ জেগে উঠবে। Body system-এর মধ্যে heart (হৃৎপিন্ড) যেমন, সমাজদেহের মধ্যে ক্ষত্রিয় তেমন। Heart-এর মধ্যে দু’রকম cells (কোষ) আছেঃ (১) white cells (সাদা কোষ) (২) Red cells (লাল কোষ)। Red cells-এর (লাল কোষের) কাজ হ’চ্ছে body-কে fit (কার্যক্ষম) রাখা এবং maintain (পরিপোষণ) করা by the proper distribution of red blood (লাল রক্ত উপযুক্ত ভাবে বিতরণ দ্বারা); এবং white cells-এর (সাদা কোষের) কাজ হ’চ্ছে body-কে protect (রক্ষা) করা। ক্ষত্রিয়ত্বের মধ্যে এই দু’টি function (কার্য) আছে; একটি সমাজদেহকে fit (কার্যক্ষম) রাখা ও maintain (প্রতিপালন) করা, আর একটি disease-এর (রোগের) হাত থেকে protect (রক্ষা) করা। কিন্তু এই দুই blood-এর supply (যোগান) নির্ভর করছে stomach-এর (পাকস্থলীর) উপর। সমাজদেহের brain (মস্তিষ্ক) হ’চ্ছেন ব্রাহ্মণ (বিপ্র), যাঁদের working (কার্যতা) নির্ভর করছে ক্ষত্রিয়শক্তি বৈশ্যশক্তি এবং শূদ্রশক্তির উপর। তাঁরা যেমন-তেমন এই তিন শক্তির নিকট support and help (সাহায্য ও সহানুভূতি) পা’চ্ছেন, তেমন-তেমন এই তিনকে regulate, control (নিয়মিত ও আয়ত্ত) করতে পারছেন। এই চারিশক্তির মধ্যে কেহই ছোট-বড় নয়। একটা harmony (সমন্বয়) ও co-ordination-এর (সমবায়ের) যোগে এদের মধ্যে একযোগে একতানে কাজ হ’চ্ছে। কিন্তু body এর মধ্যে brain-এর স্থান যেমন সর্বোচ্চ এবং সর্ব উচ্চে থাকাটা legs, stomach ও heart-এর existence-এর পক্ষে নিতান্ত দরকার, তেমন ব্রাহ্মণকে উচ্চ place দেওয়াতে, যে উচ্চতা তাঁ’র মধ্যে inherent (স্বাভাবিক) হ’য়ে আছে, অন্যান্য বর্ণ চলতে পারছে ঠিকমত তাঁরই guidance-এ (নির্দেশে)। Head-কে বড় স্বীকার করা যেমন body-র অন্যান্য অঙ্গের পক্ষে লজ্জার নয়, বরং পরম গৌরবের, তেমনি অন্যান্য বর্ণের পক্ষে ব্রাহ্মণকে বড় ব’লে মানা তাঁদের বাঁচা-বাড়ার পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। Superior (শ্রেয়)-এর উপর শ্রদ্ধা রে’খে যদি তুমি সমাজকে পুনর্গঠন করতে লেগে যাও,তবে সে সমাজ টিঁকবে-তার growth (বৃদ্ধি) হবে healthy.” (ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃঃ-৬৮-৬৯)
উপরোক্ত বাণী থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, বর্ণাশ্রমের বিন্যস্ত বিভাজন আমাদের শরীর বিধানেও বিদ্যমান। বর্ণাশ্রমানুগ বিধান অনুযায়ী শূদ্র বর্ণ শ্রমশিল্প, কারিগরি বিদ্যার সেবার মাধ্যমে সব বর্ণকে সাহায্য করবেন। শরীর বিধানে আমাদের পদযুগল দেহটাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায় তাই পদযুগলকে শূদ্র বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বৈশ্যরা কৃষি ও বাণিজ্যের সেবা দ্বারা সকলের উদরপূর্তি করছেন। সেই উদরকে বয়ে বেড়াচ্ছে জানু বা জঙ্ঘা। তাই জঙ্ঘা বৈশ্যত্বের প্রতীক। ক্ষত্রিয়রা বাহুবল দ্বারা অসৎ নিরোধ করে সমাজকে রক্ষা করেন। শরীর বিধানে বাহু আমাদের দেহটাকে বিপদ-আপদ থেকে আগলায়, ক্ষত থেকে ত্রাণ করে, তাই বাহুকে ক্ষত্রিয় বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বিপ্র বর্ণ বোধ ও বোধির পরামর্শ দিয়ে সকল বর্ণকে বর্ণধর্ম পালন করার শিক্ষা দেয়, বর্ণানুগ কর্মে উৎসাহিত করে বিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের মস্তিষ্ক বিবেক, বিচার-বুদ্ধি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমগ্র দেহটাকে পরিচালনা করে, তাই মাথাকে বিপ্র বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এইভাবে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিন্যস্ত মেলবন্ধনে দেহটাকে সুস্থভাবে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। ছোটবড়ো কেউ নয়। যে যার বৈশিষ্ট্যে শ্রেষ্ঠ। ওই শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়মকে অগ্রাহ্য করে কেউ যদি মাথার কাজ পা-কে দিয়ে, পায়ের কাজ মাথাকে দিয়ে করাতে যায় তাহলে দেহটাই রক্ষা করা যাবে না। তেমনি বিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থা রক্ষার স্বার্থে আর্য্য ঋষিরা প্রতিটি বর্ণের জন্য নির্দিষ্ট কর্ম ও আইডেনটিটি বা স্মারক চিহ্নের বিধান দিয়েছেন। শ্বেত বর্ণে বিপ্র, লোহিত বর্ণে ক্ষত্রিয়, হরিদ্রা বর্ণে বৈশ্য এবং সবুজ বর্ণে শূদ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই জীবনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ করার করার বিধির নাম ধর্ম। ধর্মকে রক্ষা করার জন্য রাজনীতি। শ্রীমদ্ভগবদগীতা যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বর্ণাশ্রম বিধায়িত বিন্যস্ত সমাজের ওই চারটি বর্ণের চিহ্ন সাদা, লাল, হলুদ ও সবুজ। বর্তমান পুরুষোত্তম যাকে আর্য্যকৃষ্টির স্মারক পতাকা তথা জাতীয় পতাকা হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন।—সেই পতাকার অনুসরণে আর্য্য মহাসভার দলীয় পতাকা নির্বাচন করা বাঞ্ছনীয়।
।। আর্য্যকৃষ্টির স্মারক পতাকা প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্যবাণী ।।
বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মাণ মূর্ত্ত ইষ্ট
বা আদর্শ’ পুরুষোত্তমই
তোমাদের জাতীয় পতাকার
প্রাণস্বরূপ হয়ে উঠুন;
চতুর্ব্বর্ণ-বিরেখ
সুদর্শনচক্র-বিভূষিত
পবিত্র পরমার্থ-অভিধ্যায়ী
প্রাণনপ্রদীপী উড্ডীয়মান
নর্ত্তনলাস্যমণ্ডিত হ’য়ে উঠুক তা’;
ঐ ইষ্টপ্রাণ প্রাণনলাস্যই হ’য়ে উঠুক
তোমাদের সংহতির জীবন্ত মন্ত্র—
তন্ত্র-নিয়মনী উৎসর্জ্জন-অনুক্রমণায়;
তোমরা পতাকাকে যখনই প্রণাম ক’রবে,
মনে রেখো—
সেই পতাকা প্রাণবন্ত
তোমাদের ঐ বৈশিষ্ট্যপালী আপুরয়মাণ
মূর্ত্ত আদর্শ-পুরুষোত্তমে,
সেই পতাকার প্রণাম-মন্ত্র হ’য়ে উঠুক-
‘বন্দে পুরুষোত্তমম্’—
সেই পুরুষোত্তমেরই
ধ্যানবিভোর জাগ্রত স্মৃতি নিয়ে;
তোমাদের স্বরাষ্ট্রনীতিই হো’ক,
আর, পররাষ্ট্রনীতিই হো’ক,
তা’ যেন সর্ব্বথাই
স্বস্তি-প্রণোদনায় পরিচালিত হয়—
সন্ধিৎসু সত্তাপোষণী স্বাচ্ছন্দ্যের
ছান্দোগ্য-অনুশীলনী তৎপরতা নিয়ে,
সাম্য, সাগ্নিক সম্বর্দ্ধনা
অর্থাৎ সম্বর্দ্ধনী অগ্রগতি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের
সুকেন্দ্রিক, সুবিনায়িত অন্বিত চলনে,
অসৎ-নিরোধী, তৎপর প্রস্তুতির
পবিত্র উপকরণে;
তোমাদের সব্যষ্টি গণদেবতা যেন
আদর্শ-পুরুষোত্তমের
অর্ঘ্য-অন্বিত সঙ্গতিশালিন্যে
ব্রাহ্মণ্য-অনুবেদনী অভিধায়
সুনিয়ন্ত্রিত হয়; (সংক্ষিপ্ত, বাণী সংখ্যা ৩৬৫)
জাতীয় পতাকা সম্বন্ধে পরম দয়াল বললেন–- “আমার মনে হয়, আমাদের জাতীয় পতাকা তিনরঙা না হ’য়ে, চাররঙা হওয়া উচিত। চতুর্ব্বর্ণের চারটি রঙ। তার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের একখানা হাত দেওয়া থাকবে। হাতে থাকবে সুদর্শন।
দেবীদা প্রশ্ন করলেন—প্রত্যেক বর্ণের রঙ তো আলাদা হবে?
ঠাকুর—নিশ্চয়ই। উপরে সাদা, তার নীচে লাল, তার নীচে হলুদ এবং সবুজ। এই রকম থাকবে। (দীপরক্ষী ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১৯)
।। ‘আর্য্য’ শব্দের বিশেষত্ব ।।
‘আর্য্য’ শব্দটি মূলতঃ গুণবাচক। যাঁরা বর্ণাশ্রম, চতুরাশ্রম পরিপূরণী দশবিধ সংস্কারে সংস্কৃত হতেন তাঁদেরই আর্য্য অভিধায় ভূষিত করা হতো। তাঁরাই ক্রমে আর্য্য জাতিভুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমান যুগধর্মে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যেমন সম্বোধনে ‘স্যর’, ‘ম্যাডাম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেসময় সদাচারী বর্ণাশ্রমানুগজীবন যাপন কারীদের উদ্দেশ্যে ‘আর্য্য’, ‘আর্য্যপুত্র’, ‘আর্য্যা’ ইত্যাদি সম্বোধনসূচক শব্দ ব্যবহৃত হতো। এই ব্যবস্থা সকলের জন্য, এখানে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। এ বিষয়ে বর্তমান পুরুষোত্তম এক যুগান্তকারী বিধান দিলেন।
মঙ্গোলীয় নিগ্রো যারা
দ্রাবিড়ী কোল ম্লেচ্ছাবধি
আর্য্যীকৃত হলেই তারা
আর্য্যদেরই সুসন্ততি।
যুগ পুরুষোত্তমের আদর্শকে স্বীকার করলেই আর্য্যীকৃত হওয়া যায়। এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন, “পঞ্চবর্হিঃ যা’রা স্বীকার করে, আর সপ্তার্চ্চি অনুসরণ করে, তারা যেই হোক আর যা’ই হোক– আর্য্য বা আর্য্যীকৃত । ৬০১ । (শাশ্বতী অখণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৭)
এবার পঞ্চবর্হিঃ এবং সপ্তার্চ্চিঃ-র অনুশাসন বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক।
।। পঞ্চবর্হিঃ ।।
১। একমেবাদ্বিতীয়ং শরণম্।
২। পূর্ব্বেষামাপূরয়িতারঃ প্রবুদ্ধা ঋষয় শরণম্।
৩। তদ্বর্ত্মানুবর্ত্তিনঃ পিতরঃ শরণম্।
৪। সত্তানুগুণা বর্ণাশ্রমাঃ শরণম্।
৫। পূর্ব্বাপূরকো বর্ত্তমানঃ পুরুষোত্তমঃ শরণম্ ।
এতদেবার্য্যায়ণম্, এষ এব সদ্ধর্ম্মঃ,
এতদেব শাশ্বতং শরণ্যম্।’’
১। এক অদ্বিতীয়ের শরণ লইতেছি।
২। পূর্ব্বপূরণকারী প্রবুদ্ধ ঋষিগণের শরণ লইতেছি।
৩। তাঁহাদের পথ অনুসরণকারী পিতৃপুরুষগণের শরণ লইতেছি।
ইহাই আর্য্যপথ, ইহাই সদ্ধর্ম্ম, আর ইহাই চিরন্তন শরণযোগ্য।
“আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেল সেইদিন যেদিন থেকে আমরা পঞ্চবর্হির মূল নির্দ্দেশ অবজ্ঞা করতে শুরু করলাম। তখন থেকে আমরা অপরের খোরাক হলাম কিন্তু নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখে পরকে আপন ক’রে নেবার সামর্থ্য হারিয়ে ফেললাম।”
পঞ্চবর্হিঃ এবং সপ্তার্চ্চিঃ-র অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করে দেশ ও জাতির মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর সম্বিতী গ্রন্থে বলছেন—
মতবাদ যাই হোক না,—
আর, যে-কোন সম্প্রদায়ই হোক,
যা’ মুখ্যতঃ ‘পঞ্চবর্হিঃ’ ও ‘সপ্তার্চ্চিঃ’কে
স্বীকার করেনিকো—
কোন-না-কোন রকমে,—
তা’ কখনও অনুসরণ করতে যেও না,
তা’ কিন্তু জঘন্য—অসম্পূর্ণ,
সত্তা-সম্বর্দ্ধনার পরিপন্থী তা’;
আর, ঐ ‘পঞ্চবর্হিঃ’ ও ‘সপ্তার্চ্চিঃ’ই হ’চ্ছে
সেই রাজপথ—
যা’কে স্বীকার ও গ্রহণ করে চললে
ক্রমশঃই তুমি সার্থকতায় সমুন্নত হ’তে পার। ২৩৪
এই বাণী বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকে মনুষ্যত্বে উত্তরণের পথ দেখিয়েছে। এখন মানা, না-মানা যার যার নিজস্ব ব্যাপার! আর্য্য মহাসভা রাজনৈতিক দল সকলের কাছে এই সত্য পৌঁছে দেবার জন্য দায়বদ্ধ।
‘‘হিন্দু মুসলমানের নামে নাক সিটকায়, মুসলমান হিন্দুদের নামে নাক সিটকায়—তার মানে তারা ভগবানকে, ধর্মকে, প্রেরিতকে ভালবাসে না। আর্য্যরা মানে এক অদ্বিতীয়কে, পূর্বতন ঋষি মহাপুরুষদিগকে, তারা মানে পূর্বপুরুষকে ও জন্মগত বিশিষ্ট গুণসম্পদকে। অর্থাৎ বর্ণধর্মকে, সর্ব্বোপরি তারা মানে বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মান যুগপুরুষোত্তমকে। এগুলি মালার মত গাঁথা আছে। যাদের দেখার চোখ আছে ও দেখতে চায়, তারাই দেখতে পায়। বেদ, কোরান, বাইবেল ঘেঁটে দেখ, সব জায়গায় ঐ একই জিনিস রকমারি ভাবে পাবে। অন্ততঃ ওগুলির উল্টো কথা পাবে না। কোরাণে স্পষ্ট করে আছে পিতৃপুরুষকে স্বীকার করার কথা। আমি ইসলামের ভক্ত হলে আমার নাম গোলাম সোফান হবে কেন? অনুকূল চক্রবর্তীই তো থাকা উচিত। কারণ, খোদাতায়ালা যেমন সকলের, রসুল যেমন সকলের, ইসলামও তেমনি সকলের। মুসলমানের মধ্যেও বংশগত আভিজাত্য ও বৈশিষ্ট্যকে শ্রদ্ধা দিয়ে চলার কথা আছে। ওর ভিতর দিয়েই তো বর্ণধর্মের মূল তাৎপর্য্য-সম্বন্ধে সমর্থন পাওয়া যায়। আজ আমরা বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করতে চাই কেন ? রসুলের কি তেমন কোন কথা আছে ? আর নিজেদের বৈশিষ্ট্যকে যদি বজায় রাখতে চাই, তবে অপরের বৈশিষ্ট্য যাতে বজায় থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা লাগে। অপরের বৈশিষ্ট্য ভাঙ্গার প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিলে, কালে-কালে নিজের বৈশিষ্ট্য ভাঙ্গার পথই প্রশস্ত হয়।
আমি বলি, আমি যদি হযরতকে ভালবাসি এবং তাঁর নীতিবিধি মেনে চলি, তবে আমি হিন্দু থাকব না কেন? পরমপিতার পথে চলতে গিয়ে পিতৃপরিচয় খোয়াতে হবে কেন? আমি তো বুঝি হিন্দুও আর্য্য, মুসলমানও আর্য্য। উভয়ের পন্থা ও গন্তব্য এক। হযরত পূর্ববর্তীকে মানেন, পরবর্তীকে মানার ইঙ্গিতও তিনি দিয়ে গেছেন, তিনি যা মানেন আমরা যদি তা না মানি, তার মানে আমরা তাঁকে মানি না। মুসলমান পীরের কাছ থেকে দীক্ষা নেয়া লাগে, হিন্দুরও গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়া লাগে, সে একই কথা। শুধু ভাষা আলাদা। কতকগুলি নীতি আছে, দেশকাল, পাত্র, নির্ব্বিশেষে সর্ব্বত্র সর্বদা সবার পালনীয়, আবার কতকগুলি আছে বিশেষ-বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ-বিশেষ অবস্থায় ও দেশকালে পালনীয়। এই দুটোর মধ্যে গুলিয়ে ফেলতে নেই। Fundamental (মৌলিক) ও universal (সার্ব্বজনীন) জিনিস হল—এক অদ্বিতীয়কে মানা, পূর্বতন ঋষি-মহাপুরুষকে মানা, পিতৃপুরুষকে মানা, বৈশিষ্ট্য মানা, পূরয়মান যুগপুরুষোত্তমকে অনুসরণ করে চলা। তুমি হিন্দুই হও বা মুসলমানই হও, এগুলি যদি না মান, তুমি হিন্দুও নও, মুসলমানও নও, এককথায় তুমি ম্লেচ্ছদলভুক্ত, ম্লেচ্ছ মানে যারা সংস্কৃতির উল্টো চলে। আর যে এগুলিকে মেনে চলে সে যে সম্প্রদায়ের লোক হোক না কেন, তাকে তুমি কখনও কাফের বলতে পার না। কাফের মানে যে ধর্মবিরোধী চলায় চলে। সাম্প্রদায়িক বিরোধের প্রশ্রয় না দিয়ে, ধর্মবিরুদ্ধ চলনের বিরুদ্ধে আমাদের জেহাদ ঘোষণা করা লাগে। তাই করা লাগে যাতে প্রতি প্রত্যেকে ঈশ্বরপ্রেমী হয়ে ওঠে, ধর্মপ্রবুদ্ধ হয়ে ওঠে। এ দায় হিন্দু-মুসলমান সকলেরই মিলিত দায়। তাই, এই কাজে হিন্দুর মুসলমানকে সাহায্য করা উচিত, মুসলমানেরও হিন্দুর সাহায্য করা উচিত। আমি বুঝি, সৎসঙ্গ যেমন হিন্দুর, তেমনি মুসলমানের, তেমনি বৌদ্ধের, তেমনি খ্রিষ্টানের, তেমনি অন্যান্য সকলের। সব মানুষই পরমপিতার, তা তারা জানুক বা না-জানুক, মানুক বা না-মানুক।
(আঃ প্রঃ একাদশ খন্ড, ইং ১৭-০৩-১৯৪৮)
আমি বুঝিনা–কোন হিন্দু শুচিশুদ্ধভাবে মসজিদে যেয়ে প্রার্থনা করতে পারবে না কেন, আবার একজন সদাচারী মুসলমান হিন্দুর প্রার্থনা-মন্দিরে বসে প্রার্থনা করতে পারবে না কেন ! ভগবান মানুষকে তার language (ভাষা) দিয়ে চেনেন না, তিনি চেনেন তাকে তার feeling (বোধ) ও activity (কর্ম্ম) দিয়ে। (আঃ প্রঃ ৯ম খণ্ড)
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন—হজরত যীশু, হজরত মহম্মদ আমাদেরও prophet (প্রেরিতপুরুষ)। আর্য্যধারা যদি জীবন্ত থাকত, তা’হলে হজরত যীশু, হজরত মহম্মদ হয়তো একাদশ অবতার, দ্বাদশ অবতার ব’লে পরিগণিত হ’তেন। Anti-Biblism (বাইবেল-বিরোধী), Anti-Quranism (কোরাণ-বিরোধী), Anti-Vedism (বেদ-বিরোধী)-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তার নিরাকরণ করতে হবে। শাক্ত বিপ্র এবং বৈষ্ণব বিপ্র-পরিবারে যেমন বিয়ে-সাদির কোন নিষেধ নেই—সৌর বিপ্র ও গাণপত্য বিপ্রে যেমন বিয়ে চলতে পারে, ইষ্ট, কৃষ্টি ও পিতৃপুরুষের ঐতিহ্যবাহী রসুল-ভক্ত বিপ্র, বুদ্ধভক্ত বিপ্র, খ্রীষ্টভক্ত বিপ্রের সঙ্গেও তেমনি বিধিমাফিক বিয়ে-থাওয়া হ’তে পারে—এতে কোন বাধা নেই। কারণ, স্বধর্ম্ম ও কৃষ্টি-নিষ্ঠ থেকে যে-কোন পূরয়মাণ মহাপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধানতি নিয়ে চলা ধর্ম্মের পরিপন্থী তো নয়ই বরং পরিপোষক। তবে প্রত্যেকটি বিয়ের ব্যাপারে খুব হিসাব ক’রে চলতে হবে, যাতে কোন রকমের ব্যত্যয়ী কিছু বা প্রতিলোম-সংস্রব না ঘটে। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড, ২। ৭। ১৯৪০)
* * *
সত্যের পথে চলতে পিয়াসী “সত্যমেব জয়তে”-এর সীলমোহর এর অধিকারী হতে চাওয়া সকল দেশসেবক পার্টির সদস্যদের কিছু নির্দিষ্ট আদর্শের অনুসরণ করে চলা উচিত। সাত্তিক ব্যক্তি চরিত্র নির্মাণ না করে, সদাচারী না হয়ে কখনোই মানুষের সেবা করে মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটানো সম্ভবপর নয়। তাই ব্যক্তি চরিত্র নির্মাণকল্পে কতগুলো বিধান মেনে চলতে হবে সবাইকে। যদি মানুষের মত মানুষ হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই।
একজন মানুষের শারীরিক-মানসিক বিধানকে সুস্থ রাখতে হলে অভক্ষ্যভোজী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুনাদি তামসিক আহার করা যাবে না। করলে স্বাস্থ্য ক্ষুণ্ণ হবে। অগম্যাগামী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ প্রতিলোম, সগোত্র এবং সপিণ্ড সম্বন্ধীয়দের সাথে অবিধি পূর্বক ধর্মবিরুদ্ধ বিবাহের মাধ্যমে কামাচার করা যাবে না, করলে নীরোগ সুসন্তানের জনক-জননী হওয়া যাবে না। স্মৃতিকে নিশ্চল রাখতে শারিরীক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সদাচার পালন করতে হবে। অসৎ পথ বর্জন করতে হবে। কদাচারী প্রদত্ত আহার ও পানীয় গ্রহণ করা যাবে না। করলে সংক্রামিত হবার আশঙ্কা থাকবে। এই আবশ্যিক জ্ঞানগুলো জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যই আর্য্য মহাসভা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
আমাদের জীবধর্মের এক আবশ্যিক জৈবিক তাগিদ হলো আহার বা খাদ্য। যদিও ব্যাপক অর্থে আহার মানে আহরণ। যার মধ্যে সবকিছুই আছে। খাওয়া-দাওয়া, শোয়া-বসা, চলাফেরা, কথাবার্তা, কাজকর্ম, তথাকথিত প্রেম-ভালবাসা, বিয়ে করা, বাবা-মা হওয়া ইত্যাদি। আমাদের উপনিষদের ঋষিরা ওই সবগুলোকে একত্রিত করে ‘আহার’ নামকরণ করে বললেন, ‘‘আহারশুদ্ধৌ সত্তাশুদ্ধিঃ, সত্তাশুদ্ধৌ ধ্রুবাস্মৃতিঃ …… ’’—অর্থাৎ জীবন ধারণের নিমিত্ত আহরণগুলো শুদ্ধ হলে সত্তা শুদ্ধি হয়, সত্তা শুদ্ধি হলে স্মৃতি নিশ্চল হয়। স্মৃতি নিশ্চল হলে জাতিস্মর হওয়া যায়। জীবনভূমির এপার-ওপার নিরীক্ষণ করা যায়। যারা দেশসেবক হবেন, তারা যদি আদর্শ চলন-চরিত্র দিয়ে আত্মশুদ্ধির পথে চলতে অভ্যস্ত না হন, দেশের নাগরিকদের কোন সম্পদের উপহার দেবেন ? তাই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বিশুদ্ধ চলন-চরিত্রের ওপর নির্ভর করছে ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। এবং ওই দৃষ্টান্তই ভারতকে মহান ভারতের শিরোপায় অধিষ্ঠিত করবে ভবিষ্যতে। এ বিষয়ে জীবন পিয়াসী সকল মানুষকে ভেবে দেখতে হবে। কোন ধর্মীয় মতবাদ প্রবৃত্তি-প্ররোচিত অশুদ্ধ আহার-বিহার-অনাচারকে সমর্থন করেনি।
আহার বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের বাণী
সর্বশ্রেষ্ঠ আর্য্য হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ মহাভারতের অনুশাসনপর্ব—১১৪ অধ্যায়ে বলা হয়েছে–
“যে ব্যক্তি মোহ প্রভাবে পুত্র-মাংস-তুল্য অন্যজীবের মাংস ভক্ষণ করে, সে অতি জঘন্য প্রকৃতির এবং তার সেই জীবহিংসা বহুবিধ পাপযোনিতে জন্মগ্রহণ করবার একমাত্র কারণ বলে নির্দিষ্ট হয়।’’
শুধু হিন্দু মতেই নয়, কোন ধর্মীয় মতবাদে জীবহত্যা স্বীকৃত নয়। কোরানে, আর্য্য হিন্দু-শাস্ত্রে এবং পুরুষোত্তমদের বাণীতে কোথাও ‘বলিদান’ বা ‘কোরবাণী’-র নামে প্রাণী হত্যার অনুমোদন নেই।
“আল্লার নিকট তাহার মাংস ও তাহার রক্ত কখন পৌঁছে না বা তিনি তাহা ইচ্ছা করেন না। বরং তোমরা অসৎকর্ম্ম হইতে নিজেকে রক্ষা কর ইহাই তিনি ইচ্ছা করেন। তিনি আমাদের অধীনে থাকিয়া কার্য্যনির্বাহের জন্য পশু সৃষ্টি করিয়াছেন—সেজন্য তোমরা খোদার নিকট নম্র ও নিরীহ হইতে শিক্ষালাভ করিবে। এই সৎপথ-প্রাপ্তির অর্থাৎ সৎ-শিক্ষার জন্যই খোদা এই ব্যবস্থা করিয়াছেন। যাহারা অন্যের মঙ্গল সাধন করে, তাহাদের মঙ্গল করিয়া থাকেন ……..” (কোর-আণ—২২ হজ ৩৭ র, ৫)
“বাসোপযোগী গৃহ, গুপ্তস্থান রক্ষা করিবার উপযুক্ত বস্ত্র, এবং শুষ্ক-রুটি ও পানীয় ব্যতীত মানব-সন্তানের অন্য কোন জিনিসের উপর অধিকার নাই ।” (–হাদিস তিরমিজি)
“একটু পানি এবং কয়েকটি খর্জ্জুরে তাঁহার ক্ষুধার নিবৃত্তি হইত । হজরত মোহাম্মদ একাধারে ধর্ম্ম-প্রবর্ত্তক, মহাকর্মী এবং সন্ন্যাসী ছিলেন ।” (ইসলামের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৯)
ভগবান বুদ্ধদেব বলেছেন, “আমি কখনই কাউকে মাংস খাওয়ার অনুমোদন করি নি, করি না এবং করব না।” (লঙ্কাবতার সূক্ত)
প্রভু যিশু বলেন, “তুমি হত্যা করিও না” । (এক্সোডাস – 20:13)
“যে একটি ষাড়কে হত্যা করলো, সে যেন একটি মানুষকে হত্যা করলো।” (ইসা – 66:33)
উক্ত অনুশাসনবাদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যে নিজেকে পরমেশ্বরের সন্তান বা খোদাতাল্লার বান্দা মনে করবেন তিনি কখনই কোন প্রাণী হত্যা করবেন না এবং প্রাণীর রক্ত-মাংসে ক্ষুধার নিবৃত্তি করবেন না।
প্রত্যেকের মানসিক অবস্থা-অনুযায়ী তার থেকে একটা Radiation (বিকিরণ) নির্গত হয়, সেই Radiation (বিকিরণ) আবার অন্যকে Influence (প্রভাবিত) করে । সেই জন্য শুধু খাওয়া কেন, সবাইকে সব সময় ছোঁয়াও ভাল নয়। বিশেষতঃ মানুষ যখন সাধন-ভজন ব্রত প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপৃত থাকে। এগুলি কোন কুসংস্কারের কথা নয়। সাদা চোখে দেখা যায়। আবার সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কার করলে তাতেই ধরা পড়তে পারে।
(শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, আঃ প্রঃ-৩/২৮০)
* * *
“…… আমরা আমাদের নিজেদের কৃষ্টির ধার না ধেরে পরের পরাক্রমে অভিভূত হয়ে চলছি। তাই, আমরা যত আন্দোলনই করি, একটা bastard thinking (জারজ) চিন্তা নিয়ে চলি।” (আলোচনা-প্রসঙ্গে ২১ খণ্ড, পৃঃ ৮১)
তাই—
আর্য্যকৃষ্টি অনুযায়ী রাষ্ট্রকে অবহিত করার জন্য
।। ‘বিধান বিনায়ক’ গ্রন্থ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদেশ।।
“তোমরা
শাসন-সংস্থায় পদক্ষেপ করবার সাথে-সাথেই
কী দায়িত্বের কর্ণধার হ’য়ে পদক্ষেপ ক’রছ—বোধিদীপনা নিয়ে
কুশলকৌশলী সমীক্ষ অনুচর্য্যার সম্বেগ-সহ
তা’ স্মৃতিপটে জাগরূক রাখতে যত্নবান হয়ো,
আর, শ্রেয়নিষ্ঠায় অচ্যুত থেকে
হৃদ্য বৈধী ব্যক্তিত্বে
অটুট হ’য়ে যাতে থাকতে পার,—
তাই ক’রে চ’লো
সমস্ত প্রবৃত্তিকে শ্রেয়ার্থ-সংহত ক’রে;
১। প্রথমেই নজর রেখো
বিবাহ ও সুজনন-সংস্কারের উপর,
শ্রেয়কুল-সংস্কৃতি-সম্ভূত কন্যা
যাতে অশ্রেয়
বা অপকৃষ্ট-সংস্কৃতি-সম্পন্ন কুলে
অর্পিত না হয়—
তা’র সুব্যবস্থা ক’রো ;
কন্যার কুল-সংস্কৃতি ও চারিত্রিক সঙ্গতি
যেন বর বা পুরুষের
কুল-সংস্কৃতি ও চরিত্রের অনুপোষণী হয় ;
পণ বা যৌতুক-লালসার অপসারণে
লক্ষ্য রেখো,
পুরুষের সুকেন্দ্রিকতা
ও নারীর সতীত্বের উপর ভিত্তি করে
তোমাদের গৃহ, সমাজ ও গণ যেন
উদ্বর্দ্ধনমুখর হ’য়ে চলে ;
প্রথমেই এ-কথা বলার উদ্দেশ্য এই—
সুজনন যদি না হয়,
যে-নিয়ন্ত্রণের দ্বারা জাতক
শ্রেয় জৈবী-সংস্থিতি পেয়ে
আয়ু, মেধা, বল,
সুসঙ্গত চরিত্র এবং গুণবৈশিষ্ট্য নিয়ে কৰ্ম্মানুপ্রেরণায় যোগ্য হ’য়ে ওঠে,—
তা’ যদি না ক’রতে পার,
রাষ্ট্র-সংহতি ও রাষ্ট্রসত্তার সম্বর্দ্ধনা
দিন-দিনই ঘোর তমসাবৃত
ও নিথর হ’য়ে উঠতে থাকবেই কি থাকবে; প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে অবহেলা করে
যে-বিজ্ঞানেরই অবতারণা কর না কেন,
তা’ কখনও সহজ, সলীল, শুভসন্দীপী
হ’য়ে উঠতে পারবেই না,
অমনতর অবান্তর কল্পনাও
একটা মূঢ়তা মাত্র ;
তাই, শুধুমাত্র বর্ণাশ্রমের নীতিবিধিকে
দক্ষচক্ষুতে সুনিয়ন্ত্রিত ক’রে চ’লতে পারলেই
রাষ্ট্র-সংস্থা সৎ-সম্বদ্ধ হ’য়ে চ’লতে পারে,—
প্রাচীন শাস্ত্রে এ-কথা বহুল কীৰ্ত্তিত হ’য়ে আছে,
তাই, রাষ্ট্র-সংস্থার প্রধান করণীয়ই হচ্ছে
বর্ণাশ্রমের ধারণ ও সংরক্ষণ।
২। কৃষি-ব্যাপারে
বীজ ও ভূমির সুসঙ্গতির প্রতি লক্ষ্য রেখো,
যে-ভূমিতে যে-বীজের ফলন
পুষ্ট ও অধিক হ’য়ে ওঠে,
তা’র সুব্যবস্থা ক’রো,
কৃষি সম্বন্ধীয় চলনসই তত্ত্বগুলিতে
মানুষ যা’তে শিক্ষা লাভ করে—
তা’র ব্যবস্থা
ও যথাসম্ভব তা’তে প্রেরণাসম্বুদ্ধ করে
কৃষি-ব্যাপারে
লোককে এমনতর ব্যাপৃত রাখ,—
যাতে ক্রমশঃই
নানা জাতীয় ফসলের প্রাচুর্য্য ঘটে ওঠে,
আর, শাসন-সংস্থার সুব্যবস্থ পরিচালনে
পূর্ত্তবিভাগ, নদী-সংস্কার, সেচ
ও বনব্যবস্থার সুনিয়ন্ত্রণে
তা’দিগকে কৃষিকৰ্ম্মে
যথাসম্ভব সব দিক-দিয়ে সাহায্য ক’রো,
যাতে খাদ্য-বিষয়ে পরমুখাপেক্ষী না-থেকে
দেশ স্বাবলম্বী তো হ’য়ে ওঠেই,
বরং উদ্বৃত্ত খাদ্যবণ্টনে
অন্যের অভাবকেও দূরীভূত ক’রতে পারে।
৩। মানুষের সম্বেগকে
এমন উদ্দীপ্ত ক’রে তোল,
যা’তে তা’রা যোগ্যতায় অভিদীপ্ত হ’য়ে ওঠে,
এবং পারদর্শিতা, বোধ ও শ্রমনিয়োজনে
দেশ ও বিদেশের প্রয়োজনে
শিল্পের উন্নতি করতে পারে—
কুটীরশিল্পের সম্প্রসারণে
সবিশেষ লক্ষ্য রেখে—–
যাতে অধিকাংশ পরিবারই
শিল্প পরিচর্য্যায় ব্যাপৃত হ’য়ে ওঠে,
আর, ঐ জাতীয় সমস্ত ব্যাপারের জন্য
যে-যে উপকরণের প্রয়োজন
তা’ বিহিত ত্বরিতভাবে সরবরাহ কর– শিল্পোপযোগী যন্ত্রপাতি ও শক্তি সরবরাহকে
সহজ, সুগম ও ব্যাপক ক’রে তু’লে;
সঙ্গে সঙ্গে যানবাহন ও যোগাযোগের
বিহিত ব্যবস্থা কর,
যাতে কেউ
জীবনচর্য্যার যোগ্যতর পরিচর্য্যায়
কোন দিক-দিয়ে কোনরকমে
ব্যাহত না হয় ;
বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে,–
শ্রমিকরা যা’তে ধনিকের উপচয়ী হয়,
এবং ধনিকরা যা’তে
শ্রমিকদের সত্তাপোষণী হয়,
আর, যোগ্যতায় অভিদীপ্ত হ’য়ে
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে
শ্রমিকরা যাতে স্বাবলম্বী হ’য়ে ওঠে—
নিজের পরিবারকে শ্রমনিকেতন ক’রে
সম্পদে উদ্ভিন্ন হ’য়ে।
৪। ব্যবসা-বাণিজ্য-নিয়ন্ত্রণ
এমনই শুভ, সহজ,
অনুচৰ্য্যাদীপক হওয়া উচিত,
যা’র ফলে বা যে-নিয়ন্ত্রণে
মানুষ এতটুকুও অভাব বোধ না করে,
বরং যোগ্যতা ও প্রাচুর্য্যে উচ্ছল হ’য়ে ওঠে;
দেশে যা’ জন্মে, তা’র সহজ পরিবেষণ
ও জীবন-চলনার পক্ষে যা’ নিতান্তই প্রয়োজনীয়,
অথচ দেশে পাওয়া যায় না—
বিদেশ হ’তে এমনতর দ্রব্যাদির
শীঘ্র ও সহজ আমদানি
এমনতরভাবে
যা’তে মূল্য-বাহুল্যে
মানুষ পীড়িত না হ’য়ে ওঠে,
বা কেউ তা’র অভাবে সঙ্কটাপন্ন হ’য়ে
জীবন না হারায়,——
অতীব তৎপরতা নিয়ে
তীক্ষ্ণ চক্ষুর দিব্য বিবেচনায়
তা’র সমাধান হওয়া একান্তই সমীচীন—
অবান্তর গণবিক্ষোভের অবসরই যাতে না থাকে
এমনতরভাবে;
কৃষি ও শিল্পের উপচয়ী উৎপাদন ও বণ্টন
এবং বাণিজ্য ও বৈদেশিক অর্থ-বিনিময়ের
লাভজনক সুপ্রসারই হ’চ্ছে
অর্থনীতির মূল ভিত্তি,
আবার, কৃষিই এ-সবের মেরুদণ্ড,
যা’দের কৃষি অব্যবস্থ——
অনটনও তা’দের অপরিহার্য্য,
তা’দের পরশোষী না হ’য়ে উপায়ই থাকে না ।
৫। শিক্ষাকে একানুধ্যায়ী আদর্শে
অনুচর্য্যী ধৰ্ম্মের ভিত্তিতে
সুসঙ্গত সত্তাপোষণী ক’রে তোল,
যা’তে কোন শিক্ষাই
অন্য যা’-কিছুর সাথে
সঙ্গতির তাল রেখে
সম্বুদ্ধ সম্বর্দ্ধনায়
বাস্তব যোগ্যতার উৎক্রমণে
উদ্গতি লাভ ক’রতে না-পেরে—
বৃথা ও বিচ্ছিন্ন হ’য়ে না ওঠে ;
শ্রদ্ধোষিত অন্তরাসী হ’য়ে
প্রতিপ্রত্যেকে যা’তে শিক্ষানুবৰ্ত্তনায়
উচ্ছল চলনে চ’লতে পারে, –
তা’র জন্য যথাবিহিত পরিবেশ সৃষ্টি কর ;
শিক্ষকদিগকে ঐ অমনতর শিক্ষার
মূর্ত্তপ্রতীক হ’য়ে উঠতে হবে,
তাঁরা যদি সুকেন্দ্রিক, একানুধ্যায়ী
সশ্রদ্ধ না হ’য়ে ওঠেন—
অন্তরাসী সম্বেগ-সম্বুদ্ধ হ’য়ে—
ছাত্রেরাও সুসঙ্গত হয়ে উঠবে না তাঁতে,
অন্তরাসী হবে না,
যা’র ফলে, শিক্ষা
একটা শাতনী পটভূমিতে
আবর্ত্তিত হয়ে উঠবে ;
শিক্ষার সাথে
বৈধানিক দক্ষতা ও শক্তি
এমনতর সূক্ষ্ম, সবেগ
ও কৰ্ম্মঠ হয়ে ওঠা চাই,
যা’র ফলে, মানুষ
কোন ব্যাপারের সম্মুখীন হ’লেই
মুহূর্ত্তে সেগুলি উপলব্ধি ক’রতে পারে,
ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎকে
দেশকালপাত্র ও অবস্থার ভিতরেও
ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমানের সঙ্গতি নিয়ে
লহমায় বেছে নিতে পারে ।
৬। গবেষণা কেন্দ্রগুলিকে দেশের
দীপালী-বীক্ষণাগার ক’রে তুলতে হবে,
সুসঙ্গত সত্তাপোষণী সমাচার
যা’তে সুদূরপ্রসারী পরীক্ষায়
সুনিশ্চয়ী তাৎপর্য্যে
সবার কাছে উপস্থিত হয়,
যা’র পরিপালনে তারা জীবন ও সম্বৃদ্ধিতে
আরো হ’তে আরোতর উদ্বর্দ্ধনায়
নিয়ত চলৎনশীল থাকতে পারে—
আদর্শ ও ধর্ম্মের ভিত্তিতে
নিটোলভাবে দাঁড়িয়ে—
তা’র ব্যবস্থা ক’রতে হবে।
৭। তোমাদের স্বাস্থ্য অভিযান যেন
গ্রামের কানায় কানায় উপস্থিত হয়,
সদাচার ও স্বাস্থ্য-নীতিগুলিতে
প্রতিটি ব্যষ্টি যেন পারদর্শী হয়ে ওঠে,
ঔষধ, পথ্য, চিকিৎসা ও বৈদ্যের
যেন এতটুকু অভাব না ঘটে,
তোমাদের গণজীবন
স্বাস্থ্যে, বীর্য্যে
অযুত-আয়ু হ’য়ে
বীৰ্য্যবান যোগ্যতা নিয়ে
তাদের অস্তিকে স্বস্তি-বিকিরণে
যেন বিকীর্ণ ক’রে তোলে,—
হৃদ্য হ’য়ে, তৃপ্তিপ্রদ হ’য়ে
মধুদীপনার রশ্মিজাল বিচ্ছুরণে
অস্তিত্বের সামগানে
সম্বৃদ্ধ ক’রতে পারে সবাইকে ।
৮। শান্তিরক্ষক-বিভাগ ও সৈন্য-বিভাগ
সুষ্ঠু সন্দীপনায়
আদর্শপ্রাণ ধৰ্ম্মানুগ ভিত্তিতে
অসৎ-নিরোধী হ’য়ে
যা’তে প্রতিপ্রত্যেকের আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে,
সে-বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রেখো,
ব্যতিক্রমে
বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করো;
নিরাপত্তা যেখানে সন্দেহের
নিরোধও সেখানে অব্যর্থভাবে প্রয়োজন—
ক্ষিপ্র তৎপরতায় ;
আর, শান্তিরক্ষক ও সৈন্য-বিভাগের
প্রতিপ্রত্যেকে যেন
একানুধ্যায়ী, ধৰ্ম্মপ্রদীপ্ত
সৌকৰ্য্য-সমন্বিত ঐ শাসন সংস্থার
স্বভাব-যাজী হ’য়ে ওঠে–
বাক্য, ব্যবহার ও কর্ম্মের সুসঙ্গতির তালে,
যার ফলে, প্রত্যেকটি মানুষ
উপলব্ধি ও উপভোগ করতে পারে
ঐ শাসন-সংস্থা
তাদের কাছে কতখানি শ্রেয় বা প্রিয়,
সবাই যেন একটা আসান ও আশা পায়,
শাস্তিকেও তারা যেন
স্বস্তি ব’লে আলিঙ্গন ক’রতে পারে।
৯। গুপ্তচর-বিভাগকে
এমনতর ক্ষিপ্র, দক্ষ, নিপুণ, বিশ্বস্ত ও তৎপর
ক’রে তুলতে হবে—
আপ্রাণ শ্রেয়ার্থ-অভিদীপনা-নিবদ্ধ করে,
যেন তারা যাই করুক না কেন
শ্রেয়ার্থকে
কিছুতেই বিসৰ্জ্জন দিতে না পারে,
তাদের জীবনমূল
যেন এতই ধর্মভিত্তিতে প্রোথিত থাকে যে,
তাকে উল্লঙ্ঘন করা তাদের পক্ষে
দুর্ভাবনীয় ব্যাপার হ’য়ে দাঁড়ায়;
তা’দের চক্ষু, কর্ণ, জিহবা,
নাসিকা, ত্বক্ ইত্যাদিকে
এতই তীক্ষ্ণ ও নির্ভুল বোধপ্রবণ ক’রে তুলতে হবে,—
যা’তে তা’রা স্বতঃই
বিচক্ষণ বোধ-তাৎপৰ্য্যশীল হয়ে ওঠে,
তাদের উপস্থিতবুদ্ধি, বাক্য-বিন্যাস
এমনতর ক’রে তুলতে হবে–
যাতে কোন বিষয়ে তাদের বিবরণ
বাস্তবতারই বাক্-ছবি হ’য়ে ওঠে,
তাদের ধারণাগুলিকে
এমনতর সুস্থ ধৃতি-প্রবণ ক’রে তুলতে হবে—
যাতে বিবরণে
কোনমাত্র ব্যতিক্রম না হয়,
অযথা অপকৃষ্ট-ধারণাদুষ্ট হয়ে
বা বাস্তব বিষয়ের অসাক্ষাৎকারে
তাদের প্রদত্ত কোন বিবরণের দ্বারা
কেউ যেন
অযথাভাবে আক্রান্ত বা বিমর্দ্দিত না হয়,
আবার, আলস্য বা প্রবৃত্তি-প্রলুব্ধ হয়ে
তাদের ক্ষিপ্র নৈপুণ্য
এতটুকুও যেন বিকম্পিত না হয়ে ওঠে,
দুষ্ট পরিবেশ বেষ্টিত হয়েও
তাদের এমনতর
উপস্থিতবুদ্ধির তালিমসম্পন্ন হওয়া উচিত—
যাতে তারা
যে-কোন অবস্থায় পড়ুক না কেন,
সে-ব্যুহ ভেদ ক’রে ফিরে আসা
তাদের পক্ষে হস্তামলকবৎ হ’য়ে ওঠে,
তারা যেন
সাহস ও প্রত্যয়ে অভিদীপ্ত হয়ে চলে,
দেবপ্রভ চরিত্র,
শাতন-ভেদী ইন্দ্রিয় ও বোধি-সমন্বিত যে যত,—
সেই তত শ্রেয়,
দক্ষ, পারদর্শী, কর্ম্মপটু হ’য়ে থাকে,
নিষ্ঠা, সহ্য, ধৈর্য্য, অধ্যবসায়
ও কৰ্ম্মপটু তীব্রবীর্য্যী বোধায়নী সন্ধিৎসাই হচ্ছে
তাদের প্রিয় সম্পদ ;
গুপ্তচর-বিভাগ ছাড়া
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও উৎকর্ষ-অভিধ্যায়িতার জন্য
উপযুক্ত সন্ধানী বিভাগেরও প্রয়োজন,
যা’রা দক্ষ, কর্ম্মপটু, সুসন্ধিৎসু
নিপুণ অভিধ্যায়িতা নিয়ে
ক্ষিপ্র তৎপরতার সহিত
রাষ্ট্রের সম্পদ ও আপদকে
সম্যকভাবে নির্দ্ধারণ ক’রে
চতুর বৈধী-তৎপরতায়
উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণে
আপদকে নিরাকরণ ক’রে
সম্পদকে সুবর্দ্ধিত ক’রে তুলতে পারে,
উক্ত বিভাগে সত্তাপোষণী ধৰ্ম্মানুগ সুনিষ্ঠ একানুধ্যায়ী তাৎপর্য্যবান
পটু, শ্রমপ্রিয়, ধীমান কর্মীর নিয়োগও
একান্ত প্রয়োজন ।
১০। বিচারালয়ে বিচারক
ঐ সশ্রদ্ধ ধৰ্ম্মানুগ
একানুধ্যায়িতা নিয়ে
যেন এমনতর
বিচার ও সুশাসন-তৎপর হ’য়ে ওঠেন,–
যা’তে সব্যষ্টি প্রত্যেকটি গণগুচ্ছই
তাঁ’তে আস্থাসম্পন্ন, তৃপ্ত ও সন্দীপ্ত হ’য়ে
শাসন-সংস্থায় আত্মনিয়োগ করে,
তা’র সৌকর্য্যে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে—
স্বাভাবিক স্বতঃ-সন্দীপনায় ।
১১। কর্মচারী নিয়োগ-ব্যাপারে
প্রথমেই দেখা উচিত
সসংস্কৃতি তা’র কুল ও বংশ,
দেখতে হবে
মাতৃকুলই হোক বা পিতৃকুলই হোক—
তাতে কোনরকম অশ্রেয় বা অবৈধ
বিক্ষেপ আছে কিনা,
কারণ, তা’ থাকলে,
সে যত বড়ই দক্ষ
ও বোধিবীৰ্য্যবান হোক না কেন,
অবিশ্বস্ত হওয়ার ঝোঁক তা’তে
কিছু-না-কিছু থাকবেই ;
আবার, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি
যেন একমাত্র বিচার্য্য না হ’য়ে ওঠে,
বিশ্বস্ত, দক্ষ, বীৰ্য্যবান,
কর্ম্মঠ পারদর্শিতাকে ভিত্তি ক’রেই
নির্বাচন-বিচার চালানো যুক্তিসঙ্গত,
তা’র সাথে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা থাকে—
সে তো ভালই,
তা’ ছাড়া
স্বাস্থ্য, মনোবল, সাহস, বোধিদক্ষতা
অনুবৰ্ত্তিতা, উপস্থিতবুদ্ধি,
সুসঙ্গত ক্ষিপ্র চিন্তাসঙ্গতি,
সুসিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা,
নির্ভুল ও ক্ষিপ্র সম্পাদনী
তৎপরতা ইত্যাদি দেখা
অতীব সমীচীন ;
এগুলি দেখতে হবে,
যে যে-পদের প্রার্থী
তা’র উপযোগিতা-অনুপাতিক—
জৈবী-সঙ্গতিকে ভিত্তি করে।
১২। স্বরাষ্ট্র ও বৈদেশিক দপ্তরকে
এমনতরই সাবুদ ক’রে তুলতে হবে,
যাতে স্বরাষ্ট্র ও বিদেশের
সুসঙ্গত পারস্পরিক অনুচৰ্য্যায়
কোথাও এতটুকু অবিবেকী অসামঞ্জস্য না থাকে,
তা’রা বান্ধবতায় সুনিবন্ধ হয়ে ওঠে—
পারস্পরিকতায়,
রাষ্ট্রসত্তা ও স্বার্থকে অব্যাহত রেখে,
সত্তাপোষণী ধৰ্ম্ম, কৃষ্টি
ও আদর্শানুগ রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্যকে
অটুট রেখে,
সম্ভ্রমাত্মক অনুবেদনী আনতির সহিত ;
বৈদেশিক বান্ধবতা যেন অচ্ছেদ্য থাকে,
কোনপ্রকার কূটকৌশলই যেন
ঐ বান্ধবতাকে ছিন্ন করতে না পারে,
তাদিগকে এমনতর ক’রে তোল
যাতে তারা তোমার রাষ্ট্রীয় সত্তার সংরক্ষণ
ও তৎপরিপন্থী যা’-কিছুর নিরাকরণে
অপরিহার্য্যভাবে
সক্রিয় স্বতঃ-অনুধ্যায়ী হয়ে ওঠে।
১৩। আবার, ঐ আদর্শকে রূপায়িত ক’রতে
রাষ্ট্রদূতও তেমনতরভাবে
নিয়োগ করো,
রাষ্ট্রসত্তায় স্বার্থবান, সদ্বংশজ, বিদ্বান,
সুসঙ্গত বোধিপরায়ণ,
উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন, নীতিজ্ঞ, মিষ্টভাষী,
ধৰ্ম্ম, কৃষ্টি ও আদর্শে অচ্যুত সুনিষ্ঠ,
কৌটিল্য-অভিজ্ঞ, ইঙ্গিতজ্ঞ, মর্ম্মজ্ঞ,—
মোক্তা কথায়
এই জাতীয় জন্ম ও গুণবিশিষ্ট
শ্রেয়ার্থপরায়ণ লোকই কিন্তু
দৌত্যের উপযুক্ত পাত্র,
বিসদৃশ, বিশৃঙ্খল যা’,
আদর্শ, ধৰ্ম্ম ও কৃষ্টি-সমন্বিত
রাষ্ট্রসত্তা ও স্বার্থকে
ব্যাহত করে, খাটো করে,
বা নিন্দা করে যা’,—
সুযুক্তিপূর্ণ তথ্য-সমন্বিত
বাক্য, ব্যবহারের ভিতর-দিয়ে
তাকে নিয়শ্রিত করে
রাষ্ট্রসত্তা ও স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে,—
এমনতর উপস্থিতবুদ্ধি নিয়ন্ত্রিত-ধী-সমন্বিত
কূট-কৃতি পরিচর্য্যাসম্পন্ন ব্যক্তিই
দৌত্য-ব্যাপারে বাঞ্ছনীয় ।
১৪। প্রচার-প্রাচুর্য্য এতই হওয়া উচিত—
যাতে দেশের আদর্শ, দেশের কৃষ্টি,
দেশের বিবর্ত্তনী পদক্ষেপ,
বিদেশের প্রত্যেককেই
মুগ্ধ ও আন্দোলিত ক’রে তোলে—
উন্নয়ন-অনুশীলনী সম্বেগে,—
সবাই শ্রদ্ধাবন্ত হয়ে ওঠে
তোমার দেশের গণ ও ব্যষ্টিতে;
ধৰ্ম্মের মূলসূত্র যা’,
আদর্শ, কৃষ্টি এবং সত্তাপোষণী নীতি যেগুলি—
সে-সবগুলি বিহিতভাবে উদ্ভিন্ন করে
সঞ্চারিত ক’রে, নিয়মন ক’রে
যাতে প্রত্যেকটি ব্যষ্টি
তদ্ভাবান্বিত হয়ে ওঠে
একত্বানুধাবনী তাৎপর্য্যে,
পারস্পরিক বৈশিষ্টপোষণী সশ্রদ্ধ পরিচর্য্যায়,
বাক্যে, ব্যবহারে, চলনে,—
তার বিহিত ব্যবস্থা করা নিতান্তই সমীচীন,
আর, ঐ সমীচীনতার অবহেলা
যতই বেশী হ’য়ে ওঠে,
একানুধ্যায়ী সংহতি-স্বাতন্ত্র্য
পারস্পরিক সহযোগিতা
যোগ্যতা-অভিদীপ্ত বিবৰ্ত্তনী অনুপ্রাণনা
ক্রমশঃই অপলাপের দিকে
চ’লতে থাকে ততই,
তখন সত্তাতান্ত্রিকতার বদলে আসে—
প্রবৃত্তির ব্যভিচারী পরিক্রমা,
দুর্ব্বুদ্ধির উদগ্র লেলিহান সম্বেগ,
যা’ নিজের সত্তাকেই আয়বাদ দিয়ে
পরিশোষণ করে
তারই উপভোগ্য উপকরণ-সংগ্রহে
আগ্রহবিধুর হ’য়ে ওঠে,
এই হচ্ছে শাতনী সঞ্চলন,—
ব্যষ্টি, গণ ও রাষ্ট্রকে
সৰ্ব্বনাশে সমাধিগ্রস্ত করার
আত্মঘাতী আবেগ—
যা’ গণবিদ্রোহের সৃষ্টি ক’রে তোলে ।
১৫। শাসন-সংস্থা নিজে
তা’র প্রতিটি কর্মচারী-সহ
যথাসম্ভব একানুধ্যায়িতার সহিত
পরার্থপরতার সম্বেগ নিয়ে
কৃতি-অধ্যুষিত সন্দীপনায়
যেন রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যষ্টিকে দেখা-শোনা করেন,
তা’ ছাড়া, নিয়মিতভাবে নগর—
বিশেষতঃ পল্লী-পরিদর্শন,
লোকের সুখদুঃখ, অভাব-অভিযোগের তথ্য গ্রহণ,
তন্নিরাকরণী যোগ্যতা-সন্দীপী আলোচনা,
অযথা অবান্তর ব্যয়বাহুল্যের
সঙ্কোচ ও সুনিয়মন,
এবং বিশেষ বিষয়ে বিহিত স্থানে
আপূরণী সাহায্য-দানের
এমনতর ব্যবস্থা যেন করেন
যার ফলে
প্রতিপ্রত্যেকের বোধে
উপস্থাপিত হয় যে,—
শাসন-সংস্থা তা’র প্রতিটি ব্যষ্টি-সহ
তাদের কাছে কতখানি আত্মীয়ভাবাপন্ন;
এটা একটা অপরিহার্য্য করণীয়।
১৬। করধার্য্য এমনি ক’রে করো,—
যাতে মানুষের কর
তোমার শাসন-সংস্থার
সহায় হ’য়ে ওঠে,
সম্বর্দ্ধনার শক্তি হয়ে ওঠে,
তোমার কর যেন
মানুষের করকেই আলিঙ্গন করে,
আবার মানুষের যোগ্যতা
ও আন্তরিক আগ্রহ
কর্ম্মদীপ্ত হয়ে
যেন এমনতর উপচয়ী হ’য়ে ওঠে,—
এবং তোমাদের পালন পরিচর্য্যায়
এমনতরই সম্বুদ্ধ ও সম্বৃদ্ধ হ’য়ে ওঠে—
যা’র ফলে, প্রতিটি গণের
আগ্রহ-উদ্দীপ্ত অবদানে
তোমাদের রাজকোষ
উচ্ছল চলনায় চলতে থাকে,
আর, তা’র ব্যবহারও যেন এমনতর হয়—
যাতে ঐ কোষ অবাধভাবে
উপচয়ী চলনে চলতে পারে
এবং ব্যয়টাই যেন উপচয়ের কারণ হয়ে ওঠে;
রাজকোষ যেখানে অপটু,
গণযোগ্যতাকে সম্বেগে প্রবুদ্ধ করে
উৎপাদন-হারকেই প্রবুদ্ধ করে তোল—
ক্রমচলনের ভিতর-দিয়ে,
আর, রাজকোষকে উচ্ছল করে
তুলতে চেষ্টা কর—
সমবেত সানুকম্পী পরিচর্য্যায় ;
গণসত্তার নিরাপত্তার জন্য
আয়ের একদশমাংশ সংরক্ষিত ক’রে
অন্যায্য-ব্যয়-সঙ্কোচে
ন্যায্য নিয়ন্ত্রণে
গণ-নিরাপত্তাকে অটুট ক’রে তোল,
আর, গণসত্তা-পোষণ ও প্রবর্দ্ধনের জন্য
‘যা’ প্রয়োজন
‘তা’ ঐ নয়-দশমাংশের ভিতর
নিষ্পন্ন করতে চেষ্টা কর;
যতক্ষণ পর্য্যন্ত কোন উৎপাদন
তেমনতর প্রাচুর্য্যে উপস্থিত না হয়—
যা’র ফলে, নিরাপত্তার ব্যয়
ঐ উপচিত ভাণ্ডার থেকেই
সচ্ছল হ’য়ে ওঠে,
ততদিন শ্রমপটুতাকে উপেক্ষা না ক’রে
উৎপাদনকে আরো-আরো
সম্বুদ্ধ করে তুলো;
তাতে তোমার রাষ্ট্রসত্তাও
পরাক্রমশীল হয়ে উঠবে।
১৭। নিজের দেশের দুর্ব্বলতা যেগুলি আছে,
সেগুলির সংস্কারে
জাতিকে সবল করে তুলতে হবে,
অনটনের অপনোদনে
দেশকে প্রাচুর্য্যে উদ্ভিন্ন করে তুলতে হবে,
অপটু যারা তা’দিগকে পটুত্বে
প্রকৃষ্ট করে তুলতে হ’বে,
যারা অপলাপের কোলে অবশায়িত
তাদিগকে উদ্গতিশীল করে তুলতে হবে,
সৎ-কে আরো আরোতে
উদ্দীপ্ত করে তুলতে হবে—
বৈধী বৈশিষ্ট্যপালী বিবৰ্ত্তন-পদক্ষেপী ক’রে সুকেন্দ্রিকতায় সুনিবদ্ধ করে।
১৮। অবিশ্বস্ততা ও কৃতঘ্নতাকে
উপযুক্ত উপায়ে
নিরোধ করবেই কি ক’রবে—
ক্ষিপ্র তৎপরতায়,
যা’র ফলে, মানুষের ঐ প্রবৃত্তি
বৃদ্ধিপর না হ’য়ে
ক্রমশঃই সঙ্কুচিত হয়ে
অপলাপে নিঃশেষ হয়ে ওঠে,
যেখানে দেখবে
অসৎ যা’, বিরোধী যা’
আদর্শ, ধৰ্ম্ম, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি-বিধ্বংসী যা’
নিয়তই ক্রুর ও সাংঘাতিকভাবে
তোমার সংস্থা ও সত্তার
অপঘাতী হয়ে চলেছে,—
সুদৃঢ় প্রস্তুতি নিয়ে
তাকে অনতিবিলম্বেই নিরোধ ক’রতে
একটুকুও ত্রুটি ক’রো না,
বিলম্বে তাকে হয়তো আয়ত্তে আনা
সুকঠিনই হয়ে উঠতে পারে;
সম, দান, ভেদ ও দণ্ডের প্রতি
বিশেষ বিবেচনা
ও অনুধ্যায়ী বিচারণার সহিত
যেখানে যখন যেমনটি প্রয়োজন
সত্তাসম্বর্দ্ধনা ও অসৎ-নিরোধে
সেখানে তেমনতরই
যথাসম্ভব প্রস্বস্তির আবহাওয়া নিয়ে
তা নিষ্পাদন করতে
একটুও অবহেলা করো না;
সাম-দানে যদি সমস্যা সমাধান লাভ করে
তবে ভেদ সৃষ্টি করতে যেও না,
ভেদেই যেখানে তা নিরাকৃত হয়
সেখানে দণ্ড দিতে যেও না;
কিন্তু দণ্ড যেখানে অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছে
সেখানে দণ্ডকে ত্যাগ করো না,
আবার, কোথাও প্রয়োজন হ’লে
যুগপৎ চতুঃ-পন্থাই অবলম্বন করতে পার;
ফলকথা, অবৈধ যা’, অসৎ যা’,
অন্যায় যা’,
তা’ যেন ভীত, ত্রস্ত শ্রদ্ধাবনত হ’য়ে থাকে
তোমাদের শাসন-নিয়ন্ত্রণের ফলে।
১৯। সর্ব্বোপরি, তোমাদের শাসন-সংস্থা যেন
বৈশিষ্ট্যপোষণী লোকপালী সংস্থা
ও সুসঙ্গত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিপোষণে
যত্নবান্ হয়,
বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মাণ বিজ্ঞ-মহানদের প্রতি
বিশেষ সম্ভ্রম ও অনুচর্য্যা নিয়ে চলে,
আর, শাসন-সংস্থার পরিচালকবর্গ যেন
দেশের পূরয়মাণ ধৰ্ম্ম-প্রবক্তা যাঁরা
তঁৎসংশ্রয়ে উপস্থিত হয়ে
সশ্রদ্ধ আগ্রহে
উন্মুখ আপ্রাণতা নিয়ে
আলাপ-আলোচনার ভিতর-দিয়ে
তাঁদের দূরদর্শী উপদেশ ও অনুশাসন-গ্রহণ
ও তৎপ্রবর্ত্তনায় মনোযোগী হন,
এতে শাসন সংস্থা স্বতঃই
অভ্যুদয়ী কল্যাণের পথে চলতে পারবে ।
২০। এইতো গেল সেগুলি—
মোটা কথায় যা আমার ইয়াদে আসে ;
তবে আরো মনে হয়,
শাসন-পরিষদ বা শাসন-সংস্থার বাহিরে
সব সময়ই এমনতর একজন প্রাজ্ঞ বহুদর্শী
ইষ্ট, কৃষ্টি ও ধর্মের অনুচর্য্যাপরায়ণ
বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মাণ
কেউ যদি থাকেন,
যিনি ঐ শাসন-সংস্থার
সমস্ত নিয়মন ও পরিচালনে
নিয়ত লক্ষ্য রেখে
বাষ্টিগত ও সমষ্টিগতভাবে
লোকের অভিধ্যায়ী প্রয়োজনগুলিকে
অবলোকন করে থাকেন—
সম্যক্ তাৎপর্যে অভিগমনশীল হ’য়ে
সুসঙ্গত সূত্রকে অনুভব করে—
শ্রদ্ধাবনত অন্তঃকরণে
আগ্রহদীপনার সহিত
বোধায়নী পরিচর্য্যায়
পরিপ্রশ্ন ও সেবার দ্বারা
আলোচনায়
সমস্ত ব্যাপারগলিকে অনুধাবন করে
যখন যে-ব্যাপারে যেমন প্রয়োজন
তাঁর মত
ও কুশলকৌশলী নিয়মনের মন্ত্রণা নিয়ে—
তা’ পূৰ্ত্তনীতি সম্বন্ধেই হো’ক
আর, কৌটিল্য-সম্বন্ধীয়ই হো’ক,
নিজদিগকে তদনুপাতিক
সংস্থ ক’রে চ’লতে পারলে
শাসন-সংস্থা
আরও সুষ্ঠু, সুকেন্দ্রিক
ও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে
অচ্যুত আদর্শাভিগমনে ;
কারণ, যা’রা দাবা খেলে,—
নিজেদের দুরাগ্রহ ঔৎসুক্য-বশতঃ
তাদের বোধদর্শিতা
অনেকখানি অবসন্ন হ’য়ে ওঠে,
ঐ কুশলকৌশলী তাৎপর্য্য-পরায়ণ
বোধিসম্পন্ন পৃষ্ঠপোষকের ইঙ্গিত
তখন সাফল্যের দিকেই নিয়ে যায়,
আমার বৃদ্ধি ও বিবেচনা-মাফিক
শাসন-সংস্থার বাহিরে
এমনতর একজন
মানুষের প্রয়োজন অপরিহার্য্য—
যদিও সব ক্ষেত্রে, সব সময়ে
এমনতর লোক পাওয়া দুষ্কর;
আর, এমনতর লোক থাকুন আর নাই থাকুন—
শাসন-সংস্থার বাইরে
সব সময়
এমন শক্তিশালী নাগরিক সংস্থার প্রয়োজন,
যে-সংস্থা
নাগরিকদের ভিতর থেকে
ইষ্ট, কৃষ্টি ও ধৰ্ম্ম-অনুশাসন-সম্বুদ্ধ
শ্রেয়-কুল-সম্ভূত
আদর্শপ্রাণ সৰ্ব্বসঙ্গত বোধসম্ভারসম্পন্ন
বেদ-বিজ্ঞানবিৎ,
কৰ্ম্মপ্রাজ্ঞ,
বৈশিষ্ট্যপালী-আপূরয়মাণ-শ্রেয়নিষ্ঠ
সভ্য দ্বারা সুসংহিত হবে,
সুনিবদ্ধ হ’য়ে রইবে,—
যা’রা ধর্ম্মানুগ অস্তিবৃদ্ধির নিয়মনে
গণজীবনকে
যেমনতরভাবে নিয়ন্ত্রিত করা উচিত
তা’ তো করবেনই,
আরো, শাসন-সংস্থার
যে-কোন বিধি প্রণয়ন করতে হলে
তাঁদের অনুমতি ছাড়া
তা ঐ বিধান-সভায়
উত্থাপিত হতে পারবে না;
পরিস্থিতি, দেশকালপাত্র ও প্রয়োজন-অনুপাতিক এমনতর ব্যবস্থা যদি না হয়,
পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রবর্তিত এই পবিত্র ধ্বনির মাধ্যমে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানাদি সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অবতার পুরুষদের বন্দনা করা হয়।
।। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্য অবদান।।
নিবেদনে— তপন দাস
————————————————
মহাভারতের বনপর্বে বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিলেন, সব চাইতে আশ্চর্যের বিষয় কি ?
উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী জেনেও মানুষ ন্যায়, নীতি, ধর্ম বিসর্জন দিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকতে চায় এটাই সব চাইতে আশ্চর্যের বিষয় ।
তাই, আমরা, ঠাকুরের মানুষেরা যেন ওইসব পথের পথিক না হই । প্রবৃত্তিধর্মী অসৎ পথ অবলম্বন করে যদি চিরজীবি হওয়া যেত তাহলে না হয় অসৎ পথের আশ্রয় অবলম্বন করার সার্থকতা থাকত। তাই আমাদের বাঁচতে হবে পরমপিতার খুশির জন্য, মরতেও হবে পরমপিতার খুশির জন্য—মৃত্যুকে অবলুপ্ত করার লক্ষ্যে, ‘তৃষ্ণার একান্ত নির্বান— মহাচেতন সমুত্থান।’ বাণীকে সম্মান জানাতে।
নির্দিষ্ট অপরাধবোধ ছাড়াও দুর্বলতাজনিত উৎকণ্ঠার ভয়, আগন্তুক ভয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয় মনের পিছু ছাড়ে না । সব ভয়ের চরম মৃত্যুভয় । একটু অভ্যাস করলেই অন্তর্যামী স্বরূপ পরমাত্মিক শক্তির সাহায্যে আধিভৌতিক, আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক ত্রিবিধ ভয় থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারে । এজন্য প্রবৃত্তি অভিভূতির সব দুর্বলতা কাটিয়ে ইষ্টকর্মে নিয়োজিত থাকতে হবে । তাই তো ঠাকুর আমাদের সব ভয় থেকে মুক্তি দিতে বাণী দিলেন ।–
“সব প্রবৃত্তি রত থাকে
ইষ্টকর্ম লয়ে,
সেই তো যোগী, সেই সন্ন্যাসী,
কাল নত যার ভয়ে ।”
“He will stand like a tower when everything rocks around him and when his softer fellow- mortals are winnowed like chaff in the blust.”
(আঃ প্রঃ ২/৭৫)
(যখন সবকিছুর অস্তিত্ব টলায়মান হয়ে উঠবে, এবং শক্তিহীন নির্জীব লোকগুলি ঝড়ের আগে তুষের মত উড়ে যাবে, তখন সে একটা স্তম্ভের মত নিজের শক্তিতে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ।)
জীবের জীবনবৃদ্ধির অপলাপকারী মৃত্যুকে প্রণাম জানিয়ে, মৃত্যুকে অবলুপ্ত করার এই পথকে আঁকড়ে আমরা যেন অনন্ত জীবনের অধিকারী হতে পারি । দৈব দুর্বিপাক ভূমিকম্পে ভীত না হয়ে আমরা সকলে যেন মৃত্যুকে অবলুপ্ত করার সাধনা ইষ্টনাম এবং ইষ্টকর্মে মত্ত থাকি, পড়শিদের, পারিপার্শ্বিকদের, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আক্রান্তদের সহায় হয়ে,—মৌখিক স্তুতি, আত্মার শান্তি কামনার পাশাপাশি বাস্তব কর্মের মাধ্যমে । পরমপিতার অনুশাসনকে সহায় করে বিশ্ব প্রকৃতিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সব্বাইকে।
বিশ্ব-প্রকৃতির পরম দান, পঞ্চ-মহাভূত—ক্ষিতি, অপ্, মরুৎ, ব্যোম ও তেজ-এর অজৈব উপাদানের সমাহারে পুষ্টি পেয়ে প্রাণপঙ্ক মাত্রেরই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আদর্শ পরিবেশ এই পৃথিবী নামক সবুজ গ্রহটি। নগর-সভ্যতার ধারক-বাহকেরা আসুরিক ক্ষমতার বলে, ভোগবাদের ছাড়পত্রের বলে, আদর্শহীনতার বলে ভারতীয় ধর্মের অঙ্গীভূত পঞ্চ-মহাযজ্ঞ, সদাচার এবং বর্ণাশ্রমকে বিদায় জানিয়ে বসুন্ধরার পরিবেশকে যে ধ্বংসাত্মক পথে এগিয়ে দিয়েছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ‘নাসা’-র গবেষণা। উদ্বেগ প্রকাশ করে গিয়েছিলেন কবিগুরু, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’-এর প্রতিবাদী বাণীতে।
ভারতবর্ষের বৃহত্তম নদী গঙ্গাকে আমরা মা বলি, যাঁর পূত স্রোতধারায় স্নাত হয়ে পবিত্র হই, সেই মায়ের শরীরে নগর-সভ্যতার পুর-বিভাগ যখন পরিকল্পিতভাবে পূতিগন্ধ ক্লেদ নিক্ষেপ করে, ধর্মের ধ্বজাধারীরা তথাকথিত পূজা-পার্বনের বর্জ্য নিক্ষেপ করে পুণ্য অর্জন করে, তখন মনে হয় না যে আমরা কোন উন্নত সভ্যতার সভ্য, প্রগতি বাদের বাদী, আর্য্য সংস্কৃতির ধারক বাহক ধার্মিক।
পরিবেশ সম্বর্দ্ধনার সেই পরম অনুশীলন কি ভাবে বিকৃত হয়েছে সে বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। বরং বসুন্ধরার পরিবেশকে রক্ষা করার ব্রতে কিভাবে ব্রতী হওয়া যায় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের উপদেশ মেনে আমাদের প্লাস্টিক-সভ্যতার কর্ণধারেরা যাতে পরিবেশ বান্ধবের ভূমিকা গ্রহণ করেন। রাষ্ট্র নায়কেরা যাতে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ভূমিদূষণ, ভূ-স্তরদূষণ, জলদূষণ প্রতিরোধ করে গ্লোবাল-ওয়ার্মিং বা বিশ্ব-উষ্ণায়ন-ভ্রূকুটি থেকে সভ্যতাকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হন, সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে, জনমত গঠন করতে হবে, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের লাগামহীন ভোগের চাহিদা মেটাতে যে হারে ভূ-গর্ভস্থ তেল, গ্যাস, কয়লা, বিবিধ আকরিক উত্তোলন করতে গিয়ে ভূ-স্তরের অবক্ষয়কে আহ্বান করে চলেছি, ধ্বংস করে চলেছি ‘রেন ফরেস্ট’কে। এর বিরুদ্ধে সরব না হলে কোন মূল্যেই বাঁচানো যাবে না মানব সভ্যতাকে!
আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর পূর্বে পরম বিজ্ঞানী শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সরব হয়েছিলেন এই ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রতিরোধ মানসে। বিজ্ঞান-সাধক শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়, পদার্থবিজ্ঞানী কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য প্রমুখ ভক্তদের উৎসাহ দিয়ে হিমাইতপুরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্র। বিজ্ঞান-বিষয়ক অত্যাশ্চর্য্য বহুকিছুর সাথে সন্ধান দিয়েছিলেন সহজলভ্য আবহাওয়া বিদ্যুতের। ভূ-গর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন পরবর্তী শূন্যগর্ভ অবস্থাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কিভাবে পুণঃ-পূর্ণকরণ বা রিফিলিং করলে ভূ-স্তরের ক্ষতি হবে না সে বিষয়েও তিনি বলে গেছেন। তাঁর প্রদত্ত ওইসব ফরমূলাকে বাস্তবায়িত করতে পারলে ভূ-স্তরকে বিনষ্ট না করে, পরিবেশকে দূষিত না করেই প্রাকৃতিক দৌ-শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শক্তি-সম্পদে সমৃদ্ধ হতে পারত আমাদের সভ্যতা।
আমরা জানি, ধর্ম শব্দের অর্থ ধারণ করা। আমাদের অস্তিত্বের ধারক, পালক-পোষক পরমাপ্রকৃতির পঞ্চ-মহাভূত। উক্ত পঞ্চ-মহাভূতের অজৈব উপাদানের সমাহারে পুষ্টি পেয়ে প্রাণপঙ্ক মাত্রেরই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আদর্শ পরিবেশ এই বসুন্ধরা—নীল-সবুজ গ্রহ। ধারণ করতে হবে ওই প্রাকৃতিক উপাদানসমূহকে, ওঁদের বিনাশ করলে আমরাও বিনাশ হবো। নচেৎ বিশুদ্ধ জলের বোতলের মত অক্সিজেন সিলিণ্ডার পিঠে বয়ে ঘুরতে হবে একদিন নিকট ভবিষ্যতে।
পল-বিপল, দণ্ড-প্রহর, অহোরাত্র, আহ্নিকগতি, বার্ষিকগতির দিনরাত, মাস, বছর হয়েই চলেছে আদিকাল থেকে, প্রাকৃতিক নিয়মে।দিন-মাস-বছর আসে যায়, রেখে যায় কিছু স্মৃতি মনের মণিকোঠায়। ওই স্মৃতির মালাগুলোকে স্মৃতিবাহীচেতনার ভল্টে অনন্তকাল জমা করে রাখার জন্য আর্য্য-ঋষিরা প্রতিটি মুহূর্তের জীবন ধারণের আহরণ শুদ্ধির মাধ্যমে ধ্রুবাস্মৃতির সন্ধান দিয়ে গেছেন ‘‘আহারশুদ্ধৌ সত্তাশুদ্ধি, সত্তাশুদ্ধৌ ধ্রুবাস্মৃতি’’ মন্ত্রে । শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র স্বস্ত্যয়ণী ব্রতের ‘নিয়তং স্মৃতিচিদয়ুতে’ মন্ত্রে য়াকে সমৃদ্ধ করেছেন। য়ে মুহূর্ত চলে যাবে তা আর ফিরে আসবে না। চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা সমৃদ্ধ সবুজ গ্রহ পৃথিবীর প্রতিটি মুহূর্তকেই যাতে চিরনবীনতায় আস্বাদন করতে পারি, উপভোগ করতে পারি সেজন্যই আর্য্য সভ্যতার ঊষা লগনে পরমপিতার প্রতিভূ আর্য্য ঋষিগণ ‘‘মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ……..’’ মন্ত্রে বন্দনা করে বসুন্ধরার মধুময় পরিবেশকে রক্ষা অর্থাৎ পূজা করতে শিখিয়েছিলেন। পূজা শব্দের অর্থ পূরণ করা, সম্বর্দ্ধনা, সম্যকভাবে বর্দ্ধনার লক্ষ্যে এগিয়ে চলা। যেমন-যেমন আচরণে, পরিবেশের অজৈব উপাদানসমূহকে রক্ষা করে সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া যায় তাই ছিল আর্য্য ভারতের পূজা, যজ্ঞ, হোম, উৎসবের তাৎপর্য্য।
আমরা যে ৩৩ কোটি দেবতার কথা শুনেছি সে সংখ্যাটা ৩৩,০০০০০০০ নয়, শুধুই ৩৩। কোটি অর্থে (piece) বোঝান হয়েছে, যথা, জীবকোটি, ঈশ্বরকোটি একক অর্থে ব্যবহৃত হয়।
বাস্তবে আমাদের এই সবুজ গ্রহের জীবকূলের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জৈবাজৈব রসদের যোগানদাতার মূল মালিক সূর্য। সূর্যর আর এক নাম আদিত্য। আদিত্য মানে দেবতা। দেদীপ্যমান যা তাকে দেবতা বলে। দেবতা মানে দ্যুতি বিশিষ্ট সত্তা। সব দেবতাই মূলতঃ পরব্রহ্মের প্রতীক। যেমন পৃথিবীর অধিপতি অগ্নি, অন্তরীক্ষে ইন্দ্র বা বায়ু ও দ্যুলোকে সূর্য। পৃথিবী, অন্তরীক্ষ এবং দ্যুলোক-এর প্রতিটি স্থানে ১১টি করে বেঁচে থাকার আবশ্যিক উপাদান সরবরাহকারী দেদীপ্যমান উৎস রয়েছে। উক্ত ৩৩টি জীবনীয় উৎস-সমূহকে দেবতা বলা হয়েছে উপনিষদে।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৩য় অধ্যায়, ৯ম ব্রাহ্মণ)-এর ঋষি শাকল্য, ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য সমীপে দেবতার সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্যাদি ৩১ সংখ্যক দ্যুতিবিশিষ্ট প্রাকৃতিক সত্তা এবং ইন্দ্র ও প্রজাপতি মিলিয়ে ৩৩ সংখ্যক দেবতার উল্লেখ করেছিলেন। ওই ৩৩ কোটি (33 pieces) দেদীপ্যমান উৎসসমূহকে রক্ষা করার প্রশ্নে আমরা প্রবৃত্তি পরবশ হয়ে যাতে দুর্বৃত্ত না হই তারজন্য উপনিষদের ঋষিগণ ‘আত্মানং বিদ্ধি’-র শপথ বাক্যের পাঠ দিলেন।—পরমপিতার সন্তান তুমি, নিজেকে জানো, নিজের প্রতিরূপ মনে করে পরিবেশকে বাঁচাও, নিজে বাঁচ। ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’—জীবনবিধ্বংসী আচরণ ত্যাগ করে জীবনবৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলো। ‘মা গৃধ’—লোভ করো না। সদাচার এবং বর্ণাশ্রম মেনে চলো। পরিবেশকে সমৃদ্ধ করে নিজে সমৃদ্ধ হও। এই ছিল ভারতবর্ষের বিধি-বিন্যস্ত সমাজ সংগঠনের, ধর্মের, পূজার, উৎসবের বাস্তব রূপ। ওই হৃত-গৌরব যুগোপযোগী করে পুণঃ-প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন সব দেবতার সমাহারের প্রতীকস্বরূপ পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। যার প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় তাঁর প্রদত্ত ‘আর্য্য সন্ধ্যা’ প্রার্থনা মন্ত্রে।
আমরা, ভারত রাষ্ট্রের অধিবাসীরা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের পবিত্র মন্ত্র মূণ্ডকোপনিষদের ‘সত্যমেব জয়তে’-র মধ্যে নিহিত সত্যের সন্ধান করার চেষ্টা না করে, ‘মেরা ভারত মহান’ মন্ত্রের ধ্বজাধারীরা ভারতীয় আর্য্যকৃষ্টি রক্ষার পবিত্র কর্তব্য ভুলে, ধর্মের নামে কতগুলো কু-সংস্কারে, আর বিজ্ঞানের নামে ভোগবাদে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছি। অথচ বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে, ভারতীয় পঞ্চ-মহাযজ্ঞের বিধানকে, সমাজ বিজ্ঞানীরা সমাজ-বন্ধনের দৃঢ়তার অবক্ষয় রোধে, শ্রেণী-বিন্যস্ত বর্ণাশ্রমানুগ সমাজ ব্যবস্থার বিধানকে এবং প্রজনন বিজ্ঞানীরা সুস্থ মানবজাতি গঠনের জন্য সুবিবাহ ও সুপ্রজনন বিধিকে মেনে চলতে পরামর্শ দিয়েছেন।
বেদ-উপনিষদ-গীতা. ঋষি এবং মহাপুরুষদের নিদেশে কোথাও প্রচলিত পূজার নামে, অনিত্য বস্তুর উপাসনার নামে, হৈ-হুল্লোর করে পরিবেশ দূষণ করার অনুমোদন নেই। ব্যক্তি চরিত্র গঠনের নিমিত্ত সাধন-ভজন-আরাধনা বাদ দিয়ে যে তন্ত্রমতে আমরা পরিবেশ দূষণ করতে প্রতিমা পূজায় মেতে উঠি, সেই তন্ত্র-ই প্রতিমা পূজাকে ‘‘বাহ্যপূজা অধমাধম’’ বলে বর্ণনা করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও, ‘‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’’ ছন্দের ডালিতে প্রতিমা পূজার অসারতার বার্তা রেখে গেছেন।
বসুন্ধরার পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, এক বিপ্লব নিয়ে এলেন। ‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে, ধর্ম বলে জানিস তাকে। বাঁচা-বাড়ার মর্ম যা, ঠিকই জানিস ধর্ম তা। Upholding urge of existence is Dharma.’……..ইত্যাদি বাণীর মাধ্যমে। অতএব, চাঁদার জুলুম, ফুল, বেলপাতা, ধূপহীন ধূপকাঠি, নৈবেদ্য, দশ-(অ)কর্মার ফর্দ, ঢাক, ঢোল, বাজি, হৈ-হুল্লোর, তার শব্দে মাইকের ডালি দিয়ে নয়— তোমাকে ধার্মিক হতে হলে আগে পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির বাস্তব কর্মে ব্রতী হতে হবে। পরিবেশ হিতৈষী হতে হবে, তবেই তুমি ভারতীয় মতের ‘ধার্মিক’ অভিধায় ভূষিত হতে পারবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আদর্শের অনুগামীদের নিত্য ইষ্টভৃতি করতে হয়। ইষ্টভৃতি মানে ইষ্ট কর্মের ভরণ। ইষ্টকর্ম মানে পূর্ত্তকর্ম—পরিবেশের উপাদানকে,পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার বাস্তব কর্ম। যা প্রকৃত ইষ্টভৃতির মন্ত্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। “…..ইষ্টভ্রাতৃভূতযজ্ঞৈস্তৃপ্যন্তু পারিপার্শ্বিকাঃ ।” এর সরলার্থ খুব সহজ। শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শ অনুযায়ী সদাচার এবং বর্ণাশ্রমানুগ জীবন বর্দ্ধনার বিধি মেনে সপারিপার্শ্বিক জীবনবৃদ্ধির পথে চলেন যিনি, এমন গুরুভাই-ই প্রকৃত ইষ্টভ্রাতা।–যাঁর আপদে-বিপদে সাধ্যানুগ সাহায্য করতে হবে। ভূত মানে,–ক্ষিতি, অপ্, মরুৎ, ব্যোম ও তেজ-আদি সৃষ্টি-প্রকরণের পঞ্চ-মহাভূত, যা পরিবেশের অজৈব উপাদান, যার সাহায্য ব্যতীত জৈব প্রাণপঙ্ক (protoplasm) বাঁচতে পারে না। সেগুলোকে প্রাণ পণ করে রক্ষা করতে হবে। প্রতিনিয়ত এই শপথ মেনে চলার নাম ইষ্টভৃতি। অতএব প্রতিটি আমি যদি প্রকৃত ইষ্টভৃতি মহাযজ্ঞের যাজ্ঞিক হবার শপথ পালন করতে পারি তাহলেই অনেকাংশে রক্ষা করা যাবে সুজলা-সুফলা-মলয়জ-শীতল বসুন্ধরার পরিবেশকে।
এ যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের সচেতন করে দিতে বাণী দিয়ে বললেনঃ
‘‘ইষ্টভরণ, পিতৃপোষণ,
পরিস্থিতির উন্নয়ন,
এ না করে, যাই না করিস
অধঃপাতেই তোর চলন।’’
ওই অধঃপতন থেকে মধুময় বসুন্ধরাকে রক্ষা করতে কৃপা পরবশ হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর ‘পঞ্চবর্হি’ এবং ‘সপ্তার্চ্চি’ পালনের অনুশাসন দিলেন। দলীয় প্রীতির কবলে পড়ে মৃত্যুকে অবলুপ্ত করার সেই অনুশাসন বিধিকে অবজ্ঞা করার স্পর্দ্ধা যেসব তথাকথিত সৎসঙ্গীরা দেখাচ্ছেন, তাদের অধঃপতনকে প্রতিরোধ করতে হলে, তাদেরও সামিল করতে হবে উক্ত ইষ্ট-ভরণের অনুশাসন পালনে। তা যদি না করি আমরাও কিন্তু বঞ্চিত হব ‘ইষ্ট ভরণের’ পবিত্র কর্ম থেকে।
উফ্ কি গরম! বলে হা-হুতাশ করে লাভ নেই, অহঙ্কারের দেমাকে বেঁচে থাকার আশ্রয় পঞ্চ-মহাভুতকে যে-হারে অত্যাচার করে চলেছি, তার ফল তো ভুগতে হবেই।
————————————————————————–
যাকগে, আজ ২২শে এপ্রিল। আমাদের বসবাসপোযোগী এই পৃথিবী নামক সবুজ গ্রহটিকে তার স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ রাখতে খ্রীস্টিয় ১৯৭০ সাল থেকে এই দিনটিকে বসুন্ধরা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
‘ধনধান্যে পুষ্পেভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’-র বাণীর স্রষ্টা কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করতেই হয় আজকের দিনটির স্মরণে। প্রণাম নিবেদন করতে হবে কবীন্দ্র রবীন্দ্রকে যিনি,
‘প্রথম প্রভাত উদয় তব গগনে,
প্রথম সাম রব তব তপোবনে,
প্রথম প্রচারিত তব বন-ভবনে
জ্ঞান-ধর্ম কত কাব্যকাহিনী…….’ বাণীর গাঁথায় বন্দনা করেছেন ভারত-জননীকে। প্রণাম জানাতে হবে সেই পরমপুরুষ অনুকূলচন্দ্রকে যিনি উপরোক্ত স্রষ্টাদের বাণীগুলোকে অমর করে রেখেছেন তাঁর আলোচনার ছত্রে ছত্রে। ‘পদ্ম আসন ধান ভরা ক্ষেত’, ‘আর্য্য ভারতবর্ষ আমার জ্ঞান-গরিমা-গরবিনী’ ইত্যাদি বাণীর সুর-ঝঙ্কারে বসুন্ধরাকে বন্দনা করেছেন।
পরমাপ্রকৃতির পঞ্চ-মহাভূত ক্ষিতি, অপ্, মরুৎ, ব্যোম ও তেজ-এর অজৈব উপাদানের সমাহারে পুষ্টি পেয়ে প্রাণপঙ্ক মাত্রেরই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আদর্শ পরিবেশ এই বসুন্ধরা। পরমপিতার প্রতিভূ আর্য্য ঋষিগণ ‘‘মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ……..’’ মন্ত্রে বন্দনা করে বসুন্ধরার মধুময় পরিবেশকে রক্ষা অর্থাৎ পূজা করতে শিখিয়েছিলেন। ‘পূজা’ শব্দের অর্থ সম্বর্দ্ধনা। যেমন যেমন আচরণে পরিবেশের অজৈব উপাদানসমূহকে রক্ষা করে সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া যায় তাই ছিল আর্য্য ভারতের পূজা, যজ্ঞ, হোমের তাৎপর্য্য। আমরা প্রবৃত্তি পরবশ হয়ে যাতে দুর্বৃত্ত না হই তারজন্য আমাদের ঋষিরা স্মরণ করিয়ে দিলেন ‘আত্মানং বিদ্ধি’—পরমপিতার সন্তান তুমি, নিজেকে জানো, নিজের প্রতিরূপ মনে করে পরিবেশকে বাঁচাও, নিজে বাঁচ। ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’—জীবনবিধ্বংসী আচরণ ত্যাগ করে জীবনবৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলো। ‘মা গৃধ’—লোভ করো না। সদাচার এবং বর্ণাশ্রম মেনে চলো। পরিবেশকে সমৃদ্ধ করে নিজে সমৃদ্ধ হও। এই ছিল ভারতবর্ষের বিধি-বিন্যস্ত সমাজ সংগঠনের, ধর্মের, পূজার বাস্তব রূপ।
নগর-সভ্যতার আসুরিক ক্ষমতার বলে, ভোগবাদের ছাড়পত্রের বলে, আদর্শহীনতার বলে সদাচার এবং বর্ণাশ্রমকে বিদায় জানিয়ে বসুন্ধরার পরিবেশকে যে ধ্বংসাত্মক পথে এগিয়ে দিয়েছে নগর-সভ্যতা তা’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ‘নাসা’-র গবেষণা। উদ্বেগ প্রকাশ করে গিয়েছিলেন কবিগুরু, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’-এর প্রতিবাদী বাণীতে।
পরিবেশ সম্বর্দ্ধনার সেই পরম অনুশীলন কি ভাবে বিকৃত হয়েছে সে বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। বরং বসুন্ধরাকে রক্ষা করার ব্রতে কিভাবে ব্রতী হওয়া যায় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের উপদেশ মেনে আমাদের প্লাস্টিক-সভ্যতার কর্ণধারেরা যাতে পরিবেশ বান্ধবের ভূমিকা গ্রহণ করেন। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ভূমিদূষণ, জলদূষণ প্রতিরোধ করতে সচেষ্ট হন। সে বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
ভারতবর্ষের বৃহত্তম নদী গঙ্গাকে আমরা মা বলি, যাঁর পূত স্রোতধারায় স্নাত হয়ে পবিত্র হই, সেই মায়ের শরীরে পুর-বিভাগ যখন পরিকল্পিতভাবে পূতিগন্ধ ক্লেদ নিক্ষেপ করে, ধর্মের ধ্বজাধারীরা তথাকথিত পূজা-পার্বনের বর্জ্য নিক্ষেপ করে পুণ্য অর্জন করে, তখন মনে হয় না যে আমরা কোন উন্নত সভ্যতার সভ্য, প্রগতি বাদের বাদী, আর্য্য সংস্কৃতির ধারক বাহক ধার্মিক।
ধর্ম শব্দের অর্থ ধারণ করা। আমাদের অস্তিত্বের পালক-পোষক পরমাপ্রকৃতির পঞ্চ-মহাভূত ক্ষিতি, অপ্, মরুৎ, ব্যোম ও তেজ ধারণ করতে অর্থাৎ ওদের অস্তিত্বকে ধরে রাখতে হবে, বিপন্ন হতে দেওয়া যাবে না। উক্ত পঞ্চ-মহাভূতের অজৈব উপাদানের সমাহারে পুষ্টি পেয়ে প্রাণপঙ্ক মাত্রেরই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আদর্শ পরিবেশ এই বসুন্ধরা। পরমপিতার প্রতিভূ আর্য্য ঋষিগণ ‘‘মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ……..’’ মন্ত্রে বন্দনা করে বসুন্ধরার মধুময় পরিবেশকে রক্ষা অর্থাৎ পূজা করতে শিখিয়েছিলেন। পূজা শব্দের অর্থ সম্বর্দ্ধনা। যেমন যেমন আচরণে পরিবেশের অজৈব উপাদানসমূহকে রক্ষা করে সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া যায় তাই ছিল আর্য্য ভারতের পূজা, যজ্ঞ, হোমের তাৎপর্য্য। আমরা প্রবৃত্তি পরবশ হয়ে যাতে দুর্বৃত্ত না হই তারজন্য বার বার স্মরণ করিয়ে দিলেন ‘আত্মানং বিদ্ধি’—পরমপিতার সন্তান তুমি, নিজেকে জানো, নিজের প্রতিরূপ মনে করে পরিবেশকে বাঁচাও, নিজে বাঁচ। ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’—জীবনবিধ্বংসী আচরণ ত্যাগ করে জীবনবৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলো। ‘মা গৃধ’—লোভ করো না। সদাচার এবং বর্ণাশ্রম মেনে চলো। (সম্প্রতিকালে “করোনা ভাইরাস” সঙ্কটে সকলেই প্রাণ বাঁচাতে যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অভ্যস্ত হয়েছিল, তা’ প্রকৃত অর্থে ত্রি-স্তরীয় সদাচার-বিধির অন্তর্ভুক্ত না হলেও, শারীরিক সদাচার তো বটে!) পরিবেশকে সমৃদ্ধ করে নিজে সমৃদ্ধ হও। এই ছিল ভারতবর্ষের বিধি-বিন্যস্ত সমাজ সংগঠনের, ধর্মের, পূজার বাস্তব রূপ।
বেদ-উপনিষদ-গীতা, ঋষিগণ, মহাপুরুষগণ-এর নিদেশে কোথাও প্রচলিত পূজার নামে, অনিত্য বস্তুর উপাসনার নামে, হৈ-হুল্লোর করে পরিবেশ দূষণ করার অনুমোদন নেই। ব্যক্তি চরিত্র গঠনের নিমিত্ত সাধন-ভজন-আরাধনা বাদ দিয়ে যে তন্ত্রমতে আমরা পরিবেশ দূষণ করতে প্রতিমা পূজায় মেতে উঠি, সেই তন্ত্র-ই প্রতিমা পূজাকে ‘‘বাহ্যপূজা অধমাধম’’ বলে বর্ণনা করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও, ‘‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’’ ছন্দের ডালিতে প্রতিমা পূজার অসারতার বার্তা রেখে গেছেন।
বসুন্ধরা রক্ষার স্বার্থে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, এক বিপ্লব নিয়ে এলেন। ‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে, ধর্ম বলে জানিস তাকে। বাঁচা-বাড়ার মর্ম যা, ঠিকই জানিস ধর্ম তা। Upholding urge of existence is Dharmma.’……..ইত্যাদি বাণীর মাধ্যমে। অর্থাৎ তোমাকে ধার্মিক হতে হলে আগে পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির বাস্তব কর্মে ব্রতী হতে হবে।
বসুন্ধরার মৌলিক উপাদানসমূহকে পোষণ দিতে, রক্ষা করতে, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র যে আর্য্যসন্ধ্যার অনুশাসন অনুশীলন করতে বললেন তা’ও আমরা নানা অজুহাতে উপেক্ষা করে চলছি!
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আদর্শের অনুগামীদের নিত্য ইষ্টভৃতি করতে হয়। ইষ্টভৃতি মানে ইষ্ট কর্মের ভরণ। ইষ্টকর্ম মানে পূর্ত্তকর্ম—পরিবেশের বাস্তব সেবা। যা প্রকৃত ইষ্টভৃতির মন্ত্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। “…..ইষ্টভ্রাতৃভূতযজ্ঞৈস্তৃপ্যন্তু পারিপার্শ্বিকাঃ ।” এর সরলার্থ খুব সহজ। শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শ অনুযায়ী সদাচার এবং বর্ণাশ্রমানুগ জীবন বর্দ্ধনার বিধি মেনে সপারিপার্শ্বিক জীবনবৃদ্ধির পথে চলেন যিনি, এমন গুরুভাই-ই প্রকৃত ইষ্টভ্রাতা।–যাঁর আপদে-বিপদে সাধ্যানুগ সাহায্য করতে হবে। ভূত মানে,–ক্ষিতি, অপ্, মরুৎ, ব্যোম ও তেজ-আদি সৃষ্টি-প্রকরণের পঞ্চ-মহাভূত, যা পরিবেশের অজৈব উপাদান, যার সাহায্য ব্যতীত জৈব প্রাণপঙ্ক (protoplasm) বাঁচতে পারে না। সেগুলোকে প্রাণ পণ করে রক্ষা করতে হবে। প্রতিনিয়ত এই শপথ মেনে চলার নাম ইষ্টভৃতি। অতএব প্রতিটি আমি যদি প্রকৃত ইষ্টভৃতি মহাযজ্ঞের যাজ্ঞিক হবার শপথ পালন করেন তাহলেই অনেকাংশে রক্ষা করা যাবে সুজলা-সুফলা-মলয়জ-শীতল বসুন্ধরাকে।
বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রদত্ত ‘পঞ্চবর্হি’ এবং ‘সপ্তার্চ্চি’-র অনুশাসনের বিধি মেনে চলতে পারলে প্রতিরোধ করা যাবে আধিদৈবিক, আধিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক নামের ত্রিতাপ জ্বালার চোখ রাঙানিকে। এজন্য অনিত্য বস্তুর উপাসনাকে এড়িয়ে বা পাশ কাটিয়ে, নিত্যবস্তুর উপাসনাকে পাথেয় করতে হবে। সবাই ভালো থাকুন অন্তর্দেবতা পরমপিতার পরমাত্মিক শক্তির সাহচর্যে। বন্দে পুরুষোত্তমম্!
[ভালোই সব চলছিল। সৎসঙ্গ নিয়ে বেশ আনন্দেই ছিলাম। হঠাৎ তালটা যেন কেটে গেল। দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রম থেকে প্রকাশিত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র লিখিত ‘সত্যানুসরণ’ নামক গ্রন্থের ৪৫তম সংস্করণের ৬৫তম পাতার প্রথম অনুচ্ছেদের বাণীর উপদেশটা আমাকে বেশ বিপাকে ফেলে দিয়েছে। আমার নাম দিবাকর বৈদ্য। আমি অকপটে সব ‘খ্যাপন’ করলাম। দয়া করে আমার কথাগুলো একটু শুনবেন। বলা যায় না, আপনাদেরও কাজে লেগে যেতে পারে।]
* * *
একজন দাদা, নাম অনিমেষ চৌধুরী। দেখা হলেই ‘জয়গুরু’ দিয়ে সম্ভাষণ করেন। ভালো-মন্দ খোঁজখবর নেন। মাঝে-মাঝে ঠাকুরের কথা বলেন। বাড়িতে যেতে বলেন। একদিন সন্ধ্যা-প্রার্থনার আগে ওঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, ওনার বাড়ীতেই না-হয় আজকের প্রার্থনাটা করে নেব। উনি দু’জন মা’কে নিয়ে বসে তখন ধ্যান করছিলেন। পরে জেনেছিলাম ওই দু-জনা ছিলেন ওঁর স্ত্রী ও কন্যা। সামনে ঠাকুরের একটা মাত্র প্রতিকৃতি। আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে বসতে বললেন। অনিচ্ছা সত্বেও বসলাম। ‘অনিচ্ছা সত্বেও’ কথাটা বলতে বাধ্য হলাম, কারণ, ওনার বাড়িতে ঠাকুরের ফটো ছাড়া জগজ্জননী বড়মা, শ্রীশ্রীবড়দা, শ্রীশ্রীদাদা, বর্তমান আচার্য্যদেব পূজ্যপাদ বাবাইদা, পূজ্যপাদ অবিনবাবু-দের কোন ছবি নেই। যা’— কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। ‘আচার্য্য-পরম্পরাকে’ যে বা যারা মানে না, তারা ‘ইষ্টদ্রোহী’, আমি তাদের সঙ্গ সবসময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। তেমন শিক্ষাই পেয়েছি আমাদের ঋত্বিক দাদাদের কাছ থেকে। নতুন পরিচয়, তাই আগে থেকে বুঝতে পারিনি, যে দাদাটি ইষ্টদ্রোহী। আচার্য্য-পরম্পরা মানে না। মনে যাইহোক, ভদ্রতার খাতিরে মুখে বললাম, দাদা, সময় তো পার হয়ে গেল, প্রার্থনা করবেন না।
—‘এই তো করবো।’ বলেই উঠে দাঁড়ালেন।
পাশে বসে থাকা মায়েদের দিকে ইশারা করতেই শঙ্খধ্বনি, হুলুধ্বনি বেজে উঠল। অমনি দাদাটি ডান হাতটি উপরে তুলে, বাম হাতটিকে ঝুলন্ত রেখে কি-সব বলতে লাগল। সবটা মনে নেই। তবে প্রথমদিকের শব্দগুলো— তমসার পার অচ্ছেদ্যবর্ণ মহান পুরুষ … গোছের এইরকম কিছু। (যা আমাদের উপাসনা বইতে লেখা আছে দেখেছি।) তারপর প্রার্থনা শুরু করলেন। প্রথম দুটো বিনতির পর ‘গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু’ না করে আবার কীসব বলতে শুরু করলেন। বাংলা আর সংস্কৃতে। তারপর শুরু করলেন ‘গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু’। তারপর আবার কতগুলো সংস্কৃত মন্ত্র আওড়াতে লাগলেন।—যা আমি কোনদিন কোন সৎসঙ্গ অধিবেশনে করতে দেখিনি। আমার ধৈর্য্যের, রাগের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল। তবুও কৌতুহল বশে নিজেকে সংযত করে নিলাম। ওনার মনগড়া প্রার্থনা শেষে আমাকে সত্যানুসরণ-এর একটি নির্দিষ্ট অংশ থেকে পাঠ করতে বললেন, আমি পাঠ করলাম—‘‘কোন-কিছু ‘আজ বুঝেছি আবার কাল বুঝা যায় না—হেঁয়ালি’ ইত্যাদি ব’লে শৃগাল সেজো না—কারণ, ইতর জন্তুরাও যা’ বোঝে তা’ ভোলে না। তাই, এই প্রকার বলাটাই দুষ্ট বা অস্থির-বুদ্ধির পরিচায়ক।’’
আমার পড়া শেষ হতেই উনি ‘চলার সাথী’ গ্রন্থ থেকে ‘সন্ধ্যা ও প্রার্থনা’ অংশটি পাঠ করলেন। পাঠ শেষ করে আমাকে একটা কীর্তন করতে বললে, আমি কিছুটা অনিচ্ছা সত্বেও ‘জয় রাধে রাধে’ কীর্তনটা করলাম। কীর্তনটা শেষ হলে উনি আমার খুব প্রশংসা করে বললেন, খুব ভাল লাগল তোমার কীর্তন,—‘ছাড়োরে মন কপট চাতুরি, বদনে বলো হরি হরি!’—কি অপূর্ব কথা! তাই না ভাই ?—তারপর যেন অনেকটা আক্ষেপের সুরেই বললেন, ‘কোথায় আর পারলাম কপটতা ত্যাগ করে ধর্মরাজ্যে প্রবেশ করতে!’ —ঠিক আছে! তাহলে ধ্বনি দিয়ে দি। কি বলো?
আমার সম্মতি পেয়ে উনি ‘বন্দে পুরুষোত্তমম্! বন্দে আর্য্য পিতৃন! বন্দে মাতৃবর্গান্! বন্দেহংকৃষ্টি দৈবতান্!— ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে প্রার্থনা-পর্বের ইতি টানলেন। বড়মা এবং আচার্য্যদেব-দের নামে কোন ধ্বনি দিলেন না। আমার মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। —এ তো অন্যায়! অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়াও তো অন্যায়। তাই আমি সহ্য করতে না পেরে বলেই বসলাম,—দাদা! আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি ?
—অনায়াসে করতে পার।
—আপনি চলার সাথী থেকে ‘সন্ধ্যা ও প্রার্থনা’-র বাণীটা পড়লেন, অথচ আপনি প্রার্থনার সময়সূচী মেনে প্রার্থনাটা করলেন না। আর প্রার্থনাটাকেও বিকৃত করে করলেন। যেগুলো ঠাকুর করতে মানা করে গেছেন। আর একটা কথা, আপনি আপনার বাড়ীতে শ্রীশ্রীবড়মা, শ্রীশ্রীবড়দা, শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব, পূজনীয় বাবাইবাবা, পূজনীয় অবিনবাবুদের কোন ছবি রাখেন নি, তাঁদের নামে কোন ধ্বনিও দিলেন না!—কেন, জানতে পারি কি?
আমার কথা শুনে হা-হা করে হেসে উঠে বললেন, তোমার কথাটা ঠিক সোনার পাথরবাটির মত হয়ে গেল না-কি?
—তার মানে?
—তার মানে হলো এই, শ্রীশ্রীঠাকুর চলার সাথী গ্রন্থে ‘সন্ধ্যা ও প্রার্থনা’ শিরোনামে যে বাণীটি লিপিবদ্ধ করেছেন, তার মধ্যে তিনি তাঁর রচিত ‘আর্য্যসন্ধ্যা’ ও ‘প্রার্থনা’-র কথা বলেছেন। উক্ত প্রার্থনার অস্তিত্ব যেখানে বিলুপ্ত করা হয়েছে, সেখানে প্রার্থনা না করে প্রার্থনার-সময়সূচী দিয়ে কি হবে? আর ইষ্টাসনে সদগুরু ছাড়া অন্যান্য ছবি রাখতে গেলে তো সত্যানুসরণ থেকে ‘‘গুরুই ভগবানের সাকার মূর্ত্তি, আর তিনিই Absolute (অখণ্ড)।’’—লেখাটি বাদ দিতে হবে।
—প্রার্থনার অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা হয়েছে মানে!— আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? দেওঘরে, অসংখ্য কেন্দ্র-মন্দিরগুলোতে সকাল-সন্ধ্যায় তাহলে কি করা হয়?
—যা করা হয় সেগুলো শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র রচিত এবং নিদেশিত প্রার্থনা নয়। তুমি এ বিষয়ে যদি জানতে চাও, প্রার্থনা বিষয়ক প্রামাণ্য গ্রন্থ ঋত্বিগাচার্য্য প্রণীত ‘অনুসৃতি’ এবং ‘সৎসঙ্গ পাব্লিশিং প্রকাশিত ‘প্রার্থনা’ শিরোনামের গ্রন্থটি ভাল করে পড়ে নিও।
—দেখুন ওসব পড়ার আমার দরকার নেই। ওসব এখন অচল। আমরা আচার্য্যদেবের নির্দেশে ‘উপাসনা’ বইটাকে মেনে চলি। উপাসনা বইয়ের প্রথমেই লেখা আছে ১৯৬৫ সালে শ্রীশ্রীঠাকুর ওসব বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন।
আমার কথা শুনে দাদাটি ‘হো-হো’ করে আবার পাগলের মত হেসে উঠে বলল, তোমার কথার উত্তরটা ঠাকুর সত্যানুসরণের ৬৫ সংখ্যক পাতায় দিয়েছেন, যেটা আজকে তুমি পাঠ করলে। আমার প্রতি রাগ না করে, বাড়িতে গিয়ে বাণীটা ভাল করে বোঝার চেষ্টা করবে।
যাইহোক, লোকটার ব্যবহারে আন্তরিকতার সুর ছিল। ফেরার সময় আমাকে ৫টা ফল এবং কিছু ভ্রাতৃভোজ্যও দেয়। আমি স্থান ত্যাগ করে বাড়ি না ফিরে আমাদের কেন্দ্র-মন্দিরে চলে যাই। এ বিষয়ে একটা হেস্তনেস্ত করার জন্য। ভাগ্য ভাল, দেখা পেয়ে যাই বিভাস সরকারদার। প্রবীণ ঋত্বিক-দেবতা। ঠাকুর দেখা মানুষ, আচার্য্যদেবের কাছের লোক, তাঁর কাছে গিয়ে ঘটনাটা খুলে বলি। তিনি সব শুনে বললেন, ঠিক আছে তুমি বাড়ি চলে যাও, দেখি কি করা যায়।
* * *
তারপর বেশিদিন কাটেনি। বিভাসদার সাথে সৎসঙ্গ সেরে ফিরছিলাম। ভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে যায় অনিমেষদার সাথে। আমি বিভাসদার সাথে অনিমেষদার পরিচয় করিয়ে দিলে, বিভাসদা অনিমেষদাকে বলেন আপনি আমাদের গুরুভাই অথচ মন্দিরে আপনাকে দেখি না, কি ব্যাপার?
—‘আমি কি ওখানে ভণ্ডামি করতে যাব?’ অনিমেষদার অনভিপ্রেত উত্তর শুনে বিভাসদা বলেন—ভণ্ডামি বলছেন কেন, আমরা কি ওখানে ভণ্ডামি করছি?
—ওটা আমার কথা নয়, ঠাকুরের কথা।
—ঠাকুরের কথা! প্রমাণ দিতে পারবেন?
—অবশ্যই। তবে রাস্তায় নয় বাড়িতে চলুন, ঠাকুরের বই খুলে প্রমাণ দেব।
—দেখুন, এখন তো আপনার বাড়িতে যাওয়া সম্ভব না, বরং কাল সকালে প্রেয়ারের আগে মন্দিরে আসুন, প্রেয়ারের পর না হয় যুক্তিতর্ক করা যাবে।
—দেখুন, মনে কিছু করবেন না, আবার আমাকে অপ্রিয় কথা বলতে বাধ্য করলেন।
—এমন কি বললাম, যাতে আপনাকে অপ্রিয় কথা বলতে হবে?
—ওই যে প্রেয়ারের কথা বললেন না, আপনারা কি প্রেয়ার করেন, যে প্রেয়ার করতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন!
—এ আপনি কি বলছেন! দেওঘর থেকে নির্ধারিত প্রেয়ারের সময়সূচী মেনে রীতিমত মাইকের মাধ্যমে আমাদের মন্দিরে প্রেয়ার করা হয়, আপনি বলছেন, আমরা প্রেয়ার করি না! আপনি প্রমাণ করতে পারবেন তো?
—অবশ্যই।
—তাহলে কাল আসুন আপনার প্রমাণপত্র সব নিয়ে।
* * *
মন্দিরের কাছে বাড়ী হবার সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই মন্দিরে গিয়ে সকালের প্রার্থনাটা করি। সেদিন প্রার্থনা শেষে দেখি অনিমেষদা এসেছেন। বিভাসদা ওনাকে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
এবার বলুন আপনার বক্তব্য। ঠাকুরের বলা অনুযায়ী আমারা যে ভণ্ডামি করছি, প্রেয়ার করছি না, প্রমাণ করে দেখান।
অনিমেষদা সত্যানুসরণ গ্রন্থটি বের করে বলেন, আপনারা এই বইটিকে যদি মানেন, তাহলে দেখুন ৩১ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ‘‘গুরুই ভগবানের সাকার মূর্ত্তি, আর তিনিই Absolute (অখণ্ড)।’’ আবার ৫৭ পৃষ্ঠায় ঠাকুর আত্ম-প্রচারকদের ভণ্ড বলেছেন।
—ঠাকুর, আত্ম-প্রচারকদের ভণ্ড বলেছেন, আমরা তো আর আত্ম-প্রচারক নই!
—গুরুর পাশে শিষ্যদের ছবি রেখে প্রচার করা কি সত্য প্রচারের নামে আত্ম-প্রচার করা নয়?— আপনারা প্রার্থনার নামে দয়ালবাগ সৎসঙ্গের যে বিনতি করেন, সেই বিনতিতে বলেন :
“তুম্ বিন কোই সমরথ নহী জাসে মাঁগু দানা”
“রাধাস্বামী গুরু সমরথ তুম বিনা আউর্ ন দুসরা ।”
আবার শঙ্করাচার্য্য রচিত গুরু বন্দনায় বলি—
“গুরোঃ পরতরং নাস্তি…..”
“কেবলং জ্ঞানমূর্ত্তিম্ ।”
ওই মন্ত্রগুলো একমাত্র গুরুকে উদ্দেশ্য করেই যদি বলা হয়ে থাকে তাহলে গুরুর আসনের পাশে কি গুরুর শিষ্যদের ছবি রাখা যায়? একটা প্রাইমারি স্কুলেও হেড্ স্যরের চেয়ারের একটা আলাদা মর্যাদা থাকে, আপনারা দাদা-প্রীতির নামে সে মর্যাদাটুকুও ক্ষুণ্ণ করে চলেছেন, এগুলোকে কি আত্মপ্রচার বলে না?
বিভাসদাকে নিরুত্তর থাকতে দেখে অনিমেষদা বললেন, আপনারা যারা ঠাকুরের সাথে ঠাকুরের শিষ্যদের প্রচার করতে গিয়ে তাদের প্রতিকৃতিরও পূজা করছেন, তা ভণ্ডামি নয় কি? এই গেল ভণ্ডামির উত্তর। এরপর রয়েছে প্রেয়ার। এই দেখুন সৎসঙ্গ পাব্লিশিং প্রকাশিত ২ খানি গ্রন্থ। এটি শ্রীশ্রীঠাকুরের ইংরেজী ভাষায় লিখিত ‘লর্ডস্ প্রেয়ার’। ভাল করে দেখে বলুন তো এই প্রেয়ার আপনারা করেন কি-না?’
বিভাসদা বইটা নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, ‘না করি না’।
—‘তাহলে দেখুন ‘প্রেয়ার’ না করেই মিথ্যা প্রেয়ারের গর্ব করে চলেছেন। ঠাকুরের ভাষায় এর নাম দ্বন্দ্বীবৃত্তি। সবচাইতে বড় পাপ। ঠিক আছে, ইংরেজীর কথা বাদই না হয় দিলাম, বাংলা ভাষায় ঠাকুরের লেখা ‘প্রার্থনা’ নামে একটা বই আছে এবং সেই বইটাও সৎসঙ্গ পাব্লিশিং থেকে প্রকাশিত। প্রথম প্রকাশ ১৯৪৯ সালে। ভাল করে দেখুন তো, এই বইয়ের কোন নির্দেশ মেনে আপনারা প্রার্থনা করেন কি-না?’
বিভাসদা বইটা ভাল করে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, ‘না, করি না’।—তবে এই প্রার্থনা করতে তো ঠাকুরই নিষেধ করে গেছেন ১৯৬৫ সালে, উপাসনা বইতে যা স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে।
—মনে কিছু করবেন না দাদা, যাকে আমরা ঠাকুর বলে মানি, সেই তিনিই যদি তাঁর রচিত প্রার্থনা করতে নিষেধ করেন, তাহলে তাঁর নাম করে দীক্ষার সঞ্চারণা করাও তো আর একটা ভণ্ডামি! কোন সাবজেক্ট নেই, সিলেবাস নেই অথচ ধরে ধরে এনে ছাত্র ভর্তি! কোন বুদ্ধিমান মানুষ কি মেনে নেবেন? আপনি যদি সত্যি-সত্যিই নিজেকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্য বলে মনে করেন তাহলে একটা কাজ অবশ্যই করা উচিত, আপনাদের আচার্য্যদেবকে বলে সত্যানুসরণ থেকে ‘‘কোন-কিছু ‘আজ বুঝেছি আবার কাল বুঝা যায় না—হেঁয়ালি’ ইত্যাদি ব’লে শৃগাল সেজো না—কারণ, ইতর জন্তুরাও যা’ বোঝে তা’ ভোলে না। তাই, এই প্রকার বলাটাই দুষ্ট বা অস্থির-বুদ্ধির পরিচায়ক।’’ এই অংশটা বাদ দিতে বলে বলে দিন।
—কেন, প্রার্থনার সাথে সত্যানুসরণের বাণীর সম্পর্ক কি?
—কারণ, পুরুষোত্তম যদি অভ্রান্ত হয়েই থাকেন, তাঁর নিদেশিত কোন বিধির পরিবর্তন তিনি কখনোই করেন না, কেউ করুক, তা-ও তিনি অনুমোদন করেন না, এমনকি কাউকে পরিবর্তন করার অধিকারও দেন না। তাই তিনি সত্যানুসরণের ওই বাণীতে বললেন, ‘ইতর জন্তুরাও যা’ বোঝে তা’ ভোলে না।’ তাই আমার তো মনে হয়, ঠাকুর তাহলে ভুল করে ওই বাণীটা দিয়েছিলেন, না হলে আপনারা তাঁর রচিত এবং নিদেশিত আহ্বানী, সন্ধ্যা ও প্রার্থনা-র সবটা বাদ দিয়ে, তাঁর নিদেশকে অমান্য করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারতেন না!
—দেখুন, আপনি আমাদের যতই যুক্তি দেখান, আমাদের ভোলাতে পারবেন না। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, আপনারা ঠাকুরের নির্দেশের আচার্য্য-পরম্পরা মানেন না। সে আপনারা না মানুন, আমরা কিন্তু আচার্য্যদেবের নির্দেশের বাইরে এক পা-ও চলতে রাজী নই।
—খুব ভাল কথা, আপনি আমাকে বললেন, ‘‘আপনারা ঠাকুরের নির্দেশের আচার্য্য-পরম্পরা মানেন না।’’ একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো, আপনারা উপাসনা, অধিবেশন বা সৎসঙ্গ করার সময় আসনে আচার্য্য-পরম্পরার নামে বা অজুহাতে যাঁদের প্রতিকৃতি রাখেন, তাঁদের দেওয়া কোন প্রার্থনা, উপাসনা করেন কি?—অতএব আপনারা যে পদ্ধতিতে আচার্য্য-পরম্পরা মেনে চলছেন, ওইভাবে মেনে চলার কথা ঠাকুর কোথায় বলেছেন, তাঁর বলা প্রামাণ্য শ্রুতিবাণী থেকে প্রমাণ দেখাতে পারবেন?
কেন জানি বিভাসদা কোন উত্তর দিতে পারলেন না দেখে অনিমেষদা বললেন, অভিধান মতে আচরণসিদ্ধ ব্যক্তিকেই ‘আচার্য্য’ বলে। যিনি যে বিষয়ের আচার্য্য হবেন, তাঁকে সে বিষয়ে আচরণসিদ্ধ হতে হবে। যেমন, আমরা নিউটন, আর্কিমিডিস, আইনস্টাইন প্রমুখ বিজ্ঞান-আচার্য্যদের কেউ দেখিনি। তাঁরা বিগত হবার পর তাঁদের আবিষ্কৃত সূত্র বা জ্ঞানের সাথে পরিচিত হই তাঁদের লিখে রাখা বইয়ের মাধ্যমে, তাঁদের বংশধরদের মাধ্যমে নয়। সেই বইগুলো বাজারে সহজলভ্য হলেও আমরা বই পড়ে সেগুলো নিজে নিজে আয়ত্ব করতে পারি না বলেই শিক্ষকদের মাধ্যমে শিখতে হয়। এবার কোন শিক্ষক যদি ওই বিজ্ঞান-আচার্য্যদের মূল সূত্রগুলো বাদ দিয়ে ভুল শেখাতে শুরু করেন এবং প্রতিপত্তির জোরে বংশানুক্রমিকভাবে জ্যেষ্ঠ-সন্তান-পরম্পরা চালাতে থাকে, মূলসূত্র জানা কোন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছাত্র কি তা মেনে নেবেন?
—তা কি করে হয়!
—তাই যদি না হয়, তাহলে আপনারা কোন্ হিসেবে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মূলসূত্র অর্থাৎ আদর্শকে সযত্নে পরিহার করা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ সন্তান পূজনীয় অমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং পরবর্তী বংশানুক্রমিকভাবে জ্যেষ্ঠ-সন্তান-পরম্পরাদের ছবি পুজো করতে শুরু করেছেন? এঁরা কিসের আচার্য্য এবং কোন্ আচরণ দ্বারা আপনাদের শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আদর্শ বিষয়ে শিক্ষিত করেছেন বা করছেন?
—দেখুন কিসের সাথে কিসের তুলনা করছেন? আমাদের দেশে আচার্য্য প্রথা কুলগুরু প্রথা কি চালু নেই?
—আপনি যখন বলছেন, থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু ঠাকুর এ বিষয়ে কোন বাণীতে কি বলে গেছেন, সে সম্পর্কে যদি কিছু জানা থাকে বলুন।
—না, ওগুলো আমার শোনা কথা, কোন বাণীতে কি বলে গেছেন তা বলতে পারব না। তবে—
“ইষ্টগুরু পুরুষোত্তম
প্রতীক গুরু বংশধর,
রেতঃ শরীরে সুপ্ত থেকে
জ্যান্ত তিনি নিরন্তর।”
এই বাণীটা যদি ঠাকুরের দেওয়া হয় তাহলে বংশধররা কি প্রতীক-গুরু নয়?
—অবশ্যই। তাহলে তো আপনাদের আচার্য্যদেবদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে যে!
—তার মানে?
—তার মানে অতি সহজ। অবতার-তত্ত্বের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। কারণ রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, যীশুখ্রীস্ট, হজরত মহম্মদ, চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণদেব-দের রেত-শরীরের সাথে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কি কোন সম্পর্ক আছে?
—তা’ কি করে থাকবে! তাছাড়া চৈতন্যদেব ও রামকৃষ্ণদেবের তো কোন সন্তানই ছিল না।
—ঠিক তাই। তাহলে চৈতন্যদেবের পূর্ববর্তী পুরুষোত্তম যিনি ছিলেন বলে আপনার মনে হয়, তাঁর সর্বশেষ বংশধরদের মধ্যে প্রতীক গুরু খুঁজে দীক্ষা নিয়ে ধর্ম পালন করা উচিত। তাই নয় কি? তা করতে পারা কি আপনাদের দ্বারা সম্ভব হবে?
বিভাসদাকে নিরুত্তর থাকতে দেখে অনিমেষদা বলেন, তা যদি না হয়, তাহলে ওই বাণীর উপর ভিত্তি করে আচার্য্য-পরম্পরার নামে কুলগুরুগিরির ব্যবসা চালানো থেকে অবিলম্বে বিরত হওয়া উচিত।
শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শ অনুসারে পিতা থেকে পুত্র জন্মায়। পুত্র, পিতার অছি (trustee) মাত্র। যে পুত্র পিতার অছি-কে বহন করে সমৃদ্ধ করে তাকেই পিতার আদর্শ পুত্র বলবে সবাই। তাই বলে পুত্র কখনো পিতা হতে পারে না। তাই যদি হতো বিশ্বশ্রবা ঋষির পুত্র বিভীষণকে আদর্শ পুত্র না বলে রাবনকে তো বলতে পারতেন শ্রীশ্রীঠাকুর। আপনারা ওই বাণীকে ভিত্তি করে, ঠাকুরের মূল আদর্শ বাদ দিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে জ্যেষ্ঠ-সন্তান-পরম্পরার চতুর্থ পুরুষকে পর্যন্ত ঠাকুর বানিয়ে ছেড়েছেন। অথচ ঠাকুরের প্রথম বংশধরদের মধ্যে একমাত্র জীবিত সন্তান—পূজনীয় কাজলদাকে বংশধর বলে গণ্য করছেন না। আপনারা সত্যিই যদি উপরের ওই বাণীকে মর্যাদা দিতেন তাহলে সর্বাগ্রে তাঁর পুত্রকে কীলকেন্দ্রে বসাতেন। যুক্তিসঙ্গত যা’, তা’ না করে আপনারা মনগড়া আচার্য্য-পরম্পরায় মেতে উঠে সৎসঙ্গের মূল আচার্য্যের অনুশাসনকে নিকেশ করে দিলেন! ইতিহাস কি আপনাদের কোনদিন ক্ষমা করবে?
শাস্ত্রের ব্যাখ্যা অনুযায়ী পরাবিদ্যায় আচরণসিদ্ধ ব্রহ্মজ্ঞ ইষ্টগুরুকে আচার্য্য এবং অপরাবিদ্যায় আচরণসিদ্ধ শিক্ষাগুরুকে উপাচার্য্য বলা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের কৃপাচার্য্য, দ্রোণাচার্য্য, ধৌম্য নামে তিনজন উপ-আচার্য্য থাকা সত্বেও পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণকে আচার্য্য পদে বরণ না করা পর্য্যন্ত তিনি দুর্বলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন নি। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রও পূর্ববর্তী পুরুষোত্তমদের আচার্য্য হিসেবে মেনে চলতেন। এবং মেনে চলতে বলেছেন। তাঁর বলা অনুযায়ী—
সত্তার মূলই হ’ল আত্মা,
আর, এই আত্ম-সমীক্ষুই আত্মবিৎ—
আর, তিনিই আচার্য্য ;
তদন্বিতবৃত্তি ও তৎসমাহিতচিত্ত যিনি—
তিনিই বোধ করেন তাঁ’কে অখণ্ড সচ্চিদানন্দ—
আত্মার মূর্ত্ত প্রতীক। ৩৩১ । (সম্বিতী)
পুরুষোত্তম আসেন যখন
ইষ্ট, আচার্য্য তিনিই গুরু,
তিনি সবার জীবন-দাঁড়া
তিনিই সবার জীবন-মেরু।
তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর ওই নিদেশ অমান্য করা শুরু হয়েছিল বলেই তিনি অমান্যকারীদের উদ্দেশ্যে বাণী দিয়ে বললেন—
আচার্য্য ছেড়ে আচার্য্য ধরলি
মূর্খতাতে দিলি পা,
জ্ঞানের বুকে মারলি ছুরি
লাভ হ’ল তোর ধৃষ্টতা।
আর কুলগুরু অর্থাৎ কৌলগুরু-পরম্পরার কথা যদি বলেন, তাহলে শুনুন—আর্য্যকৃষ্টির রক্ষক সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত রঘুবংশের কৌলগুরু ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠদেব শ্রীরামচন্দ্রকে ‘‘ওঁ নারায়ণঃ পরাবেদা নারায়ণঃ পরাক্ষরঃ।/নারায়ণঃ পরামুক্তি নারায়ণঃ পরাগতিঃ॥’’ মন্ত্রে স্বস্তিবাচন করার সময় শ্রীরামচন্দ্রের মধ্যে পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণকে উপলব্ধি করলে তিনি নারায়ণের পরিবর্তে রামচন্দ্র শব্দ বসিয়ে মন্ত্রটিকে পরিমার্জিত করেন। নররূপী নারায়ণ পুরুষোত্তম রামচন্দ্রকে কেন্দ্র করে সবাইকে ধর্ম পালন করতে উদ্বুদ্ধ করলেন। এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—-গুরু মানেই সদগুরু–আচার্য্য। গুরু-পুরুষোত্তমই সচ্চিদানন্দের মূর্ত্ত বিগ্রহ, তিনিই রূপায়িত ঈশ্বর প্রেরণা, তিনিই আত্মিক শক্তির প্রোজ্জ্বল প্রকাশ, অস্তিবৃদ্ধির পরম অমৃতপথ। দুনিয়ার যত দ্বন্দ্বের মাঝে অন্বয়ী সার্থকতার সারকেন্দ্র তিনিই। তাঁকে ভালবেসে, তাঁর ইচ্ছা পরিপূরণ ক’রে, তদনুগ আত্মনিয়ন্ত্রণে, তাঁরই সঙ্গ, সাহচর্য্য ও সেবার ভিতর-দিয়ে মানুষ ঈশীস্পর্শ লাভে ধন্য হয়। আর গুরু-পুরুষোত্তমকে direct (সরাসরি) যারা না পায়, তারা তঁদনুবর্ত্তী আচার্য্য-পরম্পরার ভিতর দিয়ে তাঁর ভাবটাই কিছু না কিছু পায়।…….. (আঃ প্রঃ ১/৪. ১২. ১৯৪১)
তাঁর অবর্তমানে তাঁর আদর্শের ধারার প্রবহমানতা রক্ষা করার জন্য তঁদনুবর্ত্তী আচার্য্য-পরম্পরা বজায় রাখতে আচার্য্য হবার যোগ্যতাও নির্ধারণ করে বাণী দিলেন।
‘‘চরিত্র ও চর্য্যার
নিষ্ঠা-বিনায়িত ইষ্টার্থবাহী
বাস্তব সঙ্গতিশীল
সার্থক অনুচলন যা’র নাই—
বাক্য ও ব্যবহারে উদ্ভিন্ন হ’য়ে,—
সে কিন্তু আচার্য্য হ’তে পারে না ;
আচার্য্য হওয়ার ন্যূনতম ভূমিই এই। ১৯ ।’’ (আদর্শ-বিনায়ক)
উপরোক্ত বাণীতে কোথাও কি তাঁর বংশধরদের কথা, জ্যেষ্ঠ-পরম্পরার কথা উল্লেখ করেছেন? তথাপি ওই নিদেশ-বাণীকে যদি আপনাদের আচার্য্যদেব মানতেন এবং সব্বাইকে মানাতে উৎসাহিত করতেন, তাহলে সৎসঙ্গের নীতি ও আদর্শ নিয়ে এত দলাদলি, ভেদাভেদ হবার কোন সুযোগই থাকত না। তাঁরা যদি তাঁদের মধ্যে ঠাকুরত্বকে জাগ্রত রাখার সদিচ্ছা পোষণ করতেন, তাহলে ইষ্টগুরু পুরুষোত্তম প্রদত্ত নিত্যকর্মের আবশ্যিক অনুশাসন, যেমন আহ্বানী, আচমণ, পুরুষোত্তম বন্দনা, আর্য্য-সন্ধ্যা, পঞ্চবর্হিঃ ও সপ্তার্চ্চিঃ মন্ত্রগুলো প্রার্থনা থেকে বাদ দিয়ে ‘প্রার্থনা-সময়সূচী’-র প্রচার করে নিত্য প্রার্থনা নামের পরাকাষ্ঠা দেখাতেন না। ঠাকুরের রচিত ইষ্টভৃতির মন্ত্র “ইষ্টভৃতির্ময়াদেব কৃতা প্রীতৈ তব প্রভো। ইষ্টভ্রাতৃভূতযজ্ঞৈস্তৃপ্যন্তু পারিপার্শ্বিকাঃ॥” বাদ দিয়ে অন্য মন্ত্র চালু করা হতো না! এ বিষয়েও তিনি আমাদের সচেতন করে দিতে বলে গেছেন—
ওই বাণী অনুসারে আপনারা জঘন্য পথে চলছেন চলুন। তাই বলে আমাকেও কি চলতে হবে? দেখুন দাদা, ঠাকুরের বলা বাণীকে অমান্য করে, ঠাকুর-বিরোধী চলনে চলার অধিকার আপনার বা আপনাদের যেমন আছে, তেমনি মান্য করার অধিকার তো আমার থাকা উচিত। তাই আমার একটা অনুরোধ আপনাদের বিচারে কোন গোষ্ঠীদ্বারা ঘোষিত বা নির্বাচিত আচার্য্যদেব(গণ) যদি সবই হয়, তাঁরাই যদি আপনাদের একমাত্র উপাস্য হয়, তাহলে শ্রীশ্রীঠাকুরের নাম না নিয়ে, তাঁর প্রতিকৃতি না রেখে, আপনাদের আচার্য্যদেবের প্রতিকৃতির উপাসনা করুন,—আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু ঠাকুরের নামে মন্দির করে, ঠাকুরবাড়ি নাম দিয়ে ঠাকুরের আদর্শবিরোধী চলনে চলতে দেখলে প্রতিবাদ হবেই। আমরা শ্রীশ্রীঠাকুরের কৃষ্টিসন্তান, আমাদের উপর তিনি কাতর আবেদনে কিছু দায়িত্ব দিয়ে গেছেন—
‘‘আর্য্যকৃষ্টির যা’ ব্যাঘাত
খড়্গে তোরা কর নিপাত।
ভণ্ড ঠগী দেখবে যেথায়
করো সামাল সবায়,
কেউ যেন না ঠকে পড়ে
ওদের ভাঁওতায়।’’
‘‘বড়খোকাই হো’ক—, মণিই হো’ক—বা কাজলই হো’ক— বা আপনারাই হোন— আপনাদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই আমি আশা করি যে আপনারা নিজেদের জীবনে ও চরিত্রে আমাকে বহন ক’রে নিয়ে বেড়াবেন এবং অন্যের কাছেও আমাকে পৌঁছে দেবেন—অবিকৃতভাবে, অবশ্য প্রত্যেকে তার বৈশিষ্ট অনুযায়ী। আর আমাকে বহন করা ও পৌঁছে দেওয়া মানে, আমার mission (আদর্শ ও উদ্দ্যেশ্য)-কে বহন করা ও পৌঁছে দেওয়া, আর আমার mission (আদর্শ ও উদ্দেশ্য) মানে সকলের mission (আদর্শ ও উদ্দেশ্য)। জীবনীয় প্রতিটি যা’-কিছুর ইষ্টানুগ সত্তাসম্বর্দ্বনাই আমার mission (আদর্শ ও উদ্দেশ্য)।’’ (আ. প্র. ৩/১৭. ১. ১৯৪২)
‘‘মানুষ, গোরু, পোকা-মাকড়, এমনকি একটা পিঁপড়া পর্য্যন্ত বাঁচতে চায়। মরতে চায় না কেউ। আমিও না। কিন্তু মানুষের শরীর চিরকাল থাকে না, এও ঠিক। তাই আমি বেঁচে থাকতে চাই আপনাদের মধ্যে। আপনারাই আমাকে ব’য়ে নিয়ে বেড়াবেন যুগ যুগ ধরে, ………….. আমাকে এইভাবে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আপনারা গ্রহণ করুন। নইলে আমার কথাগুলি প্রাণ পাবে না। সেগুলি শূন্যে হাহাকার করে ফিরবে।’’ (আ. প্র. খণ্ড ১৮, পৃঃ ২৫০)
এবার আমার প্রশ্ন, আপনাদের আচার্য্যদেব শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শ পালনের মৌলিক ব্যাপারটা তো বিকৃত করে রেখেছেনই, আদর্শ প্রচারের জন্য কি কি করেছেন?
—কেন, কত মন্দির তৈরি করেছেন, গণদীক্ষা দেওয়া চলছে।
— ঠিক বলেছেন, মন্দির অবশ্যই হয়েছে বা হচ্ছে তা’ কিন্তু ঠাকুরের ঈপ্সিত মন্দির নয়, আপনাদের আচার্যদেবদের ঈপ্সিত।
—এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত কোন প্রামাণ্য তথ্য দেখাতে পারবেন?
—তাহলে মনোযোগ দিয়ে শুনুন—মন্দির, শ্রীমন্দির ও সৎসঙ্গ বিহার-এর গঠনতন্ত্র প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেছেন—‘‘সব মন্দিরই শ্রীমন্দির। জায়গায় জায়গায় মন্দির বা সৎসঙ্গ বিহার ঠিক করা ভাল, যাতে লোকে meet (সাক্ষাৎ) করতে পারে। সেখান থেকে মানুষকে সবভাবে infuse (উদ্বুদ্ধ) করতে হবে। ধর্ম্ম কী, কৃষ্টি কী, সদাচার কী, বিবাহের নীতি কী, যোগ্যতার অনুশীলন কিভাবে করতে হয়, সেবানুচর্য্যার ভিতর দিয়ে সবাই পারস্পরিকভাবে সম্বন্ধান্বিত হয় কিভাবে ইত্যাদি কথা সেখান থেকে চারাতে হবে। মানুষকে practically educated (বাস্তবভাবে শিক্ষিত) করে তুলতে হবে। তাছাড়া মানুষের জন্য যতখানি যা করা যায় তাও বাস্তবভাবে করতে হবে মন্দিরগুলিকে কেন্দ্র করে। মন্দির থাকলে, ঋত্বিক থাকবে, dispensary (চিকিৎসাকেন্দ্র), হাসপাতাল, গবেষণাগার, তপোবনের শাখা ইত্যাদি থাকবে। হয়তো ঐ মন্দিরগুলিই এক একটা university (বিশ্ববিদ্যালয়) বা সর্ব্বতোমুখী শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।’’ (আলোচনা-প্রসঙ্গে, ২১ খণ্ড, পৃঃ ৩১, ৪ঠা বৈশাখ, ১৩৫৯, বৃহস্পতিবার, ইং ১৭-০৪-১৯৫২)
এই বইটাও কিন্তু আপনারা প্রকাশ করেছেন। এবার বলুন কি বলবেন, ঠাকুরের ঈপ্সিত মন্দির আপনারা কোথায় কোথায় করেছেন?
অনিমেষদার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারলেন না বিভাসদা।
তাই কিছুক্ষণ থেমে অনিমেষদাই বললেন, দেখুন দাদা, শ্রীশ্রীঠাকুর মূলতঃ মানবদেহটাকেই শ্রীবিগ্রহ মন্দির করে গড়ে তুলতে বলেছেন। আমাদের মনগড়া মন্দির-নির্মাণ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন—‘‘আমার নামে দেখবে অনেক মন্দির হবে | কিন্তু আমার ইচ্ছা করে তোমাদের হৃদয়টা, চলমান জীবনটা আমার জাগ্রত মন্দির হোক | এবং আমাকে তোমরা সর্বত্র বয়ে নিয়ে বেড়াও | ধর্ম মানুষের জীবনের মধ্যে না থাকলে, আচরণের মধ্যে না থাকলে, ধর্মসঙ্ঘ থাকা সত্ত্বেও ধর্ম লোপ পায় | এবার সে ব্যাপারটা ঘটতে দিও না | আমার কথাগুলি মনে রেখো | এবং আমার কথাগুলি পৃথিবীর লোকে যাতে জানতে পারে, সময়মত তার ব্যবস্থা ক’রে যেও | কে কখন উপযুক্ত লোক আসবে, ঠিক কি? তবে আমার কাজটা হ’লো ঈশ্বরকোটি পুরুষের কাজ | যুগে যুগে তারা আসে | ঈশ্বর ছাড়া আর কিছুই তাদের মজাতে পারে না |’’
‘‘আমি নগণ্য মানুষ, কিন্তু পরমপিতা আমাকে দিয়ে যা বলালেন, যা করালেন, মনুষ্যসমাজ তার উপর না দাঁড়ালে, সব জ্ঞানগুণ সত্ত্বেও পৃথিবী মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটির হাত থেকে রেহাই পাবে না। মানুষের সব শক্তি নিয়োজিত হবে সপরিবেশ আত্মহননে এবং জীবনের ভিত্তিভূমির ধ্বংসসাধনে। আমার বিশ্বাস, তোমরা যদি না কর, হয়ত বাইরের লোক এসে এ কাজ করবে। তোমরা যেই হও আর যাই হও না, বিকৃত হ’লে এ কাজ করবার অধিকার ও
যোগ্যতা হারিয়ে ফেলবে। কামিনী-কাঞ্চনাসক্ত কতকগুলি ওঁছা লোক তোমাদের কাছে ভীড় জমাবে এবং আত্মস্বার্থের জন্য পরস্পর শকুনের মত কামড়াকামড়ি করবে। সৎসঙ্গে একদিন বৃষ্টির জলের মত টাকাবৃষ্টি হবে। সেই দিনই সৎসঙ্গের বিপদের দিন। ঐশ্বর্য ও ক্ষমতায় মাথা ঠিক থাকে খুব কম লোকেরই। যারা মনে করে ঐশ্বর্য্য ও শক্তি পরমপিতার, তিনিই মালিক, আমি এর
অছিমাত্র, কাজলের ঘরে থাকা সত্ত্বেও তাদের গায়ে কালি লাগে না। নইলে মুস্কিল আছে।’’
‘স্মৃতি-তীর্থে’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ১০২-১০৫ থেকে নির্বাচিত বাণী।)
শ্রীশ্রীঠাকুরকে যদি মেনেই থাকেন তাহলে ঠাকুরের নিদেশ মেনে চলা উচিত। তাহলে কোন্ নিদেশ মেনে আপনাদের আচার্য্যদেব(গণ) ঠাকুরের নামে একের পর এক মন্দির নির্মাণ করে ইষ্ট প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে আত্ম প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন!—এর কি উত্তর দেবেন বলুন?
আর গণদীক্ষার কথা বলেছিলেন তো? তাহলে শুনুন—ঠাকুরের মতে, দীক্ষা হলো, কোন আদর্শকে সঞ্চারণা করার মাধ্যম। ঠাকুরের মূল আদর্শ—ঈশ্বর এক, ধর্ম এক, প্রেরিত-পুরুষ সেই এক-এরই বার্তাবাহী-র বার্তায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা। দীক্ষার মাধ্যমে নাম-ধ্যান, শবাসন, থানকুনি পাতা সেবন, সত্তাপোষণী নিরামিষ আহার গ্রহণ, পঞ্চবর্হিঃ এবং সপ্তার্চ্চিঃ-র অনুশাসন মেনে সদাচার এবং বর্ণাশ্রমানুগ জীবন যাপন বিষয়ে উপদেশ দান এবং নিয়মনাগুলো শিখিয়ে দেওয়া। ওই নিয়মনাকে স্বীকৃতি দান করার মাধ্যম হল ইষ্টভৃতি মহাযজ্ঞ পালন—যা দীক্ষাপত্রে উল্লেখ থাকে। এর জন্য কম করে ৩০ মিনিট সময় লাগা উচিত। অথচ গণদীক্ষার নামে যে ভাবে, যে হারে দীক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে তা নিয়ে একটা কর্মশালার মাধ্যমে সমীক্ষা চালালেই দেখা যাবে, তথাকথিত বেশিরভাগ দীক্ষিতগণ, ইষ্টাসনে একাধিক ফটো রেখে তার সামনে বসে বিনতি করা (যদিও তা’ সংখ্যায় নগণ্য), ইষ্টভৃতি এবং আচার্য্যভৃতির নামে পয়সা রাখা এবং মাস গেলে ‘উপযোজনা কেন্দ্রে’ পৌঁছে দেওয়া ভিন্ন কিছুই তারা জানে না।
শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবদ্দশায় একসাথে শতাধিক লোককে বসিয়ে দীক্ষা দান করার কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা জানা যায় নি। তৎকালিন ঋত্বিক দেবতারাও ছিলেন শ্রদ্ধা আকর্ষণী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তথাপিও শ্রীশ্রীঠাকুরকে আক্ষেপ করে বলতে হয়েছিল, —‘‘বৃত্তিতে তেল মালিশ করে বা স্বার্থপ্রত্যাশাকে উসকে দিয়ে মানুষকে দীক্ষিত করতে নেই। তা’তে মানুষ asset (সম্পদ) হয় না।’’ (আ. প্র. ৫ম খন্ড, ২৯. ১২. ১৯৪৩)
—‘‘দ্যাখেন, (বীরেন ভট্টাচার্য্যের প্রতি) আজকাল আপনারা কতলোক দীক্ষা দিচ্ছেন, কিন্তু তার বেশীরভাগই বাজারী। ……ধর্ম্ম বলতে আমি যে সর্ব্বতোমুখী সঙ্গতিশীল কেন্দ্রানুগ কর্ম্মময় সার্থক জীবনের কথা বলি, তা অনেকেরই মাথায় ঢোকে না। ভাবে, আমাকে দিয়ে পরকালের পথ করে নেবে। কিন্তু পরিবার, দেশ, সমাজ, জাতি ও জগতকে …..দুনিয়াটাকে স্বর্গ করে তুলবে সে কথা আর ভাবে না।’’ (আলোচনা প্রসঙ্গে ৩য় খণ্ড, ১৩ই চৈত্র, শনিবার, ১৩৪৮, ইং ২৮। ৩। ১৯৪২)
পরিবার, দেশ, সমাজ, জাতি ও জগতকে …..দুনিয়াটাকে স্বর্গ করে তোলার জন্য একদা দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রম থেকে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, আলোচনা পত্রিকার, মাঘ সংখ্যার, ১৫০ পৃষ্ঠা থেকে তার একটা ক্ষুদ্র চিত্র তুলে ধরছি।
“সৎসঙ্গের বর্তমান সর্বপ্রধান লক্ষ্যবস্তু হইল বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, দেশীয় ঔষধপত্র প্রস্তুতের রসায়ণাগার ও কারখানা, হাসপাতাল, প্রসূতিসদন, বালক-বালিকাদের শিক্ষার জন্য উচ্চ বিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র, কুটির-শিল্প ভবন, কৃষিপরীক্ষা-ক্ষেত্র প্রভৃতি স্থাপন পূর্বক পাবনার ন্যায় একটি আদর্শ পল্লী-উন্নযন কেন্দ্রের পুণঃ প্রতিষ্ঠা করা। প্রসঙ্গতঃ ইহা উল্লেখযোগ্য যে, অতীতের সেই পাবনা-সৎসঙ্গ পল্লী সংগঠনের উজ্জল আদর্শরূপে অদ্যাপি সারা ভারতে প্রসিদ্ধ হইয়া আছে. আর শুধুমাত্র বিহারেই নয়, পরন্তু ভারতের সকল প্রদেশেই এইরূপ আদর্শ কেন্দ্র স্থাপন করাই সৎসঙ্গের অভিলাষ।
শাণ্ডিল্য বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি আবাসিক পল্লী-বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন পূর্বক শ্রীশ্রীঠাকুরের পরিকল্পনাগুলির বাস্তব রূপায়নের উচ্চাকাঙ্খাও সৎসঙ্গ পোষণ করিয়া চলিয়াছে।……” (আলোচনা, মাঘ, ১৩৬৫/পৃঃ ১৫০)
উক্ত দলিল থেকে প্রাপ্ত সংবাদে এটুকু বোঝা গেল যে, পাবনার হিমাইতপুর আশ্রমে শ্রীশ্রীঠাকুর যথেষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে যে-সব কর্ম-প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তুলেছিলেন, তদনুরূপ কেন্দ্র ভারতের প্রতিটি প্রদেশে স্থাপন করা হবে। এবং একটি শাণ্ডিল্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে,—যা শ্রীশ্রীঠাকুরের এক অন্যতম ইচ্ছা।
এবার দেখে নেওয়া যাক পাবনার হিমাইতপুর-আশ্রমের কর্ম-প্রতিষ্ঠানসমূহের এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
অখ্যাত পল্লী হিমায়েতপুরে বায়ু থেকে বিদ্যুত উত্পাদন করে পরম বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর। গড়ে তুলেছিলেন—তপোবন ও মাতৃ বিদ্যালয়—যা শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত মনোমোহিনী ইনষ্টিউট অফ সায়েন্স এণ্ড টেকনোলজি নামের বিজ্ঞান কলেজ। কেমিক্যাল ওয়ার্কসের জীবনদায়ী ঔষধসমূহ দেশে এবং বিদেশে সমাদৃত হয়েছিল।
বৈদ্যুতিক এবং যন্ত্রশিল্পের আধুনিক সব ধরণের কাজ হতো ইলেকট্রিকাল ও মেকানিক্যাল ওয়ার্কসপে। যথা,–ঢালাই, ঝালাই, লেদের কাজ, ডাইস, ইলেক্ট্রোপ্লেটিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ফিটিং, আরমেচার, ব্যাটারি প্লেট তৈরি ও মেরামত, ডায়নামো মেরামত ইত্যাদি। ছিল—ময়দার কল, আটার কল, চালের কল, তেলের কল, চিনির কল, মেডিকেটেড ওয়াটার মেশিন, স্পাইস পাউডারিং, সুতার গুটি তৈরি, টেলারিং, বোতাম তৈরি, গ্লাস ব্লোয়িং, পটারী ওয়ার্কস্, বেকারী, লজেন্স তৈরি, গ্রোসারী প্রোডাক্ট ইত্যাদির শিল্প। ছিল—কার্ডবোর্ড কারখানা, স্টীমলণ্ড্রী, কটন ইণ্ডাস্ট্রিজ, হোশিয়ারী শিল্প, ব্যাঙ্ক, ইঞ্জিনীয়ারিং ওয়ার্কস্, বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্র, স্বাস্থ্য বিভাগ, গৃহনির্মাণ বিভাগ, কলাকেন্দ্র, প্রেস (যেখানে বাংলা, হিন্দী, সংস্কৃত, উর্দু, আরবী, ফারসী হরফের কাজ হতো, দেশ ভাগের পর পাকিস্তান সরকার জবরদখল করে ঢাকাতে নিয়ে যায়।), পাব্লিশিং হাউস, ফিলানথ্রপি, মাতৃসঙ্ঘ ইত্যাদি। (তথ্যসূত্রঃ ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত জীবনী গ্রন্থ)
শুধু আশ্রমবাসীরাই নয়, জাতি-বর্ণ-সম্প্রদায়-ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলেই ওইসব প্রতিষ্ঠানের সুলভ সেবা পেতেন। তথাপিও পাকিস্তান সরকার ওই সর্বজনীন কল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠানসমূহ দখল করে কেন বিনষ্ট করেছিলেন তার উত্তর আমার জানা নেই।
যেমন জানা নেই, আলোচনা পত্রিকাতে বর্ণিত শ্রীশ্রীঠাকুরের একান্ত ইচ্ছাগুলোর বাস্তবায়ন দেওঘর সৎসঙ্গ কর্তৃপক্ষ করেছেন কি-না। যদি করে থাকেন কোথায় করেছেন, তার উদাহরণ দিন। ওই ইষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দেখার পর আপনার সাথে গলা মিলিয়ে ‘আচার্য্যদেব কি! —জয়!’ ধ্বনি দিয়ে মানব জীবনটাকে ধন্য করব। না, না, আপনার এক্ষুনি জানাতে হবে না, আপনাকে এক মাস সময় দিচ্ছি। আশাকরি এই সময়ের মধ্যে আপনি সব তথ্য সংগ্রহ করে আমাকে জানাতে পারবেন। আর যদি অনিবার্য্য কোন কারণে জানাতে না পারেন, তাহলে পরমপিতার একটা ভয়াল বাণী শুনে নিন।
সবাই ক্ষমা পাবে—
তা’ তা’রা যেমনতর অপরাধেই
অপরাধী হোক না কেন,
কিন্তু ক্ষমা পাবে না তারাই—
যা’রা পবিত্র সত্তাকে
অবমানিত করে,
অবলাঞ্ছিত করে,
—তা’ কখনও নয়।
(ধৃতি-বিধায়না, ২য় খণ্ড, বাণী সংখ্যা ১১৬)
* * *
যদিও অনিমেষদা, বিভাসদাকে কথাগুলো বলেছিলেন। তবুও কেন জানি আমার ভয় ভয় করছে। দেওঘরের আচার্য্যদেবদের পাল্লায় পড়ে এ কোন্ বিপদে আবার পড়লাম! আমার আবার কিছু হবে না তো! আমি ক্ষমা পাব তো ? হে দয়াল! তুমি রক্ষা কোরো।
সদদীক্ষা গ্রহণ মানবজীবনের এক আবশ্যিক প্রক্রিয়া। সৌর, গাণপত্য, শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণবাদি সব মতবাদেই দীক্ষা সঞ্চারণার মাধ্যমে জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক সাধনার নিয়ম শেখান হয়। যা মানব জীবনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে পুরুষোত্তমের আবির্ভাবের সাথে সাথে অন্যান্য মতবাদের দীক্ষিতদেরও সদদীক্ষার মাধ্যমে তাঁকে গ্রহণ করতে হয়। তাঁকে গ্রহণ না করলে গুরুত্যাগ দোষে দুষ্ট হতে হয়।
এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেছেন—
পুরুষোত্তম আসেন যখন
সব গুরুরই সার্থকতা
তাঁকে ধরলে আসে না-কো
গুরু-ত্যাগের ঘৃণ্যকথা।
* * *
পুরুষোত্তম যখন আসেন সবার গুরু তিনিই হন,
তাতে নিষ্ঠা যতই দড় তার অন্তরে তিনিই রন।
পুরুষোত্তমের আবির্ভাবে—সঞ্চারণার অধিকার,
অন্য কারো থাকতে পারে এমন কেউ থাকে না আর।
* * *
না ধরে প্রেরিতে বর্তমান
অন্ধতমোয় হয় প্রয়াণ।
* * *
পুরুষোত্তমের দীক্ষা সবারই নিতে হয় কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর—দীক্ষা সবারই নেওয়া প্রয়োজন এবং নানাজনের নানা জায়গায় দীক্ষা নেওয়া হয়তো আছে। হিন্দুদের কথা, মহাপুরুষ বা পুরুষোত্তম যখন আসেন, তখন তাঁকেই গ্রহণ করাই লাগে। তাঁকে গ্রহণ করলে সবগুলির পুরশ্চরণ হয়। আর, তাঁকে কেন্দ্র ক’রেই সব দীক্ষার integration (সংহতি) আসে। কেউ হয়তো তান্ত্রিক দীক্ষা নিয়েছে, কেউ হয়তো শৈব মতে দীক্ষা নিয়েছে। সেগুলির অনুষ্ঠান ক’রে বা না ক’রে যদি মহাপুরুষ বা পুরুষোত্তম-নির্দেশিত পন্থায় সাধন করে, ওতেই তাদের দীক্ষা সার্থক হবে। সাধু নাগ মহাশয় তো আগে দীক্ষা নিয়েছিলেন। কিন্ত রামকৃষ্ণদেবকে পেয়ে তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নিতে দ্বিধা করেননি। তাতে ওই (আগের) দীক্ষারই পুরশ্চরণ হয়েছিল। এইভাবে পুরুষোত্তমকে গ্রহণের রীতি যদি না থাকে, বিভিন্ন দীক্ষাপদ্ধতি ও তাতে দীক্ষিত লোকগুলো বিচ্ছিন্ন হ’য়ে থাকে। লোকসংহতি বলে জিনিষটা আসে না। ভাবগুলি integrated (সংহত) হয় না। নানা মত ও পদ্ধতির solution (সমাধান) হয় না। বিভিন্ন রকমগুলির solution (সমাধান) না হ’য়ে যে-দীক্ষাতেই মানুষ দীক্ষিত হোক না কেন, তাতে পরম solution (সমাধান) অর্থাৎ meaningful adjustment (সার্থক বিন্যাস) হয় না, নানা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। তাদের কেউ কাউকে দেখতে পারে না, বিরোধ থেকেই যায়, consolidation (দৃঢ়ীকরণ) হয় না।
আমাদের হিন্দুদের মধ্যে ধারণা আছে “সর্ব্বদেবময়ো গুরু”। গুরুর মধ্যে সমস্ত দেবতাকে দেখতে চাই আমরা। অর্থাৎ, তিনি তেমনি সর্ব্বপরিপূরক হওয়া চাই বাস্তবে। তা’ না হ’লে ব্যষ্টি ও সমষ্টির সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব নয়। তাঁর কাছে দীক্ষা first and foremost (প্রথম ও প্রধান)। আর, যা কিছুকে সঙ্গতিশীল অন্বয়ী তাৎপর্য্যের ভিতর দিয়ে সত্তাপোষণী ক’রে তোলাই হ’ল তপস্যা। তাকেই বলে শিক্ষা। (আলোচনা প্রসঙ্গে, খণ্ড ২২/৪. ৯. ১৯৫৩)
শ্রীশ্রীঠাকুরঃ সদ্গুরু বা পুরুষোত্তমকে পেয়েও যারা দীক্ষা না নেয় তারা কিন্তু ঠকে যায়। তিনি তো আর নিত্য আসেন না। পেয়েও ছেড়ে দেওয়া মানে মন, মায়া, কাল ও প্রবৃত্তির ঘানিতে আরো শত সহস্রবার ঘোরা। (আ. প্র. ৩/১৩৫)
শ্রীশ্রীঠাকুরঃ পুরুষোত্তমের সংবাদ যাদের কাছে যেয়ে পৌঁছায়নি, তারা বরং blessed (আশিষপুষ্ট)। কিন্তু যারা সংবাদ পেয়েও তাঁকে গ্রহণ করল না তারা fateless (ভাগ্যহীন)। (দীপরক্ষী ১/১৩৭)
প্রশ্নঃ পুরুষোত্তম তো সর্বদা পৃথিবীর বুকে থাকেন না। দেহধারী-পুরুষোত্তম যখন না থাকেন, তখন মানুষ কাকে ধরবে?
শ্রীশ্রীঠাকুরঃ ধরা মানে দীক্ষা নেওয়া। যুগপুরুষোত্তমের ভাবে ভাবিত, অনুরঞ্জিত, নিষ্ঠাবান, আচারবান, তদ্গতচিত্ত ঋত্বিকের কাছ থেকে ঐ পুরুষোত্তম প্রবর্তিত দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ঐ পুরুষোত্তমকেই ইষ্ট মেনে তাঁর পথে চলবে। (আঃ প্রঃ ১০/১৬)
প্রেরিতপুরুষদের আগমন নিয়ে কথা উঠল—
শ্রীশ্রীঠাকুরঃ শেষে যিনি আসেন তিনি ঐ পূর্ব্বতনদেরও গুরু। ‘স পূৰ্ব্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ’—কালের দ্বারা তিনি অবিচ্ছিন্ন নন। (দীপরক্ষী ৫/১০৭)
শ্রীশ্রীঠাকুরঃ পুরুষোত্তম হলেন World teacher (বিশ্ব শিক্ষক)। তাঁতে সংহত হয়ে সকলেই যদি চলে, সব সাধু মহাপুরুষরাও যদি তাঁর অনুবর্ত্তী হয়ে চলে, তবে দেশ-দুনিয়া বেঁচে যায়, উন্নত হয়। (আঃ প্রঃ ২০/৩৫৮)
।।সদগুরুর দীক্ষা কেন নিতে হবে ।।
শ্রীশ্রীঠাকুর—‘‘মানুষ যদি কোন-কিছু অবলম্বন না ক’রে একাগ্র হ’তে চেষ্টা করে, complex (প্রবৃত্তি)-গুলি dormant, dull ও indolent (সুপ্ত, ভোঁতা ও অলস) হ’য়ে যায়। কিন্তু মানুষ যদি সুকেন্দ্রিক হয়, তাতে সেগুলি roused, active ও meaningful (জাগ্রত, সক্রিয় ও সার্থক) হয়, individuality grow করে (ব্যক্তিত্ব গজায়)। আমাদের শরীরে যতগুলি cell (কোষ) আছে, সেগুলি concentric (সুকেন্দ্রিক) না হ’লে ছিটিয়ে যেত, impuls (সাড়া) carry (বহন) ক’রতে পারত না, বিচ্ছিন্ন হ’য়ে থাকত। concentric (সুকেন্দ্রিক) হওয়াই হ’লো উন্নতিলাভের পরম পথ। …… Earth (পৃথিবী)-টা যদি sun- এ (সূর্য্যে) concentric (সুকেন্দ্রিক) না হ’তো তাহ’লে তা ভেঙে গুঁড়ো-গুঁড়ো হ’য়ে যেত। গ্রহগুলি যদি কোথাও নিবদ্ধ না থাকতো, তবে অস্তিত্ব বজায় রেখে চলতে পারত না। আমাদের প্রত্যেকের ভিতরেই একটা যোগাবেগ আছে। ভালবাসা ও টান জিনিসটা দেওয়াই আছে। বীজ ও ডিম্বকোষের মধ্যে টান না থাকলে conception (গর্ভসঞ্চার) হয় না, ব্যক্তিই বেরোয় না। ঐ টানকে রক্ষা করার জন্য সুকেন্দ্রিক হওয়া লাগে। সেজন্য বামুন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের ছোট বয়সেই দীক্ষা নিতে হ’তো। দীক্ষা এসেছে দক্ষ কথা হ’তে। দীক্ষা মানে তাই যা’ আমাদের দক্ষ ক’রে তোলে। ….. ধর্ম ও বিজ্ঞান পরস্পর জড়িত। ধর্মে যদি বিজ্ঞান না থাকে, তবে তা’ অন্ধ। আবার বিজ্ঞানে যদি ধর্ম না থাকে, তবে তা খোঁড়া।’’
(আলোচনা প্রসঙ্গে ১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৩৬০, সোমবার।)
*******
সদ দীক্ষা তুই এক্ষনি নে ইষ্টেতে রাখ সম্প্রীতি,
মরন তরন এ নাম জপে কাটেই অকাল যমভীতি।
—শ্রীশ্রীঠাকুর
।। সৎ দীক্ষা সঞ্চারণা পদ্ধতি ।।
জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে চাইলে বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আদর্শে দীক্ষা বা আদর্শ জীবন-চলনার নিয়ম গ্রহণ করতেই হবে। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আদর্শ-নির্দিষ্ট দীক্ষাপদ্ধতিতে প্রথমে আচমন করে সংবেদনী পাঠ করতে হয়। তারপর আসন করে বসা শিখতে হয়। তারপর প্রণাম মন্ত্র পাঠ করিয়ে আজ্ঞাচক্রে ধ্যান শিখতে হয়। যে ধ্যানকে ঊষানিশায় কম পক্ষে আধঘণ্টা থেকে ৪৫ মিনিট সাধন করতে হয়। ধ্যানান্তে পুনরায় প্রণাম মন্ত্র পাঠপূর্বক *স্বতঃ-অনুজ্ঞা পাঠ করিয়ে চরিত্রায়িত করার শিক্ষা দেওয়া হয়। যথা—
আমি অক্রোধী
আমি অমানী
আমি নিরলস
কাম-লোভজিৎ-বশী
আমি ইষ্টপ্ৰাণ
সেবাপটু
অস্তি-বৃদ্ধি-যাজন-জৈত্র
পরমানন্দ
উদ্দীপ্ত শক্তি-সংবৃদ্ধ
তোমারই সন্তান
প্রেমপুষ্ট, চির-চেতন,
অজর, অমর
আমায় গ্রহণ কর,
প্ৰণাম লও।
* স্বতঃ-অনুজ্ঞা (auto-suggestion) —নিজেই নিজেকে আদেশ ক’রে অন্তঃস্থ চৈতন্যের জাগরণ ঘটানোর অনুশীলন। যা প্রতিবার ধ্যানান্তে করতে হয়।
তারপর শবাসন ধ্যান শিখিয়ে দিনে ৩-৪ বার অভ্যাস করতে বলা হয়। তারপর থানকুনি পাতা খাওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়। তারপর সংকল্প পাঠ করাতে হয়। তারপর দক্ষিণা বাক্য পাঠ করাতে হয়। তারপর জপ ও সিদ্ধি বিষয়ে উপদেশ দিয়ে ধ্যানের পদ্ধতির উপদেশ দিতে হয়। সবশেষে ইষ্টভৃতির উপদেশ প্রদান করা হয়।
* * *
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আদর্শের আবশ্যিক পালনীয় প্রাথমিক বিষয়সমূহ—অভক্ষ্যভোজী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুনাদি তামসিক আহার করা যাবে না। যারা করেন, আর্য্য হিন্দুমতে তাদের অভক্ষ্যভোজী বলা হয়েছে। অগম্যাগামী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ যারা প্রতিলোম, সগোত্র এবং সপিণ্ড সম্বন্ধীয়দের সাথে অবিধি পূর্বক ধর্মবিরুদ্ধ বিবাহের মাধ্যমে কামাচার করে, হিন্দুমতে তাদের অগম্যাগামী বলা হয়েছে। এরা কদাচারী, এদের প্রদত্ত আহার ও পানীয় অশুদ্ধ। (দ্রঃ সম্বিতী)
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্যদের প্রাথমিকভাবে আবশ্যিক পালনীয় বিধিসমূহ। ঊষানিশায় মন্ত্রসাধন, আহ্বানীসহ সন্ধ্যা ও প্রার্থনা, ইষ্টভৃতি (ইষ্টনীতির ভরণ), পরিশ্রান্ত হলে শ্রান্তি কাটাতে কমপক্ষে ৩ বার ৫-৭ মিনিট শবাসন নিত্য-সাধন করতে হবে। বর্ণধর্মানুযায়ী সদাচারী হতে হবে। বর্ণাশ্রম মেনে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। আপদ্ধর্ম ব্যতীত অন্য বর্ণের বৃত্তিহরণ করা চলবে না। ‘পঞ্চবর্হিঃ’ এবং ‘সপ্তার্চ্চিঃ’-র বিধান মেনে চলতে হবে। ওইসব বিধানসমূহকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমের নাম দীক্ষা গ্রহণ করা।
যাঁরা এস. পি. আর., পি. আর. উপাধির বলে দীক্ষা সঞ্চারণা করেন, তাঁরা যজমানদের দিয়ে ‘‘এই দীক্ষা গ্রহণ করিয়া আমি সর্বান্তকরণে শপথ করিতেছি যে—মানুষের জীবন ও বৃদ্ধির পরম উদ্ধাতা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে প্রতিষ্ঠা করাই এইক্ষণ হইতেই আমার জীবনের যজ্ঞ হউক। ……’’ ইত্যাদি উচ্চারণ করিয়ে সংকল্প-শপথ গ্রহণ করান। এবং দীক্ষাপত্রের ২টি স্তবকে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। এর উদ্দেশ্য যজমান যা’তে ঠাকুরের আদর্শ মেনে চলেন তারজন্য একেবারে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থাপত্র স্বয়ং শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত। দীক্ষাদাতার কর্তব্য, দীক্ষা গ্রহিতাকে শ্রীশ্রীঠাকুরের উপরোক্ত আদর্শের বিষয়ে সম্যকভাবে অবগত করিয়ে দীক্ষা দান করা। তা’ না করিয়ে দীক্ষাদাতা যদি তড়িঘড়ি করে যেনতেন প্রকারেণ মন্ত্র দিয়ে সই-সাবুদ করিয়ে নেয়, তাহলেই মুশকিল। কপটাচার এবং দ্বন্দ্বীবৃত্তি দোষে দুষ্ট হতে হবে। অনেকক্ষেত্রে সেই প্রবহমানতা চলছে। যারফলে বেশিরভাগ দীক্ষিতগণ মনে করেন, সকালবেলা উঠে ঠাকুরের নামে পয়সা রাখা, শুক্রবার নিরামিষ খেলেই শ্রীশ্রীঠাকুরের শিষ্য হওয়া যায়। অথচ, সত্যানুসরণ গ্রন্থের প্রথমেই তিনি এ বিষয়ে সাবধান বাণী দিয়ে রেখেছেন। “অর্থ, মান, যশ ইত্যাদি পাওয়ার আশায় আমাকে ঠাকুর সাজিয়ে ভক্ত হ’য়ো না, সাবধান হও—ঠকবে ; তোমার ঠাকুরত্ব না জাগলে কেহ তোমার কেন্দ্রও নয়, ঠাকুরও নয়–ফাঁকি দিলেই পেতে হবে তা’।” অর্থাৎ, আমার মধ্যে যদি তাঁর আদর্শের প্রকাশ না হয়, ঠাকুরত্ব না জাগাতে পারি, তাহলে তিনি আমার ঠাকুর নন। সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন। সেই হিসেবে বিচার করে দেখলে দেখা যাবে, তাঁর আদর্শ মেনে চলেন যাঁরা, যজনসিদ্ধ যাঁরা, একমাত্র তাঁদেরই অধিকার রয়েছে, যাজন করার, প্রচার করার। অথচ, আমরা এসব মূল বিষয়টিকে অনেক সময় উপেক্ষা করে, নিত্য সাধন-পদ্ধতির নামধ্যান, শবাসন, সদাচার, বর্ণাশ্রম, ঠাকুরের বলা অনুযায়ী পরিচ্ছদ, ইত্যাদিতে ছাড় দিয়ে, নিয়মের শিথিল করে অধিবেশন করে চলেছি। এ বিষয়ে সকলকে সচেতন হবে, নচেৎ দ্বন্দীবৃত্তি দোষে দুষ্ট হতে হবে।
দীক্ষার সময় ইষ্ট প্রতিষ্ঠার সপক্ষে যে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়, সেই শপথের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠা বা ইষ্ট-প্রতিষ্ঠাই দীক্ষিত-জীবনের একমাত্র যজ্ঞ। যজ্ঞ শব্দের অর্থ লোকসম্বর্দ্ধনী অনুচর্য্যা—ব্যক্তি, দম্পতি, গৃহ, সমাজ ও রাষ্ট্রের লোকসম্বর্দ্ধনী অনুচর্য্যা। ওই ইষ্টপ্রতিষ্ঠা নামক যজ্ঞের বা লোকসম্বর্দ্ধনী অনুচর্য্যার প্রাথমিক ধাপ, ব্যক্তিগত জীবনে ইষ্টনীতির পরিপালন করে নিজের চলন-বলন, খাওয়া-দাওয়া, জৈবিক তাগিদের কাজকর্মগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। যাকে আমরা যজন বলতে পারি।
ব্যক্তিগত জীবনে যজনশীল হওয়ার জন্য ঊষা-নিশায় নিয়মিত কমপক্ষে ৪৫ মিনিট করে মন্ত্রসাধন, ৫ থেকে ৭ মিনিট করে কমপক্ষে তিনবার শবধ্যান, ইক্ষুগুড়সহ থানকুনি পাতা খাওয়া, সত্তাপোষণী নিরামিষ আহার গ্রহণ, প্রার্থনা মন্ত্রে প্রদত্ত পঞ্চবর্হিঃ এবং সপ্তার্চ্চির অনুশাসন মেনে সদাচার এবং বর্ণাশ্রম ধর্ম পালন, — ইত্যাদির নিত্য নিয়মিত অনুশীলন করার মাধ্যমে যজনশীল হতে হয়। যজনশীলতার মুখ্য বিষয়, বর্ণধর্ম পালন, দ্বন্দ্বীবৃত্তি ও প্রতিলোম আচরণ ত্যাগ করা। সবর্ণ অনুলোম বিবাহের নীতি পালন করা। কারো বৃত্তিহরণ না করে বর্ণানুগ কর্মদ্বারা দিন গুজরানি আয়ের অগ্রভাগ ইষ্টের উদ্দেশ্যে নিবেদন করার শপথ পালনের নাম ইষ্টভৃতি বা ইষ্টনীতির ভরণ। বাস্তবে দেখা যায় বেশিরভাগ দীক্ষিতগণ ওইসব অনুশাসন অনুশীলনে গুরুত্ব না দিয়ে, শুক্রবার তথাকথিত নিরামিষ খেয়ে, সকালে উঠে কিছু পয়সা বা টাকা দিয়ে, বহুলাংশে ইষ্টপ্রদত্ত মন্ত্রকে বাদ দিয়ে সংঘ নির্দিষ্ট আদেশ মেনে ইষ্টভৃতি করে, মাসান্তে কারো কাছে/উপযোজনা কেন্দ্রে/পছন্দের সংগঠনে/অনলাইনে জমা করে দেয়।
বাস্তবে ইষ্টভৃতি হচ্ছে সামর্থীযোগ। জাগতিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে সামর্থ্য বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে, ইষ্টের নীতিকে ভরণ বা পালন করার দৈনন্দিন শপথ গ্রহণ করা। যা’ দীক্ষাপত্রে লিপিবদ্ধ আছে। দীক্ষাপত্রে বর্ণিত উক্ত বিধিসমূহকে ভালভাবে বোঝাবার পর সম্মত হলেই পবিত্র দীক্ষা দেওয়া উচিত। যেমন কোন স্কুলে ভর্তি হবার পূর্বে নিয়মাবলীর ফর্ম ফিল আপ করতে হয়। ভর্তি হবার পর ফর্ম ফিল আপ করার নিয়ম নেই। অথচ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দীক্ষা-প্রার্থীদের শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত অনুশাসনের নিয়মাবলী জানান হয় না। তথাকথিত দীক্ষাদাতারা এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন বলে মনে হয় না। যদি করতেন, ‘শুক্রবার নিরামিষ খেলেই হবে।’— শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সৎমন্ত্রে দীক্ষিতদের মধ্যে এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা পেত না। এর সত্যতা বুঝতে হলে তথাকথিত সৎসঙ্গীদের সাথে বন্ধুর ন্যায় মিশে উক্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই প্রকৃত সত্য জানা যাবে। আমরা, দীক্ষা এবং দীক্ষানুচলন বিষয়ে ইষ্টানুগ গুরুত্ব না দেবার ফলে অপযাজনের জন্য সাধারণ জনমানসে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আদর্শ বিষয়ে ভুলবার্তা যাচ্ছে। ফলে, অজ্ঞ জনেরা শ্রীশ্রীঠাকুরকে নিয়ে অনেকে বিরূপ সমালোচনা করার ধৃষ্টতা প্রকাশের সাহস পায়। যা’ মানবসভ্যতার উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। এ বিষয়ে ইষ্টপ্রাণ দাদা ও মায়েদের সচেতন হতেই হবে—শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শকে অবিকৃতভাবে প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে।
।। ইষ্টভৃতি প্রকরণ ।।
সৎসঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কথিত ‘সৎসঙ্গ চায় মানুষ’ বাণীতে বর্ণিত সৎসঙ্গের আদর্শের সাথে, ‘ইষ্টভৃতি’ শব্দের মর্মার্থের সাথে পরিচিত নাহলেও ‘ইষ্টভৃতি’ নামের সাথে বেশীরভাগ সংঘকেন্দ্রিক জনেরা যেমন পরিচিত, তেমনি সাধারণ লোকেরা শ্রীশ্রীঠাকুরের নামে টাকাপয়সা রাখার মাধ্যম হিসেবে ‘ইষ্টভৃতি’ শব্দকে জানেন। অনেকানেক দীক্ষিত জনেরা মাছ-মাংস-পেঁয়াজ-রসুনাদি অভক্ষ্য ভোজন করে, বর্ণাশ্রমধর্মের প্রতি মুখ ফিরিয়ে বৃত্তিহরণ কর্মাদি করে, প্রতিলোম-বিবাহ বিলাসে অগম্যাগামী হয়েও গর্ব করে বলেন, ‘আমি রোজ ১০/২০/৩০ ……… টাকা করে ইষ্টভৃতি করি।’ ইষ্টনীতি পালন না করে, যজন না করে, ইষ্টনীতি পালন করাতে উৎসাহিত না করে, যাজন না করে, বিধির বিধান অমান্য করে, যেনতেনভাবে টাকা উপায় করে, সেই টাকা ইষ্টের উদ্দেশ্য নিবেদন করে কোন সংগ্রাহকের কাছে জমা দিলে আত্মতুষ্টি লাভ যেতে পারে, কিন্তু ইষ্টভৃতি নামক মহাযজ্ঞের যাজ্ঞিক হওয়া যাবে না।
এ বিষয়ে ঠাকুরের নিদেশটা জেনে নিতে পারলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে, যদি বুঝতে আগ্রহ থাকে।
“ঈশ্বর-অনুধ্যায়িতা নিয়ে
গণহিতী অনুচর্য্যায়
তাদের যে অনুগ্রহ-অবদান অর্জ্জন কর,
সেই অবদান হ‘তে
শ্রদ্ধানুস্যূত অন্তঃকরণে
স্বতঃস্বেচ্ছায় তোমার ইষ্টকে যা নিবেদন কর,
তাই-ই কিন্তু তোমার শ্রেষ্ঠ ইষ্টভৃতি।”
(ধৃতি-বিধায়না, ১ম খণ্ড, বাণী সংখ্যা ৩০৬)
শ্রীশ্রীঠাকুর দিন গুজরানী আয় থেকে ইষ্টভৃতির অর্ঘ্য আহরণ করতে বলেছেন। কাউকে পীড়িত না করে, নিজে পীড়িত না হয়ে, বর্ণানুগ কর্মের সেবার মাধ্যমে, বৃহত্তর পরিবেশে, ঘটে ঘটে ইষ্ট স্ফূরণের বা মঙ্গল প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত থাকার বিনিময়ে অযাচিত প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পদকে বলা যেতে পারে অনুগ্রহ অবদান। আমার সেবায় (service)-এ তুষ্ট হয়ে সেবা গ্রহণকারী অনুগ্রহ করে করে আমাকে যা দেবেন, তা থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য স্বরূপ ইষ্টের উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে হবে। এই বাণীর মাধ্যমে শ্রীশ্রীঠাকুর এক ভাগবত অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন পরমরাষ্ট্রিক সমবায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। পরিবেশের সকলকে নিয়ে বাঁচা এবং বৃদ্ধি পাওয়ার বাস্তুতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বিন্যাস-ব্যবস্থার সরলীকরণ অবদান ইতিপূর্বে পরিলক্ষিত হয়নি।—মানবসভ্যতার সার্বিক উত্তরণের জন্য।
বাণীর মধ্যে প্রকট হয়ে রয়েছে ঈশ্বর অনুধ্যায়িতার প্রকৃত স্বরূপ, ইষ্টভৃতির বাস্তবায়নের ফরমূলা।
বর্ণানুগ কর্ম এবং ঈশ্বর অনুধ্যায়িতা ব্যতীত ইষ্টভৃতি বাস্তবায়িত হয় না। ইষ্টভৃতির নামে শুধুমাত্র ইষ্টের প্রীতির জন্য কাউকে পীড়িত না করে নিজে পীড়িত না হয়ে বর্ণানুগ কর্মের সেবা মাধ্যমে আহরিত অর্থ ‘দিন গুজরানী আয়’-কেই ইষ্টভৃতির অর্ঘ্য হিসেবে নিবার্চিত করেছেন শ্রীশ্রীঠাকুর। ওই নির্দেশ অনুসারে ইষ্টার্ঘ্য আহরণ করার মধ্যেই প্রীতি, মৈত্রী ও ঐক্যের বীজ বপন করে দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন আর্য্যকৃষ্টির সদাচার এবং বর্ণাশ্রম ধর্মকে। ওই ইষ্টার্ঘ্য ইষ্টকে দিতে হবে। তিনি তা দিয়ে PHILANTHROPICAL WORK বা সব্যষ্টি সমষ্টির মধ্যে ভাগবত ঐক্য স্থাপন দ্বারা গণহিতৈষণা কর্ম করবেন। ইষ্টভৃতির দাতা এবং গ্রহীতার মেলবন্ধনে গড়ে উঠবে পরম রাষ্ট্রিক সমবায়। এই ছিল ঠাকুরের পরিকল্পনা। সেই উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছিলেন ফিলানথ্রপি কার্যালয়। মাসান্তে ওই অর্ঘ্য পাঠাতে হবে ইষ্টসকাশে। ইষ্টের নামে প্রেরিত ওই অর্ঘ্য গৃহীত হতো ফিলানথ্রপিতে। পাঠাবার পর দুজনকে ভ্রাতৃভোজ্য দিতে হবে। এর মাধ্যমে পারস্পরিক প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করলেন। দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে চাইলেন। ইষ্টভৃতি গ্রহীতারা এ বিষয়টিকে ইষ্টানুগ-বোধ দিয়ে বিবেচনা করলে কিছুটা কাজের কাজ হবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুশ্রুতি গ্রন্থে ইষ্টভৃতির বিষয়ে বললেন :
“দিন গুজরানী আয় থেকে কর
ইষ্টভৃতি আহরণ,
জলগ্রহণের পূর্ব্বেই তা’
করিস্ ইষ্টে নিবেদন ;
নিত্য এমনি নিয়মিত
যেমন পারিস ক’রেই যা’
মাসটি যবে শেষ হবে তুই
ইষ্টস্থানে পাঠাস্ তা’ ;
ইষ্টস্থানে পাঠিয়ে দিয়ে
আরো দু’টি ভুজ্যি রাখিস্,
গুরুভাই বা গুরুজনের
দু’জনাকে সেইটি দিস্ ;
পাড়া-পড়শীর সেবার কাজে
রাখিস কিন্তু কিছু আরো,
উপযুক্ত আপদগ্রস্তে
দিতেই হ’বে যেটুকু পার ;
এসবগুলির আচরণে
ইষ্টভৃতি নিখুঁত হয়–
এ না-ক’রে ইষ্টভৃতি
জানিস্ কিন্তু পূর্ণ নয়।”
উপরোক্ত বাণীর মাধ্যমেও পরিস্ফূট হয়েছে সপারিপার্শ্বিক জীবনবৃদ্ধিদ ভাগবত ঐক্যের পরমবার্তা।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত ইষ্টভৃতি নিবেদন মন্ত্রের ‘‘ইষ্টভৃতির্ম্ময়াদেব কৃতাপ্রীত্যৈ তবো প্রভো, ইষ্টভ্রাতৃভূতযজ্ঞৈস্তৃপ্যন্তু পারিপার্শ্বিকাঃ।।’’ উচ্চারণ করার সাথে সাথে বৃহত্তর পারিপার্শ্বিকের জীবনবৃদ্ধির দায়ভারের শপথ নিতে হয় আমাদের। সব অবস্থাতে বাস্তব কর্মে বৃহত্তর পরিবেশের জৈবাজৈব সবকিছুকে পালন-পোষণে সমৃদ্ধ করে রাখার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই সার্থক হয় ইষ্টভৃতি পালন। ইষ্টাদর্শের পঞ্চবর্হিঃ ও সপ্তার্চ্চি-র বিধি মেনে শারিরীক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সদাচার পালনে, ইষ্টপ্রোক্ত বিধি অনুসরণ করে বিবাহ ও সুপ্রজনন নীতি পালনে অভ্যস্ত না হতে পারলে—‘আমি ইষ্টভৃতি করি’ এই কথা বলা বোধহয় সমীচীন হবে না। ইষ্টভৃতি করা মানে, বাস্তবে ইষ্টনীতি মেনে চলা, ইষ্টনীতির ভরণ করা।
যদিও ইষ্টভৃতি প্রচলনের পূর্বে সত্যানুসরণের “তুমি তোমার, নিজ পরিবারের, দেশের ও দশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী।” বাণী-মাধ্যমে অনুরূপ দায়ভার দিয়েই রেখেছিলেন ব্যষ্টি ও সমষ্টি উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রেখে।
এ তো গেল ইষ্টভৃতি আহরণ ও নিবেদনপর্ব। এর পর রয়েছে প্রেরণপর্ব। প্রেরণ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর স্পষ্ট নির্দেশ করে দিয়ে বলেছেন :
ইষ্টভৃতি ইষ্টকেই দিস্
করিসনা তা’য় বঞ্চনা।
অন্যকে তা’ দিলেই জানিস
আসবে বিপাক গঞ্জনা।।
অর্থাৎ ইষ্টভৃতি ইষ্টেরই প্রাপ্য, অন্য কারও নয়। ওই অর্ঘ্য দিয়ে ইষ্টকর্ম করা হবে। ইষ্টকর্ম মানে পূর্ত্তকর্ম। যা প্রকৃত ইষ্টভৃতির মন্ত্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। “…..ইষ্টভ্রাতৃভূতযজ্ঞৈস্তৃপ্যন্তু পারিপার্শ্বিকাঃ ।।” এর সরলার্থ খুব সহজ। শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শ অনুযায়ী সদাচার এবং বর্ণাশ্রমানুগ জীবন বর্দ্ধনার বিধি মেনে সপারিপার্শ্বিক জীবনবৃদ্ধির পথে চলেন যিনি এমন গুরুভাই-ই প্রকৃত ইষ্টভ্রাতা।–-যাঁর আপদে-বিপদে সাধ্যানুগ সাহায্য করতে হবে। ভূত মানে,—ক্ষিতি, অপ্, মরুৎ, ব্যোম ও তেজ-আদি সৃষ্টি-প্রকরণের পঞ্চ-মহাভূত, যা পরিবেশের অজৈব উপাদান, যার সাহায্য ব্যতীত জৈব প্রাণপঙ্ক (protoplasm) বাঁচতে পারে না। উক্ত উপাদানসমূহকে সমৃদ্ধ রাখার জন্য আর্য্যদের বাস্তব পূর্ত্ত-কর্মের মাধ্যমে নিত্য পঞ্চ-মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে হতো সপারিপার্শ্বিক জীবনবৃদ্ধিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে। শ্রীশ্রীঠাকুর ইষ্টভৃতি মহাযজ্ঞের মাধ্যমে ওই প্রক্রিয়াকে নবীকরণ করলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর হিমাইতপুরে সপারিপার্শ্বিক জীবন বৃদ্ধিদ আশ্রম সংগঠনের মাধ্যমে, ইষ্টভৃতি প্রবর্তনের পূর্বেই ইষ্টভৃতি মহাযজ্ঞের বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আমাদেরও তাই করতে হবে, বাস্তবে।
ইষ্টের অবর্তমানে, ইষ্টাদর্শের পরমরাষ্ট্রিক সমবায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীক্ষা, শিক্ষা, বিবাহ, কৃষি ও শিল্পের বাস্তবায়ন করতে নিবেদিত-প্রাণ যিনি, তিনিই ইষ্টার্ঘ্য গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তি।
এ বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট নিদেশ—‘‘আগত যিনি, উপস্থিত যিনি, তাঁর বিগতিতে বা তিরোভাবে তাঁর বংশে যদি তাঁতে অচ্যুত সশ্রদ্ধ আনতিসম্পন্ন, প্রবুদ্ধ সেবাপ্রাণ, তৎবিধি ও নীতির সুষ্ঠু পরিচারক ও পরিপালক, সানুকম্পী চর্য্যানিরত, সমন্বয়ী সামঞ্জস্য প্রধান, পদনির্লোভ, অদ্রোহী, শিষ্ট-নিয়ন্ত্রক, প্রীতিপ্রাণ—এমনতর কেউ থাকেন, তাঁরই অনুগমন করো—কিংবা তাও যদি না পাও—তবে তাঁর কৃষ্টি সন্ততির ভিতর অমনতর গুণসম্পন্ন যিনি তাঁরই অনুগমন করো পারম্পর্য্যে—যতক্ষণ আবার আগতের অভ্যুত্থান না হয়, ঠকবে না—শিষ্ট সমন্বয়ে সম্বর্দ্ধনাও পাবে।’’
(সম্বিতী, আদর্শ, ৩৯)
উক্ত বাণীর সরলার্থ,—যিনি অর্থ-মান-যশ ইত্যাদির নাগপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিজের চরিত্রে ঠাকুরত্বকে জাগ্রত করেছেন, তাঁকে কেন্দ্র করে চলতে হবে, তাঁকেই ইষ্টার্ঘ্য দিতে হবে। অন্যথায় বিপাক-গঞ্জনাকে মেনে নিতে হবে।
ওই বাণীর মর্মার্থ অনুযায়ী ১. ইষ্ট পরিবারের সব সদস্যরা মিলে যাঁকে উপযুক্ত নির্বাচন করবেন তাঁকে কেন্দ্র করে চলতে হবে। ২. ইষ্ট পরিবারের সদস্যরা যদি অমনতর গুণসম্পন্ন উপযুক্ত কাউকে নির্বাচিত না করতে পারেন তাহলে কৃষ্টিসন্তানদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করতে হবে এবং তাঁর অনুগমন করে কেন্দ্রায়িত চলনে চলতে হবে।—অন্যথায় শ্রীশ্রীঠাকুরের নিদেশ অনুযায়ী বিপাক-গঞ্জনাকে মেনে নিতে হবে।
।। চক্রফটো ধ্যান করা বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতবাদ ।।
শৈলেনদা—আমাদের দীক্ষাদানের সময় যে চক্রফটো ধ্যান করার কথা বলতে হয় ……… ।
শ্রীশ্রীঠাকুর—ওটা আমি আগে করিনি। পরে হয়েছে। পি. সি. সরকার যখন আশ্রম (পাবনায়) গেল, তখন তার সাথে কথায়-কথায় light reflection-এর (আলোর প্রতিফলনের) কথা উঠল। সে বলল, শাস্ত্রে এরকম যন্ত্রের কথা আছে। ঐরকম গোলাকার একটা যন্ত্রের মধ্যে যদি মনঃসংযোগ করা যায় তাতে একটা mechanical push (যান্ত্রিক প্রযোজনা) মতন হয়, আর তাতে brain power (মস্তিষ্কের শক্তি) বাড়ে। তখন আমি সাদা-কালো ক’রে এই ষোড়শদল চক্রের idea (পরিকল্পনা) দিই। পরে কেষ্টদা তন্ত্র থেকে খুঁজে বের করল, এরকম একটা যন্ত্রের কথা সেখানে আছে, তার নাম মহালক্ষ্মীযন্ত্র। ঐ সময় থেকে এ’টা চলে আসছে। এরপর শৈলেনদা শবাসন করা নিয়ে কথা তুললেন। সেই প্রসঙ্গে বললেন পরম দয়াল—শবাসন আমিও করতেম । ওতে শরীরটা soothed (ঠান্ডা) করে। শবাসন নিয়মিত করলে সহজে হার্টফেল হতে দেয় না। (দীপরক্ষী, ষষ্ঠ খণ্ড, ইং ২৯-৪-১৯৬০)
।। প্রসঙ্গ : মায়েদের নামধ্যান বা মন্ত্রসাধন ।।
মেয়েরা নামটাম বেশী করলে, তাদের চেহারায় একটা অপূর্ব্ব লালিত্য ফুটে ওঠে। সে লালিত্য দেখে কিন্ত কামভাব জাগে না, শ্রদ্ধা হয়। (আ. প্র. ১৬/ ৩. ৪. ১৯৪৯)
।।শ্রীশ্রীঠাকুরের নামের নেশা পেয়ে বসার অভিজ্ঞতা ।।
সব কাজের মধ্য দিয়ে সর্ব্বদা নাম চালাবার বুদ্ধি ছিল আমার। তাছাড়া যখনই ফাঁক পেতাম, নামধ্যান ও ভজন করতাম। কোন সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই হয়তো ধ্যানে ডুবে যেতাম। আর ঊষা-নিশায় তো করতামই। ধূঁ-ধূঁ হয়ে যেতাম। নাম করতে করতে চলেছি, হয়ত বেতবনের মধ্যে ঢুকে গেলাম। নাক বরাবর যেতে যেতে হয়তো পটলক্ষেতেই উপস্থিত হলাম। বাইরের দিকে খেয়ালই থাকত না। নামের নেশা পেয়ে বসে থাকত। (আ. প্র. ১৬/ ৫. ৪. ১৯৪৯)
।। পুণ্যপুঁথি গ্রন্থ থেকে নামধ্যান সাধনার সহজ পদ্ধতি ।।
ধ্যান করবি সকল সময়। চলতে বসতে খেতে শুতে সকল সময়। একটু অভ্যাস করলেই হয়, বেশী কঠিন কিছু নয়। আর মনে অনবরত নাম, এমনকি কথা বলতে পর্য্যন্ত মনের মধ্যে নাম হচ্ছে, এই রকম করতে করতে স্বারূপ্য লাভ হয়। ৯। ২৪
দ্যাখ, নিঝুম হ’য়ে নাম কর, ডুবে নাম কর, বেশ তালে তালে নাম কর আর মনের চোখটি ঠিক জায়গায় রাখ। নীলদাঁড়া সোজা ক’রে হাত দুটি ঘুরিয়ে মাজার উপর রাখ। কাজের সময় কাকেও কাছে রাখবি নে, একা। এমন ক’রে বসবি, যাতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ না ঝুলে পড়ে, না গ’লে পড়ে। একটা ঘুমের অবস্থা আসবে, সেটা করিস নে। অন্য রকম স্মৃতি কিছু আসতে দিস না, আসলেও তাড়িয়ে দিবি। তিন বেলা প্রত্যেকবার এক ঘন্টা থেকে দেড়ঘন্টা। ৩৫। ৭
কর্ম না করলে ধ্যান হয় না। আসলে ধ্যানে অধিকারী হয় না। যে যত কর্মী সে তত ধ্যানী। ঘুম বেশী করতে নেই। ঘুম বেশীতে লয় এনে দেয়। মাঝামাঝি থাকবি। ৪৫। ৫
দ্যাখ, যেমন তেমন করে নাম কর্তে পাল্লেই আয়ু বৃদ্ধি হয়। নামের সঙ্গে সঙ্গে আয়ু বল সব বেড়ে পড়ে। নামে মুক্তি।
অনবরত নাম করবি আর চলতে ফিরতে সব সময় নাসামুলে দৃষ্টি রাখবি। দ্যাখ, যে আপন গুরুকে ঐ জায়গায় জাগিয়ে নিতে পারে, তার সব হবে। ২০। ২৪
তাঁকে ধ্যান করবি চব্বিশ ঘণ্টা। সব দেখবি—সব সেই। তা’কেই কয় সন্ধ্যারে বন্ধ্যা করা। ৩। ১৯
পূর্ণবেগে কীর্ত্তনটা কর, তারপর গিয়ে ধ্যান ধারণা সব কর। যখন দর্শন-টর্শন হবে তা হোক, তারপর যখন শব্দটা শুনতে পাবি, তখন ঐ শব্দের দিকে মনটা ফেলে দিয়ে চুপ ক’রে থাকবি। ১৩। ১৯
ঐ নামটি ও ধ্যানটি যদি চব্বিশ ঘণ্টা করতে পারিস, — এমন-কি অন্যের সাথে কথা কইতেও ধ্যানটি হওয়া দরকার। সন্ধ্যায় শব্দ শোনা যায়। সন্ধ্যাটা দিন যায় রাত আসে— ভোরেও । তাই দুই সময়ই প্রকৃত কাজের সময়। দুই সময়ই ভাল। ২৬। ৬১
যে সর্ব্বক্ষণ নাম করে, সে যদি কাউকে স্পর্শ করে, তার ভিতর একটা অপূর্ব্ব পুলক-শিহরণ জাগে। সমস্ত শরীরের ভিতর দিয়ে আনন্দের বিদ্যুৎ-দীপ্তি খেলে যায়, সে বোধ করে তার চোখের ভিতর-দিয়ে যেন ঐ স্পর্শসঞ্জাত জ্যোতিষ্ক কণা ঠিকরে বেরুচ্ছে। যারা ঠিক-ঠিক মত রোজ করে তারা নিজেরা যেমন উপকৃত হয়, তাদের কাছে এসে অপরেও তেমনি উদ্দীপ্ত হ’য়ে ওঠে। চোখমুখের লালিত্য দেখে মানুষ মোহিত হ’য়ে যায়।
সাধারণতঃ রোজ দুবার আসন ক’রে ব’সে যতটা পারা যায় নাম-ধ্যান করতে হয়। তা’ছাড়া সবসময় সব কাজের মধ্যে নাম করতে হয়, যেমন শিস দিতে-দিতে, গান করতে-করতে কাজ করে। নাম করলে তজ্জাতীয় কম্পনের সৃষ্টি হয় কোষের ভিতর এবং আমাদের মনও ঐ স্তরে উন্নীত হ’তে থাকে। অনুরাগের সঙ্গে নাম করতে হয়। নাম-ধ্যান ঠিক মত করলে মনের চাঞ্চল্য ক’মে যায়।
আগুনে যেমন জ্বলে যায়, তেমনি জোর নাম করলে, নামের আগুনে সব পাপ-তাপ, আধিব্যাধি জ্বলে যায়। আগুনের তাপ খুব বাড়ালে পোড়ে না, তাই নাম খুব জোর চালান লাগে।
আমার এমন হ’তো—খামখা নাম ক’রে যাচ্ছি—মরুভূমির মত অবস্থা—স্বাদ নাই, রস নাই, তাক নাই অথচ ছাড়তে পারি না। এইভাবে চলতে-চলতে হঠাৎ-হঠাৎ ক’রে কেমন ক’রে যেন বেঁধে গেল—তখন ঝরঝর ক’রে অনেকখানি আসতে থাকে। আমি নিজেই নেশায়ই করতাম। হওয়া, পাওয়ার বালাই বড় একটা ছিল না। ভাল লাগত তাই করতাম। যেমন আছে—মদ খেয়ে যদি মাতলামি না করে, তাহলে মাতাল হয় না; তেমন নাম ক’রে সেই মাফিক কাজ না করলে হয়ত নিরেট হ’য়ে রইল। নাম আর কাজ এক সাথে চালান লাগে।
কিরণদা—ধ্যান-ধারণা করতে গেলে তো খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে সাবধান হওয়া লাগে।
শ্রীশ্রীঠাকুর–খাওয়া-দাওয়া হাল্কা ও পুষ্টিকর হবে এবং মাত্রাও কম হবে।”
১৯২৩ সালের মে মাস। কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বলিতেছেন—
“নামের উপর খুব stress দিতে হয়। তাহলে intellect at will কোথাও apply করা যায় আবার ছাড়াও যায় সহজে। আমি কখনও কিছু ছাড়িনি, ছাড়ার কথা কখনও আমার মনেই হয় নি। যখন যেটাতে মন লাগত তখন সেটাই করতাম। অন্য কাজে মন লাগলে করতাম। আর আমি কখনো বসে আসন করে নাম করিনি, দৌড়িয়ে বেড়াতুম, কখন হয়ত বসে পড়তাম, কিন্তু বুদ্ধি করে নয়। তাই বলে আপনারা যেন মনে না করেন বসার দরকার নেই। Regularly বসা (at least সকাল ও সন্ধ্যায়) খুবই দরকার। সকালে ও সন্ধ্যায় চাদরে শরীর ঢেকে (বাহিরের influence না আসার জন্য) দুবার অন্ততঃ বসা উচিত। তা ছাড়া ২ মিনিট ১০ মিনিট যখনই পারা যায় বসা দরকার। কিন্তু সকাল সন্ধ্যায় যেন আজীবন বসা থাকে। পথে ঘাটেও একখানা বড় রুমাল বা চাদর সঙ্গে রাখা ভাল। যখন সময় হবে তখনই বসা দরকার, মুসলমানদের নমাজ পড়ার মত। নতুন বিয়ের পর বৌয়ের কথা যেমন সর্বদা মনে থাকে, কত রাত্রি জাগরণে কেটে যায় কিন্তু কয়েক বৎসরের মধ্যেই এ-পাশ ফিরে ও-পাশ ফিরে শুয়ে থাকে, তেমন পুরাতন হতে দিতে নেই। আমার কাছে ত নাম কখন পুরাতন হয়নি—সব সময়েই নতুন মনে হয় ।
Succession of events যেখানে বেশী সেখানে সময় যেন তাড়াতাড়ি চলে, যেমন সুখের সময় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। আবার succession যেখানে কম, সেখানে সময় যেন ফুরোতে চায় না। ধ্যানের সময় প্রথম প্রথম মনে হয় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। উঠে ঘড়ি খুলে দেখা গেল মোট ১০ মিনিট হয়েছে। আবার attachment হলে ধ্যানে এক ঘণ্টা হয়ে গেলে, মনে হয় যেন মাত্র ১০ মিনিট হ’ল। তাহলে time এর perception শুধু succession of events এর ওপর নির্ভর করে না, আমাদের মনের attachment বা concentration এর উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ মন যদি একটা idea তে attached হয় এবং তাতে যদি তার full concentration থাকে সেখানে মুহূর্তকালই অনন্তকালে পর্যবসিত হতে পারে। আর concentration না থাকলে মুহূর্তকাল অনেক সময় বলে বোধ হয়। unattached এর পক্ষে ধ্যানের সময় যেন কাটেই না। Attachment একে থাকলে beyond time যাওয়া যায়, attachment বহুতে হলেই time এর মধ্যে এসে পড়ে। ছেলেদের time খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়, activity খুব বেশি, কারণ succession of ideas খুব বেশি। যত বড় হয় তত যেন মনের ভিতর ফাঁক বেড়ে যেতে থাকে ।” (ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত জীবনী গ্রন্থের ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩৫-৩৬)
।। চক্রফটো ধ্যান ও শবাসন করা বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতবাদ ।।
শৈলেনদা—আমাদের দীক্ষাদানের সময় যে চক্রফটো ধ্যান করার কথা বলতে হয় ……… ।
শ্রীশ্রীঠাকুর—ওটা আমি আগে করিনি। পরে হয়েছে। পি. সি. সরকার যখন আশ্রম ( পাবনায়) গেল, তখন তার সাথে কথায়-কথায় light reflection-এর (আলোর প্রতিফলনের) কথা উঠল। সে বলল, শাস্ত্রে এরকম যন্ত্রের কথা আছে। ঐরকম গোলাকার একটা যন্ত্রের মধ্যে যদি মনঃসংযোগ করা যায় তাতে একটা mechanical push (যান্ত্রিক প্রযোজনা) মতন হয়, আর তাতে brain power (মস্তিষ্কের শক্তি) বাড়ে। তখন আমি সাদা-কালো ক’রে এই ষোড়শদল চক্রের idea (পরিকল্পনা) দিই। পরে কেষ্টদা তন্ত্র থেকে খুঁজে বের করল, এরকম একটা যন্ত্রের কথা সেখানে আছে, তার নাম মহালক্ষ্মীযন্ত্র। ঐ সময় থেকে এ’টা চলে আসছে। এরপর শৈলেনদা শবাসন করা নিয়ে কথা তুললেন। সেই প্রসঙ্গে বললেন পরম দয়াল—শবাসন আমিও করতেম । ওতে শরীরটা soothed (ঠান্ডা) করে। *শবাসন নিয়মিত করলে সহজে হার্টফেল হতে দেয় না। (দীপরক্ষী, ষষ্ঠ খণ্ড, ইং ২৯-৪-১৯৬০)
* শবাসন পদ্ধতি : পরিশ্রমে পরিশ্রান্ত হলে বিনা বালিশে চিত হয়ে শুয়ে পা দু’টি লম্বা করে ছড়িয়ে দিন। নাসামূলে নাম ও মস্তকের পশ্চাদ্ভাগে ইষ্টমূর্তির ধ্যান করুন। হাত দু’টি শরীরের দু’ পাশে দেহ সংলগ্ন রাখুন। হাতের চেটো শিথিল ভাবে থাকবে। হাত, পা, দেহ অবশ হয়ে গেছে এ রূপ ভেবে মৃত ব্যক্তির মতো ৫-৭ মিনিট শুয়ে থাকুন। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে।
।।শবাসন কেন করতে হয়।।
একজন জিজ্ঞাসা করলেন– শবাসন কি মৃত্যুর ধরণ অভ্যাস করা?
শ্রীশ্রীঠাকুর — এটা শরীর-বিধানকে নিয়ন্ত্রিত করবার ক্ষমতা দেয়। এটা দ্বারা হার্ট ফেল ইত্যাদি আকস্মিক ব্যাপার এড়ান যায়। (আঃ প্রঃ ২০/৩০. ১২. ১৯৫১)
।। নামধ্যান ও সাধনকালে স্মরণীয়।।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রসঙ্গতঃ বললেন– নামধ্যানে nerve-system ( স্নায়ুতন্ত্র) strengthened ( শক্তিশালী) ও abler (সমর্থতর) হয়। হঠাৎ মাত্রা খুব চড়িয়ে দিতে নেই। Gradually (ক্রমশ) বাড়াতে হয়। স্নায়ুবিধান শান্ত থাকে এমনতর খাদ্য খেতে হয়, যেমন butter (মাখন), milk (দুধ), honey (মধু), plantain (কলা)। Association-ও (সঙ্গও) তপস্যার অনুকূল হওয়া চাই। নামধ্যানে nervous system (স্নায়ুতন্ত্র) অত্যন্ত sensitive ও recepetive (সাড়াপ্রবণ ও গ্রহণমুখর) হয়, Just like a powerful Camera (ঠিক একটি শক্তিশালী ক্যামেরার মত) যা’ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিষ ধ’রে নিতে পারে। (আ. প্র. ১৫/ ১৭. ২. ১৯৪৯)
।। নামধ্যানের তত্ত্ব প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্যবাণী ।।
শ্রীশ্রীঠাকুর– নামই হ’ল বিশ্বচরাচরের প্রতিটি সত্তার মূল ভিত্তি। তাই, নামকে জানলে আত্মতত্ত্ব জানা যায়। নামকে জানতে গেলে নামীর শরণাপন্ন হ’তে হয়। নামী মানে যিনি নামস্বরূপ অর্থাৎ নামের মূর্ত্ত বিগ্ৰহ। তিনি হ’লেন দয়ীপুরুষ। জীবের প্রতি করুণাবশে তিনি মানুষ হ’য়ে আসেন, যাতে মানুষ তাঁকে ধ’রে দয়ালদেশে পৌঁছাতে পারে। নামে প্রেরণা জোগায় আর ধ্যান মানুষকে ধ্যেয়ের ভাবে ভাবিত ক’রে তঁদভিমুখী ও তঁৎচলনপরায়ণ ক’রে তোলে। যার-তার ধ্যান করতে নেই, কারণ তাতে ধ্যেয়ের মধ্যে যদি কোন imperfection (অপূর্ণতা) বা unsolved knot (অসমাহিত গ্ৰন্থি) থাকে, তবে তা’ ধ্যানীর মধ্যে transmitted (সঞ্চারিত) হ’য়ে যেতে পারে। উপর থেকে যিনি perfection (পূর্ণতার) তকমা নিয়ে আসেন, তিনিই ধ্যেয়। কারণ, He is the highest and best guide and goad to human evolution (তিনি হলেন মানব-বিবর্ত্তনের সর্ব্বোচ্চ ও সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পরিচালক ও অনুপ্রেরক)। পুরুষোত্তমকে যারা জীবদ্দশায় পায়, তাঁরা যদি তাঁর প্রতি অনুরক্ত হ’য়ে তাঁর সঙ্গ, অনুসরণ, অনুচর্য্যা ও তীব্র কর্ম্মসহ নিষ্ঠাসহকারে নামধ্যান করে, তবে অল্প সময়ের মধ্যে ঢের এগিয়ে যেতে পারে। পুরুষোত্তমই ইষ্ট, পুরুষোত্তমই ধ্যেয়। তাঁর অন্তর্ধানের পরও তিনিই মানুষের ইষ্ট ও ধ্যেয় হ’য়ে থাকেন, যতদিন পর্য্যন্ত তাঁর পুনরাবির্ভাব না ঘটে। তাঁর অনুগামীদের কাজ হ’ল তাঁকেই লোকসমক্ষে তুলে ধরা। মানুষের প্রাপ্তব্য হলেন ঈশ্বর এবং পুরুষোত্তমই হ’লেন রক্তমাংস-সঙ্কুল আমান ঈশ্বর। আবার, পুরুষোত্তমকে নিজ জীবন দিয়ে যিনি যতখানি অবিকৃতভাবে ধারণ, বহন, প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশ করেন, যাঁর চরিত্র ও ব্যাক্তিত্ব যতখানি ইষ্টানুরাগসন্দীপী, তিনি ততখানি পূজনীয় মানুষের কাছে।
(আঃ প্রঃ ১১ খণ্ড থেকে সংগৃহীত)
।। প্রত্যেককে নামধ্যানে অভ্যাস করাবার পদ্ধতি ।।
শ্রীশ্রীঠাকুর কয়েকজনকে লক্ষ্য ক’রে বললেন –খুব সকালে উঠে ভোর চারটের মধ্যে প্রাতঃকৃত্যাদি ও নামধ্যান সেরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জাগরণী গান গেয়ে সবাইকে জাগিয়ে দিতে হয়। তাড়াতাড়ি যাতে নামধ্যানে বসে তা’ করতে হয়। ওতে লোকে আনন্দ পায়, স্ফূর্তি পায়, তাদের শরীরও ভাল থাকে। আগে যতদিন ভোরে সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে নামধ্যান করিয়েছি, ততদিন মানুষ অকালে মরেনি। তাই প্রত্যেককে এটা করানো লাগে।
(আ. প্র. ১৬/ ১৫. ৪. ১৯৪৯)
।। মৃত্যুকে অবলুপ্ত করার সহজ উপায় ।।
শ্রীশ্রীঠাকুর অমনি বললেন—অশ্বিনীদা, regular সাধন যে করে তার আর মৃত্যুভয় থাকে না। সে জীবন্তে ম’রে দেখে, death point এত বেশী দূর নয় যে কিছুকাল regular সাধন করলে তাহা না feel করা যায়। কিন্তু যে তাহা একবার feel করেই আবার সাধন ছেড়ে দেয় তারও কিন্তু অসুখে ভুগে মরতে হয়। আর, যে তা’ feel করেও regular সাধন করতে থাকে, তার শরীরধ্বংসকারী অসুখ হলে ইচ্ছায় মনকে শরীর থেকে তুলে নিয়ে death point সহজে pass করে; বড় একটা কষ্ট পায় না—অভ্যাস রাখতে হয়। তবে একবারও যে জীবন্তে তা’ feel করেছে সেও রোগে ভুগতে-ভুগতে সেই point-এর কাছে গেলে তার সেই সংস্কার জেগে ওঠে এবং সেও তখন তাতে concentrate করে ভাল idea-তে absorbed হয়ে (যথা, সদ্গুরুধ্যান ইত্যাদি) দেহত্যাগ করে; ফলে সদগতি হয়। আর, যার অভ্যাস আছে, সে তো কতবার death point অনুভব করে ফিরে আসছে, সে অসুখে বেশী ভোগে না; সে-রকম দেখলে তো ঐ point-এ concentrate করে সদগুরুর ধ্যানে absorbed হয়ে শরীর ছাড়ে। Death-টা হচ্ছে কর্মসংস্কারগত একটা idea-তে বেশী absorbed হ’য়ে এই ব্যক্তিত্ববোধ হারান। এই আমি অশ্বিনী রূপে যে আমিত্ব-বোধ-এর সঙ্গে সম্বন্ধরাহিত্য, এই আমিত্বের সঙ্গে যে connecting links আছে তাহা cut off হয়ে যায়। যে idea-টা তকালে predominant থাকে তাতে absorbed হয়ে যেন তাহাই আমি—এইভাবে তন্ময় হয়ে এই আমিত্বকে বিস্মৃত হওয়া। একপ্রকার লয় আর কি। সাধকেরও লয় বহুবার ঘটবার মত হয়, উচ্চ-উচ্চ ধামে (plane-এ) যখন গতি হয়, তখন তাতে absorbed হয়ে লয় হয়। যে যত তীব্র সাধক, সে লয় তত রক্ষা করে-করে উচ্চ হতে উচ্চতর লোকে যায়। আর, যেখানে গিয়ে লয় এসে যায়, সেই তার খতম।
(সূত্রঃ অমিয়বাণী)
।।মৃত্যুকালে নাম করার কি ফল হয়।।
একজন জিজ্ঞাসা করলেন– মরার সময় নাম করে, তার ফল কী হয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর — সেটা যদি তার সত্তাকে স্পর্শ করে তবে ভাল হয়। সত্তাকে স্পর্শ না করলে পরজন্ম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ফলপ্রসূ হয় না। অর্জ্জিত সংস্কার যেমন সত্তাসঙ্গত না হ’লে সন্তানে বর্ত্তায় না। (আঃ প্রঃ ২০/১৭. ৭. ১৯৫১)
।।প্রার্থনা করা বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ভাষণ ।।
“আমরা প্রার্থনা করি কেন ? প্রার্থনার গোড়ার ব্যাপার হচ্ছে সঙ্কল্প-উদ্দীপ্ত হওয়া। সঙ্কল্প উদযাপনের জন্য যেমন ক’রে ভাবতে হয়, বলতে হয়, করতে হয়, আবেগ-আগ্রহকে উদ্বুদ্ধ ক’রে আপ্রাণ সম্বেগে তা’ করাকেই কয় প্রার্থনা। উন্মাদনা নাই, ভাব নাই, আগ্রহ নাই– সঙ্কল্প সেখানে সফল হয় কম । Determination যদি পাকা না হয়, ভাব যদি গম্ভীর না হয়, তা’ সুসিদ্ধ হয় না । প্রার্থনা করার মানেও তাই– ঐ সঙ্কল্প ও ভাবকে পাকা ক’রে তুলে সেই পথে চলা ।”
(ইংরাজী 12. 02. 1950 যতি আশ্রম প্রাঙ্গনে, সেগুন গাছের নীচে, চৌকিতে বসে, মাইকের সামনে যে ভাষণ দান করেছিলেন তার নির্বাচিত অংশ।
সূত্রঃ মহামানবের সাগর তীরে, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১০)
।। প্রার্থনা করা প্রসঙ্গে ।।
মিঃ হক — মুখে বার-বার বললে, প্রার্থনা করলে কি হবে ? বিশেষতঃ আমাদের আরবী- ভাষার পদগুলির অর্থই তো অনেকে বোঝে না। এমনতর আওড়ানিতে কি কোন ফল হয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর —“আবৃত্তিঃ সর্ব্বশাস্ত্রানাং বোধাদপি গরীয়সী”। আবৃত্তি চালাতে থাকলে ধীরে ধীরে বোধও ফুটে ওঠে। ওগুলি বাদ দিতে নেই — অবশ্য অর্থের
ব্যুৎপত্তি না হ’লে চলা, করা ঠিক-ঠিক ফুটে ওঠে না।
প্রার্থনা মানে, করার ভিতর-দিয়ে প্রকৃষ্টভাবে কোন-
কিছু অধিগত বা আয়ত্ব করা । যেটাকে প্রার্থনা বলেন
, ওটা হ’লো auto-suggestion (স্বতঃ-অনুজ্ঞা) বিশেষ। প্রার্থনার মধ্যে আছে বাস্তব করা। প্রার্থনা
বিঃ দ্রঃ প্রার্থনা করার সময়ে হারমোনিয়ামাদি বাজনার ব্যবহার নিষেধ করেছেন শ্রীশ্রীঠাকুর।
(ধৃতি-বিধায়না, ২য় খণ্ড, বাণী সংখ্যা ৩২৫)
।। তপো-বিধায়না গ্রন্থ থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্যবাণী ।।
********************************
“প্রার্থনা বা তপঃ-উপাসনার পক্ষে
*ঊষা বা ব্রাহ্মমুহূর্ত্ত,
মধ্যাহ্ন ও সায়ংকাল—
এই তিনই শ্রেষ্ঠ,
তা’র ভিতর আবার
ব্রাহ্মমুহূর্ত্তই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ;
মানসিক জপ সর্ব্বকালেই শ্রেয়;
আবার, প্রসন্ন, নির্দ্বন্দ্ব,
হৃদ্য-প্রীতি-প্রবুদ্ধ-যাজন
যা’ চিন্তন ও কথনের ভিতর-দিয়ে
উভয়কেই উদ্যোগী-উৎফুল্ল ক’রে তোলে,—
তা’ কিন্তু সর্ব্বকালেই শ্রেষ্ঠ।” ৯৩।
*শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রুতিবাণী অনুযায়ী ঊষা-নিশায় মন্ত্রসাধন দৈনন্দিন সাধনার জন্য আবশ্যিক বিষয় হওয়া সত্বেও ব্যক্তিগত ও সংঘগত সৎসঙ্গের উৎসব-অনুষ্ঠানগুলোতে ওইসময় ঊষা-মাঙ্গলিকী/প্রভাতী কীর্তন অনুষ্ঠানের নামে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে যে-সব অনুষ্ঠান করা হয় সেগুলি কিভাবে চালু হলো আমার জানা নেই, কোন সহৃদয় ভক্ত জানালে বাধিত হবো।
তুমি তোমার একক উপাসনাকে
পূত নিষ্ঠায়
সুমার্জ্জিত অনুশীলন-তৎপরতায়
অব্যাহত রেখে
বিশুদ্ধ শরীর ও পবিত্র অন্তঃকরণে
সমবেত প্রার্থনায় যোগ দাও,
কিন্তু সমবেত প্রার্থনাকে সর্ব্বস্ব ধ’রে নিয়ে
একক-উপাসনাকে পরিত্যাগ ক’রতে যেও না।
(২৪২, তপোবিধায়না ১ম)
।। সন্ধ্যা ও প্রার্থনা।।
সৎসঙ্গ অধিবেশনে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ‘চলার সাথী’ গ্রন্থটি অবশ্য পাঠ্য হিসেবে মান্য করা হয়। উক্ত গ্রন্থের ৯৯ সংখ্যক বাণীতে বলা আছে—
ঐ রকমের ভিতর-দিয়া যথাবিনিয়োগে উহারই আবৃত্তি স্নায়ুমন্ডলকে উদ্দীপ্ত করিয়া হৃদয়কে তজ্জ্যোতিসম্পন্ন করতঃ উচ্ছলতায় সংবুদ্ধ ও কৰ্ম্ম-সন্দীপনায় সংবৃদ্ধ করিয়া তোলে—-
ইহা অতি নিশ্চয়! (পথের কড়ি, পৃঃ ১৮৯)
*এই শ্রুতিবাণী অনুযায়ী পুরুষোত্তমের শ্রীমুখনিঃসৃত দীপ্তভাষা ব্যতীত অন্যান্য গুরুদের রচনাসমূহ সন্ধ্যাবন্দনায় বা প্রার্থনায় আবৃত্তি করা চলে কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র দৈনন্দিন সাধনার সন্ধ্যা ও প্রার্থনার অনুশীলন বিষয়ে বলেছেন—“তবে আমার মনে হয়, আমাদের সন্ধ্যামন্ত্র যা আছে গায়ত্রী, প্রাণায়াম বাদ দিয়ে—সেগুলি congregational (সমবেত) প্রার্থনা-হিসাবে চলতে পারে। ভাবের প্রতি নজর রেখে অর্থবোধ নিয়ে, ঐগুলি পাঠ বা আবৃত্তিতে এবং একটা পাঠের পর চোখ বুজে একটু চিন্তায়, মন—এমনকি শরীর পর্য্যন্ত কেমনতর হ’য়ে ওঠে, কিছুদিন একটু করলেই হাতে-হাতে বোধ করতে পারা যায়। ভাবের সহিত ঐ শব্দগুলি উচ্চারণে এতই তীব্রতা ও enlightenment (প্রবোধ) এনে দেয় যা’তে নাকি পারিপার্শ্বিক-সহ সমস্ত জীবনটাই কেমনতর জীবনে মুহূর্তে যেন উদ্বুদ্ধ হ’য়ে ওঠে। গায়ত্রী ও প্রাণায়াম বাদ এই জন্য বললাম—ইহা জপ ও চিন্তার সহিত meditation (ধ্যান)-এর জন্য, তাই উহা নিরিবিলি হ’য়ে করতে পারলেই ভাল।
“Enlightened (প্রবুদ্ধ) আর্য্যরা জড়ের পুজো নিয়ে কখনই বেকুবের মতন ব্যাপৃত ছিলেন না। সূর্য্য, বাতাস, জল ইত্যাদি সেই পরমপুরুষের দান–যা, প্রতিনিয়তই আমাদের জীবন ও বৃদ্ধিকে invigorate (উজ্জীবিত) ও accelerate (ত্বরান্বিত) করছে। তাদের উপলক্ষ্য ক’রে সেই Almighty (সর্বশক্তিমান)-তে কৃতজ্ঞতার সহিত আকৃষ্ট বা মুগ্ধ হতেন। আর, যে-প্রার্থনার কথা পূর্ব্বে বলেছি তা’ congregation-এর মধ্যে: সবাই–ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এমন-কি শূদ্রও–অবলীলাক্রমে করতে পারেন।
(নানা-প্রসঙ্গে–৪র্থ খণ্ড পৃষ্ঠা-১৫২)
** প্রার্থনা জিনিসটা কি এবং কেন করতে হবে **
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র রচিত প্রার্থনা (৩য় সংস্করণ) পুস্তিকার
অবতরণিকা থেকে—
“বাস্তব প্রার্থনাসমূহ ঋষিরই বাণী। তাই বেদের মন্ত্রগুলির বক্তা হচ্ছেন ঋষি। যাঁর মন একে নিয়ন্ত্রিত— স্বতঃ-মনন দ্বারা যিনি বিষয়সমূহকে গভীর প্রজ্ঞালোকে সম্যক্ দর্শন করেন তিনিই হচ্ছেন ঋষি ৷ এই ঋষিব্যক্তিত্ব জগতে এক দুর্লভ সামগ্রী। মননশীল মনীষী বা মুনি অনেকেই হন কিন্তু দ্রষ্টাঋষি যখন-তখন, যেখানে-সেখানে মেলে না। তাঁর জন্মার্জিত সহজ সংস্কার ও বৈশিষ্ট্য, তাঁর জীবন, তাঁর চরিত্র, তাঁর বোধ, তাঁর অনুভব — তাঁর কৰ্ম্ম, তাঁর বহুদর্শন—এদের ভিতর থাকে এমন একটা সমঞ্জস একতানতা –Complete harmony — এমন একটা Sincere integrity — একনিষ্ঠ সমাহার — যা’র ভিতর দিয়ে এক মোহন প্রজ্ঞাঘন ব্যক্তিত্বের উদ্ভব হয় – প্রেমে, সম্বোধনায়, চারিত্র্যে, ঔজ্জ্বল্যে, অন্তর্গূঢ় দূরদৃষ্টি ও সহানুভূতিতে তিনি হন মহনীয়, বরণীয় – সর্ব্বলোকেশ্বর প্রভু। আন্তরিকভাবে বাস্তব একনিষ্ঠ যিনি নন তাঁর সহৃদয়তা পূত, পবিত্র, একান্ত হ’য়ে ওঠে না – তাই প্রবৃত্তিখচিত মন “যাহা চায় তাহা ভুল ক’রে চায়, যাহা পায় তাহা চায় না”—এমনতর মন প্রতি পলে পলে বৃত্তিপ্ররোচনায় বিচ্ছিন্নভাবে নানানটা চেয়ে বসে। কিন্তু যিনি পথ পেয়েছেন – বা যিনি পরম-পিতার সহিত একান্ত ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র সমগ্র অন্তর দিয়ে, সমগ্র সত্তা দিয়ে রচনা করেছেন তাঁর আকুল প্রার্থনার একনিষ্ঠ উলঙ্গ তীব্রতা ও সত্যতা বিশ্বমানবের মনে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে। তাই বশিষ্ঠ-সৃষ্ট ব্রাহ্মণ বিশ্বামিত্রের অন্তর্ভেদী ব্রহ্মমন্ত্র গায়ত্রী হ’য়ে উঠল— যে গান করল প্রাণের তীব্র প্রেরণা নিয়ে সেই ত্রাণ পেল, যীশুখৃষ্টের Lord’s Prayer প্রতিটি মানবের প্রাত্যহিক জীবনের সম্পূর্ণতার আকুল আকাঙ্ক্ষাকেই রূপদান করল—চিরন্তন ক’রে তুলল মানবজাতির উন্নয়নের মহনীয় আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলিকে কৃষ্টিপথে অধিগত করতে, দিব্য প্রার্থনারূপে ঋষির অন্তরাত্মার প্রাণফাটা ক্রন্দনের মধ্য দিয়ে উদ্ভিন্ন হ’য়ে উঠল বেদমন্ত্রসমূহ সাৰ্ব্বজনীন ব্যক্তিত্ব-স্ফুরণে। হয়ে উঠল ভারতের সভ্যতার এই চিরন্তনী ধারা — শুধু ভারত কেন, সারা বিশ্বেই ইহার পরিব্যাপ্তি। হজরত মহম্মদে প্রার্থনা, যীশুর প্রার্থনা, শ্রীবুদ্ধের সঙ্কল্প, শ্রীরামকৃষ্ণের আকুল প্রার্থনা, ঋষিগণের প্রার্থনা, মৈত্রেয়ীর প্রার্থনা — জগতের মহামনীষিগণের প্রার্থনা-সাহিত্য মন্থন ক’রে মানবের কল্যাণ ও উন্নয়ন-পথের প্রধান মণি-মাণিক্যসমূহ সংগ্রহ করে সর্বজনের প্রেরণা, এষণা ও মনঃশক্তিকে একাগ্র এবং মহিমান্বিত করে তোলবার জন্য প্রকাশ করার আজ বিশেষ প্রয়োজন। সহৃদয়, একনিষ্ঠ, Sincere মানবের প্রার্থনা কর্ম্মপ্রেরণাকে সঞ্জীবিত ক’রে তোলে সত্য পথে সুষ্ঠু রকমে । তাই, এই প্রার্থনাসমূহ চয়ন ক’রে ও প্রয়োজন হ’লে অনুবাদ ক’রে আজ বাংলার জাতীয় সাহিত্যকে ঐশ্বর্য্যশালী ক’রে তোলা প্রতি চিন্তাশীল ব্যক্তিরই কর্তব্য—মনীষী ও ঋষির আকুল প্রার্থনা-মণ্ডিত প্রেরণাগুলি যদি আমাদের নিত্য জীবনের আবেগ-আকাঙ্ক্ষাগুলিকে নিয়ন্ত্রিত ক’রে, স্ফুরিত ক’রে বাস্তবে রূপায়িত ক’রে তোলে, তাহাতে জাতীয় শক্তিরই উদ্বোধন হয়—তাহা সাহিত্যের অপূর্ব্ব রত্ন ।
আর, এই সাহিত্যকে বরণ ক’রে জাতীয় জীবনে জীবন্ত ক’রে গৃহে গৃহে মঙ্গল-শঙ্খনিনাদে প্রতিষ্ঠিত করতে হ’লেই সৰ্ব্বপ্রথম আমাদের চাই বর্ত্তমান ঋষির প্রাণের গভীর অনুভূতিময় প্রার্থনাসমূহের সহিত পরিচিত হওয়া, তাহাদের ভাবধারার অমৃত রসসিঞ্চনে নিজেদের জীবনকে পুত-আবেগমণ্ডিত, কৰ্ম্মঠ ক’রে তোলা ।
তাই, পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের নবীন সাহিত্য হইতে বেদমন্ত্রের ছায়াবলম্বনে বাংলা ভাষায় যে সন্ধ্যাপ্রার্থনা মন্ত্র তাঁর গভীর অনুভূতির উপর দাঁড়াইয়া দান করিয়াছেন তাহাই আজ দেশবাসীর নিকট উপস্থাপিত করিতেছি। তাঁর ভাষার বেদমন্ত্রবৎ নির্ঘোষ, তাঁর প্রার্থনার Classic মহিমা, তাঁর প্রার্থনার romantic ঝঙ্কার ইহাকে একটি বিশিষ্ট শাশ্বত নবীন রূপদান করিয়াছে— আমাদের বাংলা ভাষায় আমরা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের অমিয় বাণী, চিঠি, সমাধি-অবস্থার অপূর্ব্ব ভাববাণী, কবিতা, ছড়া, গদ্য, পদ্য, বহু উক্তি ও লেখা পাইয়া ধন্য হইয়াছি— বঙ্গসাহিত্য ঋষির বাণী ও লেখনীতে আজ বাস্তবিকই কৃতার্থ হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তাঁর এই সামমন্ত্রবৎ গভীর প্রার্থনারাজি বেদের ঝঙ্কার তুলিয়া আজ বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতার প্রাত্যহিক জীবনের নিত্যকর্ম্মকে প্রাণবন্ত, গভীর ও মহনীয় করিয়া তুলিয়া বীর্য্যবতী কর্মদ্যোতনায় ভরপূর করিয়া তুলিল – বঙ্গসাহিত্যে এমনতর অবদান আজ পর্য্যন্ত আমরা আর কোন অনুভব-সম্পদে বরিষ্ঠ মহাপুরুষের শ্রীমুখ হইতে পাই নাই—ইহা অপূৰ্ব্ব—ইহার ধ্বনি মনকে শক্তিমান করিয়া গড়িয়া তোলে—ইহার বৈদিক-ঐতিহ্য-প্রবোধী সমর্থ ভাবধারা জীবনকে মেরুদণ্ডশালী সমর্থ করিয়া তোলে— ভাববিলাসী জাতিকে পূত সংকল্পের দিকে, কর্ম্মঠ জীবনের পূর্ণ আদর্শের প্রেরণা দান করে ।
আজ জাতির এই দুর্দ্দিনে, জাতীয় শক্তির এই ক্ষীণ-স্রোতা দুর্বল মুহূর্ত্তে সে পুরশ্চরণ-প্রার্থনামন্ত্র ঋষির কম্বুকণ্ঠে বাংলার মাটিতে, বাংলার ভাষায় বিঘোষিত হ’ল—আশা করি, দেশবাসিগণ দৈনন্দিন জীবনে তাকে প্রত্যেকে অনুসরণ ক’রে নিজ শক্তির উৎসকে বাধানির্ম্মুক্ত ক’রে প্রাণবান হয়ে উঠবেন, অমৃতকে লাভ ক’রে ধন্য হ’য়ে উঠবেন, সাৰ্থক হ’য়ে উঠবেন—তবেই আমাদের এ প্রার্থনামন্ত্ৰ পাওয়া আজিকার জাতির এই ঘনঘটা সমাচ্ছন্ন কালরাত্রির মহানিশায় কৃতকৃতার্থ হ’য়ে উঠবে।”
বন্দে পুরুষোত্তমম্ !
সৎসঙ্গ, দেওঘর ( বিহার ) বিনয়াবনত
১লা শ্রাবণ, ১৩৫৬ শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচাৰ্য্য
তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা
আর্য্যদ্বিজগণের সন্ধ্যা-প্রার্থনার বেদবাণীসমূহ ‘প্রার্থনা’ নামে এই পুস্তিকায় বাংলা ভাষায় এনে দিয়েছেন পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র । সাধনপথের অগ্রগতিতে পরমসহায়ক, নিত্য-অনুধ্যেয় এই বাণীগুলি ঘরে-ঘরে পঠিত ও অনুসৃত হ’য়ে মানুষকে দিব্য চেতনায় সমারূঢ় ক’রে তুলুক এই আমাদের প্রার্থনা পরমপিতার শ্রীচরণে।
বিঃ দ্রঃ এই প্রার্থনা পুস্তিকার প্রকাশক শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জ্যেষ্ঠপুত্র পূজনীয় শ্রীযুক্ত অমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী মহোদয় ভূমিকা মাধ্যমে সবাইকে সন্ধ্যা-প্রার্থনা নিত্য অনুশীলন করার আবেদন রেখেছেন। কিন্তু দেওঘর সৎসঙ্গের কর্ত্তৃপক্ষ দীর্ঘকাল ধরে প্রার্থনা না করে, মাসে মাসে প্রার্থনার সময়সূচী প্রকাশ করলেও ঠাকুরবাংলোর পার্লারে ওই আবেদনকে অগ্রাহ্য করা হয়। শ্রীশ্রীঠাকুরের রচিত উক্ত সন্ধ্যা ও প্রার্থনা করা হয় না! শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বিধানে যার নাম দ্বন্দ্বীবৃত্তি।
।। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বিধান মতে প্রাতঃকালিন সন্ধ্যা ও প্রার্থনার প্রস্তুতি ।।
।। *জাগরণী।।
“ওঠো, জাগো—
বরণীয় যিনি তাঁতে
নিবুদ্ধ হও—
ঊষা এল আজ
এ-জীবনে নবীন হ’য়ে
নবীন উদ্যমে—অর্ক আলোকে,
উদ্বুদ্ধ ক’রে তোল
তাঁরই জীবনমন্ত্রে—
ওঠ, আসন গ্রহণ কর,
প্রার্থনা কর,
প্রবুদ্ধ হ’য়ে সকল কর্ম্মে
তাঁকে পরিপালন কর,
শান্তি আসুক,
স্বধা আসুক,
স্বস্তি আসুক,
তোমার জীবনে জীবন্ত হ’য়ে।” (সম্বীতি)
(আঃ প্রঃ ১৬/১৫. ৪. ১৯৪৯)
*শ্রীশ্রীঠাকুরের নিদেশ মেনে ব্রাহ্ম মুহূর্তে সবাইকে নামধ্যানের মাধ্যমে অনাহত-নাদ বা মন্ত্রসাধন করার প্রস্তুতির জন্য জাগরণী গানে আবেদন জানানো হতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় উৎসব-অনুষ্ঠানগুলোতে উক্ত মন্ত্রসাধনের নিদেশ না মেনে বরং ঊষা-মাঙ্গলিকীর অনুষ্ঠানের নামে মন্ত্রসাধনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হয়!
———————————————————————————————————-
শ্রীশ্রীঠাকুর কয়েকজনকে লক্ষ্য ক’রে বললেন–খুব সকালে উঠে ভোর চারটের মধ্যে প্রাতঃকৃত্যাদি ও নামধ্যান সেরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জাগরণী গান গেয়ে সবাইকে জাগিয়ে দিতে হয়। তাড়াতাড়ি যাতে নামধ্যানে বসে তা’ করতে হয়। ওতে লোকে আনন্দ পায়, স্ফূর্তি পায়, তাদের শরীরও ভাল থাকে। আগে যতদিন ভোরে সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে নামধ্যান করিয়েছি, ততদিন মানুষ অকালে মরেনি। তাই প্রত্যেককে এটা করানো লাগে। (আ. প্র. ১৬/ ১৫. ৪. ১৯৪৯)
।।সান্ধ্যকালিন সন্ধ্যা ও প্রার্থনার প্রস্তুতি ।।
।। *সায়ন্তনী ।।
প্রাক্-সায়াহ্নে সায়ন্তনী আবৃত্তি। “সূর্য্য পাটে বসেছে— সন্ধ্যা তার তামসী বিতানে ঘাটে-বাটে ছড়িয়ে পড়েছে— স্নিগ্ধ ক’রে— বিশ্রামে ভুবনকে আলিঙ্গন করে, তাপস! শান্ত হও! বরেণ্য যিনি— তোমার সব মন দিয়ে তাঁতে ছড়িয়ে পড়, উপাসনা কর তাঁর— দিনের সব কর্ম্মের সাথে যা’-কিছু করেছ—স্মরণে এনে নিবেদন কর তাঁকে—সার্থকে, বিশ্রামের সুষুপ্তি-অঙ্কে এলিয়ে দিয়ে— তোমার সসত্ত্ব শরীর, উন্মাদনার সৎমন্ত্রী সোমরস পান ক’রে সুপ্তি পাও—তৃপ্তি পাও— সুস্থি পাও— উদাত্ত জীবনে আবার জেগে উঠতে।” (সম্বীতি)
————————————————————————————————–
*সায়ন্তনীর আত্ম-বিশ্লেষণসূচক বাণীসমূহ অর্থবোধক মননশীলতায় আবৃত্তি করার পর মন্ত্রসাধন/নামধ্যান করার পর হুলুধ্বনি শঙ্খধ্বনী পূর্বক অগ্রণী কর্তৃক আহ্বানী মন্ত্রের উদঘোষ হওয়া বাঞ্ছনীয়, অবিকৃত সাধনার স্বার্থে।
।। আহ্বানী ।।
“তমসার পার—-
অচ্ছেদ্যবর্ণ
মহান্ পুরুষ
ইষ্টপ্রতীকে আবির্ভূত !
যদ্বিদাচারণে
তদুপাসনাতেই
ব্রতী হই !
—জাগ্রত হও
আগমন কর—
আমরা যেন একেই অভিগমন করি,
একোদ্দেশ্যেই বাক্, কর্ম্ম বিনিয়োগ করি,
একনিরন্তরতায়
সেই তাঁকেই যেন জানিতে পারি,
শ্রদ্ধানুসৃত—
আপূর্য্যমাণ
ইষ্টৈকপ্রাণনায়
একই মন্ত্রে একই মননে
সমষ্টি-উৎসারণায়
বৈশিষ্ট্য-পূরণী একচেতনাভিমন্ত্রণে
শিষ্ট হবিঃ ও শ্রেষ্ঠ হবনায়
সমান আকূতি ও সম্যক হৃদয়ে
জীবন-বর্দ্ধনে
ঋদ্ধিমান্ হই !
স্বস্তি ! স্বস্তি ! স্বস্তি !”
————————————————————————————————-
।। আহ্বানী মন্ত্রের কতিপয় অর্থ ।।
১. অচ্ছেদ্যবর্ণ—বর্ণের ছেদ নাই যেখানে, সকল বর্ণের সমাহার। উপনিষদের ‘আদিত্যবর্ণ’ এর অনুবাদ, শ্রীশ্রীঠাকুরকৃত। কোটি সূর্য্যের দীপ্তির ন্যায় জ্যোতির্ম্ময়। সূর্যকিরণের মধ্যে সাতটি রং সমানভাবেই আছে। সূর্যকিরণ পেতে হ’লে সাত রংকেই সমানভাবে পেতে হবে। তেমনি পুরুষোত্তমও সব কিছুর সামগ্রিক সমাহার। [আদিত্য = অখণ্ড, অচ্ছেদ্য] “তমসার পার অচ্ছেদ্যবর্ণ মহান পুরুষ।”
২. যদ্বিদাচরণ—যে আচরণে জানা যায় ; জ্ঞান লাভের যে আচরণ।
ব্যক্তি-দম্পতি-গৃহ-সমাজ-রাষ্ট্রের হবে উন্নয়ন যজন-যাজন-ইষ্টভৃতি-স্বস্ত্যয়নীর তাই কর প্রবর্তন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নিয়ন্ত্রণে অনুশাসন দাও বর্ণাশ্রমের, আৰ্য্যপথই তুমি সর্বকালের!
ধর্মের গ্লানিতে ভীত, বৃত্তিবশে আবর্তিত পৃথিবীর বুকে সকল বাদের মোহহারী, সত্তাধর্মের স্থাপনকারী সর্বতোভাবে পূরণে রত ইষ্ট এক ও অদ্বিতীয়,— যুগাদর্শ তুমিই সর্ব্বোত্তম !
অধিজাত—অধিকার করে জাত, আশ্রয় করে জাত। প্রত্যুত্থিত—সাড়ার প্রতিক্রিয়ায় উত্থান। সাড়াসম্পাদনী—প্রতিক্রিয়া সম্পাদন করা। গর্জ্জমান—গর্জন করছে, শব্দ করছে। উদ্দৃপ্ত—অতি অহংকারে তেজীয়ান। সম্বৎসর—সাড়া বছর। বোধপাত—উপলব্ধি হওয়া। বিধায়িত—বিধান, বিধি, বা নিয়মনায় আবদ্ধ। সৃজনপ্রলয়ক্ষম—সৃষ্টি এবং ধ্বংস করতে সক্ষম। বশী—যিনি বশ করতে পারেন, জানেন। বিধিনিঃসরনে—বিহিত ধারণপোষণের ক্রিয়া ক্ষরিত হওয়ায়। বিসৃষ্ট—বিশেষরূপে সৃষ্ট। আবিশ্বে—বিশ্ব জুড়ে। কল্পনা বিধানে—বিধি নিয়ন্ত্রিত বিধানে। আপূর্ব্ব—পূর্ব থেকেই।
স্ব-অয়নস্যূত=নিজ পথের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৃত্তি-অভিধ্যান=বৃত্তি অভিমুখিনতা। অস্তি—অস্তিত্ব। চিদায়িত—চৈতন্যপ্রাপ্ত। ব্যাবর্ত্ত—বিরূপ আবর্ত্ত। ব্যোম-বিজৃম্ভী— (হা করা আকাশের প্রকাশক।) উল্লম্ফি—লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চলা। অর্ণব—সতত গতিশীল। অন্তরীক্ষ—সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থান।
*বৃত্তি-অভিধ্যান*—পুরুষ নিষ্ক্রিয়, স্বীয় ভাবে স্থিত। কিন্তু সৃষ্টির জন্য চাই বৃত্তি-অভিমুখিনতা, অর্থাৎ কোন-একটা বিশেষ ভাবনার বৃত্তের মধ্যে অভিনিবিষ্ট হওয়া। তা’ না হ’তে পারলে সৃষ্টিক্রিয়া সম্ভব হয় না। ইহাই ‘বৃত্তি অভিধ্যান’। সংঘাত-শিথিল—কর্মচাঞ্চল্য যেখানে শিথিল।
উদ্দৃপ্ত—শ্রেয়-আনতির ভিতর দিয়ে যে দৃপ্তভাব আসে।
“একই বাপ-মায়ের পাঁচটি সন্তান পাঁচরকম হয়। কারণ, উপগতির সময় নারী, পুরুষকে যখন যেমন প্রেরণা দেয়, পুরুষের ভিতরকার তেমনতর জিনিসই তখন বেরোয়। *স্ব-অয়ন-স্যূত বৃত্ত্যাভিধ্যান তপস্যায় গতি ও অস্তি অধিজাত হয়েছে।* সেখানে স্ব হচ্ছে যেন পুরুষ, sperm. (বীজ), বৃত্তি যেন প্রকৃতি ovum (ডিম্বকোষ), আর অভিধ্যান হলো cohesive affinity. (যোগাবেগ)। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রেরণায় একই পুরুষের ভিতর থেকে বিভিন্ন গুণের সৃষ্টি হ’লো। যত রকমের গুণই থাক না কেন, তার Grand division (প্রধান বিভাগ) ঐ চার বর্ণের মধ্যেই রয়েছে। শুধু মানুষের জন্যই নয়, জীব-জগতের সব স্তরেই চাতুর্ব্বর্ণ রয়েছে, সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই বর্ণ ঢুকে গেছে। প্রথম থেকেই তা instinct হিসাবে থাকে। Environment (পারিপার্শ্বিক) এর মধ্যে তা প্রকাশিত হয়। Generation after generation (বংশ পরম্পরায়) সেই ধারা চলে।” (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড / ১৭৩-১৭৪ পৃঃ)
———————————————————————————————-
৩। আহুতি মন্ত্র।
হে সূর্য্য ! হে আমাদের
জীবন ও বৃদ্ধির উদগাতা ! আবশ্যকীয় যজ্ঞ ! হে মহান্ আচরণপ্রতিষ্ঠ শ্রেষ্ঠ যজ্ঞকর্ত্তৃগণ !
আমাদের অনভিধ্যাত
অসাঙ্গযজ্ঞকৃত
অভিনিঃসৃত পাপ হইতে রক্ষা করুন ! আমরা আমাদের প্রবৃত্তিস্বার্থ-সম্পাদন-প্রলুব্ধ হইয়া অহোরাত্রিতে আদর্শবিমুখ-ইন্দ্রিয়-বশবর্ত্তিতায় মন, বাক্য, হস্ত, পদ, উদর ও শিশ্নদ্বারা যে সমস্ত জীবন-ক্ষয়কারী দুরিতকর্ম্ম করিয়াছি, আলোক তাহা অবলুপ্ত করিয়া দিউক,— এই আমি— আমাকে পরম-অমৃত-যোনিসম্ভূত ধ্বান্তারি সূর্য্য-জ্যোতিতে আহুতি দিলাম !
(পাঠ বিধি— বীরাসনে বসিয়া গোকর্ণাকৃতি দক্ষিণ হস্তে বায়ু লইয়া মন্ত্র পাঠ করিয়া জল-কল্পনায় ঐ বায়ু পান করিতে-করিতে মনে করিবে—ঐ বায়ু সূর্য্য-জ্যোতিতে মহান জ্যোতিষ্মান হইয়া উঠিয়াছে—উহা পান করিয়া আমার সমস্ত পাপ উহাতে নিঃশেষে আহুতি হইয়া অন্তঃস্থ প্রতি-কণা মহতী জ্যোতিষ্মতায় পরিণত হইতেছে।)
————————————————————————————————-
উদ্গাতা=উন্নতির গান করেন যিনি।
যজ্ঞ=লোক-সম্বর্দ্ধনী অনুচর্য্যা।
অনভিধ্যাত=যাহার সম্যক ভাবনা করা হয়নি। অসাঙ্গ=যা সমাপন করা হয়নি। অভিনিঃসৃত=তজ্জনিত ক্ষরণযুক্ত। প্রবৃত্তিস্বার্থ-সম্পাদন-প্রলুব্ধ=বন্ধুরূপী শত্রু ষড়রিপুর ইশারায়, প্রবৃত্তিলোলুপ চলনে চলতে অভ্যস্ত। অহোরাত্র=দিবানিশি/সর্বদা। শিশ্ন=জননেন্দ্রিয়।
(পাঠবিধি : পূর্বোক্ত বীরাসনকে সুখাসনে পরিবর্তিত করিয়া বসিয়া ঐ মন্ত্রার্থ চিন্তা করিতে-করিতে একবার প্রাণায়াম অর্থাৎ পুরক, রেচক ও কুম্ভক করিতে হইবে।)
————————————————————
মন্ত্রার্থ :
দ্যুলোকায়িত স্বঃ=স্বর্গের অনুরূপ ভাবলক্ষণযুক্ত।
উৎসবপ্রাণ মহঃ=উন্নতিপ্রসব করাই যা’র বৈশিষ্ট্য।
উদ্ভবাত্মক জনঃ=সৃষ্টিকারী লোক।
তাপোদ্বুদ্ধ তপঃ=তাপের দ্বারা জাগরিত তপস্যা।
বিদ্যমানতার প্রতীক=বেঁচে থাকার ক্রিয়া বা অস্তিত্ব সম্পন্নতার প্রতীক বা চিহ্ন।
সবিতা=সূর্য্য।
ধী=বোধ, জ্ঞান, প্রজ্ঞা।
জ্যোতি=তেজ, দীপ্তি।
প্রণব=প্রকৃষ্টভাবে স্তব করা।
——————————————————–
৫। সাবিত্রী মন্ত্র (২)।
ওঁ ভূঃ—যাহা উৎপন্ন হইয়াছিল, ভুবঃ —যাহা উৎপন্ন হইতেছে, আর দ্যুলোকায়িত স্বঃ— সেই পরমপ্রসূ
সবিতার
বরেণ্য
উদ্দীপ্ত
তেজোময়ী দীপ্তি—
যিনি
আমাদের
ধীসমূহকে
নানাকর্ম্মে প্রেরিত করিতেছেন,
তাঁহাকে ধ্যান করি—
ওঁ ! (সুখাসনে বসিয়া উক্ত মন্ত্রার্থ চিন্তা করিতে-করিতে জপ করিতে হইবে। ৪ ও ৫ স্তবকের মন্ত্র জপ ও ধ্যানের জন্য, তাই নিরিবিলিতে করাই বাঞ্ছনীয়।)
————————————————————————————————–
বিঃ দ্রঃ সাবিত্রী বা গায়ত্রী মন্ত্র হল বৈদিক আর্য্য-হিন্দু সনাতন ধর্ম্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বেদের অন্যান্য মন্ত্রের মতো গায়ত্রী মন্ত্রকেও অপৌরষেয় মনে করা হয়। তবে গবেষকেরা ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রকে গায়ত্রী মন্ত্রের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি মনে করেন। মন্ত্রটি বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত। ঋগ্বেদের (মণ্ডল ৩।৬২।১০) একটি সূক্ত।
মন্ত্রটির শুরুতে ওঁ-কার এবং “মহাব্যাহৃতি” নামে পরিচিত “ভূর্ভুবঃ স্বঃ” শব্দবন্ধটি পাওয়া যায়। এই শব্দবন্ধটি তিনটি শব্দের সমষ্টি―ভূঃ, ভুবঃ ও স্বঃ। এই তিনটি শব্দ দ্বারা তিন জগতকে বোঝায়। ভূঃ বলতে বোঝায় মর্ত্ত্যলোক, ভূবঃ বলতে বোঝায় স্বর্গলোক এবং স্বঃ হল স্বর্গ ও মর্ত্ত্যের সংযোগরক্ষাকারী এক লোক। বেদে যে সপ্তভূমি বা সাত জগতের উল্লেখ আছে, এগুলি তার মধ্যে তিনটি জগতের নাম। ধ্যান অনুশীলনের ক্ষেত্রে ভূঃ, ভুবঃ ও স্বঃ—এই তিন লোক চেতন, অর্ধচেতন ও অচেতন―এই তিন স্তরের প্রতীক। তথাকথিত প্রচলিত হিন্দু ধর্মীয় মতবাদে বিপ্রদের মধ্যে উপনয়ন সংস্কার মাধ্যমে এই মন্ত্র উচ্চারণের অধিকার প্রাপ্ত হয়। বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সাবিত্রীমন্ত্রকে নবীকরণ করে সর্বজনীন প্রার্থনা মন্ত্রে স্থান দিয়েছেন। সৎমন্ত্রে দীক্ষিত পঞ্চবর্হিঃ ও সপ্তার্চ্চি অনুশাসনে অনুশাসিত আর্য্যীকৃতদের সাবিত্রীমন্ত্র আবৃত্তির অধিকার দিয়েছেন। অন্তরাসীজন নানা-প্রসঙ্গে ৪র্থ খণ্ড পাঠ করলে সবিস্তারে জানতে পারবেন।
শতাবধিবর্ষ বাঁচিয়া থাকি ! আরো হে দেব ! হে জগৎজ্যোতি ! শতবর্ষের পরেও বহু বহুতর বর্ষ ধরিয়া আমরা এই সকলের সম্যকভাবে অধিকারী থাকিতে পারি !
(দাঁড়াইয়া দুই হাত কনুই পর্যন্ত তুলিয়া বাকী অংশ পার্শ্বে সংলগ্ন রাখিয়া আকাশে দৃষ্টি নিবন্ধ করিয়া উক্ত মন্ত্র পাঠ করিবে ও মন্ত্রার্থ চিন্তা করিতে-করিতে ভাবিতে হইবে—আমি ঐ সমস্তের অধিকারী হইলাম।)
* বর্ণাশ্রমাঃ = বর্ণব্যবস্থা; বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—এই চার বর্ণের বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হয় যে সামাজিক ব্যবস্থায়। বর্ণ জাতি নয়। উপরোক্ত চতুর্বর্ণের সহজসংস্কারমূলক বিভাগকেই বর্ণাশ্ৰম বলে।
* তথাগতা = তথা + আগতাঃ = সেই প্রকারে আগত, সেই রূপে আগত যাঁরা; তথা আগতঃ (সুপ্ সুপা সমাস); তথা = সেইরূপে বা সেই প্রকারে (অব্যয়); আগতাঃ = এসেছেন বা আবির্ভূত, প্রকট হ’য়েছেন যাঁরা; আ-√গম্ + ক্ত + ১মা বহু৹।
* তদ্বাৰ্ত্তিকাঃ = তৎ + বাৰ্ত্তিকাঃ = সেই বাৰ্ত্তা
* বর্ণাশ্রমানুগজীবনবৰ্দ্ধনাঃ = বর্ণাশ্রমের অনুযায়ী, বর্ণাশ্রমসম্মত; ‘সদাচার’-পদের বিশেষণ, অর্থাৎ এমন সদাচার যা’ বর্ণাশ্রমকে অনুগমন করে ও সত্তাপোষণী হয় তা’ জীবনবৰ্দ্ধনীয় অর্থাৎ জীবনকে বৃদ্ধিমুখর ক’রে তোলে।
* পালনীয়াঃ = পালন করার যোগ্য; ‘সদাচারাঃ’ পদের বিশেষণ। [√পাল্ + অনীয়র্]
* বিহিতসবর্ণানুলোমাচারাঃ পরমোৎকর্ষহেতবঃ ॥
* বিহিতসবর্ণানুলোমাচারাঃ = বিহিত সবর্ণ ও অনুলোম বিবাহ। বিহিত = বিধান করা হ’য়েছে এমন, বিধিসম্মত (বি-√ধা + ক্ত, কৰ্ম্মবা०)। সবর্ণ = সমান বা সদৃশ বর্ণ, সমান বর্ণের মধ্যে যে বিবাহ বিধিসম্মত (স বর্ণ যা’র এরূপ, বহুব্রীহি৹)। অনুলোম = অনুক্রম, উচ্চ থেকে ক্রমশঃ নিম্নতর এই ক্রম (লোমের অনুক্রমে, অব্যয়ীভাব সমাস)।
* পরমোৎকর্ষহেতবঃ = পরম বা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উৎকর্যের হেতু বা কারণ ; উৎকর্য = বৃদ্ধি, উন্নতি, সম্বৰ্দ্ধনা [ উৎ-√কৃষ্ + অল্ (ভাবে)]।
* স্বভাব পরিধ্বংসিনস্তু প্রতিলোমাচারাঃ।
(……… ধ্বংসিনঃ + তু)
* স্বভাবপরিধ্বংসিনঃ = স্বভাব—প্রকৃতি, স্বরূপ, মূল গুণ বা বৈশিষ্ট্য ; পরিধ্বংসিনঃ = পরিপূর্ণ বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসকারী (পরি-√ধ্বংস্ + ণিনি, কর্ত্তরি) পরিধ্বংসিন্ + ১মা বহুবচন; ‘প্রতিলোমাচারাঃ’ পদের বিশেষণ।
* প্রতিলোমাচারাঃ = প্রতিলোম বিবাহের আচার বা আচরণসমূহ।
———————————————————————
সূত্র : শব্দরত্নকোষ।
দ্বি-প্রাহরিক প্রার্থনা :
“হে পূণ্য! পরাক্রান্ত! পরাৎপর!
প্রচণ্ড মার্ত্তণ্ডবরেণ্য!
এক! অদ্বিতীয়!
তোমারই বিনিষ্কাষিত কিরণবীচি
তাপন প্রতিক্রিয়ায়
অযুত জ্যোতিষ্কের সৃষ্টি করেছে;
বৈধী মিতিচলনে চলেছে তা’রা
তোমারই প্রাণদ গতিপথে
বোধি-বিজৃম্ভী বিসৃষ্ট পরাক্রমে
সৃজন-সম্বেগে–
দৃপ্ত জীবনের অদম্য আবেগে,–
নভোমণ্ডলে সজ্জিত স্থালীর স্থল-সর্জ্জনে
দ্যৌঃ ও পৃথিবীর জীবন-দীপালি
সজ্জিত করে নাদ নিক্কণে —
অভ্যুদয়ী, আরুদ্র পরিক্রমায়;–
তোমাতেই আমার অযুত নমস্কার!”
(‘বিধি-বিন্যাস’ গ্রন্থ থেকে পরমপিতার স্তব)
** LORD’S PRAYER **
(সৎসঙ্গ পাব্লিশিং হাউস, দেওঘর থেকে প্রকাশিত ইংরেজী ভাষায় রচিত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আর্য্যসন্ধ্যা ও প্রার্থনা।)
**********************
FOREWORD
These prayers have come out spontaneously from the divine lips of our most beloved Lord Sree Sree Thakur Anukulchandra originally in English. They have the unique charm, sweetness, grandeur and depth of the Vedic chants of India, perhaps superseding them as they are fully in tune with both the past and the present. They are classic and at the same time romantic, both ancient and modern-old and new!
The Lord, the son of God, comes in different ages to remove the sorrows and sufferings of man, and He teaches us to pray to God the Father. With a naked sincerity of heart He pours forth in His unique appeal the real hankerings of the aching hearts of men. The prayers are again come in this twentieth century in Bengal in this far East. We fervently hope the disciples of Sree Sree Thakur Anukulchandra in India. America and in Europe, will find, in His prayers, echoes of their own hearts and will use these devoutly in their daily service and act in their everyday life in tune with the Infinite that can be perceived only through our intimate touch with the living Lord! May we be imbued with the inspiration of our Lord, may we be charged with the enthusiasm of our Lord, may we be invigorated with the activities of a divine life through prayer, meditation, service and love in the midst of the deadening and deteriorating din of Satan and Satanic ways of the modern times!
KRISHNAPRASANNA BHATTACHARYA
Deoghar, Bihar. 15th June, 1949.
****************************************
MY FATHER!
My Father!
The Supreme, the omnipotent
all-pervading!
My heavenly heart!
The Beginning!
The Being that hath manifested!
My God,
Oh Thou, revealed in flesh and blood!
A Child of Thyself
to wash off
the sorrows and sufferings
with begotten blood!—
Let Thy blessing flush
the dirts that are onerous
and make me pure
and able
with a tilt of blissful joy!
******************************
SUCKLE ME!
My Father!
Oh my Good,
the God!
The Beginning!
Thy water—
Thy property that has come forth
as a manifestation of Thyself
nourishes me,
quenching the thirst
that makes life
disgusted and precarious
with choking chafe!
Cheer me up!
Suckle me
with Thy vitalising fluid
as mother does her child!
Oh Thou—
the manifestation
of supreme affection!
Elate me up
in service of welfare
that enables me with a cheerful sympathetic heart,
to uplift with thy elixir
the beings
who suffer from
ignorant, obnoxious, distressing thirst!
***************************************
SO AM I THY SON EVER SOLEMN!
Thy Beaconing
descends
illuminating beings into life
with sympathy and apathy —
whence the booming uphill shower
scatters around
as manifestations—
the universe, the phenomena,
with sun, moon and stars
graced, beautified and illuminated—
that I behold!—
I am also one of them
though unlike in embodiment—
the child of Supreme Father
as they are!
The harm, the sin, the betrayal
that dwindles and deceives life
taking away far—afar
from Beloved Father
dives into forgetful ignorance!
Never can they touch
nor look at me!
So am I thy son
ever solemn, ever pure,
ever affectionate—
and serviceable—
as my Father in heaven!
*****************************
SAVE ME FROM THE SINS!
Oh thou the Sun,
The enlivening kiss
that irradiates from Heavenly Father!
Oh Thou Service,
the expression, the affection in action
of the Supreme Being!
and Thou the Servant,
the Master of services,
Crown of Bliss!
Save ye all myself
from the sin of unfulfilment
that recurs
from ignorance in serving
my environment!
****************************
Oh Night!
the rest that is ordained
by Supreme Law!
Save me from the sins I do
with mind, with word, with hands
and feet and other limbs!
Banish them as thou banisheth the visible with Thy darkening devour!
I surrender that me—
the sin-touched
unto the radiant,
illuminating energy
of my Supreme Father
that enlivens the being!
**********************************
FLOW IN AND ENLIVEN ME TOO!
Oh Thou Word!
Thy radiant ray
carrying the sun uphill
to expose the universe
with Thy beautiful varieties
raises up the amazing effulgence,
the sun
the source of the fluids,
the atmosphere and fire—
enlightening with fulfilment
the welkin and the earth—-
quickening in life the mobile and
the immobile:
Flow in
and enliven me too
with the flood of Thy hg!!!
I pray unto Thee—
may I bow down to them
who know you,
salute them who teach to
worship Thee—
the seers and the sacred—
my obeisance unto the
accumulated experiences of man!
—unto the breath of life!
Let me salute Death
that ceaseth my becoming—-
to be off from him!
My salutation to Thee—
the all-pervading,
the Lord Beloved!
****************************
RAISE ME UP UNTO THEE!
Thou Word—
the quickening thrill
that invigorates the life
and light of being,—
the diffused Bliss
that floods into earth,
atmosphere and welkin high
that unfolds all that hath been
with a radiance,
bestowing a luminous life—
accelerating talents to move and do!
Let me meditate on Thee—
Thy shine!
Raise me up unto thee,—
sparkling with Thy heavenly
shower!
****************************
PILOT US ACROSS!
Thou Fire Divine,
Thou the property of Supreme Being
that infuses heat and Warmth!
Burn thou entirety
the harmful intentions
of the jealous foe
and rescue us from distress and disgrace and from all the sins!
Pilots us across—
burning the disasters—-
into Thy blissful becoming!
****************************
I SALUTE THEE!
Oh thou the Becoming,
the Being
the existence that is beyond the vast darkening-yellow
tending towards the Cause!
Thou—the Frowning Apathy
that tends to take all away
from their manifestations—
transmuting Thyself into the universe!
Oh Thou!
my salutation to Thee!
I salute Thee—
the creative force!
the all-pervading!
the all-destroying!
the source of the fluids
that envelop!
*****************************
MY OBLATIONS UNTO THEE!
Oh Thou the Sun
that shineth with bliss
the Radiant,
the energy that pervades all—
salutation to Thee!
Thou—the sacred creator of worlds
That inspires us
into activities, —
My oblations unto Thee!
*******************************
MY OBEISANCE TO THEE!
Thou the Sun,
the bliss,
the Energy that hath proceeded
from the grace of divine soul,
the scarlet-red
with the wine of Life and vigour!
Thou the enemy of darkness,
elater of
darkening sinful depression,
my obeisance unto Thee!
Let me invoke thy push of Energy
with a stimulus
in the way of my Becoming—
that enables me by the grace
of Thy infused uplift—
Thy enlivening embrace—
to adore my Beloved with restless,
wistful service and acquisition
in a concord with the environment!
**********************************
PEACE, PEACE, PEACE
BE YE PEACEFUL!
Be ye Whatever—
regret not what has happened
by the impulse of your blind misfortune,
let not be afeared by the
taunting insult of your actions
that have occurred by the enticement
of the ignorant, dull,
depressing environment;
shout, cheer up—
be unquivered and attached
by your tendrils of passion
to the Ideal, the Beloved—
Whose love enters unquestionably
top to bottom
whatever ye may be—
saint, rogue, sufferer, criminal or
sinner—pervading all!
Instal Him with all your purpose,
with all your service,
with all your love and emotion,
with all the resources you have;
neglect to fulfil the narrow
sordid interests
from the universe in which you dwell;
only think of Him,
think how to fulfil His interests,
move on doing and dealing
accordingly—
elating everyone with the message
of love, hope, charity and service
that exalts!
Put thine ear to the throbbing
impulse of
environment and hear attentively the lingering music
।। প্রভু যীশুখ্রীস্ট স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। প্রভু যীশু ব্যভিচারের বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে, পৌত্তিলকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে সবাইকে সনাতনী ঈশ্বরপ্রেমে অভিষিক্ত করতে চাইলেন। তাঁর সত্তাপ্রেমী আবেদন প্রবৃত্তি-প্রেমীদের সহ্য হলো না, ফলস্বরূপ তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ হতে হলো। মানবতার শত্রু হলো জুডাস। যীশুর ক্রুশবিদ্ধের কথা উঠলে, শ্রীশ্রীঠাকুর করুণ কণ্ঠে ছলছল নেত্রে বললেন,–‘‘সেদিন যেমন যীশু crucified (ক্রুশবিদ্ধ) হয়েছিলেন, আজকের দিনেও সেই যীশু তেমনি করে crucified (ক্রুশবিদ্ধ) হয়ে চলেছেন মানুষের হাতে। এই পাপের নিবৃত্তি না হলে মানুষের নিস্তার নেই। নিস্তারের একমাত্র পথ হলো মূর্ত্ত ত্রাতা যিনি তাঁকে sincerely follow (অকপটভাবে অনুসরণ) করা। তাহলে আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলি ধীরে ধীরে শুধরে যাবে। ঠিকপথে চলতে শুরু না করলে, ভুলপথে চলার অভ্যাস আরো মজ্জাগত হবে তার chain reaction (শ্রেণীবদ্ধ প্রতিক্রিয়া) চলতে থাকবে।’’ (আ. প্র. ২৫.০১.১৯৪৮) প্রভু যীশু চরম ত্যাগ ও নির্ভরতার কথা বলেছেন।–পাখীদের বাসা আছে, শেয়ালের গর্ত আছে, কিন্তু তোমাদের মাথা গোঁজবার স্থান থাকবে না, কোন কিছুরই সংস্থান থাকবে না। ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে নিঃস্ব ও চাহিদাশূণ্য হয়ে তোমরা শুধু মানুষের মঙ্গল করে চলবে, নিজেদের জন্য কোন ভাবনা রাখবে না। ঈশ্বরের দয়ায় যখন যেমন জোটে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে।
ভূমিতে পায়ের আঙ্গুল দিয়ে। কিছুক্ষণ নীরবে গেলে, যীশু মাথা উঁচু করে দেখলেন, স্ত্রীলোকটি ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “হে নারী তোমার অভিযোগকারীগণ কোথায়, তারা কেহ কি তোমায় দোষী করে নি?’’ নারী কহিল—“না প্রভু, কেহ করে নি।” যীশু বললেন, “আমিও তোমাকে দোষী করি না, যাও আর কখনো এ মুহূর্ত হতে কোন রকম পাপ কর্ম করবে না।’’ —Neither do I condemn thee, go, and sin no more. (St, John.8:11)
ওই মা-টি যীশুর প্রেমের পরশে স্নাত হয়ে সাধ্বী হয়েছিলেন । তাঁর প্রেমের পরশে মাছ-ধরা জেলেরা মানুষ-ধরা সাধকে পরিণত হয়েছিলেন। তাই আমরা যদি বছরে একটি বড়দিন উদযাপনের-এর পাশাপাশি বাকি দিনগুলি প্রভুর যীশুর আদর্শের অনুসরণে আমাদের ছোট আমি-টাকে বড় করে তুলতে চেষ্টা করতাম ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা, বিবাহ-বিচ্ছেদ, ভ্রষ্টাচার এভাবে ব্যাপ্তি লাভ করতে পারত কি ?
।। ‘আর্য্য মহাসভা’ নামে সর্বজনীন রাজনৈতিক দল কেন প্রয়োজন ।।
—————————————————————————————
সব্বাইকে যথাবিধি শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানিয়ে সবিনয় নিবেদন,
মানবসভ্যতার এক পরম বিস্ময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র জ্ঞান গরিমায়
গরবিনী আর্য্য ভারতবর্ষের অখণ্ডতা রক্ষার কথা জনে জনে বলেছিলেন। মুসলিম
লীগ ও হিন্দু মহাসভার নেতাদের সাথে কথা বলেছিলেন সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধি
নিরসনের জন্য। হিন্দু মহাসভার নেতাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন হিন্দু মহাসভার নাম বদলে আর্য্য মহাসভা রাখতে। সত্তা-সম্বর্দ্ধনী পিয়াসী সকল সম্প্রদায়কে আর্য্য মহাসভার সদস্য করতে বলেছিলেন। মনুষ্যত্বের গুণ-সমৃদ্ধ মানব-সভ্যতাকে টিঁকিয়ে রাখার স্বার্থে যুগ-পুরুষোত্তমের উক্ত নিদেশ বাস্তবায়িত করার জন্য জীবনপিয়াসী সব্বাইকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করছি।
নিবেদনে—তপন দাস
* * *
।। আর্য্যকৃষ্টি, ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বাণী ।।
আর্য্যস্থান – পিতৃস্থান
উচ্চ সবার – পূর্য্যমান।
অমর রহুক – আর্য্যবাদ
জাগুক উঠুক – আর্য্যজাত।
ফুলিয়ে তোল – দুলিয়ে তোল
তাথৈ তালে – আর্য্যরোল।
আর্য্যকৃষ্টির – যা ব্যাঘাত
খড়্গে তোরা – কর্ নিপাত।
* * *
ARYA–ITS MEANING
“The meaning of the word
‘Arya’ is–
to go, to cultivate, to achieve.”
ARYANS
“People
who are prone to cultivate
and achieve
the clue to the philosophy
of life and becoming–
are Aryans
as I think.”
ARYAN CULTURE
“He who adopts a culture
of life and growth–
is Aryan.”
(The Message, Vol. IX by Shree Shree Thakur Anukulchandra)
* * *
রাজনীতি বলে তা’য়
পূরণ-পোষণ প্রীতিচর্য্যায়
সংহতি আনে যা’য়।
রাজশক্তি হাতে পেয়েও
সতের পীড়ক যা’রাই হয়,
দেশকে মারে নিজেও মরে
রাষ্ট্রে আনে তারাই ক্ষয়।
* * *
“Politics is that which protects, nurtures and fulfills the uphold of existence..”
“When the elite are selfish, inert and non-coperating villain rises and rules.”
* * *
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন, ……….. ভালো বংশের মানুষ চাই যারা শয়তানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। আমি ধৰ্ম্ম ছাড়া politics (পূৰ্ত্তনীতি) বুঝি না। ধৰ্ম্ম মানে ধৃতি, বাঁচাবাড়ায় চলা। বাঁচতে গেলে পরিবেশের দরকার। পরিবেশ বাঁচবে না, আমি বাঁচব, তা’ হয় না। তোমরা প্রত্যেকে মরছ মানে আমি মরছি। একটা মানুষ গেল তার মানে আমার বাঁচার উপকরণ গেল। মানুষ টাকার দাম বোঝে। মানুষের দাম বোঝে না। কিন্তু মানুষই তো যা’ কিছু সৃষ্টি করে। তাই মানুষ বাদ দিয়ে, মানুষের যোগ্যতা বাদ দিয়ে রাজনীতির দাম কী? ………………. (শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, আঃ প্রঃ ত্রয়োবিংশ খণ্ড, পৃঃ ৬৩)
———————————————————————————————–
।। অবতরণিকা ।।
ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসন ক্ষমতা অধিকার করার জন্য অনেক রাজনৈতিক দল থাকা সত্বেও “আর্য্য মহাসভা” নামের রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রয়োজন রয়েছে কেন, তার সমর্থনে আমাদের বক্তব্য।
আমরা সাধারণ জনগণেরা পলিটিক্যাল সায়েন্স বা রাষ্ট্র বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব ও তথ্য বিষয়ে পারদর্শী না হলেও এটুকু অন্ততঃ বুঝি, যে নীতিবিধির সাহায্যে রাষ্ট্রের জনগণ দুটো খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে নিরাপদে বসবাস করতে পারে তার জন্যই রাজনীতি। সেই রাজনীতির নিয়ামক মানুষ। ভারত রাষ্ট্র সেই মানুষদের প্রজা নামে পরিচিত করিয়েছেন বলেই আমরা গণ প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের নাগরিক বা প্রজা হিসেবে পরিচিত। আমাদের ভারতবর্ষে এই প্রজারাই রাষ্ট্র নির্মাণের একক। ভারতের নিজস্ব সংবিধান, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে।
‘‘সুখস্য মূলম্ ধর্মঃ।
ধর্মস্য মূলম্ অর্থঃ।
অর্থস্য মূলম্ রাষ্ট্রম্।
রাষ্ট্রস্য মূলম্ ইন্দ্রিয়-বিজয়ম্।
ইন্দ্রিয়-বিজয়স্য মূলম্ জ্ঞানবৃদ্ধসেবয়া।
জ্ঞানবৃদ্ধসেবয়া বিজ্ঞানম্।।”
অর্থাৎ, সুখের মূলে ধর্ম (যে নীতিবিধি অস্তিত্বের, ধারক, পালক, পোষক।)। ধর্মের মূলে অর্থ। অর্থ বলতে এখানে শুধু টাকাপয়সার কথা বলা হয়নি, পুরুষার্থের চতুর্বর্গ—বর্ণাশ্রম এবং চতুরাশ্রমধর্ম পালন করার বিষয়ে বলা হয়েছে। প্রজাদের পরমার্থ লাভের বিষয়ে অবহিত করার জন্য রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। রাষ্ট্রের কাজ হলো প্রজাদের ধর্মপথে, অর্থাৎ ন্যায়ের পথে পরিচালিত করা। তাই, রাষ্ট্র গঠন করতে হবে ইন্দ্রিয়বিজয়ী প্রজাদের দ্বারা। যেহেতু, ইন্দ্রিয়জাত অনিয়ন্ত্রিত লোভ, কাম, ক্রোধ, হিংসা ইত্যাদি ন্যায়ের পরিপন্থী। আধ্যাত্মিক অনুশাসন ব্যতীত ইন্দ্রিয়বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয়। আর ইন্দ্রিয়বিজয়ী হতে হলে জ্ঞানবৃদ্ধের সেবা করতে হবে, অনুশাসন মেনে চলতে হবে। ইন্দ্রিয়ের ওপর আধিপত্য বা নিয়ন্ত্রণ যাঁর আছে, তিনিই জ্ঞানবৃদ্ধ। সদগুরু হলেন সেই জ্ঞানবৃদ্ধ। সদগুরুর দীক্ষা নিয়ে আদর্শানুগ জীবন যাপন করতে পারলেই বিশেষ জ্ঞান লাভ হবে। জড় ও চৈতন্য (matter and spirit) বিষয়ক বিজ্ঞান জানা যাবে।
জ্ঞানবৃদ্ধ প্রদত্ত অনুশাসন পালন করে প্রকৃষ্ট জাতক বা ‘প্রজা’ সৃষ্টির প্রবহমানতাকে রক্ষা করে চলাই ছিল আর্য্য ভারতের আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্য। প্রায়োগিক বিন্যাসের ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে আমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি। কোন উপলক্ষ্যই যেন সেই লক্ষ্যকে ম্লাণ করতে না পারে সে বিষয়ে রাষ্ট্র-নির্মাতাদের সচেতন করার জন্যই আমাদের এই অভিযান। নাগরিক অধিকার নিয়ে দেশের আপামর জনগণ সচেতন হলেও নাগরিক কর্তব্য পালন বিষয়ে আমরা অনেকটাই উদাসীন। ‘উত্তিষ্ঠতঃ জাগ্রত’ মন্ত্রে আবার আমাদের জেগে উঠতে হবে। ‘ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’—সেই গন্তব্যে পাড়ি জমাতে।
——-
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ চায় সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে। শুধু মানুষ কেন, গাছপালা, পোকামাকড়, জন্তু-জানোয়ার—সবাই বেঁচে থাকতে চায়, বৃদ্ধি পেতে চায়। যে যে নিয়ম পালন করলে সুস্থভাবে বাঁচা যায়, বৃদ্ধি পাওয়া যায় সেই প্রক্রিয়ার নাম জীবনের ধর্ম পালন করা। কিন্তু বাস্তবে তো সবাই চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে না, একদিন-না-একদিন সবকিছুর মায়া কাটিয়ে এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিতেই হবে। এই পিণ্ডদেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে জেনেও, বুদ্ধিমান মানুষ অন্যায়, অধর্ম করে, বিবেক-বিরোধী কর্ম করে ধন-সম্পত্তি অর্জন করতে গিয়ে অসুখ, অশান্তিকে আবাহন করে, এটাই সবচাইতে আশ্চর্যের।
মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণীরা সহজাত প্রবৃত্তি মাধ্যমে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, মানুষ বুদ্ধি দ্বারা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। অরণ্যবাসী, গুহাবাসী মানুষ একসময় কাঁচা ফলমূল, মাংস ইত্যাদি খেয়ে প্রাণ ধারণ করত। ক্রমে আগুনের ব্যবহার, পশুপালন, কৃষিকাজ শিখে আস্তানা তৈরি করে, গৃহ নির্মাণ করে ক্রমোত্তরণের সিঁড়ি বেয়ে আজকের আধুনিক যুগের সভ্যতার সভ্য হতে পেরেছে।
বেঁচে থাকার প্রশ্নে মনুষ্যেতর প্রাণীরা এই আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগেও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। যেমন, পরিযায়ী পাখিরা অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে টিঁকে থাকতে নদনদী, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে জৈবিক তাগিদ পূরণের জন্য।—আবার ফিরে যায় ‘চরৈবেতি’-র পথ ধরে। ওদের জন্য কোন রাজনৈতিক দল, কোন সরকার, কোন সংগঠন নির্দিষ্ট রুট ম্যাপ, আশ্রয়-শিবির, খাদ্যের ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিছুই করে কি-না আমার জানা নেই। তবে আমার জানা মতে, প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে ওরা জীবন যাপন করে বলেই তেমন একটা অসুখী নয়, অকালমৃত্যুও হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের মত কিছু সভ্য মানুষদের অসভ্যতার জন্য ওদের সুখ-শান্তি ব্যহত হয়।
অপরপক্ষে, ধর্ম পালনের নামে, ‘ভোলেবাবা পার করেগা’ ধ্বনি সহযোগে যে-সব মানুষেরা বাঁকে করে জলঘট নিয়ে বিশেষ-বিশেষ লগনে শিবালয়ের শিবলিঙ্গে জল নিবেদন করতে যান, তাঁদের সেবা দেবার জন্য প্যাণ্ডেল করে, মাইক বাজিয়ে, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় সংগঠনগুলো কতইনা তৎপর থাকেন! শ্রাবন মাসে রাস্তার ধারে ধারে প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে ছয়লাপ হয়ে যায়! সেবার ডালি দিয়ে কে কাকে টেক্কা দেবে সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়! যারা চাক্ষুস করতে চান, একটু কষ্ট করে শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার বি. টি. রোড ধরে ডানলপ থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলেই উপলব্ধি করতে পারবেন। শ্রীরামপুরের মাহেশের রথের মেলাতে গেলেও সেবার প্রতিযোগিতা অবলোকন করতে পারবেন। সত্যিই, না দেখলে বোঝা যেত না যে, মানুষ মানুষের জন্য কত সেবা-ই না করতে পারেন!
মানুষকে সুখে-শান্তিতে রাখার জন্য (নিন্দুকেরা বলেন, ভোট পাবার জন্য।) রাজ্য সরকার ‘দুয়ারে সরকার’-এর মাধ্যমে খয়রাতি সাহায্যের বিভিন্ন নামের প্রকল্প চালু করেছেন। তথাপিও কেন জানি সরকার সব মানুষদের সুখে, শান্তিতে রাখতে পারছেন না! অসুখ, অশান্তি, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হিংসা প্রভৃতি সমস্যায় জেরবার হয়ে জনগণ থানা, পুলিশ, কোর্ট, হাসপাতাল, রাজনৈতিক নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে বাধ্য হচ্ছে! এসব সমস্যার কারণ কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত প্রবৃত্তি। মানুষের দেহে বিরাজমান বন্ধুরূপী শত্রু লোভ, কাম, ক্রোধ, মদ, মোহ, মাৎসর্য ইত্যাদির লাগামহীন পরিচর্যা। সব অশান্তির মূল কারণ ষড়রিপু। সেই ষড়রিপুর মুখে লাগাম পড়াবার মতো কোন প্রকল্প রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করছে না। করতে পারলে মানুষকে সৎ-এর বা সত্তার পথে পরিচালিত করে আত্মনির্ভর হতে শেখানো যেত। মানুষকে সুখী করা যেত। লাগামহীন ভোগের চাহিদায় সুড়সুড়ি দিয়ে মানুষকে কখনোই সুখী করা যায় না। অথচ দেখুন, সুকুমার রায়ের কালজয়ী রচনা ‘রাজার অসুখ’-এর চালচুলোহীন ভিখারীটা কেমন চাহিদাশূন্য হয়ে নিজেকে রাজার চাইতেও সুখী প্রমাণ করে ছেড়েছেন।
সুখের বিপরীতে বাস করে দুঃখ। চাওয়াটা না পাওয়াই দুঃখ। সব দুঃখের কারণ কিন্তু প্রবৃত্তি-পোষণী চাহিদার বাড়বাড়ন্ত। যাকে আমরা অভাব বলতে অভ্যস্ত। হাজার চাহিদা পূরণ করেও মানুষের অভাবজনীত দুঃখ দূর করা যায় না,—যতক্ষণ না মানুষ ওই অভাবের ভাবটাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবে। কোন রাজার বা রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়া ছাড়াই রাজার অসুখের ভিখারিটা মন থেকে অভাবের ভাবটাকে তাড়াতে পেরেছিলেন বলেই তিনি প্রকৃত সুখী হতে পেরেছিলেন।
যাইহোক, মানুষ মানুষকে সুখী করার জন্য, সুখী দেখার জন্য এখনো ভাবে। নইলে ‘ভাল থাকবেন’ বলে যবনিকা টানতেন না আলাপচারিতার অন্তে, বিদায় লগ্নের প্রাক্কালে। ভাল থাকার ইচ্ছে আছে বলেইনা ‘হ্যাভ এ গুড ডে’, ‘সী ইউ অ্যাগেইন’ ইত্যাদি শুভেচ্ছা সম্বোধনগুলো আমরা আয়ত্ত করেছি।
সরলার্থ—সকলে সুখী হোন, নিরোগ হোন এবং শান্তি লাভ করুন, কেউ যেন দুঃখ ভোগ লাভ না করে।।
মন্ত্র সমৃদ্ধ মঙ্গলাচারণের শুভেচ্ছাবার্তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
* * *
কে চায় না? সবাই তো সুখি হতে চায়, সবাই তো শান্তি চায়, সবাই তো নীরোগ থাকতে চায়। কিন্তু অ-সুখকে পাশ কাটিয়ে সুখি কিভাবে হতে হয়, অশান্তিকে পাশ কাটিয়ে কিভাবে শান্তি পেতে হয়, দুষ্ট মনকে শিষ্ট করে কিভাবে নীরোগ থাকতে হয়, তা হয়তো সকলে জানেন না।
উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, অঋণী, অপ্রবাসী, দিনান্তে একবার যে শাকান্ন খেয়ে জীবন ধারণ করেন, সে-ই প্রকৃত সুখী। শুধু কথার কথা নয়, নবদ্বীপের পণ্ডিত রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত, যাঁকে সবাই বুনো রামনাথ বলে জানতেন। তিনি তো প্রয়োজনে তেঁতুলপাতার ঝোল, আর মোটা চালের ভাত খেয়েই বিনে মাইনেতে শিক্ষকতা করতেন, সংস্কৃতে গ্রন্থ রচনা করতেন, কোন দান বা খয়রাতি সাহায্য না নিয়েই বেশ নীরোগ দেহ নিয়ে সুখে, শান্তিতে জীবন কাটিয়ে বোদ্ধা সমাজে অমর হয়ে আছেন।
মহাভারতে ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা নামক পর্বাধ্যায়ে বর্ণিত সুখের বিষয়টা আরও আরও বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহাবীর অর্জুনকে যে সুখের সন্ধান দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, নিম্নোক্ত শ্লোক বর্ণিত জ্ঞানের মাধ্যমে।
नास्ति बुद्धिरयुक्तस्य न चायुक्तस्य भावना। न चाभावयतः शान्तिरशान्तस्य कुतः सुखम्।। 2.66।। “নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা।” ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম্।। —অর্থাৎ, পরমপিতার সাথে যোগযুক্ত নয় এমন অযুক্তের বুদ্ধি হয় না, ফলে বাঁচার ভাবনা ভাবতে পারে না, শান্ত হতে পারে না, শান্তি পায় না, (কোন অবস্থায় সাম্যহারা না হওয়াই শান্তি।) আর অশান্ত যে, সে সুখের সন্ধান পাবে কোত্থেকে?
এই শ্লোকের মাধ্যমে আমরা সুখের রাজ্যে পৌঁছবার একটা সিঁড়ির সন্ধান পেলাম। বুদ্ধি থাকলেই হবে না। বুদ্ধি কোন উচ্চ আদর্শে যোগযুক্ত হলেই বাঁচার ভাবনা ভাবতে পারে, ফলে শান্ত হয়, শান্তি পায়, যার ফলে প্রকৃত সুখ আস্বাদন করতে পারেন। এথেকে বোঝা গেল যে, স্থিতধীসম্পন্ন না হলে সুখী হওয়া যায় না। স্থিতধীসম্পন্ন হতে গেলে ভালো বুদ্ধিদাতার শরণাপন্ন হতে হয়। সেই বুদ্ধিদাতা ছিলেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ।
আমরা, বুদ্ধিমান মানুষেরা প্রচলিত অনেক মতবাদ না মানলেও ধর্মগ্রন্থ হিসেবে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে কিন্তু স্বীকৃতি দিয়েছি। কোন মন্দিরে, কোন আশ্রমে নয়, কুরুক্ষেত্র নামের বিস্তৃত ধর্মক্ষেত্র প্রাঙ্গনে যার উদ্ভব। কুরু-পাণ্ডবদের রাজ্য-বিবাদ বা রাজনীতির টানাপোড়েনের চরম মীমাংসার পথ খুঁজে নেয় দুর্যোধন, যুদ্ধের মাধ্যমে। যুদ্ধ যাতে না হয় বৃষ্ণিবংশীয় শ্রীকৃষ্ণ নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে মীমাংসা করার চেষ্টা করেছিলেন। পঞ্চ পাণ্ডবদের বসবাসের জন্য মাত্র ৫ খানা গ্রাম চেয়েছিলেন। রাজী হননি কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধন। পণ করেছিলেন, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। যার ফলস্বরূপ ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের প্রাঙ্গনে যুদ্ধের আয়োজন হয়েছিল।
কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যুযুধান কৌরব ও পাণ্ডব দুইপক্ষের সৈন্য সমাবেশ হয়েছে। পাণ্ডব পক্ষের প্রধান যোদ্ধা তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন, তাঁর রথের সারথী শ্রীকৃষ্ণকে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে রথ স্থাপন করতে বললেন। শ্রীকৃষ্ণ রথটি চালিয়ে নিয়ে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে রাখলেন। অর্জুন, কৌরব পক্ষের সেনাদলের মধ্যে পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, শ্বশুর, মিত্র ও শুভাকাংক্ষীদের দেখতে পেয়ে, শুধু রাজত্ব ফিরে পাবার জন্য তো নয়ই, ত্রিভুবনের বিনিময়েও আপনজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজী নয়, স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন শ্রীকৃষ্ণকে। প্রমাদ গুনলেন শ্রীকৃষ্ণ। যার ওপর ভরসা করে ধর্ম সংস্থাপন করার পরিকল্পনা করেছেন, সেই মহাবীর অর্জুন কিনা শেষমেষ যুদ্ধবিমুখ! তীরে এসে তরী ডোবাতে চাইছে! পরিস্থিতি সামাল দিতে পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বর্ণাশ্রমানুগ ক্ষাত্রধর্ম পালন করতে উৎসাহিত করার জন্য বলেন, এই ঘোর সংঙ্কটময় যুদ্ধস্থলে যারা জীবনের প্রকৃত মূল্য বোঝে না, সেই সব অনার্যের মতো শোকানল তোমার হৃদয়ে কিভাবে প্রজ্জ্বলিত হল? এই ধরনের মনোভাব তোমাকে স্বর্গলোকে উন্নীত করবে না, পক্ষান্তরে তোমার সমস্ত যশরাশি বিনষ্ট করবে। এই সম্মান হানিকর ক্লীবত্বের বশবর্তী হয়ো না৷ এই ধরনের আচরণ তোমার পক্ষে অনুচিত। এই যুদ্ধে নিহত হলে তুমি স্বর্গ লাভ করবে, আর জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করবে৷ অতএব যুদ্ধের জন্য দৃঢ়সংকল্প হয়ে উত্থিত হও।—এইসব তত্ত্বকথা বিফল হবার পরে শ্রীকৃষ্ণ বলতে বাধ্য হলেন, আসলে তোমার বুদ্ধি বিপর্য্যয় হয়েছে বলে তুমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছ, তোমার অশান্ত হৃদয় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
যুদ্ধক্ষেত্রে রথে উপবিষ্ট হয়ে উপরোক্ত (২/৬৬) শ্লোকের মাধ্যমে দ্রোণাচার্য্য, কৃপাচার্য্য নামের বিখ্যাত শিক্ষাগুরুদের শিষ্য, মহাবীর, মহারথী, মহা-সংযমী, ব্রহ্মচারী অর্জুনকে অস্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন বললেন, ভগবানের সাথে যোগযুক্ত নয় বলে। আর যোগযুক্ত হতে হলে গুরুকরণ করতে হবে। মহাবীর অর্জুনের শিক্ষাগুরু থাকলেও ইষ্টগুরু ছিল না।
“(ইষ্ট)গুরুই ভগবানের সাকার মূর্তি, আর তিনিই absolute (অখন্ড)।”
বর্তমান ইষ্টগুরু শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলছেনঃ
শিক্ষাগুরু থাক না অনেক
শিখো যেমন পার
ইষ্টগুরু একই কিন্তু
নিষ্টাসহ ধর।
জীবনচলনার জাগতিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনে যিনি বা যাঁরা সাহায্য করেন তারা হলেন শিক্ষাগুরু। পিতামাতা থেকে স্বভাব পাই বলে তাঁরা হলেন স্বভাবগুরু। আর স্থূল হতে সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম হতে স্থূল (matter to spirit, spirit to matter), জীবননদীর ঘুর্ণিপাক থেকে বাঁচাবার কৌশল যিনি শেখাতে পারেন অর্থাৎ অন্তর্যামীকে উপলব্ধি করাতে যিনি পারেন তিনি ইষ্টগুরু বা সদগুরু। এই গুরুই হলেন ভগবানের সাকার মূর্তি। তিনিই absolute (অখণ্ড)। ইষ্টগুরু গ্রহণ করলে মানুষ স্থিতধী হয়ে ব্যক্তিসত্তার অখণ্ড বিন্যাসকে বজায় রেখে নিজসত্তাকে উপলব্ধি করতে পারে। তখন শান্তি এবং সুখ দাস হয়ে সেবা করে। মহাবীর অর্জুন সদ্-দীক্ষার মাধ্যমে ইষ্টগুরুর সাথে যোগযুক্ত ছিলেন না বলেই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বর্ণিত অনুশাসন বা সম্যক-বিধানের মাধ্যমে প্রকৃত সুখের পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যদি ধর্মগ্রন্থ হয়, তাহলে বলতে হয়, ধর্মনীতিই অর্জুনকে প্রকৃত রাজনীতি শিখিয়েছিল।
মনুষ্য দেহধারী পরমপিতা, পুরুষোত্তম, সদগুরু, বা ভগবানের সাথে যোগযুক্ত না হয়ে যেমন ধর্ম পালন করা সম্ভব নয়, তেমনি রাজনীতি শেখাও সম্ভব নয়। সনাতন ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ঈশ্বর এক, ধর্ম এক, প্রেরিতপুরুষগণ সেই এক-এরই বার্তাবাহী। এই তত্ত্বজ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করতে হলে শ্রীকৃষ্ণরূপী জীবন্ত সদগুরুর চিরন্তনী নিদেশ—
সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥ (গীতা ১৮ অধ্যায় ৬৬তম শ্লোক)
অর্থাৎ, জীবনকে ধারণ করার জন্য ধর্মের নামে প্রচলিত সব নীতিবিধি পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবো। এই বাণী মেনে চলতে হবে।
মানবজাতির মনুষ্যত্বের প্রবহমানতাকে সমৃদ্ধ করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতা গ্রন্থের ৪র্থ অধ্যায়ের ৭ম থেকে ৯ম শ্লোকে সকল-যুগের সকল মনুষ্যদের জন্য এক স্পষ্ট নির্দেশিকা, গাইডলাইন দিয়ে বলেছেন—
যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করে সাধুদের পরিত্রাণ করে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে অবতীর্ণ হই। যিনি সাধনা দ্বারা আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানতে পারেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুণরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধাম লাভ করেন।
উপরোক্ত বাণী সকল যুগের মানুষদের জন্য চূড়ান্ত পথ নির্দেশ। যখন যে রূপে পুরুষোত্তমের আবির্ভাব হবে, তখন সেই নররূপ পরিগ্রহকারী সর্বোত্তম পরিপূরণকারী পুরুষোত্তমের শরণাপন্ন হতে হবে, তাঁর ভজনা করতে হবে।—এই হলো প্রকৃত ধর্মের পথে চলে ঈশ্বরপ্রাপ্তির গন্তব্যে পৌঁছাবার সিঁড়ি, সোপান, লিফট্……. সকলের জন্য—‘নান্যপন্থাঃ বিদ্যতে হয়নায়’।
যখন যিনি পুরুষোত্তমরূপে অবতীর্ণ হন, তিনিই তখনকার সময়ের জন্য জীবন্ত বেদ, সংহিতা, পুরাণ। ওই সূত্র অনুসারে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, যীশুখ্রীস্ট, হজরত রসুল, চৈতন্যদেব, শ্রীরামকৃষ্ণদেব সকল গুরুদের গুরু সদগুরুরূপে স্বীকৃতি পান। অর্থাৎ স্থান-কাল-পরিবেশ অনুযায়ী যখন যিনি যেখানেই অবতীর্ণ হন না কেন, তাঁর মধ্যে পূর্ব পূর্ব গুরুদের জীবন্ত অনুভব করা যাবে। পূর্ববর্তীদের প্রকৃত আদর্শ খুঁজে পাওয়া যাবে। যাকে আমরা বর্তমানের সফটওয়ারের ভাষায়, অ্যাপ্লিকেশন বা অ্যাপস্-এর ভাষায় আপডেট বলি। যারমধ্যে অ্যাপ্লিকেশনের সূত্রপাত থেকে শুরু করে সর্বশেষ সংস্করণের নবীকরণের তথ্য মজুত থাকে। আমি যদি আমার মোবাইলের অ্যাপ্লিকেশনগুলো আপডেট না করি তাহলে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারব না। যারা আপডেটেড্, তারাই লক্-ডাউনের সময় অন-লাইন কাজকর্ম করে অনেক কিছু সামাল দিতে পেরেছেন। সবকিছু সামাল দিতে গেলে আপডেটেড হতে হবে সবক্ষেত্রে। ব্যাকডেটেড থেকে কিছু সামাল দেওয়া যায় না। অথচ আমরা অজ্ঞতাবশে নিজেদের ধারণ করার প্রশ্নে, অর্থাৎ ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে ব্যাকডেটেড হয়ে আছি। তাই তো বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনকূলচন্দ্র আমাদের সচেতন করে দিতে বললেন—“ভারতের অবনতি (degeneration) তখন-থেকেই আরম্ভ হয়েছে, যখন-থেকে ভারতবাসীর কাছে অমূর্ত্ত ভগবান অসীম হ’য়ে উঠেছে—ঋষি বাদ দিয়ে ঋষিবাদের উপাসনা আরম্ভ হয়েছে।
ভারত! যদি ভবিষ্যৎ-কল্যাণকে আবাহন করতে চাও, তবে সম্প্রদায়গত বিরোধ ভুলে জগতের পূর্ব্ব-পূর্ব্ব গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হও—আর তোমার মূর্ত্ত ও জীবন্ত গুরু বা ভগবানে আসক্ত (attached) হও,—আর তাদেরই স্বীকার কর—যারা তাঁকে ভালবাসে। কারণ, পূর্ব্ববর্তীকে অধিকার করিয়াই পরবর্ত্তীর আবির্ভাব।” (সত্যানুসরণ)
কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনকূলচন্দ্র বললেন—“বর্ত্তমান যিনি, তাঁকে ধরলেই তাঁর মধ্যে সব পাওয়া যায়। ………. রামচন্দ্রকে যে ভালবাসে সে যদি শ্রীকৃষ্ণকে না ধরে তবে বুঝতে হবে তার রামচন্দ্রেও ভালবাসা নেই, ভালবাসা আছে তার নিজস্ব সংস্কারে।”
(আঃ প্রঃ ২১ খণ্ড, ইং তাং ৩১-১২-১৯৫২)
* * *
ইষ্টগুরু নিদেশিত সদাচার এবং বর্ণাশ্রমধর্মকে অগ্রাহ্য করে তথাকথিত ধার্মিক হতে চাওয়া সখা অর্জুনকে প্রকৃত ধার্মিকে রূপান্তরিত করার জন্য পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন বিষাদ যোগ, সাংখ্য যোগ, কর্ম যোগ, জ্ঞান-কর্ম-সন্ন্যাস যোগ, কর্ম-সন্ন্যাস যোগ, আত্ম-সংযম যোগ, জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ, অক্ষর-পরব্রহ্ম যোগ, রাজ-বিদ্যা-রাজ-গুহ্য যোগ, বিভূতি যোগ, বিশ্বরূপ-দর্শন যোগ, ভক্তি যোগ, ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগ যোগ, গুণত্রয়-বিভাগ যোগ, পুরুষোত্তম যোগ, দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগ যোগ, শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ যোগ ও মোক্ষ-সন্ন্যাস যোগ ইত্যাদি নামাঙ্কিত অষ্টাদশ প্রকৃতির যোগ-এর সাহায্যে পরমাত্মিক শক্তির সাথে যোগযুক্ত করেন।
অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে সখাজ্ঞানে ভালবাসতেন, ভরসা করতেন, কিন্তু তাঁর ‘মানুষীতনুআশ্রিতম্ ভূত-মহেশ্বর’ রূপের পরিচয়, পুরুষোত্তমীয় শক্তির পরিচয় তিনি অনুভব করতে পারেন নি। অনুভব যদি করতে পারতেন, পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর রথের সারথী হতে বলতে পারতেন না। আর তিনি যদি অর্জুনের সারথী না হতেন, আমরা, জগৎ-সারথী প্রোক্ত সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকার চাবিকাঠি-স্বরূপ মানব জীবনের প্রকৃত সংবিধান শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পেতাম না। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার জ্ঞান পেয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ইষ্টগুরু রূপে বরণ করে তাঁর আদর্শ মেনে কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। ক্ষাত্র জনোচিত স্বধর্ম বা বৃত্তিধর্ম পালন করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। জয়লাভ করতে পেরেছিলেন জীবনযুদ্ধে। অতএব, প্রবৃত্তিপরায়ণতার বুদ্ধি যতক্ষণ না ইষ্টগুরুর আদর্শের সাথে যোগযুক্ত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত সুখি হওয়া যে সম্ভব নয় তা প্রমাণিত সত্য, যদি শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা গ্রন্থকে আমরা মান্য করি।
* * *
সম্মানীয় পাঠক, এতক্ষণে বেশ বিরক্ত হয়েছেন বুঝতে পারছি। হয়তো ভাবছেন, রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে ধর্মচর্চা শুরু করে দিয়েছেন! ধর্ম আর রাজনীতিকে এক করে ফেলতে চাইছেন!
আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যদি ধর্মগ্রন্থ হয়, তাহলে তার উৎপত্তি কি রাজনীতিকে কেন্দ্র করে নয়? কৌরব-পাণ্ডবদের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্যই তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়েছিল। ওই যুদ্ধক্ষেত্রকে কেন্দ্র করেই তো শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উৎপত্তি। আবার ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে মানেন, সেই রাজনীতির প্রেরণা ছিল শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার আদর্শ। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ-এর বন্দে মাতরম্ স্তোত্র-ও কিন্তু শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার আদর্শের অনুসরণে সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের কাছে একটা করে গীতা গ্রন্থ থাকত। তাই ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে কোন মন্তব্য করার আগে একটু ভেবেচিন্তে করতে হবে।
ভুললে চলবে না যে, ‘‘কর্ম্মণ্যেবাধিকারেস্তু মা ফলেষু কদাচন।…….’’ ––কর্মেই তোমার অধিকার ফলে নয়। ––শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই বাণীর অনুপ্রেরণায় নবযুগের অভিমন্যু ক্ষুদিরাম, দেশরক্ষার ধর্ম পালন করতে গিয়ে ফাঁসির আসামী হয়েছিলেন। ‘‘ন জায়তে ম্রিয়তে কদাচিৎ…….বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়………নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।…….’’। বাণীর অমৃত আদর্শে স্থিতপ্রজ্ঞ, মৃত্যুঞ্জয়ী ক্ষুদিরাম হাসিমুখে ফাঁসির দড়ির মালা পড়েছিলেন গলায়। একটা ক্ষুদিরামের আত্মাহুতি জন্ম দিয়েছিল হাজারো ক্ষুদিরামের। ফাঁসির রজ্জু আর ইংরেজ রাজশক্তির বুলেটের আলিঙ্গনে জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে অকালে হাসিমুখে বিদায় নিয়েছিল আর্য্য ভারতের উত্তরাধিকারের স্বপ্নদেখা কতশত বীর ভারত-সন্তানেরা। অবশেষে একদিন গ্যালন গ্যালন রক্তের বিনিময়ে আমরা ফিরে পেয়েছিলাম আমাদের জাতীয় উত্তরাধিকার। অপূর্ণ, খণ্ডিত। তথাকথিত ধর্মের সুড়সুড়িতে দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারতবর্ষ হিন্দুস্তান, পাকিস্তান আখ্যা পেয়েছিল। কিন্তু পূর্ব পশ্চিমে প্রসারিত ভারতমাতার কর্তিত দুটো বাহুর ক্ষত আজও শুকলো না। সৃষ্ট হলো জাতীয় ম্যালিগন্যাণ্ট সমস্যার। সব কিছুর কারণ কিন্তু ধর্মকে আড়াল করে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাধান্য দেওয়া।
* * *
‘পলিটিক্স মানেই—
পূর্ত্তনীতি বা পূর্য্যনীতি
অর্থাৎ, যে-সৎনীতির অনুশাসন ও অনুসরণে
পূরণ ও পালন করা যায়—
এবং বিরুদ্ধকে আবৃত করে
নিরোধ করা যায়—
এ ব্যষ্টিতেও যেমন, সমষ্টিতেও তেমনি;
আর, যাতে তা হয় নাকো—
তা পূর্ত্তনীতি বা পূর্য্যনীতি নয়।’ (শাশ্বতী, বাণীসংখ্যা ১৭৫)
উপরোক্ত বাণী থেকে জানা গেল, পলিটিক্স বা রাজনীতি মানে পূর্তনীতি। যে নীতি সকলের অভাব পূরণ করে, সবাইকে অভীষ্ট মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় পোষণ দিয়ে সব্বাইকে প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ করে সংহতির প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ, সেই নীতির নাম রাজনীতি। সবাইকে প্রীতির বাঁধনে বাঁধতে গেলে একটা উচ্চ জীবন্ত-আদর্শ থাকতে হবে। সেই আদর্শের অভাব বলেই আজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বাসা! যারা জনগণের সেবা করবেন সেই জন প্রতিনিধিদের সেবা করার জন্য, মন্ত্রীদের সেবা করার জন্য, নিরাপত্তার দেবার জন্য যদি রাজকোষ থেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়! তাহলে কি জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগনের শাসন প্রক্রিয়ায় একটা প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিচ্ছে না! যিনি জনগণের সেবা করবেন তিনি যদি সবসময় নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকতে অভ্যস্ত হন, তাহলে অন্যদের নিরাপত্তা দেবেন কিভাবে? সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি করবেন কিভাবে? যেমন ধরুন, রেলমন্ত্রী যদি নিরাপত্তার ঘেরাটোপ ছেড়ে, ছদ্মবেশে সাধারণ যাত্রী সেজে মাঝে মাঝে সাধারণ ট্রেনগুলোতে যাতায়াত করতে পারেন, তাহলে প্রকৃত সমস্যা উপলব্ধি করে সমস্যার বাস্তব সমাধান করতে পারবেন। তবে সমস্যা কিন্তু বিরাজ করছে আমাদের শাসন-সংহিতায়। যোগ্য মানুষকে যোগ্য স্থানে কাজে লাগাবার ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানে যদি থাকত, তাহলে যোগ্যতার মাপকাঠিতে মন্ত্রী করা হতো। যেমন, রেলের চৌহদ্দি সম্পর্কে যার কোন ধারণা নেই, রেলের টেকনোলজির সাথে যার কোন পরিচয় নেই, তিনি হয়ে যান রেলমন্ত্রী! শরীর বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যার সাথে যার পরিচয় নেই, তিনি হয়ে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী! অথচ একজন সাধারণ নাগরিককে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রেল বিভাগে, স্বাস্থ্য বিভাগে নিয়োগ করা হয়! (নিয়োগ দুর্নীতি ব্যতীত।) আবার নির্বাচন কমিশন উপ-নির্বাচনের নামে দেশের অনেক অর্থ অপচয় করেন। ফলে সত্যমেব জয়তে-এর নীতিবাক্য বাস্তবে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে!
অক্টোবর ২০২১-এ অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গের একটা উপ-নির্বাচনের উদাহরণ দিলে জিনিসটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। যেমন, খড়দহ বিধানসভার প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে উপ-নির্বাচন হবে, তারজন্য কালীঘাটের বিধায়ককে পদত্যাগ করিয়ে তাকে খড়দহে প্রার্থী করা হলো, কালীঘাটে আর একটা উপ-নির্বাচন করানো হলো! আবার হবে, যে-সব বিধায়কদের পদত্যাগ করিয়ে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করা হবে, সেইসব শূন্যস্থান পূর্ণ করতে আবার উপ-নির্বাচন করা হবে! এই যে, নিষ্প্রয়োজনে, উপ-নির্বাচনের নিমিত্ত ব্যয়ভার বহন করা হয়, অর্থ অপচয় করা হয়, সেটা কি ‘‘Of the people, by the people, for the people—জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।’’ ব্যবস্থার সদর্থক উদাহরণ হতে পারে?—এর জবাব কে দেবে?
* * *
‘মেরা ভারত মহান’ শ্লোগান দিতে যে-সব দেশপ্রেমী জন-প্রতিনিধিরা গর্ব বোধ করেন, প্রাচীন ভারতের শাসনতন্ত্র প্রসঙ্গে তাঁদের একটু জেনে রাখা ভাল।
প্রাচীন ভারতের শাসনতন্ত্র প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলছেন—আর্য্যদের যে কী জিনিস ছিলো তা’ কল্পনায়ই আনা যায় না। Cabinet formed (মন্ত্রীপরিষদ গঠন) হ’ত বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যদের প্রধানদের নিয়ে। প্রধানের প্রধান, তাদের প্রধান, এইরকমভাবে একটা সুন্দর gradation (পর্য্যায়) ছিলো। যারা যত বেশীকে পূরণ করতো তারা তত বড় প্রধান। প্রধান মন্ত্রী সর্ব্বদা ঠিক হ’য়েই থাকতো, উপযুক্ত লোক নির্ব্বাচন নিয়ে কোন গণ্ডগোল উপস্থিত হ’তো না। অন্যদেশ ভারতবর্ষকে আক্রমণ করার সাহসই পেতো না। সব জাতটা দারুণ compact (সংহত) থাকতো। অনুলোম বিয়ে থাকার দরুন সারা জাতটা যেন দানা বেঁধে থাকতো, আর এতে evolution–এর (ক্রমোন্নতির) সুবিধা হ’তো—যথাক্রমে পাঁচ, সাত ও চৌদ্দপুরুষ ধরে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের ভিতর যদি Brahmanic instinct (ব্রহ্মণ্য-সংস্কার) দেখা যেতো—তাদের বিপ্র ক’রে দেওয়া হ’তো। উন্নতির পথ সব দিক থেকে খোলা ছিল। আগের কালে টাকা দিয়ে একজনের সামাজিক position (অবস্থান) ঠিক করা হ’তো না। কারও হয়তো ৫০ লাখ টাকা আছে, কিন্তু কেউ হয়তো পাঁচ টাকায় সংসার চালাচ্ছে—অথচ instinct (সহজাত-সংস্কার) বড়—সে-ই বড় ব’লে গণ্য হ’তো। Instinct, habit, behaviour, activity (সংস্কার, অভ্যাস, ব্যবহার ও কর্ম)—এইগুলিই ছিল মাপকাঠি। Learning (লেখাপড়া)-কে কখনও শিক্ষা বলা হ’তো না। চরিত্রগত না হ’লে তথাকথিত পাণ্ডিত্যের কোন মূল্য দেওয়া হ’তো না। সব সময় লক্ষ্য ছিল—জ্ঞান, গুণ যাতে জন্মগত সংস্কার ও সম্পদে পরিণত হয়। বর্ণাশ্রমধর্ম্ম এত সূক্ষ্ম, উন্নত ও বৈজ্ঞানিক ব্যাপার যে অনেকে এর অন্তর্নিহিত তথ্য বুঝতে না পেরে একে বৈষম্যমূলক বলে মনে করে—এর চেয়ে বড় ভুল আর নেই। যারা বিজ্ঞানসম্মত বর্ণাশ্রমধর্ম্মকে বিপর্য্যস্ত করবার উদ্দেশ্যে generous pose (উদারতার ভঙ্গী) নিয়ে inferior (অসমর্থ)-দের ক্ষেপিয়ে তোলে, তারা সমাজের মহাশত্রু। শ্রীরামচন্দ্র শম্বুকের প্রতি কঠোর হয়েছিলেন—কারণ, শম্বুকের movement (আন্দোলন)-টা বর্ণাশ্রম-ধর্ম্মের বিরুদ্ধে একটা passionate raid (প্রবৃত্তি-প্ররোচিত অভিযান) বই আর-কিছু নয়। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড, ৩২শে জৈষ্ঠ্য, বৃহস্পতিবার, ১৩৪৬, ইং ১৫। ৬। ১৯৩৯)
* * *
ইদানীংকালে ভারতের রাজনীতির অঙ্গন ‘রাম’ নামের জয়ধ্বনিতে মুখরিত। রামমন্দিরে প্রাণ প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে আমরা ভারতীয় প্রজাগণ আর্য্যকৃষ্টির রামরাজত্বকে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। এবার অসৎ-নিরোধী তৎপরতার সাথে দুর্নীতিপরায়ণ রাবনদের বিনাশ করা সম্ভব হবে। সেই রামচন্দ্রের রাজ্য শাসন প্রণালী সম্পর্কে সামান্য কিছু কথা জেনে নিলে পাঠক অনেকটাই সমৃদ্ধ হবেন আশাকরি।
বনবাসে থাকার সময় রামচন্দ্র ভরতকে রাজকার্য পরিচালনা বিষয়ে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন—“….. তুমি গুণী ও যোগ্য ব্যক্তিকে বহু-মান প্রদর্শন করে থাক তো? বীর, বিদ্বান, জিতেন্দ্রিয়, সদ্বংশজ, ইঙ্গিতজ্ঞ লোকদের মন্ত্রীপদে প্রতিষ্ঠিত করেছ তো? তুমি তাদের সঙ্গে মন্ত্রণা কর তো? তোমাদের মন্ত্রণা লোকের মধ্যে প্রকাশ হয়ে পড়ে না তো? তুমি যথাসময়ে শয্যাত্যাগ কর তো? রাত্রিশেষে অর্থলাভের চিন্তা কর তো? তুমি সহস্র মূর্খ পরিত্যাগ করেও একজন বিদ্বানকে সংগ্রহ করতে চেষ্টা কর তো? অযোগ্য লোককে যোগ্যস্থানে ও যোগ্য লোককে অযোগ্য স্থানে নিয়োগ কর না তো? যে-সব অমাত্য উৎকোচ গ্রহণ করেন না, যাদের পিতৃপুরুষ যোগ্যতার সঙ্গে অমাত্যের কাজ করেছেন, যারা ভিতরে-বাইরে পবিত্র—সেই সব শ্রেষ্ঠ অমাত্যকে শ্রেষ্ঠ কাজে নিযুক্ত করেছ তো? রাজ্যমধ্যে কোন প্রজা অযথা উৎপীড়িত হয় না তো? শত্রুকে পরাস্ত করতে পটু সাহসী, বিপৎকালে ধৈর্য্যশালী, বুদ্ধিমান, সৎকুলজাত, শুদ্ধাচারী, অনুরক্ত ব্যক্তিকে সেনাপতি করেছ তো? বিশেষ নৈপুণ্য যাদের আছে, তাদের তুমি পুরস্কৃত ও সম্মানিত করে থাক তো? প্রত্যেকের প্রাপ্য বেতন সময়মত দিয়ে থাক তো? রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিবর্গ তোমার প্রতি অনুরক্ত আছেন তো? তোমার কার্য্যসিদ্ধির জন্য তাঁরা মিলিত হয়ে প্রাণ পর্য্যন্ত দিতে প্রস্তুত আছেন তো? বিদ্বান, প্রত্যুৎপন্নমতি, বিচক্ষণ এবং তোমার জনপদের অধিবাসীকেই দৌত্যকার্য্যে নিযুক্ত করেছ তো? স্বরাজ্যে ও পররাজ্যে প্রধান-প্রধান পদের অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য সংবাদ চরগণদ্বারা অবগত থাক তো? চরগণ পরস্পর-বিরোধী তথ্য পরিবেষণ করলে তার কারণ নির্ণয় করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করে থাক তো? প্রজাগণ সুখে আছে তো? তারা দিন-দিন স্ব-স্ব কর্ম করে সমৃদ্ধ হচ্ছে তো? তোমার আয় বেশী, ব্যয় কম হচ্ছে তো? ধনাগার অর্থশূন্য হচ্ছে না তো? অপরাধীদের ধনলোভে ছেড়ে দেওয়া হয় না তো? তুমি সাম, দান, ভেদ ও দণ্ডের প্রয়োগ যথাস্থানে করে থাক তো? তুমি ইন্দ্রিয়গণকে জয় করতে সচেষ্ট থাক তো? অগ্নি, জল, ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ ও মড়ক এই পাঁচ রকমের দৈববিপদের প্রতিকারের জন্য তুমি যত্নশীল থাক তো? সন্ধি-বিগ্রহাদি যথাস্থানে প্রয়োগ কর তো?… ইত্যাদি ইত্যাদি। (আঃ প্রঃ ৫ম খণ্ড, ইং তাং ২-৪-১৯৪৪)
উপরোক্ত বাণী-সংহিতাগুলো রাম রাজত্বের অনুশাসনবাদের কিয়দংশ মাত্র। তাই রাম-রাজত্ব প্রতিষ্ঠা-পিয়াসী জন-প্রতিনিধিদের উচিত হবে, রামচন্দ্রের সভার ন্যায় একজন আদর্শ সভাসদরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। এবং তা’ বাস্তবায়িত করতে হলে, আদর্শ প্রজাপালকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সরকারী কোষাগার থেকে সাধারণভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা যাবে না। শুনেছি, শ্রীরামচন্দ্রের শ্বশ্রুপিতা রাজর্ষি জনক নিজের জীবন ধারণের জন্য রাজকোষ থেকে এক কপর্দকও গ্রহণ করতেন না। বর্তমান শাসনতন্ত্রের পরিকাঠামো অনুযায়ী জন-প্রতিনিধিদের জন্য বরাদ্দ সুবিধা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে রাম-রাজত্ব প্রতিষ্ঠার চিন্তা অধরাই থেকে যাবে। জনগণকে স্ব স্ব আত্মমর্যাদায় সুখে রাখতে হলে জন-প্রতিনিধিগণদের বিলাস-ব্যসন সুখ-সুবিধার কথা ভুলতে হবে, নীতিপরায়ণ হতে হবে, সর্বোপরি যথার্থ ধার্মিক হতে হবে। সেদিকে দৃষ্টি দিলে তবে কাজের কাজ কিছুটা হবে। স্বমহিমায় বিরাজমান থাকবে সত্যমেব জয়তে-এর জাতীয় নীতি।
ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ব্যবস্থার গৌরবের প্রবহমানতাকে রক্ষা করতে হলে উপরোক্ত ওই বিধানসমূহকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
* * *
সাম্য, মৈত্রী ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তাঁর অনুগামীদের বললেন, “কখনও নিন্দা কর না, কিন্তু অসত্যের প্রশ্রয় দিও না। নিন্দা করতে হয় তো করবে সাক্ষাতে।”
অর্থাৎ, অস্তিত্ব ধ্বংসকারী লোককে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, অথচ তার সম্পর্কে অন্যের কাছে নিন্দাও করা যাবে না। এই দুই এর মধ্যে এক মিলনসেতু রচনা করে বিরোধহীন দুর্বার নিরোধ গড়ে তুলতে বললেন। আর যদি এড়িয়ে, গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করি তা হলেও বিপদ। “তুমি তোমার, নিজ পরিবারের, দেশের ও দশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী।”—বাণীর মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। অথচ, বাস্তবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিগণদের প্রচারের মাধ্যমে, মিটিং-মিছিলে, আলোচনায় নিন্দামন্দের প্রতিযোগিতা দেখতে এবং শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নিন্দা-মন্দ ছাড়া, তারা যেন কথা বলতেও শেখেনি। “নিন্দা-কুৎসা ক’রে কা’রও/হয় না শুভ অনুষ্ঠান,/মিষ্টি কথায় শিষ্ট চালই/উদ্বোধনার উপাদান।”—এই শিক্ষা যার আছে, তিনি কখনও নিন্দার আশ্রয় গ্রহণ করবেন না। নীতিহীন রাজনীতির টানাপোড়েনে, পারস্পরিক নিন্দা-মন্দ দিয়ে আক্রমণের ফলে উত্তরোত্তর সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অবসান কি প্রয়োজন নেই ?
উপরোক্ত নিদেশ-বাণীর বাস্তবায়ন ব্যতীত রাজনীতিকে সার্থক করা প্রায় অসম্ভব!
এবার, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্ররাজনীতির ব্যর্থতা প্রসঙ্গে ইংরেজী ভাষায় কি বললেন একটু জেনে নেওয়া যাক।—
POLITICS WEEPS ALONG
When the sufferers, the distressed
and the misfortunated
are not managed
to get rid of
the heinous, foul breathing of evil
by the service and solace of the noble,
and are not obliged by them—
Politics weeps along !
(THE MESSAGE, VOL. I, by Shree Shree Thakur Anukulchandra)
* * *
যাঁরা ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে প্রচার মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তাঁদের জেনে রাখা উচিত, গণপ্রজাতন্ত্রী আধুনিক ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভের ধর্মচক্র আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ধর্মকে রক্ষা করে চলার কর্তব্যকে। আমাদের রাষ্ট্রীয় মন্ত্র মূণ্ডক উপনিষদ থেকে প্রাপ্ত ‘সত্যমেব জয়তে’ স্মরণ করিয়ে দেয় উপনিষদীয় আচার্য্য অনুসরণের শাশ্বত অবলম্বনকে। রাষ্ট্রের কর্ণধার রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রীবর্গ প্রত্যেকেই ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করে, ঈশ্বরের প্রতিভূ জীবগণের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হয়। ঈশ্বরের প্রতিনিধি স্বরূপ জাগতিক ন্যায়দণ্ডধারী বিচারকেরা ধর্মাধিকরণ পরিচয়ে বন্দিত। বিচারালয়কে বলা হয় ন্যায়ালয় বা ধর্মস্থান। এ থেকে বোঝা গেল, ন্যায় এবং ধর্ম দুটি শব্দ সমার্থক।
ভারতীয় রাজনীতির অনুশাসনের সাম, দান, ন্যায়, দণ্ড, নীতি ও ভেদ-এর রাজধর্ম রক্ষার পবিত্র কর্তব্যে যা’তে এতটুকু অন্যায়, অধর্ম প্রবেশ করতে না পারে তার জন্যই ওইসব মহাভারতীয় নীতির অনুসরণ। বিধিবৎ প্রকৃষ্ট-জাতক সৃষ্টি করে প্রজা পালনের স্বার্থেই ওই অনুশাসনকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে প্রজাপালনের পবিত্র দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাজনৈতিক দলেরা। সেই সুবাদে রাজনৈতিক দলের জন-প্রতিনিধিরা নিজেদের দেশসেবক বলে পরিচয় দেন। ভোটে জিতে দেশ সেবার অধিকার অর্জনের প্রতিযোগিতায় জিততে অনেক রাজনৈতিক দল আবার হিংসার আশ্রয় নেয়, রক্ত ঝরে, জনগণ ঘরছাড়া হয়! এ ধরণের নোংরা রাজনীতির অপসারণের জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
দেশের সেবা করতে হলে প্রথমেই যুগ পুরুষোত্তমের আদর্শ অনুযায়ী ব্যক্তি-চরিত্র নির্মাণের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ভালো মানুষ জন্মাতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যে বিধি মেনে, ভালো ফসল, ভালো ফল, ভালো গোরু, ভালো কুকুর জন্মানো হয়, মানুষের ক্ষেত্রে সেই বিধিকে অগ্রাহ্য করছে ভারতের সংবিধান! ২১ বছরের ছেলে হলেই ১৮ বছরের ঊর্ধের মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে! জাতি, বর্ণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্বভাব-অভ্যাস-ব্যবহার ইত্যাদি কোন কিছুর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না! আমাদের রাষ্ট্রিয় কর্ণধারেরা অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড-এর মাধ্যমে উন্নত প্রজাতির পশু প্রজননের ওপর গুরুত্ব দিলেও সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন পর্ষদ মানুষের উন্নত প্রজাতি সৃষ্টি বিষয়ে উদাসীন! উদাসীন যদি না হতেন, তাহলে মানুষ জন্মানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারতেন না!
উন্নত মানের মানুষ জন্মাবার মাধ্যম, বিবাহ ও সুপ্রজনন বিধির সঠিক প্রয়োগ। সেই বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনীষীদের কিছু মতবাদ উদ্ধৃত করলাম মানবসম্পদ উন্নয়ন পর্ষদ সহ জীবনপিয়াসী মানুষদের উদ্দেশ্যে ।
“Women should marry when they are about eighteen years of age, and men at seven and thirty; then they are in the prime of life and the decline in the powers of both will coincide. “In men the bodily frame is stunted if they marry while they are growing. Since the time of generation is commonly limited within the age of seventy years in the case of man, and of fifty in the case of a woman, the commencement of union should conform to these periods.” “Further, the children, if their birth takes place at the time that may reasonably be expected, will succeed in their prime when the fathers are already in the decline of life, and have nearly reached their term of three score years and ten.” (MARRIAGE GUIDELINE-by ARISTOTLE Translated by Jowth, source Nana-Prasange, part II, page, 76) * * *
“The various problems of marriage should be considered before actual marriage, viz. (1) the question of age (2) the question of health and heredity (3) the question of physical examination (4) the question of preparedness or preparation for marriage (5) the question of delayed procreation (6) the highly important question of compatibility physical or psychic, on which so often the happiness of marriage rests.” “Sometimes a young woman will, for a time, contemplate work out and the woman who has had such an idea seldom repents abandoning it. Lady Chatterlay can never be the happy wife of her peasant lover.” (EUGENICS AND MARRIAGE, By W. Grant Hague, M.D.) * * *
“The eugenic idea, practically applied to the institution of marriage, means that no unfit person will be allowed to marry. It will be necessary for each applicant to pass a medical examination as to his, or her, physical and mental fitness. This is eminently a just decree. It will not only be a competent safeguard against marriage with those obviously diseased and incompetent, but it will render impossible marriage with those afflicted with undetected or secret disease. Inasmuch as the latter type of disease is the foundation for most of the failures in marriage, and for most the ills and tragedies in the lives of women, it is essential to devote special consideration to it in the interest of the mothers of the race…
“When a girl marries she does not know what fate has in store for her, nor is there any possible way of knowing under the present marriage system. If she begets a sickly, puny child, assuming she herself has providentially escaped immediate disease, she devotes all her mother love and devotion to it, but she is fighting a hopeless fight, as I previously explained when I stated that one-half of the total effort of one-third of the race is expended in combating conditions against which no successful effort is possible. Even her prayers are futile, because the wrong is implanted in the constitution of the child, and the remedy is elsewhere. These are the tragedies of life, which no words can adequately describe, and compared to which the incidental troubles of the world are as nothing.” (EUGENICS AND MARRIAGE, by Dr. Hirschfeld) * * * “Most people pick their partners of life with less care than their partners in business-they utilise less caution in the selection of a husband or a wife than in the choice of a cook or in the purchase of a car or cow.”
“Both the man and woman should be carefully examined not only with regard to their health-not only with regard to their fitness to marry but whether they are fit to marry each other. One man’s meat is another man’s poison. The Jill that will make Jack the happiest mortal may make life a living hell for Tom….”
“I do not see how any sane young couple can risk the hazard of marriage, involving heavy responsibilities towards each other, their progeny, society without subjecting themselves to the tests provided by Chemistry, Biology and Psycho-Analysis.” (EUGENICS AND MARRIAGE,By Dr. Alexis Carrel, Nobel Laureate) মানবসম্পদ উন্নয়নের স্বার্থে কি উপরোক্ত বার্তা মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার প্রয়োজন নেই? সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
ইদানীংকালে রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের প্রবৃত্তি-পোষিত জাগতিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যস্ত। মানুষের জিনগত সম্পদকে সংরক্ষণ করে শুদ্ধ প্রজন্ম সৃষ্টি বিষয়ে কোন পরিকল্পনা তাদের নেই। একমাত্র শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র এই মূল বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মূল চাহিদা ছিল মানবতায় সমৃদ্ধ এক-একটা শুদ্ধ মানুষ। যার প্রকাশ তিনি করেছিলেন, মহাগ্রন্থ পুণ্য-পুঁথির প্রথম বাণীতে, ‘‘আমি চাই শুদ্ধ আত্মা’’।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ওই চাহিদার পূর্তি করতে হলে চাই অপাপবিদ্ধ শুদ্ধ মনের এক-একটা সুস্থ মানুষ। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কথা সকলে না-ই মানতে পারেন কিন্তু বিজ্ঞানকে তো আর অস্বীকার করতে পারবেন না। বিজ্ঞানীরাও প্রকারান্তরে সীলমোহর দিয়েছেন শ্রীশ্রীঠাকুরের ওই চাওয়াটাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সুস্থ মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—
”Health is a state of complete physical, mental and social well-being, and not merely an absence of disease or infirmity.”
The Sign of Physical Health : “…………a good complexion, a clean skin, bright eyes, lustrous hair with a body well clothed with firm flesh, not too fat, a sweet breath, a good appetite, sound sleep, regular activity of bowels and bladder, and smooth, easy, coordinated bodily movements. All the organs of the body are of unexceptional size and function ‘normally’; all the special senses are intact; the resting pulse rate, blood pressure and excercise tolerance are all within the range of ‘normality’ for the individual’s age and sex….”
The Sign of Mental Health : “…….feel satisfied with himself. He feels happy, calm and cheerful. There are no conflicts within himself. He is well adjusted. He accepts criticism and is not easily upset. He understands the emotional needs of others, and tries to be considerate. He has good self-control; he is not overcome by emotion; he is not dominated by fear, anger, love, jealousy, guilt or worries. He faces problems and tries to solve them intelligently.”
The Sign of Social Health : “He is at peace with others and is able to feel himself as a part of a group and is able to maintain socialy considerate behaviour.”
Positive Health : “A person should be able to express as completely as possible the potentialities of his genetic heritage.”
(Source : Preventive and Social Medicine by PARK)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী শুধু বাহ্যিকভাবে নীরোগ বা ব্যাধিমুক্ত থাকাই নয়,—শরীরে, মনে, প্রাণে, সামাজিকভাবে এবং জিনগতভাবে স্বচ্ছ, স্বস্থ ব্যক্তিটিকেই সুস্থ বলা যাবে। যে ব্যক্তিটির প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জৈবিক ক্রিয়াশীলতা হতে হবে ত্রুটিমুক্ত। মানুষটিকে হতে হবে সদানন্দে পরিপূর্ণ বৃত্তি নিয়ন্ত্রিত এক ব্যক্তি। সে নিজেকে ছোটও মনে করবে না, বড় কেউকেটাও মনে করবে না। সে নিজেকে সমাজের এক অত্যাবশ্যক অংশ মনে করে সকলের সাথে মানিয়ে চলবে। সেই ব্যক্তি তার বংশগতিকে ক্লিষ্ট না করে সমৃদ্ধ করবে উত্তর প্রজন্ম সৃষ্টির মাধ্যমে।—এমন মানুষ কি আমরা চাই না! অবশ্যই চাই।
ওই ধরণের সুস্থ মানুষদের দ্বারা সুস্থ মানুষ সৃষ্টির প্রবহমানতা ঠিক রাখতে পারলেই সার্থক হবে প্রজাতন্ত্র।
প্রত্যক্ষভাবে দেখতে গেলে আমাদের ভালোমন্দ সব সৃষ্টির মূলে রয়েছে মননশীলতার প্রয়োগ।
সদা চঞ্চল এই মন প্রভাবিত হয় চিন্তার চিৎকণা দ্বারা। নিয়ন্ত্রিত হয় ইচ্ছাশক্তির দ্বারা। চিন্তাশক্তি এবং ইচ্ছাশক্তির পারস্পরিক সংযোগে সৎ এবং অসৎ দুই-ই জন্মলাভ করে। যেমন, কাশ্যপ ঋষির পত্নী দিতি-মায়ের অনিষ্ট চিন্তার ফসল ছিল হিরণ্যকশিপু। যিনি হরিভক্তি-পরায়ণ সন্তানকে পর্যন্ত মারতে নানা ফন্দী এঁটেছিলেন। আবার হরিভক্তি পরায়ণা স্ত্রী কয়াধুর সেবায়, সাহচর্য্যে, প্রেরণায়, উদ্দীপনায় হরি-বিদ্বেষী হিরণ্যকশিপুর হৃদয়ে ভক্তি ভাবের সঞ্চারণা করে প্রহ্লাদের মতো শুদ্ধাত্মাকে গর্ভে ধারণ করে রত্নগর্ভা হয়েছিলেন কয়াধু। এ থেকে বোঝা গেল যে, সৎ এবং অসৎ মননশীলতার জন্মদাত্রী একজন মা। মা মানে মেপে দেওয়া, পরিমাপিত করা। অনুশ্রুতির ছড়াবাণীতে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন—
যে ভাবেতে স্বামীকে স্ত্রী
করবে উদ্দীপিত
সেই রকমই ছেলে পাবে
তেমনি সঞ্জীবিত।
‘চলার সাথী’ গ্রন্থে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন—
‘‘নারী হইতেই জাতি জন্মে ও বৃদ্ধি পায়, তাই নারী যেমন ব্যষ্টির জননী তেমনই সমষ্টিরও ; —আর, এই নারী যেমন ভাবে আবিষ্ট থাকিয়া যেমন করিয়া পুরুষকে উদ্দীপ্ত করে পুরুষ হইতে সেই ভাবই নারীতে জন্মগ্রহণ করে ; তাই, নারী মানুষকে প্রকৃতিতে মূর্ত্ত ও পরিমিত করে বলিয়া জীব ও জগতের মা ; —তাহ’লেই বুঝিও– মানুষের উন্নতি নারীই নিরূপিত করিয়া দেয় ; তাই নারীর শুদ্ধতার উপরই জাতির শুদ্ধতা, জীবন ও বৃদ্ধি নির্ভর করিতেছে—বুঝিও, নারীর শুদ্ধতা জাতির পক্ষে কতখানি প্রয়োজনীয় ! ১৭৬ ।’’
‘নারীর পথে’ গ্রন্থে শ্রীশ্রীঠাকুর জন্ম-প্রকরণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে দিয়ে বললেন।—
শ্রীশ্রীঠাকুর—‘‘প্রত্যেক complex–এর (গ্রন্থির) সঙ্গে full (পূর্ণ আমি) থাকে। কোন গ্রন্থি বা বৃত্তি অভিহত হইলেই তাহা paralysed (অবসন্ন) হয়, তাহাতে full (পূর্ণ আমি) সেই অভিহত বৃত্তির বা গ্রন্থির reflection–এ (পরাবর্ত্তনে) dull (মূঢ়) হইয়া যায়। অর্থাৎ, নারী যেমনতর ভাবদ্বারা পুরুষকে উদ্দীপিত করে সেই ভাবই অনুপ্রাণিত হইয়া নারীতে জন্মগ্রহণ করেন , তা হলেই সেই উদ্দীপনা যেমনতর হইবে—সন্তানের জীবন ও চরিত্র temperamentally অর্থাৎ ধাতুগতভাবে বা প্রকৃতিগতভাবে তাহাই হইবে। তবেই দেখুন, নারী পুরুষের বৃত্তিগুলি যেমনভাবে পুষ্ট করিবে বা খিন্ন করিবে, সন্তান তাহার তেমনি পুষ্ট বা অপরিপুষ্ট প্রকৃতিযুক্ত হইবে। তাই, কেহ হয়ত অঙ্ক কিছুতেই বোঝে না—কেহবা অঙ্কই শুধু বোঝে আর-কিছু বোঝে না, কেহ হয়ত হিংসাপ্রবণ, দোষদৃষ্টিপরায়ণ, নিন্দুক—কেহ হয়ত উদার, দয়াপরায়ণ, দোষদৃষ্টিহীন—স্বভাবতঃই শ্রদ্ধা বা প্রশংসা-প্রকৃতিযুক্ত।’’
বর্তমান সমস্ত বিশ্বব্যাপী যেসব সমস্যা সভ্যতার সঙ্কটরূপে দেখা দিয়েছে, তার সব কিছুর মূলে রয়েছে অসুস্থ এবং বিকৃত মানসিকতা। সেই বিকৃত মানসিকতার বৃদ্ধি এবং বংশানুক্রমিক বিকাশে প্রতিরোধী লাগাম টেনে না ধরতে পারলে নিকট ভবিষ্যতে মনুষ্যত্বের মূল বুনিয়াদ বলে আর কিছু থাকবে না।
এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বহু পূর্বেই আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন—
শাসন-সংস্থা যেমনই হোক
যাতেই মাথা ঘামাও না
যৌন-ব্যাপার শুদ্ধ নাহলে
দেশের জীবন টিঁকবে না।
ওই যৌন-ব্যাপার শুদ্ধ করা বিষয়ে বিস্তারিতভাবে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, ‘‘সমাজের মূলে বিবাহ। বিবাহকে সংস্কার করতে না পারলে কোন সংস্কারই কোন কাজের নয়। Intercourse-এর সময়ে male ও female দুই জনেরই concentration যত বেশী হয় sperm ও ovum–এর উপর life impression তত বেশী হয়। সেই জন্য marriage based on real life হলে এই concentration possible হয় এবং life impression বেশী হয়। ………………আমাদের শরীর তৈয়ার করে মা। বাবা তৈরী করে মন। অবশ্য দুই-ই পরস্পর গূঢ়সম্বন্ধযুক্ত। শরীর ও মন দুর্বল হলে বোঝা যায় পিতামাতা পরস্পরের প্রতি অনুরাগবিহীন। আর শরীর ও মন উভয়ই সবল হলে বোঝা যায় পিতামাতা পরস্পরে খুব অনুরক্ত।
যেদেশে বিবাহপদ্ধতি দূষিত হয়ে পড়ে, সে দেশে শরীর ও মন দুর্বল নিয়েই সন্তান জন্মগ্রহণ করে। আবার সেই দেশে খুব বড় genius জন্মায় কেন ভেবে দেখতে হবে। Criminals, idiots প্রভৃতি যতকিছু জন্মায় তা সব বিবাহ পদ্ধতি দূষিত বলেই যে হয় তা বলাই বাহুল্য।
………. আবার দেখা যায় during the period of pregnancy যে ভাবে বা যার ভাবে সব সময় মাতাপিতা ভাবিত থাকে তদনুরূপ আকৃতি নিয়েই শিশু জন্মে। From the point of intercourse to birth মায়ের মানসিক ভাব সন্তানের শরীরের ও আকৃতির উপর ক্রিয়া করে। আবার আকৃতিকে mould করার জন্য মনকেও কিয়দংশে mould করে।
Intercourse-এর সময় খুব concentration হয়, তাই মনের মধ্য সবচেয়ে deeply impressed ideaটাই তখন spermatozoa–র ভিতর দিয়ে সন্তানে মূর্ত হয়ে উঠে।
Intercourse-এ দেখা যায়, concentration-এর একটা cessation আসে, ঠিক ধ্যানের মত। আর ধ্যানে যেমন subconscious strongest impression মূর্ত হয়ে উঠে, সন্তান জন্মাবার সময়ও ঠিক তেমনি হয়।’’
একটা সুস্থ মানবসভ্যতা গঠন করার জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর আদর্শ দীক্ষা, শিক্ষা, বিবাহ, কৃষি ও শিল্পের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার হিমাইতপুরে। সর্বোপরি আর্য্যকৃষ্টির বিবাহ নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার উপর জোর দিয়েছেন। আর্য্য বিবাহ নীতিকে যুগোপযোগীভাবে সংস্কার করার উপর জন্য জনে জনে বলেছেন। ম্যারেজ-ব্যুরো গঠন করে সুবিবাহ ও সুপ্রজনন বিধিকে মানুষের মননশীলতায় প্রবেশ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছার পূর্তি কতটা হয়েছে বা হয়নি সেই বিতর্কে না গিয়ে নিজের নিজের দায়ভারটাকে তো কাজে লাগাতে পারি! সামগ্রিকভাবে সেই দায়ভার বহন করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে আইন প্রণয়ন করা। আর সেই উদ্দেশ্য সাধনে প্রয়োজন আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক সংগঠনের।
* * *
যে রাষ্ট্র কৃষি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে, পশু উৎপাদনের ক্ষেত্রে উন্নত জাত, বংশ, গোত্র, বিচার করে; বিশ্বাসঘাতক সন্ত্রাসবাদী দমনে প্রভূত অর্থ ব্যয় করে শুদ্ধ জন্মের শংসাপত্র প্রাপ্ত পে-ডিগ্রীড অ্যালশেসিয়ান, জোবারম্যান ইত্যাদি সমৃদ্ধ জাতের কুকুর আমদানী করে;—অসংখ্য স্ট্রীট ডগ্দের অবহেলিত, দলিত হিসেবে মর্যাদা না দিয়ে! সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থাই মানুষের জন্মটাকে অশুদ্ধ করার জন্য বর্ণাশ্রমানুগ শ্রেণীবিন্যস্ত ভারতীয় সমাজ বিধানকে অমর্যাদা করে যেমন খুশি তেমন বিয়ের এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের ছাড়পত্র দিয়ে জাতিকে ভয়ানক সর্বনাশের পথে এগিয়ে দিচ্ছে–-অথচ জাত-পাতের নামে সংরক্ষণ, ভাতা চালু রেখেছে! এই বিষয়গুলো যথার্থভাবে অবগত করাবার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
জনগণের জৈবিক তাগিদ পূরণের জন্য আর কিছু না হোক, অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের তো যোগান দিতে হবে। আর তারজন্য প্রথমেই প্রয়োজন বিশুদ্ধ, সুস্থ একটা পরিবেশ। দেশসেবকেরা বিষয়টি নিয়ে যদি ভাবতেন তাহলে সত্যের পরিপন্থী অসত্য, অন্যায়, অধর্ম প্রশ্রয় পেত না। মহান নাগরিক সৃষ্টির গুরুত্বকে উপেক্ষা করে মহানগরের বিস্তার প্রাধান্য পেত না। সবুজায়ন বিনষ্ট করে নগরায়নের বাড়বাড়ন্ত হতে পারতো না! সর্বত্র দূষণ বিস্তার লাভ করতে পারত না। এ বিষয়ে সকলকে অবগত করার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
বেঁচে থাকা নিয়ে আমরা যে যতই আস্ফালন করি না কেন, মূলতঃ, প্রকৃতির অকৃপণ দান বায়ু, জল, মাটি, সূর্যালোক প্রভৃতি মৌলিক অজৈব উপাদানের উপর আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। শুধু মানুষ নয়, প্রোটোভাইরাস, ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, প্যারাসাইট, শ্যাওলা, উদ্ভিদ থেকে শুরু করে মনুষ্যেতর প্রাণী সকলের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা ওই অজৈব উপাদান বা পঞ্চ মহাভূতের উপর নির্ভরশীল। তাহলে দেশসেবার প্রথম কাজ হবে অসৎ নিরোধী তৎপরতার সাথে জৈবাজৈব প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখা। তারপর পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যার অনুশাসন মেনে নানাভাষা, নানামত, নানা পরিধানের মানুষের বৈশিষ্ট্য টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা। মহান ভারতের রাজর্ষি জনক ওই বিধি মেনে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন (সূত্র : মহাভারত, বনপর্ব)। সে বিষয়ে সবাইকে অবগত করার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
।। বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বর্ণাশ্রমের ভূমিকা ।।
আর্য্য হিন্দু সমাজে বর্ণ সংখ্যা চার, জাতি প্রায় তিন হাজারেরও বেশী। প্রাচীন ভারতে নতুন কোন জাতির সন্ধান পাওয়া গেলে ঐ জাতির গুণ ও কর্ম অনুসারে উপযুক্ত বর্ণে স্থান করে দেওয়া হত। তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থায় কুলোচিত জীবিকার মাধ্যমে জাত্যুৎকর্ষে উন্নীত বা জাত্যাপকর্ষে অপনীত হওয়ার এক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল। নাগরিকদের বৈশিষ্ট্যের পালন এবং পোষণ করত রাষ্ট্র। সত্ত্বগুণে ব্রাহ্মণ, সত্ত্বমিশ্রিত রজোগুণে ক্ষত্রিয়, রজঃমিশ্রিত তমোগুণে বৈশ্য এবং তমঃ গুণাধিকারে শূদ্রাদি বর্গ নির্ণয়দ্বারা শ্রেণী-বিন্যস্ত সমাজ সংগঠন নির্মাদ্ধারিত হতো। সমাজ ব্যবস্থায় শূদ্রের কর্ম বা বৃত্তিধর্ম ছিল শিল্পকর্ম ও সেবা; বৈশ্যের কৃষি, বাণিজ্য, গোরক্ষা; ক্ষত্রিয়েরা সমাজকে, পরিবেশকে পোষণ, প্রীতিচর্য্যা, বাহুবল দিয়ে ক্ষত থেকে ত্রাণ করার রক্ষাধর্ম পালন করতেন এবং ব্রাহ্মণদের ব্রহ্মচর্য্য, তপস্যা, মন্ত্র ও সত্য নিদ্ধারিত করা ছিল। রাজশক্তি বংশপরাস্পরায় সকল প্রজাদের বৃত্তিধর্মে নিয়োজিত করতেন। বৃত্তিহরণ স্বীকৃত ছিল না। ফলে অশিক্ষা, কুশিক্ষার বেকার সমস্যা ছিল না।
রাজর্ষি জনকের রাজ্যে কোন প্রজার কোনরূপ অভিযোগ ছিলনা রাজার বিরুদ্ধে। সকলেই গুণোচিত কর্মের এবং যোগ্যতার মর্যাদা পেতেন। দুষ্কর্মের জন্য দুষ্কৃতিরা উপযুক্ত শাস্তি পেত। সুকর্মের জন্য পুরস্কৃত হত।
ঠিক সেইভাবে, রাজর্ষি জনকের ন্যায় অসৎ নিরোধী তৎপরতার সাথে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করতে হবে। রাম-রাজত্ব না হোক, অন্ততঃ গৌরবময় গুপ্ত সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে আনতে হলে ভারতীয় শাসন সংহিতায় বা সংবিধানে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সম্প্রদায় নিরপেক্ষ ধর্মপ্রাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ করতে হবে। সংবিধানের প্রচলিত ধারা ধর্ম এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়কে একাকার করে ফেলে ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদ’,––অর্থাৎ রাষ্ট্র ধর্মের অনুবর্তী নয়’-এর মতবাদকে প্রতিষ্ঠা দেয়, তখন কি মনে হয় না যে, আমরা জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েও এক বিপর্য্যয়ী বোধ-দ্বারা পরিচালিত হয়ে পরস্পর বিরোধী আচরণ করে চলেছি ! যার ফলে ধর্মের নামে জীবন-বিরোধী অধর্মের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে রাষ্ট্রের অনুমোদন ক্রমে। এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
শাস্ত্র বা বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, যে নীতি-বিধি পদার্থের অস্তিত্ব রক্ষার সহায়ক তাই তো ধর্ম। অথবা বলা যায়, পদার্থের স্বকীয়তা ধারণ করে রাখে যা’ তাই ধর্ম। ধর্ম পালন করলেই পদার্থ টিঁকে থাকবে, নচেৎ থাকবে না। সেই ধর্মের অনুবর্তী না থাকার মানে, জীবন ধারণের শাশ্বত বিধিকে অস্বীকার করা। সংসদ প্রকাশিত ইংরেজী অভিধানে religion অর্থে বলা হয়েছে, ‘It is an action, one is bound to do.’ সেই ধর্মের আবার পক্ষ আর নিরপেক্ষ কি? ঈশ্বর যেমন এক এবং অদ্বিতীয়, ধর্মও তেমনই এক অদ্বিতীয়। এর কোন প্রকার হয় না। হিন্দুধর্ম, মুসলমান ধর্ম এগুলো সম্প্রদায়গত ধর্মীয় মতবাদ। প্রকৃত ধার্মিক তাঁরা, তাঁরা, মনুষ্যত্বের প্রকাশে এবং বিকাশে বিশ্বাসী, সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে নয়। বেদ, গীতা, কোরান, বাইবেল প্রভৃতি ধর্মীয় পুস্তকগুলিতে মনুষ্যত্বের উত্তরণের বিধান পরিবেশিত হয়েছে। রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, যীশুখ্রীষ্ট, হজরত রসুল প্রমুখ পুরুষোত্তমগণ কোথাও বিভেদ সৃষ্টি করে যান নি, সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির সুস্থ সমাবেশ গঠনের কথা বলেছেন।
বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যিক অজৈব উপকরণ বায়ু, জল, মাটি ইত্যাদির যদি ধর্ম থাকতে পারে, এবং তা’ যদি বিজ্ঞানের বইতে পাঠ্য হতে পারে, তাহলে মানুষের কি ধর্ম নেই? মনুষ্যত্ব প্রকাশের মাধ্যমেই তো মানুষ ধার্মিকতার পরিচয় দেয়। মানুষের মনুষ্যত্বের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার নীতিবিধি-সমন্বিত ভারতের নিজস্ব সংহিতাগুলোর বিধানসমূহ ভারতীয় শাসনতন্ত্রের সংহিতায় স্থান পাবে না কেন, প্রজাদের শিক্ষা দিতে পাঠ্য করা হবে না কেন? এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
ধর্ম প্রসঙ্গে বর্ণিত উপরোক্ত বাণীসমূহ কি জীবনবিরোধী কোন তাৎপর্য্য বহন করছে, না কোন ধর্ম প্রবক্তাদের, রাজনৈতিক-প্রবক্তাদের মতবাদের এতটুকু বিরোধিতা প্রকাশ করেছে ?
বর্তমান যুগ-পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সাধারণ জনদের বোঝাবার জন্য আরও সহজ ভাষায় বললেন, ‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে/ধর্ম বলে জানিস তাকে। ধর্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে/সম্প্রদায়টা ধর্ম না-রে।’ ওই সম্প্রদায় নিরপেক্ষ সমন্বয় বার্তাবহ বাণীকে গুরুত্ব না দিয়ে, রাষ্ট্র, ধর্মের নামে, শাস্ত্র বহির্ভূত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রবৃত্তি পরায়ণতার আস্ফালনকে, কতগুলো অনিত্য, অসার, অবৈজ্ঞানিক, পরিবেশ দূষক, পৌত্তলিকতার কু-সংস্কারকে যদি ‘ধর্ম’ নামে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়, তা’ কি বিচক্ষণতার পরিচায়ক হবে, না ভারতবর্ষের কৃষ্টির পরিপূরক হবে? ওই ভুলের বোঝা কি আমাদের চিরদিন বইতে হবে? আমাদের বুদ্ধি, বোধ কি নিরেটই থেকে যাবে?
রাষ্ট্রের সৃষ্টিই তো প্রজাদের অধর্ম বা দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে ধার্মিক, অর্থাৎ সু-নীতি পরায়ণ করে তোলার জন্য। সেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলো যদি ওই মহান কর্তব্য ভুলে তার প্রজাবর্গকে, তাদের পিতৃ-পিতামহের আদর্শ অনুসারী ধর্ম-পরায়ণ, কৃষ্টি-পরায়ণ হতে উৎসাহ না দিয়ে, প্রবৃত্তি-পরায়ণতায় উৎসাহ দেয়, সেটা ভারতবর্ষের জাতীয় উত্তরাধিকারত্বের অস্তিত্বকে বিপন্ন করার বার্তা ভিন্ন আর কিছু নয়। কারণ,—
‘‘প্রজা মানেই হচ্ছে—
প্রকৃষ্টরূপে জাত—
সর্ব্বসম্ভাব্য উদ্বর্দ্ধনী সার্থকতায় ;
আর প্রকৃষ্ট জন্ম পেতে হলেই চাই—
প্রজনন পরিশুদ্ধি—
সর্ব্ব-সম্ভাব্যতার বৈধানিক সংস্থিতিতে. …. ’’
(‘সম্বিতী’ গ্রন্থ থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বাণী)
* * *
।। গণ প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের সেকাল-একাল ।।
মূণ্ডক উপনিষদের পবিত্র মন্ত্র ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শকে সম্বল করে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট গণ প্রজাতন্ত্রী আধুনিক ভারতবর্ষের যাত্রা শুরু হলেও ‘‘Of the people, by the people, for the people—জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।’’-এর লক্ষ্যে রচিত কতগুলো বিধিবদ্ধ নিয়ম, শাসন সংহিতা বা সংবিধান ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী স্বীকৃতি লাভ করে, যে দিনটাকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
আর্য্যশাস্ত্র মুন্ডক উপনিষদ-এর প্রথম খণ্ড (3.1.6) থেকে গৃহীত মন্ত্র‘সত্যমেব জয়তে’ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় আদর্শ। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময় এই মন্ত্রটিকে জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে এসে জনপ্রিয় করেন। এটি ভারতের জাতীয় নীতিবাক্য হিসাবে গৃহীত হয়েছিল 26 জানুয়ারী 1950, যেদিন ভারত একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। ‘সত্যমেব জয়তে’-এর অর্থ হলো সত্যেরই জয় হয়। এটি ভারতীয় জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ-এর গোড়ায় দেবনাগরী লিপিতে খোদাই করা হয়েছে। সমস্ত ভারতীয় মুদ্রা এবং জাতীয় নথির একপাশে খোদাই করা আছে।
সত্যের আশ্রয়ে ‘আমরা করবো জয়’ এই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা, তারজন্য খোদাই করা হয়েছিল। (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া) ‘সত্যমেব জয়তে’-এর সীলমোহর হাতে পেয়ে অসত্যের পথে চলার জন্য নয়।
সত্য বিষয়ে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, “সত্যং ভূতহিতং প্রোক্তং ন যথার্থাভিভাষণম্।” অর্থাৎ যা প্রাণীদের পক্ষে মঙ্গলকর তাই সত্য। অহিতকর যথার্থ সত্য নয়।
‘সত্যমেব জয়তে’-র আধিকারিকেরা এই সত্য পথ অবলম্বন করে প্রকৃত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেই জয় হবে সত্যের। অর্থের লোভ, আত্মপ্রতিষ্ঠার মোহের কাছে ‘সত্যমেব জয়তে’-র সীলমোহর ধারকেরা যদি বিবেককে বন্ধক রেখে আত্মবিক্রয় করতে থাকে তাহলে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ভারতীয় কৃষ্টির ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে সব সত্তা প্রেমীদের।
সত্য মানে অস্তিত্ব। যার অস্তিত্ব আছে যার বিকাশ আছে তাই সত্য (real)। ঋষি প্রদর্শিত এই সত্যের পথই আর্য্য ভারতবর্ষের মূলধন। আমাদের আদর্শ ছিল– ‘আত্মানং বিদ্ধি’, নিজেকে জানো, know thyself, ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু, মাতৃবৎ পরদারেষু, লোষ্ট্রবৎ পরদ্রব্যেষু।’ সকলকে নিজসত্তার প্রতীক মনে কর, মেয়েদের নিজের মায়ের প্রতিরূপ ভেবে শ্রদ্ধা কর, অন্যের জিনিসকে মাটির ঢেলার মত দ্যাখ। ‘মা গৃধ’, লোভ কর না। তথাপি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রজাগণ কেন সত্যভ্রষ্ট হচ্ছে, ভেবে দেখার প্রয়োজন নেই?
আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, ‘প্রজা’ শব্দের অর্থ প্রকৃষ্ট জাতক। আর তন্ত্র মানে কতগুলো বিধিবদ্ধ নিয়ম বা system।
প্রজাতন্ত্রের মর্মার্থ হচ্ছে, যে তন্ত্র বা system মেনে আদর্শ প্রজা নির্মাণ, পালন, পোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষায় প্রযত্নশীল থেকে পরম রাষ্ট্রিক সমবায়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা যায়। ভারতের ব্রহ্মসূত্র, মহাকাব্য, বেদ, উপনিষদ, সংহিতা, আদর্শপুরুষ শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ বলে যা কিছু বর্তমান,—সবকিছুই ওই ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।
কতিপয় রাজনৈতিক নেতারা মহান ভারতের ওইসব বিধিকে আড়াল করে প্রবৃত্তি-পরিপোষিত শিক্ষায় প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের প্রজাদের শিক্ষিত করতে চাইছে। ফলে সন্ত্রাসবাদ, ভ্রষ্টাচার, যৌন-ব্যভিচার ক্রমবর্দ্ধমান। এর কারণ ‘সত্যমেব জয়তে’ কে বাস্তবে মূর্ত করে তোলার মত কোন ইন্দ্রিয়জয়ী সৎপুরুষের জীবন্ত আদর্শ অনুসরণ করছে না রাষ্ট্র। ফলে দেশে মহানগরের বাড়বাড়ন্ত হলেও মনুষ্যত্বের পরিচয় সম্পন্ন ‘পিতামাতার সুজননের সুসন্তান, সন্তানের সুমাতা-সুপিতা, সমাজের সুবন্ধু, রাষ্ট্রের সুনাগরিক’ এমন মহান নাগরিকের সংখ্যা ক্রমশঃ যেন অবলুপ্তির পথে।
ওই অবলুপ্তি থেকে সভ্যতাকে বাঁচাতে, যা-যা করণীয় তা যদি না করা হয়, ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
তাই, ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের প্রবহমানতা টিঁকিয়ে রাখতে হলে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে আদর্শ প্রজা সৃষ্টির মাধ্যম, সুবিবাহ ও সুপ্রজননের ওপর। সুপ্রজননের দায়িত্ব মূলতঃ মেয়েদের। মেয়েই তো মা হয়। মায়ের শুদ্ধতার ওপর নির্ভর করে সন্তানের শুদ্ধতা। বিধিমাফিক সেই মায়েদের শুদ্ধতা রক্ষা করার ব্যবস্থা না করতে পারলে শুদ্ধ প্রজা সৃষ্টি হবে না। বিপন্ন হবে প্রজাতন্ত্র! এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে আর্য্য মহাসভা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
যদিও বর্তমান পুরুষোত্তম এ বিষয়ে আমাদের সচেতন করতে বাণীর মাধ্যমে বললেন–
“দেশের অবনতির
প্রথম পদক্ষেপই হ’চ্ছে—
মেয়েদের উচ্ছৃঙ্খলতা,
পারিবারিক সঙ্গতির প্রতি
বিদ্রূপাত্মক অবহেলা,—
যা’ দেশের শুভদৃষ্টিটাও
ভেঙ্গেচুরে চুরমার করে
সর্ব্বনাশকে আমন্ত্রণ ক’রে থাকে;
তাই বলি,
মেয়েরা যেন
তাদের পবিত্রতা হ’তে
এতটুকুও স্খলিত না হয়,
ব্যবস্থা ও বিধানগুলি
এমনতরই বিনায়িত করে
তাদের ভিতর সঞ্চারিত করে তোল;
তুমি যদি দেশের স্বস্তিকামীই হও—
এদিক থেকে
তোমার দৃষ্টি ও কৃতিচর্য্যার
একটুও অবহেলা যেন না থাকে,
স্বস্তিই হ’চ্ছে
শান্তির শুভ আশীর্ব্বাদ,
আর, স্বস্তি মানেই হ’চ্ছে
সু-অস্তি—”
(বাণী সংখ্যা ৩৭৩)
* * *
প্রজা সৃষ্টি বা ব্যক্তি নির্মাণের সহজ উপায় প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন, “আর্য্যকৃষ্টির মধ্যে তো আছে তারই কলা-কৌশল। তার জন্য প্রথমে চাই good breeding (ভাল জন্ম)। ভাল জন্ম হ’তে গেলে পিতা-মাতার instinct (জন্মগত সংস্কার) ভাল হওয়া চাই এবং তাদের বিয়েও সব দিক দিয়ে মিল ক’রে হওয়া চাই। তারপর পারিবারিক চালচলন এমন হওয়া চাই, যাতে ছেলে-মেয়েরা গোড়া থেকেই সৎ দৃষ্টান্ত দেখে ভাল হওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। পারিবারিক শিক্ষা যদি ভাল না হয়, তাহ’লে পুঁথিগত শিক্ষা যতই হোক না কেন, তাতে মানুষের habits, behaviour (অভ্যাস, ব্যবহার) adjusted (সুনিয়ন্ত্রিত) হয় না।
তারপর চাই সদ্গুরুর কাছে দীক্ষিত হ’য়ে শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠাসহকারে তাঁর নির্দ্দেশ মেনে চলা।
শিক্ষা-ব্যবস্থাও এমন হওয়া দরকার, যাতে প্রত্যেকে তার বৈশিষ্ট্যের উপর দাঁড়িয়ে চৌকষ হ’য়ে উঠতে পারে। স্বতঃদায়িত্বে environment (পরিবেশ)-এর প্রয়োজন কে কতখানি পূরণ ক’রে চলতে পারে, অপরের জীবনীয় স্বার্থকে কে কতখানি বাস্তবে নিজের স্বার্থ ক’রে তুলতে পারে, মোট কথায় সেইটেই শিক্ষার বড় তকমা। আর জীবিকার ব্যবস্থা যথাসম্ভব বর্ণবৈশিষ্ট্যানুগ ও স্বাধীন হওয়া দরকার। উপার্জ্জনের অন্য যে-কোন পথই থাক, cottage-industry (কুটিরশিল্প) ও agriculture (কৃষি) সব পরিবারেই কিছু না কিছু থাকা চাই। আর চাই গো-পালন। জীবিকার জন্য যদি পরের দাসত্ব করতে না হয় বা dishonesty (অসাধুতা) করতে না হয়, তাহ’লে কিন্তু মানুষ অনেকখানি ঠিক থাকে।
আর চাই ভাল-ভাল ঋত্বিক্, অধ্বর্য্যু, যাজক। তারা তাদের উন্নত চরিত্র, সেবা ও যাজনের ভিতর-দিয়ে সারা দেশের মানুষকে সত্তাপোষণী চলনে অভ্যস্ত ক’রে তুলবে, ধর্ম্ম, ইষ্ট, কৃষ্টির ভিত্তিতে integrated (সংহত) ক’রে তুলবে। সঙ্গে-সঙ্গে দেখবে, অসৎ অর্থাৎ সত্তাপরিপন্থী রকমগুলি যাতে দানা বেঁধে উঠতে না-পারে। Simultaneously (যুগপৎ) এই সবগুলির দিকে নজর দিয়ে যদি চলা যায়, তাহ’লে দেশের আবহাওয়াই বদলে যাবে। তখন মানুষের ভাল হবার সম্ভাবনাই বেশী থাকবে। খারাপ যারা থাকবে, তারাও উপযুক্ত শাসন-তোষণ ও প্রেরণার ভিতর-দিয়ে অনেকখানি ঠিক হ’য়ে উঠবে।
Bad instinct (খারাপ সংস্কার)-ওয়ালা progeny (সন্ততি) যাতে সমাজে বাড়তে না পারে, তার ব্যবস্থা না করলেই নয়।
সেইজন্য আমি proper marriage (উপযুক্ত বিবাহ)-এর উপর অতো জোর দিই। ঐ জায়গায় হাত না দিলে সব programme (কর্ম্মসূচী)-ই fail করবে (অকৃতকার্য্য হবে)।
আমি মুখ্যু মানুষ, আমার কথার তো দাম নেই। কিন্তু দাসীর কথা বাসি হলি কামে লাগবি। (আলোচনা-প্রসঙ্গে, ষষ্ঠ খণ্ড, ২৩শে অগ্রহায়ণ, শনিবার, ১৩৫১, ইং ৯-১২-১৯৪৪)
যথার্থ মর্যাদায় প্রজাতন্ত্রকে বাস্তবায়িত করতে হলে যুগ-পুরুষোত্তমের আদর্শকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করার প্রয়োজন আছে। বর্তমান রাজনৈতিক দলের সাথে দেশপ্রেমী সচেতন ব্যক্তিবর্গ যাঁরা যুক্ত আছেন, তাঁরা কিন্তু পার্টির সব দুর্নীতি মেনে নিতে পারেন না। তাদের পথ দেখাতে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন আমার গুরুদেবের একটা বাণী। “রাজনীতি বলে তায়/পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যায়/সংহতি আনে যায়।” যে নীতি সকলের অভাব পূরণ করে, সবাইকে অভীষ্ট মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় পোষণ দিয়ে সব্বাইকে প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ করে সংহতির প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ, সেই নীতির নাম রাজনীতি। এ বিষয়ে প্রজাগণকে সচেতন করতে আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
জনগণের অভাব পূরণ যিনি বা যারা করবেন তাদের বৈশিষ্ট্যপালী হতে হবে। বৈশিষ্ট্য মানে বিশিষ্টতা। বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের নানাভাষা, নানামত, নানা পরিধানসমৃদ্ধ বিশিষ্টতার পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা সংহতির প্রতিষ্ঠা যিনি করতে পারবেন তিনি হতে পারবেন একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ।
যেমন, একজন গোপালক বা রাখাল বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের গোরু—ষাড়, বলদ, গাভী, দামড়া, বকনা নামের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের গোরুর পাল নিয়ে মাঠে চড়াতে যায়। একটা ছোট লাঠি বা পাচনের সাহায্যে সে গোরুর পাল্-কে পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা সংহত রেখে আবার গোধূলি বেলায় গোয়ালে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। যেমন, একজন চাষী তার বিভিন্ন জমির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য মেনে ভূমিকে কর্ষণ করেন বা চাষ দেন। জমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ‘জো’ বুঝে বীজ বপন করেন, চারা রোপন করেন। তারপর উপযুক্ত জলসেচ, সার, কীটনাশক, পাহারা দিয়ে পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা ফসল উৎপাদন করেন। দুঃখের বিষয় বর্তমানের রাজনীতির নেতারা সে বিষয়ে কোন গুরুত্ব আরোপ করছেন না। এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতে, বৈশিষ্ট্য মানে—তদনুপাতিক organic adjustment (বৈধানিক বিন্যাস)। তার আবার (group) গুচ্ছ আছে। এইগুলিকে বলা হয় বর্ণ, এর কোনটাই আমরা নষ্ট করতে চাই না। নষ্ট করা মানে যুগ যুগ ধরে, তিল তিল করে, যা গড়ে উঠেছে তা হারান। ন্যাংড়া আম আছে, ফজলি আম আছে আরো কত রকমের আম আছে। এর একটা জাত যদি নষ্ট করে ফেলি তাহলে তা’ আর ফিরে পাব না—হারাব চিরতরে। সেকি ভালো? ফজলি আমের মধ্যে তো আর ন্যাংড়া আমের স্বাদ পাব না। তাই যেন আমরা বুঝে চলি। (আলোচনা প্রসঙ্গে, ১৬শ খণ্ড, পৃঃ ১০৯)
আমাদের ভারতের গ্রামীন অর্থনীতি কৃষি ও গোপালনের উপর নির্ভরশীল। ভালো কৃষকেরা কখনোই যেমন খুশি তেমনভাবে, নিজের খেয়ালখুশি মত চাষ করেন না। সরকারী কৃষি বিভাগের পরামর্শ মেনে জমি অনুযায়ী উন্নত জাতের বীজ বপন করেন, চারা রোপন করেন। গোপালন ক্ষেত্রেও তাই। সরকারী পশু পালন বিভাগের বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মেনে গাভীর জাতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সম-বিপরীত উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ দিয়ে উন্নত জাতের সুস্থ, সবল বাচ্চা উৎপাদন করেন। অথচ, ওই পদ্ধতি মেনে সুস্থ মানব-শিশু সৃষ্টির বিষয়ে রাষ্ট্র উদাসীন। এ বিষয়ে সবাইকে অবগত করাবার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
আমরাও দৈনন্দিন জীবন-যাপনে সকলেই কিছু-না-কিছু বৈশিষ্ট্যের পালন-পোষণ করেই থাকি। সচেতন ব্যক্তি মাত্রেই বাজার থেকে ভালো জাতের বা কোয়ালিটির আলু, বেগুন, পটল, মুলো, আম, চাল, ডাল, চা কিনতে অভ্যস্ত। এমন কোন সুস্থ মানুষ নেই যে উদারতার নামে হিমসাগর আমের দাম দিয়ে আঁশযুক্ত টোকো আঁটিসার আম কিনে আনবেন? মিনিকীট, বাঁশকাঠি, গোবিন্দভোগ, দেরাদুন রাইসের দাম দিয়ে রেশন দোকানে প্রদত্ত মোটা চাল কিনে আনবেন?
এ থেকে প্রমাণিত হলো গাছপালা, পশুপাখি সবকিছুর জাত, বর্ণ আছে। জীব বিজ্ঞানের পুস্তকেও জাতি, প্রজাতি, বর্ণ, গোত্র-এর উল্লেখ আছে। তাহলে মানুষের কি নেই? অবশ্যই আছে। মানুষ তো সব জাতহীন হয়ে যায় নি? তবে হ্যাঁ, জাতের নামে বজ্জাতি কিন্তু চলছে—শিডিউলড্, আন-শিডিউলড্, ওবিসি, ট্রাইব প্রভৃতি নিয়ে পার্টিবাজি করতে গিয়ে সহজাত-সংস্কারের বৈশিষ্ট্যটাকে নাকাল হতে হচ্ছে! অন্যায়, অধর্ম করে, অন্যের বৃত্তি হরণ করে টাকা উপার্জন করতে গিয়ে এক অসম অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করে চলেছি আমরা। ফলে অর্থ, অনর্থ সৃষ্টি করে চলেছে ! এর অবসানের জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র এবং দারিদ্র সীমার নীচে ইত্যাদি অর্থনৈতিক মানদণ্ডে বিভাজিত। যার সাথে বর্ণানুগ কর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ফলে, তথাকথিত একজন নিম্ন বর্ণের মানুষও কালোয়ারী, দালালি, সিণ্ডিকেট, প্রমোটারী ইত্যাদি বৃত্তি মাধ্যমে প্রভূত টাকা রোজগার করার সুযোগ পাচ্ছে। উচ্চ-বিত্তধারী হয়ে অপরাপর উচ্চবর্ণকে চাকর রেখে, দরিদ্র অথচ গুণীজনদের দাবিয়ে রেখে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারছে! এক মেকী উদার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বংশানুক্রমিক গুণ ও কর্মের যোগ্যতার মানদণ্ডকে শিথিল করে সংরক্ষণ প্রথা মাধ্যমে এক পরস্পর বিরোধী শ্রেণী-বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা বর্ণাশ্রম না বুঝলেও সুবিধা আদায় করার লক্ষ্যে SC/ST/OBC বুঝতে শিখেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ‘ওয়ার্ক কালচার’ নষ্ট হয়ে এক অসম অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারী, বেসরকারী, সংগঠিত, অসংগঠিত কর্ম সংস্থানে আকাশ-পাতাল বৈষম্য। এর কারণ গোড়ায় গলদ! ব্যক্তিসত্তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ভুলে বড় হতে গিয়ে প্রকারান্তরে নিজেদের অস্তিত্বকে ম্যালিগন্যাণ্ট স্তরে বিপন্ন করে চলেছি। এর অবসান প্রয়োজন। এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। * * *
আর্য্যকৃষ্টির বর্ণাশ্রমধর্ম্মের বিধি-বিন্যাস অনুযায়ী যোগ্যতাসম্পন্ন ব্রাহ্মণেরা আচার্য্যপদে, উপাচার্য্যপদে অধিষ্ঠিত হয়ে অধ্যাপনা করতেন, শিক্ষাদানের মাধ্যমে ছাত্রদের সন্তোষ বিধান করতে পারলেই গ্রহণ করতেন শ্রদ্ধার্ঘ্যের দক্ষিণা। হাতীবাগান, হাওড়া, ভাটপাড়া, বারানসী, রাজস্থান এবং কাশ্মীরের কিছু কিছু পণ্ডিতেরা বর্তমানেও টোল বা গুরুকুল মাধ্যমে ওই প্রথা জীইয়ে রেখেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রবন্ধ এবং কালজয়ী ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শতাব্দীর মৃত্যু’ উপন্যাস ভারতীয় শিক্ষার অপমৃত্যুর এক জীবন্ত দলিল স্বরূপ।
আর্য্যকৃষ্টির ভারতবর্ষে, শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণ দুইই ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধার উপরে প্রতিষ্ঠিত। “প্রণিপাতেন, পরিপ্রশ্নেন, সেবয়া”, –-আচার্য্য বা শিক্ষকের প্রতি প্রকৃষ্টরূপে আনতি প্রকাশ দ্বারা প্রশ্নের মাধ্যমে, সেবার মাধ্যমে অজানাকে জেনে নিজেকে সমৃদ্ধ করতেন। জানার তত্ত্ব এবং তথ্য ছিল, “অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যুর্মামৃতম্ গময়” – অসৎ হতে সৎ-এ অবস্থান করে, অন্ধকার থেকে আলোর লক্ষ্যে এগিয়ে, মৃত্যুময় জগতের মধ্যে থেকেও যেন অমৃত আহরণ করতে পারি। এই গন্তব্যের লক্ষ্যে পরিচালিত। ওই গন্তব্যে পৌঁছতে “আত্মবৎ সর্বভূতেষু, মাতৃবৎ পরদারেষু, লোষ্ট্রবৎ পরদ্রব্যেষু”––সকল প্রাণীকে নিজের মত করে ভালবাসব, সকল মেয়েদের নিজের মায়ের মত সম্মান করব, অন্যের জিনিসকে রাস্তায় পরিত্যক্ত ঢিলের মত মনে করব। “মা গৃধ”—লোভ সম্বরন করব।—ইত্যাদি ছিল ভারতীয় শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ‘মেরা ভারত মহান’ শ্লোগানে সমৃদ্ধ আধিকারিকেরা ‘সত্যমেব জয়তে’-র সীলমোহর দিয়ে ওই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাকে নষ্ট করে শিক্ষকদের মাস মাইনের চাকর করার ফলে শিক্ষা আজ ব্যবসায়ে পরিণত। শিক্ষাঙ্গনে ‘আমরা ওরা’ বিভেদের শিক্ষার সাথে পরিপোষিত হচ্ছে অসদাচার, ভ্রষ্টাচার, দুর্নীতি, হিংসার শিক্ষা! এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
*** প্রাচীন ভারতের আদর্শ রাজন্যবর্গ প্রজাগণকে বংশানুক্রমিক কৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে, কর্মানুগত শাসনে রেখে কর্মচ্যুত বা বেকারদের স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যানুপাতিক কর্মে নিযুক্ত করতেন। যাতে বর্ণাশ্রম ধর্ম বিনষ্ট হয়ে প্রজাগণ সঙ্করদোষে দুষ্ট না হয়। প্রজা সঙ্করদোষে দুষ্ট হলে সমাজে ভীষণাকৃতি, বামন, কুব্জ, স্থূল মস্তিষ্ক সম্পন্ন, ক্লীব, অন্ধ, বধির, অপরাধপ্রবণ মানুষের সৃষ্টি হয়। (দ্রঃ বিষ্ণুপুরাণ) ওই শিক্ষার ধারা লুপ্ত করার ফলে সমাজের পারস্পরিক সংহতি, শান্তি, সমৃদ্ধি লোপ পেতে শুরু করেছে।
বর্তমানে জীবিকা এবং পেশাগত শ্রেণী বিন্যাসের অন্তর্ভূক্ত বৃহদায়তন, মাঝারি, ক্ষুদ্র শিল্পপতি, বাণিজ্যজীবী, পাইকারী, খুচরা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ফেরিওয়ালা, আমলা, ডাক্তার, নার্স, আয়া, বিউটিশিয়ান, উকিল, ইঞ্জিনীয়ার, শিক্ষক, করনিক, এজেণ্ট, পাইলট, ড্রাইভার, মেকানিক, অপারেটরর্স, বাইণ্ডার, প্রিন্টার, কম্পোজিটর, ওয়েল্ডার, টার্নার, ফিটার, উইভার, ইলেকট্রিশিয়ান, ইলেক্ট্রনিকস্ ওয়ার্কার, কম্প্যুটার ওয়ার্কার, কার্পেন্টার, কন্ট্রাকটর, প্রমোটার, নির্মাণকর্মী, শ্রমজীবী ইত্যাদি আরো আরো অনেক বৃত্তিতে, কর্মে নিযুক্তরা বেশীরভাগই বর্ণাশ্রম অনুসারী বৃত্তিতে রত নয়। ফলে এক অসম অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থা রাষ্টে বিদ্যমান। কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত জন্মগত সংস্কার (instinct)কে উপযুক্ত মর্যাদা না দেবার জন্য সার্বিকভাবে কর্মসংস্কৃতিতে বিপর্য্যয় নেমে এসেছে। সমান কর্মে সমান মজুরী, সমান সম্মান না পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট জনেদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্ন হচ্ছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন, (আমাদের) বর্ণাশ্রমের মধ্যে un-employment (বেকার সমস্যা) বলে জিনিস ছিল না, তা’তে বৃত্তিহরণ ছিল মহাপাপ, প্রত্যেকে স্ব-স্ব বর্ণোচিত কর্ম করতো, প্রত্যেকে প্রত্যেকের সহযোগী ও পরিপূরণী হ’তো। (আঃ প্রঃ ১ম খণ্ড, পৃঃ ৭৯)
আমার মনে হয়, বর্ণাশ্রমটা যদি ঠিকভাবে জাগিয়ে তোলা যায়, তবে অনেক কিছু গোল চুকে যায়। (আঃ প্রঃ ১ম খণ্ড, পৃঃ ৭৯)
এ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন, “ভারতবর্ষের বর্ণাশ্রম ধর্ম মানবজাতিকে ঈশ্বরের দেওয়া শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলোর অন্যতম। …..এই বর্ণাশ্রম ধর্ম ভারতে আশ্চর্যকীর্তি স্থাপন করেছে এবং ভবিষ্যতেও ভারতবাসীকে পরম লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করবে।”
(নবপত্র প্রকাশনীর বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র পৃঃ ৬৭৯ থেকে সংগৃহীত।)
বর্ণাশ্রমকে মেনে চলার জন্য একটা সময়ে ভারতবর্ষের প্রতিটি গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। উপার্জনের জন্য পরিযায়ী হতে হতো না।
।। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রদত্ত বর্ণাশ্রমের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা ।।
শরৎদা জিজ্ঞাসা করলেন—‘চাতুর্ব্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকৰ্ম্মাবিভাগশঃ’–এর মানে কী। এটা কি গোড়া থেকে আছে ? শ্রীশ্রীঠাকুর—হ্যাঁ, ভিতরে যেমন instinct (সহজাত সংস্কার বা গুণ) থাকে, কৰ্ম্মও তদনুযায়ী হয়। দুনিয়ার দুটো জিনিস ঠিক অবিকল বা একরকম দেখতে পাবেন না। প্রত্যেকটি যা-কিছুর একটা বিশিষ্টতা আছে— তা যেমন রূপে তেমন গুণে। একই বাপ-মায়ের পাঁচটি সন্তান পাঁচরকম হয়। কারণ, উপগতির সময় নারী, পুরুষকে যখন যেমন প্রেরণা দেয়, পুরুষের ভিতরকার তেমনতর জিনিসই তখন বেরোয়। স্ব-অয়ন-স্যূত বৃত্ত্যাভিধ্যান তপস্যায় গতি ও অস্তি অধিজাত হয়েছে। সেখানে স্ব হচ্ছে যেন পুরুষ, sperm. (বীজ), বৃত্তি যেন প্রকৃতি ovum (ডিম্বকোষ), আর অভিধ্যান হলো cohesive affinity. (যোগাবেগ)। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রেরণায় একই পুরুষের ভিতর থেকে বিভিন্ন গুণের সৃষ্টি হ’লো। যত রকমের গুণই থাক না কেন, তার Grand division (প্রধান বিভাগ) ঐ চার বর্ণের মধ্যেই রয়েছে। শুধু মানুষের জন্যই নয়, জীব-জগতের সব স্তরেই চাতুর্ব্বর্ণ রয়েছে, সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই বর্ণ ঢুকে গেছে। প্রথম থেকেই তা instinct হিসাবে থাকে। Environment (পারিপার্শ্বিক) এর মধ্যে তা প্রকাশিত হয়। Generation after generation (বংশ পরম্পরায়) সেই ধারা চলে।
শরতদা— বর্ণ যদি প্রধানতঃ গুণগত ব্যাপার, তাহলে hereditary varna (বংশানুক্রমিক বর্ণ) মানবার প্রয়োজন কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর—তাহলে তো বেশ বুঝেছেন দেখছি! গুণটা আসছে কোত্থেকে? সেও তো ঐ জন্মসূত্র থেকে। আপনার জৈবী বিধানকে বাদ দিয়ে আপনার কোন গুণ বা কৰ্ম্মক্ষমতা নেই। হাওয়ার উপর কিছু দাঁড়ায় না। গুণ ও কৰ্ম্মক্ষমতা শরীর, স্নায়ু, কোষ chromosome, gene ইত্যাদিকে আশ্রয় করেই অবস্থান করে। সেগুলি বংশানুক্রমিকতার সূত্র বেয়েই তো নেমে আসে, যাকে বলে immortal neckless of germ-cell (বীজ কোষের অবিনশ্বর মালা।)
শরৎদা—বর্ণধৰ্ম্ম ঠিক ভাবে পালন করতে গেলে তো মানুষ বর্ণোচিত কৰ্ম্ম ছাড়া অন্য কাজ করতে পারবে না। কিন্তু কোন মানুষের অন্য বর্ণের কৰ্ম্মে যদি বিশেষ প্রতিভা থাকে এবং তা যদি সে না করতে পারে, তাহলে তো সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর—মানুষ জীবিকার বর্ণোচিত কৰ্ম্ম ছাড়া করতে পারবে না—এক আপদ্ধর্ম ছাড়া। তাছাড়া কোন কৰ্ম্মানুশীলনে মানুষের কোন বাধা নেই। বর্ণাতীত কৰ্ম্মে যার বিশেষ প্রতিভা থাকে, বর্ণোচিত কর্মেও সে অপটু হয় না। সেই কৰ্ম্ম দিয়ে জীবিকা আহরণ করে বাদবাকী সময় সে তার প্রতিভার স্ফূরণ এবং তদনুযায়ী লোক সেবায় ব্যয় করতে পারে। তার বিনিময় সে কিছু চাইবে না, কিন্তু তার সেবায় প্রীত হয়ে স্বতঃস্বেচ্ছ আগ্রহে প্রীতি অবদান স্বরূপ কেউ যদি তাকে কিছু দেয়, তা গ্রহণ করতে তার কোন বাধা নেই। কিংবা রাষ্ট্রের তরফ থেকেও যদি তাকে কোন পুরস্কার দেয় তাও সে গ্রহণ করতে পারে। প্রত্যেকে যদি বর্ণোচিত কর্মনিরত থাকে, কেউ কারও বৃত্তিহরণ না করে তাহলে বেকার সমস্যা জিনিসটাই আসতে পারে না। অযথা প্রতিযোগিতা জিনিসটাও বন্ধ হয়ে যায়। পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। বংশপরম্পরায় একই কৰ্ম্ম করার ফলে প্রত্যেকের দক্ষতা ও যোগ্যতাও বেড়ে যায়। প্রত্যেকে স্ব স্ব কৰ্ম্ম করায় সর্ব্বতোমুখী সুষম উৎপাদন ও সেবা পরিবেষণের একটা স্বাভাবিক ব্যবস্থা স্বতঃই গজিয়ে ওঠে। কোন বর্ণের বিশিষ্ট সেবার অভাবে, তারা এবং অন্যান্য বর্ণ অপুষ্ট থাকে না। সামাজিক শৃঙ্খলা অব্যাহতভাবেই এগিয়ে চলে। তাই আমাদের বাপ, বড়বাপ, ঋষি, মহাপুরুষরা যে বিধান করে গেছেন, তা একটু তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করবেন। অদূরদর্শিতা ও হীনত্ববুদ্ধি থেকে দুনিয়ার অনেক আন্দোলনই হয়েছে, কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান কিছু হয় নি, সব ব্যাপার মানুষের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং বার বার বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য্য হয়ে উঠছে। এর আছে সুসঙ্গত ব্যক্তিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানকে আশ্রয় করার মধ্যে। এই বিজ্ঞানের নামই বর্ণাশ্রম,এবং আমাদের ঋষি-মহাপুরুষরাই এই প্রাকৃতিক বেদবিজ্ঞানের দ্রষ্টা, আবিষ্কর্তা ও প্রতিষ্ঠাতা। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড / ১৭৩-১৭৪ পৃঃ)
শ্রীশ্রীঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে বললেন—যে যে-কোন ধৰ্ম্মাবলম্বীই হোক না কেন, তার বংশে যদি প্রতিলোম সংমিশ্রণ না হয়ে থাকে, তবে তার বংশানুক্রমিক জীবিকা, অভ্যাস, আচার, ব্যবহার অনুপাতিক তার বর্ণ নিরূপণ করে বর্ণাশ্রমের বিধি অনুযায়ী তাকে পরিচালিত করা যেতে পারে। বর্ণাশ্রম একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাপার; এটা সার্ব্বজনীন। সহজাত সংস্কার বিন্যাস এবং বৈধী বিবাহের ভিতর দিয়ে বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে ধারাবাহিকতায় অক্ষুণ্ণ রেখে বংশপরম্পরায় প্রগতিপন্ন করে তোলাই হচ্ছে এর মূল কথা। পৃথিবীর প্রত্যেকটি সমাজকে যদি এমন বিধিবদ্ধভাবে সাজিয়ে তোলা যায়—তাদের বৈশিষ্ট্যের আপূরণী করে, তবে বিহিত অনুলোমক্রমে পারস্পরিক পরিণয় নিবদ্ধও সৃষ্টি করা যেতে পারে। পূরয়মান এক আদর্শ ও অনুলোম বিবাহ যেমন একটা জাতকে একগাট্টা করে তোলে, তেমনি করে তা সমগ্র বিশ্বকেও সংহত ও ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে পারে—পারস্পরিক বৈশিষ্ট্যানুগ সংহতি নিয়ে। পরমপিতার দয়ায় বিশ্বশান্তির এই যা এৎফাক বের হয়েছে, এ একেবারে চরম এৎফাক, এখন তোরা মাথায় নিয়ে করলেই হয়। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড, পৃঃ ৮৯-৯০) আমাদের বুঝটাকে পাকা করে দিতে একই বিষয় তিনি নানাভাবে উপস্থাপনা করে গেছেন যাতে আমরা ‘না বোঝার’ অজুহাত না দিতে পারি। তাই তিনি অনুশ্রুতি-র ছড়াবাণীতে
বিষয়টাকে আরো একটু প্রাঞ্জল করে তুলে ধরলেনঃ বর্ণাশ্রমী নয়কো যা’রা আৰ্য্যকৃষ্টি মেনে চলে কিম্বা আৰ্য্যকৃত হ’য়ে বর্ণাশ্রম প্রার্থী হ’লে গুণ বঞ্চনা-সক্রিয়তায় বংশক্রমে ব্যক্তিগত অনুক্রমে যথাবর্ণে করবি তা’রে সুসংহত।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র উপরোক্ত বাণীর মাধ্যমে বাহ্য জাতিভেদ প্রথার মূলোৎপাটন করে মানুষকে ভারতীয় বর্ণাশ্রমানুগ বিধানে স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত করলেন। মানুষের জাত বা সহজাত সংস্কার এবং তাদের জৈবিক তাগিদগুলো প্রবৃত্তির কবলে পড়ে মনুষ্যত্বের অপলাপী কর্মে লিপ্ত যাতে না হতে পারে, বিধিবৎ নীতি প্রণয়ণ করে বিহিত ব্যবস্থায় মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষা করা, রাজনীতির নির্দিষ্ট কর্ম।—সে বিষয়ে উদাসীন রাজনৈতিক জন প্রতিনিধিগণ! এ জন্যই আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
শান্তি-মৈত্রী-ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথ-নির্দেশ
নৃতাত্ত্বিক গঠনের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী মানুষকে আল্পাইন, ব্রাকিসেফাল, মেডিটেরিয়ান, মঙ্গোলয়েড, নর্ডিক, নিগ্রোয়েড প্রভৃতি নামে শ্রেণী বিভাজন করা হয়েছে। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সহজাত সংস্কার গুণ ও কর্মভিত্তিক বর্ণাশ্রম বিভাজনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন আর্য্য ঋষিরা। শাস্ত্রে গুণ এবং কর্ম দেখে বর্ণ নিরূপণ করার বিধান রয়েছে। সত্ত্ব গুণে বিপ্র, সত্ত্ব মিশ্রিত রজোগুণে ক্ষত্রিয়, রজোমিশ্রিত তমোগুণে বৈশ্য এবং তমোগুণাধিকারে শূদ্র চিহ্নিত করা হয়েছিল। এবং তদনুযায়ী কর্ম নির্ধারিত হয়েছিল। প্রাকৃতিক নিয়মে সকলেই স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান অধিকার করে আছে।
এ বিষয়ে একটা সুন্দর ছড়া আছে।
“শূদ্রই তো জাতির চাকা
বৈশ্য জোগায় দেশের টাকা,
ক্ষত্রিয়েরা রাজার জাত
সবার পূরণ বিপ্র ধাত।
বিপ্র যদি জাগত আবার
বিজয়গুরু মত্ততায়,
দেশটা কি আর চ’লত উধাও
সর্ব্বনাশা ব্যর্থতায় ?
ক্ষত্র যারা কায়েত হয়ে
চলছে বেভুল ঝিমিয়ে মাথা,
তা’রা যদি উঠত জেগে
চ’লত করা অসৎ যা তা’?
বৈশ্য বণিক বিশাল আয়ে
বিভব দেশে দিত যদি,
অভাব কি আর ঢুকত দেশে
হা-হুতাশে নিরবধি?
শুদ্র যদি শুচির গানে
সেবামুখর ধৃতিচর্য্যায়—
চ’লত, তবে রুখত কে তা’র
কৃতিমুখর কৃষ্টিসেবায়?
জাতিগত বৰ্ণই হ’ল
সংস্কারের গুণধারা
দুর্বল সবল যাই হোক্ না
সেই চলনে চলে তারা।
বিপ্র-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রের
বর্ণগত বিশেষ আচার
রুদ্ধ ক’রে ভাঙ্গেই যে-জন
ব্যতিক্রমী সত্তা তার।”
মানুষের বোধে উপরোক্ত সহজ-সাধারণ, অথচ প্রয়োগ ক্ষেত্রে অসাধারণ বিষয়গুলো প্রবেশ করাবার জন্য আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
* * *
জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, সমাজতত্ত্ববিদ্, মনস্তত্ত্ববিদ প্রমুখ পণ্ডিত ব্যক্তিদের বোঝাবার জন্য আরও বিস্তারিত ভাবে বললেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
” …… আর্য্য জাতির uphill motion-এর (উর্ধগামী গতির) acceleration (ত্বরান্বিত করা)-ই হ’চ্ছে front-(সম্মুখে) ব্রাহ্মণ আর back-এ (পিছনে) শূদ্র। চাতুর্বর্ণ্য বিভাগ কতকটা আমাদের body system-এর (শরীর বিধানের) মতন। শূদ্র হ’চ্ছে এই whole system-এর (সমুদয় বিধানের) carrier (বাহক) এবং supporter (সহায়ক), যা’র উপর ভর দিয়ে এই সমাজদেহ চলছে। বৈশ্যদের function (কর্তব্য) হ’ল সমাজদেহকে সুস্থ রাখা by the supply of proper nutrition and food (যথোপযুক্ত পুষ্টি এবং খাদ্য সরবরাহ দ্বারা)। বৈশ্যশক্তি এই function discharge (কর্তব্য সম্পাদন) করতে যেদিন পরাঙ্মুখ হ’ল, সেদিন এই সমাজদেহ ভেঙ্গে পড়লো। Stomach (পাকস্থলী) যদি boycott (অসহযোগ) করে, আমাদের body-system-এর (শরীর বিধানের) যে অবস্থা হয় তাই হ’ল। এই বৈশ্যশক্তি যদি আবার জাগে এবং legs, heart ও brain-কে (পা, হৃৎপিন্ড ও মস্তিষ্ককে) proper nutrition supply করে (উপযুক্ত পুষ্টি যোগায়), তবে আবার সমাজদেহ জেগে উঠবে। Body system-এর মধ্যে heart (হৃৎপিন্ড) যেমন, সমাজদেহের মধ্যে ক্ষত্রিয় তেমন। Heart-এর মধ্যে দু’রকম cells (কোষ) আছেঃ (১) white cells (সাদা কোষ) (২) Red cells (লাল কোষ)। Red cells-এর (লাল কোষের) কাজ হ’চ্ছে body-কে fit (কার্যক্ষম) রাখা এবং maintain (পরিপোষণ) করা by the proper distribution of red blood (লাল রক্ত উপযুক্ত ভাবে বিতরণ দ্বারা); এবং white cells-এর (সাদা কোষের) কাজ হ’চ্ছে body-কে protect (রক্ষা) করা। ক্ষত্রিয়ত্বের মধ্যে এই দু’টি function (কার্য) আছে; একটি সমাজদেহকে fit (কার্যক্ষম) রাখা ও maintain (প্রতিপালন) করা, আর একটি disease-এর (রোগের) হাত থেকে protect (রক্ষা) করা। কিন্তু এই দুই blood-এর supply (যোগান) নির্ভর করছে stomach-এর (পাকস্থলীর) উপর। সমাজদেহের brain (মস্তিষ্ক) হ’চ্ছেন ব্রাহ্মণ (বিপ্র), যাঁদের working (কার্যতা) নির্ভর করছে ক্ষত্রিয়শক্তি বৈশ্যশক্তি এবং শূদ্রশক্তির উপর। তাঁরা যেমন-তেমন এই তিন শক্তির নিকট support and help (সাহায্য ও সহানুভূতি) পা’চ্ছেন, তেমন-তেমন এই তিনকে regulate, control (নিয়মিত ও আয়ত্ত) করতে পারছেন। এই চারিশক্তির মধ্যে কেহই ছোট-বড় নয়। একটা harmony (সমন্বয়) ও co-ordination-এর (সমবায়ের) যোগে এদের মধ্যে একযোগে একতানে কাজ হ’চ্ছে। কিন্তু body এর মধ্যে brain-এর স্থান যেমন সর্বোচ্চ এবং সর্ব উচ্চে থাকাটা legs, stomach ও heart-এর existence-এর পক্ষে নিতান্ত দরকার, তেমন ব্রাহ্মণকে উচ্চ place দেওয়াতে, যে উচ্চতা তাঁ’র মধ্যে inherent (স্বাভাবিক) হ’য়ে আছে, অন্যান্য বর্ণ চলতে পারছে ঠিকমত তাঁরই guidance-এ (নির্দেশে)। Head-কে বড় স্বীকার করা যেমন body-র অন্যান্য অঙ্গের পক্ষে লজ্জার নয়, বরং পরম গৌরবের, তেমনি অন্যান্য বর্ণের পক্ষে ব্রাহ্মণকে বড় ব’লে মানা তাঁদের বাঁচা-বাড়ার পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। Superior (শ্রেয়)-এর উপর শ্রদ্ধা রে’খে যদি তুমি সমাজকে পুনর্গঠন করতে লেগে যাও,তবে সে সমাজ টিঁকবে-তার growth (বৃদ্ধি) হবে healthy.” (ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃঃ-৬৮-৬৯)
উপরোক্ত বাণী থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, বর্ণাশ্রমের বিন্যস্ত বিভাজন আমাদের শরীর বিধানেও বিদ্যমান। বর্ণাশ্রমানুগ বিধান অনুযায়ী শূদ্র বর্ণ শ্রমশিল্প, কারিগরি বিদ্যার সেবার মাধ্যমে সব বর্ণকে সাহায্য করবেন। শরীর বিধানে আমাদের পদযুগল দেহটাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায় তাই পদযুগলকে শূদ্র বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বৈশ্যরা কৃষি ও বাণিজ্যের সেবা দ্বারা সকলের উদরপূর্তি করছেন। সেই উদরকে বয়ে বেড়াচ্ছে জানু বা জঙ্ঘা। তাই জঙ্ঘা বৈশ্যত্বের প্রতীক। ক্ষত্রিয়রা বাহুবল দ্বারা অসৎ নিরোধ করে সমাজকে রক্ষা করেন। শরীর বিধানে বাহু আমাদের দেহটাকে বিপদ-আপদ থেকে আগলায়, ক্ষত থেকে ত্রাণ করে, তাই বাহুকে ক্ষত্রিয় বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বিপ্র বর্ণ বোধ ও বোধির পরামর্শ দিয়ে সকল বর্ণকে বর্ণধর্ম পালন করার শিক্ষা দেয়, বর্ণানুগ কর্মে উৎসাহিত করে বিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের মস্তিষ্ক বিবেক, বিচার-বুদ্ধি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমগ্র দেহটাকে পরিচালনা করে, তাই মাথাকে বিপ্র বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এইভাবে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিন্যস্ত মেলবন্ধনে দেহটাকে সুস্থভাবে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। ছোটবড়ো কেউ নয়। যে যার বৈশিষ্ট্যে শ্রেষ্ঠ। ওই শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়মকে অগ্রাহ্য করে কেউ যদি মাথার কাজ পা-কে দিয়ে, পায়ের কাজ মাথাকে দিয়ে করাতে যায় তাহলে দেহটাই রক্ষা করা যাবে না। তেমনি বিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থা রক্ষার স্বার্থে আর্য্য ঋষিরা প্রতিটি বর্ণের জন্য নির্দিষ্ট কর্ম ও আইডেনটিটি বা স্মারক চিহ্নের বিধান দিয়েছেন। শ্বেত বর্ণে বিপ্র, লোহিত বর্ণে ক্ষত্রিয়, হরিদ্রা বর্ণে বৈশ্য এবং সবুজ বর্ণে শূদ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই জীবনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ করার করার বিধির নাম ধর্ম। ধর্মকে রক্ষা করার জন্য রাজনীতি। শ্রীমদ্ভগবদগীতা যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বর্ণাশ্রম বিধায়িত বিন্যস্ত সমাজের ওই চারটি বর্ণের চিহ্ন সাদা, লাল, হলুদ ও সবুজ। বর্তমান পুরুষোত্তম যাকে আর্য্যকৃষ্টির স্মারক পতাকা তথা জাতীয় পতাকা হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন।—সেই পতাকার অনুসরণে আর্য্য মহাসভার দলীয় পতাকা নির্বাচন করা বাঞ্ছনীয়।
পতাকা সম্বন্ধে পরম দয়াল বললেন–- “আমার মনে হয়, আমাদের জাতীয় পতাকা তিনরঙা না হ’য়ে, চাররঙা হওয়া উচিত। চতুর্ব্বর্ণের চারটি রঙ। তার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের একখানা হাত দেওয়া থাকবে। হাতে থাকবে সুদর্শন।
দেবীদা প্রশ্ন করলেন—প্রত্যেক বর্ণের রঙ তো আলাদা হবে?
ঠাকুর—নিশ্চয়ই। উপরে সাদা, তার নীচে লাল, তার নীচে হলুদ এবং সবুজ। এই রকম থাকবে। (দীপরক্ষী ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১৯)
।। ‘আর্য্য’ শব্দের বিশেষত্ব ।।
‘আর্য্য’ শব্দটি মূলতঃ গুণবাচক। যাঁরা বর্ণাশ্রম, চতুরাশ্রম পরিপূরণী দশবিধ সংস্কারে সংস্কৃত হতেন তাঁদেরই আর্য্য অভিধায় ভূষিত করা হতো। তাঁরাই ক্রমে আর্য্য জাতিভুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমান যুগধর্মে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যেমন সম্বোধনে ‘স্যর’, ‘ম্যাডাম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেসময় সদাচারী বর্ণাশ্রমানুগজীবন যাপন কারীদের উদ্দেশ্যে ‘আর্য্য’, ‘আর্য্যপুত্র’, ‘আর্য্যা’ ইত্যাদি সম্বোধনসূচক শব্দ ব্যবহৃত হতো। এই ব্যবস্থা সকলের জন্য, এখানে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। এ বিষয়ে বর্তমান পুরুষোত্তম এক যুগান্তকারী বিধান দিলেন।
মঙ্গোলীয় নিগ্রো যারা
দ্রাবিড়ী কোল ম্লেচ্ছাবধি
আর্য্যীকৃত হলেই তারা
আর্য্যদেরই সুসন্ততি।
যুগ পুরুষোত্তমের আদর্শকে স্বীকার করলেই আর্য্যীকৃত হওয়া যায়। এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন, “পঞ্চবর্হিঃ যা’রা স্বীকার করে, আর সপ্তার্চ্চি অনুসরণ করে, তারা যেই হোক আর যা’ই হোক– আর্য্য বা আর্য্যীকৃত । ৬০১ । (শাশ্বতী অখণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৭)
এবার পঞ্চবর্হিঃ এবং সপ্তার্চ্চিঃ-র অনুশাসন বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক।
।। পঞ্চবর্হিঃ ।।
১। একমেবাদ্বিতীয়ং শরণম্।
২। পূর্ব্বেষামাপূরয়িতারঃ প্রবুদ্ধা ঋষয় শরণম্।
৩। তদ্বর্ত্মানুবর্ত্তিনঃ পিতরঃ শরণম্।
৪। সত্তানুগুণা বর্ণাশ্রমাঃ শরণম্।
৫। পূর্ব্বাপূরকো বর্ত্তমানঃ পুরুষোত্তমঃ শরণম্ ।
এতদেবার্য্যায়ণম্, এষ এব সদ্ধর্ম্মঃ,
এতদেব শাশ্বতং শরণ্যম্।’’
১। এক অদ্বিতীয়ের শরণ লইতেছি।
২। পূর্ব্বপূরণকারী প্রবুদ্ধ ঋষিগণের শরণ লইতেছি।
৩। তাঁহাদের পথ অনুসরণকারী পিতৃপুরুষগণের শরণ লইতেছি।
ইহাই আর্য্যপথ, ইহাই সদ্ধর্ম্ম, আর ইহাই চিরন্তন শরণযোগ্য।
“আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেল সেইদিন যেদিন থেকে আমরা পঞ্চবর্হির মূল নির্দ্দেশ অবজ্ঞা করতে শুরু করলাম। তখন থেকে আমরা অপরের খোরাক হলাম কিন্তু নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখে পরকে আপন ক’রে নেবার সামর্থ্য হারিয়ে ফেললাম।”
পঞ্চবর্হিঃ এবং সপ্তার্চ্চিঃ-র অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করে দেশ ও জাতির মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর সম্বিতী গ্রন্থে বলছেন—
মতবাদ যাই হোক না,—
আর, যে-কোন সম্প্রদায়ই হোক,
যা’ মুখ্যতঃ ‘পঞ্চবর্হিঃ’ ও ‘সপ্তার্চ্চিঃ’কে
স্বীকার করেনিকো—
কোন-না-কোন রকমে,—
তা’ কখনও অনুসরণ করতে যেও না,
তা’ কিন্তু জঘন্য—অসম্পূর্ণ,
সত্তা-সম্বর্দ্ধনার পরিপন্থী তা’;
আর, ঐ ‘পঞ্চবর্হিঃ’ ও ‘সপ্তার্চ্চিঃ’ই হ’চ্ছে
সেই রাজপথ—
যা’কে স্বীকার ও গ্রহণ করে চললে
ক্রমশঃই তুমি সার্থকতায় সমুন্নত হ’তে পার। ২৩৪
এই বাণী বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকে মনুষ্যত্বে উত্তরণের পথ দেখিয়েছে। এখন মানা, না-মানা যার যার নিজস্ব ব্যাপার! আর্য্য মহাসভা রাজনৈতিক দল সকলের কাছে এই সত্য পৌঁছে দেবার জন্য দায়বদ্ধ।
‘‘হিন্দু মুসলমানের নামে নাক সিটকায়, মুসলমান হিন্দুদের নামে নাক সিটকায়—তার মানে তারা ভগবানকে, ধর্মকে, প্রেরিতকে ভালবাসে না। আর্য্যরা মানে এক অদ্বিতীয়কে, পূর্বতন ঋষি মহাপুরুষদিগকে, তারা মানে পূর্বপুরুষকে ও জন্মগত বিশিষ্ট গুণসম্পদকে। অর্থাৎ বর্ণধর্মকে, সর্ব্বোপরি তারা মানে বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মান যুগপুরুষোত্তমকে। এগুলি মালার মত গাঁথা আছে। যাদের দেখার চোখ আছে ও দেখতে চায়, তারাই দেখতে পায়। বেদ, কোরান, বাইবেল ঘেঁটে দেখ, সব জায়গায় ঐ একই জিনিস রকমারি ভাবে পাবে। অন্ততঃ ওগুলির উল্টো কথা পাবে না। কোরাণে স্পষ্ট করে আছে পিতৃপুরুষকে স্বীকার করার কথা। আমি ইসলামের ভক্ত হলে আমার নাম গোলাম সোফান হবে কেন? অনুকূল চক্রবর্তীই তো থাকা উচিত। কারণ, খোদাতায়ালা যেমন সকলের, রসুল যেমন সকলের, ইসলামও তেমনি সকলের। মুসলমানের মধ্যেও বংশগত আভিজাত্য ও বৈশিষ্ট্যকে শ্রদ্ধা দিয়ে চলার কথা আছে। ওর ভিতর দিয়েই তো বর্ণধর্মের মূল তাৎপর্য্য-সম্বন্ধে সমর্থন পাওয়া যায়। আজ আমরা বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করতে চাই কেন ? রসূলের কি তেমন কোন কথা আছে ? আর নিজেদের বৈশিষ্ট্যকে যদি বজায় রাখতে চাই, তবে অপরের বৈশিষ্ট্য যাতে বজায় থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা লাগে। অপরের বৈশিষ্ট্য ভাঙ্গার প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিলে, কালে-কালে নিজের বৈশিষ্ট্য ভাঙ্গার পথই প্রশস্ত হয়।
আমি বলি, আমি যদি হযরতকে ভালবাসি এবং তাঁর নীতিবিধি মেনে চলি, তবে আমি হিন্দু থাকব না কেন ? পরমপিতার পথে চলতে গিয়ে পিতৃপরিচয় খোয়াতে হবে কেন ? আমি তো বুঝি হিন্দুও আর্য্য, মুসলমানও আর্য্য। উভয়ের পন্থা ও গন্তব্য এক। হযরত পূর্ববর্তীকে মানেন, পরবর্তীকে মানার ইঙ্গিতও তিনি দিয়ে গেছেন, তিনি যা মানেন আমরা যদি তা না মানি, তার মানে আমরা তাঁকে মানি না। মুসলমান পীরের কাছ থেকে দীক্ষা নেয়া লাগে, হিন্দুরও গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়া লাগে, সে একই কথা। শুধু ভাষা আলাদা। কতকগুলি নীতি আছে, দেশকাল, পাত্র, নির্ব্বিশেষে সর্ব্বত্র সর্বদা সবার পালনীয়, আবার কতকগুলি আছে বিশেষ-বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ-বিশেষ অবস্থায় ও দেশকালে পালনীয়। এই দুটোর মধ্যে গুলিয়ে ফেলতে নেই। Fundamental (মৌলিক) ও universal (সার্ব্বজনীন) জিনিস হল—এক অদ্বিতীয়কে মানা, পূর্বতন ঋষি-মহাপুরুষকে মানা, পিতৃপুরুষকে মানা, বৈশিষ্ট্য মানা, পূরয়মান যুগপুরুষোত্তমকে অনুসরণ করে চলা। তুমি হিন্দুই হও বা মুসলমানই হও, এগুলি যদি না মান, তুমি হিন্দুও নও, মুসলমানও নও, এককথায় তুমি ম্লেচ্ছদলভুক্ত, ম্লেচ্ছ মানে যারা সংস্কৃতির উল্টো চলে। আর যে এগুলিকে মেনে চলে সে যে সম্প্রদায়ের লোক হোক না কেন, তাকে তুমি কখনও কাফের বলতে পার না। কাফের মানে যে ধর্মবিরোধী চলায় চলে। সাম্প্রদায়িক বিরোধের প্রশ্রয় না দিয়ে, ধর্মবিরুদ্ধ চলনের বিরুদ্ধে আমাদের জেহাদ ঘোষণা করা লাগে। তাই করা লাগে যাতে প্রতি প্রত্যেকে ঈশ্বরপ্রেমী হয়ে ওঠে, ধর্মপ্রবুদ্ধ হয়ে ওঠে। এ দায় হিন্দু-মুসলমান সকলেরই মিলিত দায়। তাই, এই কাজে হিন্দুর মুসলমানকে সাহায্য করা উচিত, মুসলমানেরও হিন্দুর সাহায্য করা উচিত। আমি বুঝি, সৎসঙ্গ যেমন হিন্দুর, তেমনি মুসলমানের, তেমনি বৌদ্ধের, তেমনি খ্রিষ্টানের, তেমনি অন্যান্য সকলের। সব মানুষই পরমপিতার, তা তারা জানুক বা না-জানুক, মানুক বা না-মানুক।
(আঃ প্রঃ একাদশ খন্ড, ইং ১৭-০৩-১৯৪৮)
আমি বুঝিনা–কোন হিন্দু শুচিশুদ্ধভাবে মসজিদে যেয়ে প্রার্থনা করতে পারবে না কেন, আবার একজন সদাচারী মুসলমান হিন্দুর প্রার্থনা-মন্দিরে বসে প্রার্থনা করতে পারবে না কেন ! ভগবান মানুষকে তার language (ভাষা) দিয়ে চেনেন না, তিনি চেনেন তাকে তার feeling (বোধ) ও activity (কর্ম্ম) দিয়ে। (আঃ প্রঃ ৯ম খণ্ড)
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন—হজরত যীশু, হজরত মহম্মদ আমাদেরও prophet (প্রেরিতপুরুষ)। আর্য্যধারা যদি জীবন্ত থাকত, তা’হলে হজরত যীশু, হজরত মহম্মদ হয়তো একাদশ অবতার, দ্বাদশ অবতার ব’লে পরিগণিত হ’তেন। Anti-Biblism (বাইবেল-বিরোধী), Anti-Quranism (কোরাণ-বিরোধী), Anti-Vedism (বেদ-বিরোধী)-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তার নিরাকরণ করতে হবে। শাক্ত বিপ্র এবং বৈষ্ণব বিপ্র-পরিবারে যেমন বিয়ে-সাদির কোন নিষেধ নেই—সৌর বিপ্র ও গাণপত্য বিপ্রে যেমন বিয়ে চলতে পারে, ইষ্ট, কৃষ্টি ও পিতৃপুরুষের ঐতিহ্যবাহী রসুল-ভক্ত বিপ্র, বুদ্ধভক্ত বিপ্র, খ্রীষ্টভক্ত বিপ্রের সঙ্গেও তেমনি বিধিমাফিক বিয়ে-থাওয়া হ’তে পারে—এতে কোন বাধা নেই। কারণ, স্বধর্ম্ম ও কৃষ্টি-নিষ্ঠ থেকে যে-কোন পূরয়মাণ মহাপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধানতি নিয়ে চলা ধর্ম্মের পরিপন্থী তো নয়ই বরং পরিপোষক। তবে প্রত্যেকটি বিয়ের ব্যাপারে খুব হিসাব ক’রে চলতে হবে, যাতে কোন রকমের ব্যত্যয়ী কিছু বা প্রতিলোম-সংস্রব না ঘটে। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড, ২। ৭। ১৯৪০)
* * *
সত্যের পথে চলতে পিয়াসী “সত্যমেব জয়তে”-এর সীলমোহর এর অধিকারী হতে চাওয়া সকল দেশসেবক পার্টির সদস্যদের কিছু নির্দিষ্ট আদর্শের অনুসরণ করে চলা উচিত। সাত্তিক ব্যক্তি চরিত্র নির্মাণ না করে, সদাচারী না হয়ে কখনোই মানুষের সেবা করে মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটানো সম্ভবপর নয়। তাই ব্যক্তি চরিত্র নির্মাণকল্পে কতগুলো বিধান মেনে চলতে হবে সবাইকে। যদি মানুষের মত মানুষ হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই।
একজন মানুষের শারীরিক-মানসিক বিধানকে সুস্থ রাখতে হলে অভক্ষ্যভোজী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুনাদি তামসিক আহার করা যাবে না। করলে স্বাস্থ্য ক্ষুণ্ণ হবে। অগম্যাগামী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ প্রতিলোম, সগোত্র এবং সপিণ্ড সম্বন্ধীয়দের সাথে অবিধি পূর্বক ধর্মবিরুদ্ধ বিবাহের মাধ্যমে কামাচার করা যাবে না, করলে নীরোগ সুসন্তানের জনক-জননী হওয়া যাবে না। স্মৃতিকে নিশ্চল রাখতে শারিরীক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সদাচার পালন করতে হবে। অসৎ পথ বর্জন করতে হবে। কদাচারী প্রদত্ত আহার ও পানীয় গ্রহণ করা যাবে না। করলে সংক্রামিত হবার আশঙ্কা থাকবে। এই আবশ্যিক জ্ঞানগুলো জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যই আর্য্য মহাসভা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন।
আমাদের জীবধর্মের এক আবশ্যিক জৈবিক তাগিদ হলো আহার বা খাদ্য। যদিও ব্যাপক অর্থে আহার মানে আহরণ। যার মধ্যে সবকিছুই আছে। খাওয়া-দাওয়া, শোয়া-বসা, চলাফেরা, কথাবার্তা, কাজকর্ম, তথাকথিত প্রেম-ভালবাসা, বিয়ে করা, বাবা-মা হওয়া ইত্যাদি। আমাদের উপনিষদের ঋষিরা ওই সবগুলোকে একত্রিত করে ‘আহার’ নামকরণ করে বললেন, ‘‘আহারশুদ্ধৌ সত্তাশুদ্ধিঃ, সত্তাশুদ্ধৌ ধ্রুবাস্মৃতিঃ …… ’’—অর্থাৎ জীবন ধারণের নিমিত্ত আহরণগুলো শুদ্ধ হলে সত্তা শুদ্ধি হয়, সত্তা শুদ্ধি হলে স্মৃতি নিশ্চল হয়। স্মৃতি নিশ্চল হলে জাতিস্মর হওয়া যায়। জীবনভূমির এপার-ওপার নিরীক্ষণ করা যায়। যারা দেশসেবক হবেন, তারা যদি আদর্শ চলন-চরিত্র দিয়ে আত্মশুদ্ধির পথে চলতে অভ্যস্ত না হন, দেশের নাগরিকদের কোন সম্পদের উপহার দেবেন ? তাই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বিশুদ্ধ চলন-চরিত্রের ওপর নির্ভর করছে ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। এবং ওই দৃষ্টান্তই ভারতকে মহান ভারতের শিরোপায় অধিষ্ঠিত করবে ভবিষ্যতে। এ বিষয়ে জীবন পিয়াসী সকল মানুষকে ভেবে দেখতে হবে। কোন ধর্মীয় মতবাদ প্রবৃত্তি-প্ররোচিত অশুদ্ধ আহার-বিহার-অনাচারকে সমর্থন করেনি।
আহার বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের বাণী
সর্বশ্রেষ্ঠ আর্য্য হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ মহাভারতের অনুশাসনপর্ব—১১৪ অধ্যায়ে বলা হয়েছে–
“যে ব্যক্তি মোহ প্রভাবে পুত্র-মাংস-তুল্য অন্যজীবের মাংস ভক্ষণ করে, সে অতি জঘন্য প্রকৃতির এবং তার সেই জীবহিংসা বহুবিধ পাপযোনিতে জন্মগ্রহণ করবার একমাত্র কারণ বলে নির্দিষ্ট হয়।’’
শুধু হিন্দু মতেই নয়, কোন ধর্মীয় মতবাদে জীবহত্যা স্বীকৃত নয়। কোরানে, আর্য্য হিন্দু-শাস্ত্রে এবং পুরুষোত্তমদের বাণীতে কোথাও ‘বলিদান’ বা ‘কোরবাণী’-র নামে প্রাণী হত্যার অনুমোদন নেই।
“আল্লার নিকট তাহার মাংস ও তাহার রক্ত কখন পৌঁছে না বা তিনি তাহা ইচ্ছা করেন না। বরং তোমরা অসৎকর্ম্ম হইতে নিজেকে রক্ষা কর ইহাই তিনি ইচ্ছা করেন। তিনি আমাদের অধীনে থাকিয়া কার্য্যনির্বাহের জন্য পশু সৃষ্টি করিয়াছেন—সেজন্য তোমরা খোদার নিকট নম্র ও নিরীহ হইতে শিক্ষালাভ করিবে। এই সৎপথ-প্রাপ্তির অর্থাৎ সৎ-শিক্ষার জন্যই খোদা এই ব্যবস্থা করিয়াছেন। যাহারা অন্যের মঙ্গল সাধন করে, তাহাদের মঙ্গল করিয়া থাকেন ……..” (কোর-আণ—২২ হজ ৩৭ র, ৫)
“বাসোপযোগী গৃহ, গুপ্তস্থান রক্ষা করিবার উপযুক্ত বস্ত্র, এবং শুষ্ক-রুটি ও পানীয় ব্যতীত মানব-সন্তানের অন্য কোন জিনিসের উপর অধিকার নাই ।” (–হাদিস তিরমিজি)
“একটু পানি এবং কয়েকটি খর্জ্জুরে তাঁহার ক্ষুধার নিবৃত্তি হইত । হজরত মোহাম্মদ একাধারে ধর্ম্ম-প্রবর্ত্তক, মহাকর্মী এবং সন্ন্যাসী ছিলেন ।” (ইসলামের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৯)
ভগবান বুদ্ধদেব বলেছেন, “আমি কখনই কাউকে মাংস খাওয়ার অনুমোদন করি নি, করি না এবং করব না।” (লঙ্কাবতার সূক্ত)
প্রভু যিশু বলেন, “তুমি হত্যা করিও না” । (এক্সোডাস – 20:13)
“যে একটি ষাড়কে হত্যা করলো, সে যেন একটি মানুষকে হত্যা করলো।” (ইসা – 66:33)
উক্ত অনুশাসনবাদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যে নিজেকে পরমেশ্বরের সন্তান বা খোদাতাল্লার বান্দা মনে করবেন তিনি কখনই কোন প্রাণী হত্যা করবেন না এবং প্রাণীর রক্ত-মাংসে ক্ষুধার নিবৃত্তি করবেন না।
প্রত্যেকের মানসিক অবস্থা-অনুযায়ী তার থেকে একটা Radiation (বিকিরণ) নির্গত হয়, সেই Radiation (বিকিরণ) আবার অন্যকে Influence (প্রভাবিত) করে । সেই জন্য শুধু খাওয়া কেন, সবাইকে সব সময় ছোঁয়াও ভাল নয়। বিশেষতঃ মানুষ যখন সাধন-ভজন ব্রত প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপৃত থাকে। এগুলি কোন কুসংস্কারের কথা নয়। সাদা চোখে দেখা যায়। আবার সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কার করলে তাতেই ধরা পড়তে পারে।
(শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, আঃ প্রঃ-৩/২৮০)
* * *
“…… আমরা আমাদের নিজেদের কৃষ্টির ধার না ধেরে পরের পরাক্রমে অভিভূত হয়ে চলছি। তাই, আমরা যত আন্দোলনই করি, একটা bastard thinking (জারজ) চিন্তা নিয়ে চলি।” (আলোচনা-প্রসঙ্গে ২১ খণ্ড, পৃঃ ৮১)
তাই—
আর্য্যকৃষ্টি অনুযায়ী রাষ্ট্রকে অবহিত করার জন্য
।। ‘বিধান বিনায়ক’ গ্রন্থ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদেশ।।
“তোমরা
শাসন-সংস্থায় পদক্ষেপ করবার সাথে-সাথেই
কী দায়িত্বের কর্ণধার হ’য়ে পদক্ষেপ ক’রছ—বোধিদীপনা নিয়ে
কুশলকৌশলী সমীক্ষ অনুচর্য্যার সম্বেগ-সহ
তা’ স্মৃতিপটে জাগরূক রাখতে যত্নবান হয়ো,
আর, শ্রেয়নিষ্ঠায় অচ্যুত থেকে
হৃদ্য বৈধী ব্যক্তিত্বে
অটুট হ’য়ে যাতে থাকতে পার,—
তাই ক’রে চ’লো
সমস্ত প্রবৃত্তিকে শ্রেয়ার্থ-সংহত ক’রে;
১। প্রথমেই নজর রেখো
বিবাহ ও সুজনন-সংস্কারের উপর,
শ্রেয়কুল-সংস্কৃতি-সম্ভূত কন্যা
যাতে অশ্রেয়
বা অপকৃষ্ট-সংস্কৃতি-সম্পন্ন কুলে
অর্পিত না হয়—
তা’র সুব্যবস্থা ক’রো ;
কন্যার কুল-সংস্কৃতি ও চারিত্রিক সঙ্গতি
যেন বর বা পুরুষের
কুল-সংস্কৃতি ও চরিত্রের অনুপোষণী হয় ;
পণ বা যৌতুক-লালসার অপসারণে
লক্ষ্য রেখো,
পুরুষের সুকেন্দ্রিকতা
ও নারীর সতীত্বের উপর ভিত্তি করে
তোমাদের গৃহ, সমাজ ও গণ যেন
উদ্বর্দ্ধনমুখর হ’য়ে চলে ;
প্রথমেই এ-কথা বলার উদ্দেশ্য এই—
সুজনন যদি না হয়,
যে-নিয়ন্ত্রণের দ্বারা জাতক
শ্রেয় জৈবী-সংস্থিতি পেয়ে
আয়ু, মেধা, বল,
সুসঙ্গত চরিত্র এবং গুণবৈশিষ্ট্য নিয়ে কৰ্ম্মানুপ্রেরণায় যোগ্য হ’য়ে ওঠে,—
তা’ যদি না ক’রতে পার,
রাষ্ট্র-সংহতি ও রাষ্ট্রসত্তার সম্বর্দ্ধনা
দিন-দিনই ঘোর তমসাবৃত
ও নিথর হ’য়ে উঠতে থাকবেই কি থাকবে; প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে অবহেলা করে
যে-বিজ্ঞানেরই অবতারণা কর না কেন,
তা’ কখনও সহজ, সলীল, শুভসন্দীপী
হ’য়ে উঠতে পারবেই না,
অমনতর অবান্তর কল্পনাও
একটা মূঢ়তা মাত্র ;
তাই, শুধুমাত্র বর্ণাশ্রমের নীতিবিধিকে
দক্ষচক্ষুতে সুনিয়ন্ত্রিত ক’রে চ’লতে পারলেই
রাষ্ট্র-সংস্থা সৎ-সম্বদ্ধ হ’য়ে চ’লতে পারে,—
প্রাচীন শাস্ত্রে এ-কথা বহুল কীৰ্ত্তিত হ’য়ে আছে,
তাই, রাষ্ট্র-সংস্থার প্রধান করণীয়ই হচ্ছে
বর্ণাশ্রমের ধারণ ও সংরক্ষণ।
২। কৃষি-ব্যাপারে
বীজ ও ভূমির সুসঙ্গতির প্রতি লক্ষ্য রেখো,
যে-ভূমিতে যে-বীজের ফলন
পুষ্ট ও অধিক হ’য়ে ওঠে,
তা’র সুব্যবস্থা ক’রো,
কৃষি সম্বন্ধীয় চলনসই তত্ত্বগুলিতে
মানুষ যা’তে শিক্ষা লাভ করে—
তা’র ব্যবস্থা
ও যথাসম্ভব তা’তে প্রেরণাসম্বুদ্ধ করে
কৃষি-ব্যাপারে
লোককে এমনতর ব্যাপৃত রাখ,—
যাতে ক্রমশঃই
নানা জাতীয় ফসলের প্রাচুর্য্য ঘটে ওঠে,
আর, শাসন-সংস্থার সুব্যবস্থ পরিচালনে
পূর্ত্তবিভাগ, নদী-সংস্কার, সেচ
ও বনব্যবস্থার সুনিয়ন্ত্রণে
তা’দিগকে কৃষিকৰ্ম্মে
যথাসম্ভব সব দিক-দিয়ে সাহায্য ক’রো,
যাতে খাদ্য-বিষয়ে পরমুখাপেক্ষী না-থেকে
দেশ স্বাবলম্বী তো হ’য়ে ওঠেই,
বরং উদ্বৃত্ত খাদ্যবণ্টনে
অন্যের অভাবকেও দূরীভূত ক’রতে পারে।
৩। মানুষের সম্বেগকে
এমন উদ্দীপ্ত ক’রে তোল,
যা’তে তা’রা যোগ্যতায় অভিদীপ্ত হ’য়ে ওঠে,
এবং পারদর্শিতা, বোধ ও শ্রমনিয়োজনে
দেশ ও বিদেশের প্রয়োজনে
শিল্পের উন্নতি করতে পারে—
কুটীরশিল্পের সম্প্রসারণে
সবিশেষ লক্ষ্য রেখে—–
যাতে অধিকাংশ পরিবারই
শিল্প পরিচর্য্যায় ব্যাপৃত হ’য়ে ওঠে,
আর, ঐ জাতীয় সমস্ত ব্যাপারের জন্য
যে-যে উপকরণের প্রয়োজন
তা’ বিহিত ত্বরিতভাবে সরবরাহ কর– শিল্পোপযোগী যন্ত্রপাতি ও শক্তি সরবরাহকে
সহজ, সুগম ও ব্যাপক ক’রে তু’লে;
সঙ্গে সঙ্গে যানবাহন ও যোগাযোগের
বিহিত ব্যবস্থা কর,
যাতে কেউ
জীবনচর্য্যার যোগ্যতর পরিচর্য্যায়
কোন দিক-দিয়ে কোনরকমে
ব্যাহত না হয় ;
বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে,–
শ্রমিকরা যা’তে ধনিকের উপচয়ী হয়,
এবং ধনিকরা যা’তে
শ্রমিকদের সত্তাপোষণী হয়,
আর, যোগ্যতায় অভিদীপ্ত হ’য়ে
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে
শ্রমিকরা যাতে স্বাবলম্বী হ’য়ে ওঠে—
নিজের পরিবারকে শ্রমনিকেতন ক’রে
সম্পদে উদ্ভিন্ন হ’য়ে।
৪। ব্যবসা-বাণিজ্য-নিয়ন্ত্রণ
এমনই শুভ, সহজ,
অনুচৰ্য্যাদীপক হওয়া উচিত,
যা’র ফলে বা যে-নিয়ন্ত্রণে
মানুষ এতটুকুও অভাব বোধ না করে,
বরং যোগ্যতা ও প্রাচুর্য্যে উচ্ছল হ’য়ে ওঠে;
দেশে যা’ জন্মে, তা’র সহজ পরিবেষণ
ও জীবন-চলনার পক্ষে যা’ নিতান্তই প্রয়োজনীয়,
অথচ দেশে পাওয়া যায় না—
বিদেশ হ’তে এমনতর দ্রব্যাদির
শীঘ্র ও সহজ আমদানি
এমনতরভাবে
যা’তে মূল্য-বাহুল্যে
মানুষ পীড়িত না হ’য়ে ওঠে,
বা কেউ তা’র অভাবে সঙ্কটাপন্ন হ’য়ে
জীবন না হারায়,——
অতীব তৎপরতা নিয়ে
তীক্ষ্ণ চক্ষুর দিব্য বিবেচনায়
তা’র সমাধান হওয়া একান্তই সমীচীন—
অবান্তর গণবিক্ষোভের অবসরই যাতে না থাকে
এমনতরভাবে;
কৃষি ও শিল্পের উপচয়ী উৎপাদন ও বণ্টন
এবং বাণিজ্য ও বৈদেশিক অর্থ-বিনিময়ের
লাভজনক সুপ্রসারই হ’চ্ছে
অর্থনীতির মূল ভিত্তি,
আবার, কৃষিই এ-সবের মেরুদণ্ড,
যা’দের কৃষি অব্যবস্থ——
অনটনও তা’দের অপরিহার্য্য,
তা’দের পরশোষী না হ’য়ে উপায়ই থাকে না ।
৫। শিক্ষাকে একানুধ্যায়ী আদর্শে
অনুচর্য্যী ধৰ্ম্মের ভিত্তিতে
সুসঙ্গত সত্তাপোষণী ক’রে তোল,
যা’তে কোন শিক্ষাই
অন্য যা’-কিছুর সাথে
সঙ্গতির তাল রেখে
সম্বুদ্ধ সম্বর্দ্ধনায়
বাস্তব যোগ্যতার উৎক্রমণে
উদ্গতি লাভ ক’রতে না-পেরে—
বৃথা ও বিচ্ছিন্ন হ’য়ে না ওঠে ;
শ্রদ্ধোষিত অন্তরাসী হ’য়ে
প্রতিপ্রত্যেকে যা’তে শিক্ষানুবৰ্ত্তনায়
উচ্ছল চলনে চ’লতে পারে, –
তা’র জন্য যথাবিহিত পরিবেশ সৃষ্টি কর ;
শিক্ষকদিগকে ঐ অমনতর শিক্ষার
মূর্ত্তপ্রতীক হ’য়ে উঠতে হবে,
তাঁরা যদি সুকেন্দ্রিক, একানুধ্যায়ী
সশ্রদ্ধ না হ’য়ে ওঠেন—
অন্তরাসী সম্বেগ-সম্বুদ্ধ হ’য়ে—
ছাত্রেরাও সুসঙ্গত হয়ে উঠবে না তাঁতে,
অন্তরাসী হবে না,
যা’র ফলে, শিক্ষা
একটা শাতনী পটভূমিতে
আবর্ত্তিত হয়ে উঠবে ;
শিক্ষার সাথে
বৈধানিক দক্ষতা ও শক্তি
এমনতর সূক্ষ্ম, সবেগ
ও কৰ্ম্মঠ হয়ে ওঠা চাই,
যা’র ফলে, মানুষ
কোন ব্যাপারের সম্মুখীন হ’লেই
মুহূর্ত্তে সেগুলি উপলব্ধি ক’রতে পারে,
ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎকে
দেশকালপাত্র ও অবস্থার ভিতরেও
ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমানের সঙ্গতি নিয়ে
লহমায় বেছে নিতে পারে ।
৬। গবেষণা কেন্দ্রগুলিকে দেশের
দীপালী-বীক্ষণাগার ক’রে তুলতে হবে,
সুসঙ্গত সত্তাপোষণী সমাচার
যা’তে সুদূরপ্রসারী পরীক্ষায়
সুনিশ্চয়ী তাৎপর্য্যে
সবার কাছে উপস্থিত হয়,
যা’র পরিপালনে তারা জীবন ও সম্বৃদ্ধিতে
আরো হ’তে আরোতর উদ্বর্দ্ধনায়
নিয়ত চলৎনশীল থাকতে পারে—
আদর্শ ও ধর্ম্মের ভিত্তিতে
নিটোলভাবে দাঁড়িয়ে—
তা’র ব্যবস্থা ক’রতে হবে।
৭। তোমাদের স্বাস্থ্য অভিযান যেন
গ্রামের কানায় কানায় উপস্থিত হয়,
সদাচার ও স্বাস্থ্য-নীতিগুলিতে
প্রতিটি ব্যষ্টি যেন পারদর্শী হয়ে ওঠে,
ঔষধ, পথ্য, চিকিৎসা ও বৈদ্যের
যেন এতটুকু অভাব না ঘটে,
তোমাদের গণজীবন
স্বাস্থ্যে, বীর্য্যে
অযুত-আয়ু হ’য়ে
বীৰ্য্যবান যোগ্যতা নিয়ে
তাদের অস্তিকে স্বস্তি-বিকিরণে
যেন বিকীর্ণ ক’রে তোলে,—
হৃদ্য হ’য়ে, তৃপ্তিপ্রদ হ’য়ে
মধুদীপনার রশ্মিজাল বিচ্ছুরণে
অস্তিত্বের সামগানে
সম্বৃদ্ধ ক’রতে পারে সবাইকে ।
৮। শান্তিরক্ষক-বিভাগ ও সৈন্য-বিভাগ
সুষ্ঠু সন্দীপনায়
আদর্শপ্রাণ ধৰ্ম্মানুগ ভিত্তিতে
অসৎ-নিরোধী হ’য়ে
যা’তে প্রতিপ্রত্যেকের আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে,
সে-বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রেখো,
ব্যতিক্রমে
বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করো;
নিরাপত্তা যেখানে সন্দেহের
নিরোধও সেখানে অব্যর্থভাবে প্রয়োজন—
ক্ষিপ্র তৎপরতায় ;
আর, শান্তিরক্ষক ও সৈন্য-বিভাগের
প্রতিপ্রত্যেকে যেন
একানুধ্যায়ী, ধৰ্ম্মপ্রদীপ্ত
সৌকৰ্য্য-সমন্বিত ঐ শাসন সংস্থার
স্বভাব-যাজী হ’য়ে ওঠে–
বাক্য, ব্যবহার ও কর্ম্মের সুসঙ্গতির তালে,
যার ফলে, প্রত্যেকটি মানুষ
উপলব্ধি ও উপভোগ করতে পারে
ঐ শাসন-সংস্থা
তাদের কাছে কতখানি শ্রেয় বা প্রিয়,
সবাই যেন একটা আসান ও আশা পায়,
শাস্তিকেও তারা যেন
স্বস্তি ব’লে আলিঙ্গন ক’রতে পারে।
৯। গুপ্তচর-বিভাগকে
এমনতর ক্ষিপ্র, দক্ষ, নিপুণ, বিশ্বস্ত ও তৎপর
ক’রে তুলতে হবে—
আপ্রাণ শ্রেয়ার্থ-অভিদীপনা-নিবদ্ধ করে,
যেন তারা যাই করুক না কেন
শ্রেয়ার্থকে
কিছুতেই বিসৰ্জ্জন দিতে না পারে,
তাদের জীবনমূল
যেন এতই ধর্মভিত্তিতে প্রোথিত থাকে যে,
তাকে উল্লঙ্ঘন করা তাদের পক্ষে
দুর্ভাবনীয় ব্যাপার হ’য়ে দাঁড়ায়;
তা’দের চক্ষু, কর্ণ, জিহবা,
নাসিকা, ত্বক্ ইত্যাদিকে
এতই তীক্ষ্ণ ও নির্ভুল বোধপ্রবণ ক’রে তুলতে হবে,—
যা’তে তা’রা স্বতঃই
বিচক্ষণ বোধ-তাৎপৰ্য্যশীল হয়ে ওঠে,
তাদের উপস্থিতবুদ্ধি, বাক্য-বিন্যাস
এমনতর ক’রে তুলতে হবে–
যাতে কোন বিষয়ে তাদের বিবরণ
বাস্তবতারই বাক্-ছবি হ’য়ে ওঠে,
তাদের ধারণাগুলিকে
এমনতর সুস্থ ধৃতি-প্রবণ ক’রে তুলতে হবে—
যাতে বিবরণে
কোনমাত্র ব্যতিক্রম না হয়,
অযথা অপকৃষ্ট-ধারণাদুষ্ট হয়ে
বা বাস্তব বিষয়ের অসাক্ষাৎকারে
তাদের প্রদত্ত কোন বিবরণের দ্বারা
কেউ যেন
অযথাভাবে আক্রান্ত বা বিমর্দ্দিত না হয়,
আবার, আলস্য বা প্রবৃত্তি-প্রলুব্ধ হয়ে
তাদের ক্ষিপ্র নৈপুণ্য
এতটুকুও যেন বিকম্পিত না হয়ে ওঠে,
দুষ্ট পরিবেশ বেষ্টিত হয়েও
তাদের এমনতর
উপস্থিতবুদ্ধির তালিমসম্পন্ন হওয়া উচিত—
যাতে তারা
যে-কোন অবস্থায় পড়ুক না কেন,
সে-ব্যুহ ভেদ ক’রে ফিরে আসা
তাদের পক্ষে হস্তামলকবৎ হ’য়ে ওঠে,
তারা যেন
সাহস ও প্রত্যয়ে অভিদীপ্ত হয়ে চলে,
দেবপ্রভ চরিত্র,
শাতন-ভেদী ইন্দ্রিয় ও বোধি-সমন্বিত যে যত,—
সেই তত শ্রেয়,
দক্ষ, পারদর্শী, কর্ম্মপটু হ’য়ে থাকে,
নিষ্ঠা, সহ্য, ধৈর্য্য, অধ্যবসায়
ও কৰ্ম্মপটু তীব্রবীর্য্যী বোধায়নী সন্ধিৎসাই হচ্ছে
তাদের প্রিয় সম্পদ ;
গুপ্তচর-বিভাগ ছাড়া
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও উৎকর্ষ-অভিধ্যায়িতার জন্য
উপযুক্ত সন্ধানী বিভাগেরও প্রয়োজন,
যা’রা দক্ষ, কর্ম্মপটু, সুসন্ধিৎসু
নিপুণ অভিধ্যায়িতা নিয়ে
ক্ষিপ্র তৎপরতার সহিত
রাষ্ট্রের সম্পদ ও আপদকে
সম্যকভাবে নির্দ্ধারণ ক’রে
চতুর বৈধী-তৎপরতায়
উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণে
আপদকে নিরাকরণ ক’রে
সম্পদকে সুবর্দ্ধিত ক’রে তুলতে পারে,
উক্ত বিভাগে সত্তাপোষণী ধৰ্ম্মানুগ সুনিষ্ঠ একানুধ্যায়ী তাৎপর্য্যবান
পটু, শ্রমপ্রিয়, ধীমান কর্মীর নিয়োগও
একান্ত প্রয়োজন ।
১০। বিচারালয়ে বিচারক
ঐ সশ্রদ্ধ ধৰ্ম্মানুগ
একানুধ্যায়িতা নিয়ে
যেন এমনতর
বিচার ও সুশাসন-তৎপর হ’য়ে ওঠেন,–
যা’তে সব্যষ্টি প্রত্যেকটি গণগুচ্ছই
তাঁ’তে আস্থাসম্পন্ন, তৃপ্ত ও সন্দীপ্ত হ’য়ে
শাসন-সংস্থায় আত্মনিয়োগ করে,
তা’র সৌকর্য্যে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে—
স্বাভাবিক স্বতঃ-সন্দীপনায় ।
১১। কর্মচারী নিয়োগ-ব্যাপারে
প্রথমেই দেখা উচিত
সসংস্কৃতি তা’র কুল ও বংশ,
দেখতে হবে
মাতৃকুলই হোক বা পিতৃকুলই হোক—
তাতে কোনরকম অশ্রেয় বা অবৈধ
বিক্ষেপ আছে কিনা,
কারণ, তা’ থাকলে,
সে যত বড়ই দক্ষ
ও বোধিবীৰ্য্যবান হোক না কেন,
অবিশ্বস্ত হওয়ার ঝোঁক তা’তে
কিছু-না-কিছু থাকবেই ;
আবার, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি
যেন একমাত্র বিচার্য্য না হ’য়ে ওঠে,
বিশ্বস্ত, দক্ষ, বীৰ্য্যবান,
কর্ম্মঠ পারদর্শিতাকে ভিত্তি ক’রেই
নির্বাচন-বিচার চালানো যুক্তিসঙ্গত,
তা’র সাথে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা থাকে—
সে তো ভালই,
তা’ ছাড়া
স্বাস্থ্য, মনোবল, সাহস, বোধিদক্ষতা
অনুবৰ্ত্তিতা, উপস্থিতবুদ্ধি,
সুসঙ্গত ক্ষিপ্র চিন্তাসঙ্গতি,
সুসিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা,
নির্ভুল ও ক্ষিপ্র সম্পাদনী
তৎপরতা ইত্যাদি দেখা
অতীব সমীচীন ;
এগুলি দেখতে হবে,
যে যে-পদের প্রার্থী
তা’র উপযোগিতা-অনুপাতিক—
জৈবী-সঙ্গতিকে ভিত্তি করে।
১২। স্বরাষ্ট্র ও বৈদেশিক দপ্তরকে
এমনতরই সাবুদ ক’রে তুলতে হবে,
যাতে স্বরাষ্ট্র ও বিদেশের
সুসঙ্গত পারস্পরিক অনুচৰ্য্যায়
কোথাও এতটুকু অবিবেকী অসামঞ্জস্য না থাকে,
তা’রা বান্ধবতায় সুনিবন্ধ হয়ে ওঠে—
পারস্পরিকতায়,
রাষ্ট্রসত্তা ও স্বার্থকে অব্যাহত রেখে,
সত্তাপোষণী ধৰ্ম্ম, কৃষ্টি
ও আদর্শানুগ রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্যকে
অটুট রেখে,
সম্ভ্রমাত্মক অনুবেদনী আনতির সহিত ;
বৈদেশিক বান্ধবতা যেন অচ্ছেদ্য থাকে,
কোনপ্রকার কূটকৌশলই যেন
ঐ বান্ধবতাকে ছিন্ন করতে না পারে,
তাদিগকে এমনতর ক’রে তোল
যাতে তারা তোমার রাষ্ট্রীয় সত্তার সংরক্ষণ
ও তৎপরিপন্থী যা’-কিছুর নিরাকরণে
অপরিহার্য্যভাবে
সক্রিয় স্বতঃ-অনুধ্যায়ী হয়ে ওঠে।
১৩। আবার, ঐ আদর্শকে রূপায়িত ক’রতে
রাষ্ট্রদূতও তেমনতরভাবে
নিয়োগ করো,
রাষ্ট্রসত্তায় স্বার্থবান, সদ্বংশজ, বিদ্বান,
সুসঙ্গত বোধিপরায়ণ,
উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন, নীতিজ্ঞ, মিষ্টভাষী,
ধৰ্ম্ম, কৃষ্টি ও আদর্শে অচ্যুত সুনিষ্ঠ,
কৌটিল্য-অভিজ্ঞ, ইঙ্গিতজ্ঞ, মর্ম্মজ্ঞ,—
মোক্তা কথায়
এই জাতীয় জন্ম ও গুণবিশিষ্ট
শ্রেয়ার্থপরায়ণ লোকই কিন্তু
দৌত্যের উপযুক্ত পাত্র,
বিসদৃশ, বিশৃঙ্খল যা’,
আদর্শ, ধৰ্ম্ম ও কৃষ্টি-সমন্বিত
রাষ্ট্রসত্তা ও স্বার্থকে
ব্যাহত করে, খাটো করে,
বা নিন্দা করে যা’,—
সুযুক্তিপূর্ণ তথ্য-সমন্বিত
বাক্য, ব্যবহারের ভিতর-দিয়ে
তাকে নিয়শ্রিত করে
রাষ্ট্রসত্তা ও স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে,—
এমনতর উপস্থিতবুদ্ধি নিয়ন্ত্রিত-ধী-সমন্বিত
কূট-কৃতি পরিচর্য্যাসম্পন্ন ব্যক্তিই
দৌত্য-ব্যাপারে বাঞ্ছনীয় ।
১৪। প্রচার-প্রাচুর্য্য এতই হওয়া উচিত—
যাতে দেশের আদর্শ, দেশের কৃষ্টি,
দেশের বিবর্ত্তনী পদক্ষেপ,
বিদেশের প্রত্যেককেই
মুগ্ধ ও আন্দোলিত ক’রে তোলে—
উন্নয়ন-অনুশীলনী সম্বেগে,—
সবাই শ্রদ্ধাবন্ত হয়ে ওঠে
তোমার দেশের গণ ও ব্যষ্টিতে;
ধৰ্ম্মের মূলসূত্র যা’,
আদর্শ, কৃষ্টি এবং সত্তাপোষণী নীতি যেগুলি—
সে-সবগুলি বিহিতভাবে উদ্ভিন্ন করে
সঞ্চারিত ক’রে, নিয়মন ক’রে
যাতে প্রত্যেকটি ব্যষ্টি
তদ্ভাবান্বিত হয়ে ওঠে
একত্বানুধাবনী তাৎপর্য্যে,
পারস্পরিক বৈশিষ্টপোষণী সশ্রদ্ধ পরিচর্য্যায়,
বাক্যে, ব্যবহারে, চলনে,—
তার বিহিত ব্যবস্থা করা নিতান্তই সমীচীন,
আর, ঐ সমীচীনতার অবহেলা
যতই বেশী হ’য়ে ওঠে,
একানুধ্যায়ী সংহতি-স্বাতন্ত্র্য
পারস্পরিক সহযোগিতা
যোগ্যতা-অভিদীপ্ত বিবৰ্ত্তনী অনুপ্রাণনা
ক্রমশঃই অপলাপের দিকে
চ’লতে থাকে ততই,
তখন সত্তাতান্ত্রিকতার বদলে আসে—
প্রবৃত্তির ব্যভিচারী পরিক্রমা,
দুর্ব্বুদ্ধির উদগ্র লেলিহান সম্বেগ,
যা’ নিজের সত্তাকেই আয়বাদ দিয়ে
পরিশোষণ করে
তারই উপভোগ্য উপকরণ-সংগ্রহে
আগ্রহবিধুর হ’য়ে ওঠে,
এই হচ্ছে শাতনী সঞ্চলন,—
ব্যষ্টি, গণ ও রাষ্ট্রকে
সৰ্ব্বনাশে সমাধিগ্রস্ত করার
আত্মঘাতী আবেগ—
যা’ গণবিদ্রোহের সৃষ্টি ক’রে তোলে ।
১৫। শাসন-সংস্থা নিজে
তা’র প্রতিটি কর্মচারী-সহ
যথাসম্ভব একানুধ্যায়িতার সহিত
পরার্থপরতার সম্বেগ নিয়ে
কৃতি-অধ্যুষিত সন্দীপনায়
যেন রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যষ্টিকে দেখা-শোনা করেন,
তা’ ছাড়া, নিয়মিতভাবে নগর—
বিশেষতঃ পল্লী-পরিদর্শন,
লোকের সুখদুঃখ, অভাব-অভিযোগের তথ্য গ্রহণ,
তন্নিরাকরণী যোগ্যতা-সন্দীপী আলোচনা,
অযথা অবান্তর ব্যয়বাহুল্যের
সঙ্কোচ ও সুনিয়মন,
এবং বিশেষ বিষয়ে বিহিত স্থানে
আপূরণী সাহায্য-দানের
এমনতর ব্যবস্থা যেন করেন
যার ফলে
প্রতিপ্রত্যেকের বোধে
উপস্থাপিত হয় যে,—
শাসন-সংস্থা তা’র প্রতিটি ব্যষ্টি-সহ
তাদের কাছে কতখানি আত্মীয়ভাবাপন্ন;
এটা একটা অপরিহার্য্য করণীয়।
১৬। করধার্য্য এমনি ক’রে করো,—
যাতে মানুষের কর
তোমার শাসন-সংস্থার
সহায় হ’য়ে ওঠে,
সম্বর্দ্ধনার শক্তি হয়ে ওঠে,
তোমার কর যেন
মানুষের করকেই আলিঙ্গন করে,
আবার মানুষের যোগ্যতা
ও আন্তরিক আগ্রহ
কর্ম্মদীপ্ত হয়ে
যেন এমনতর উপচয়ী হ’য়ে ওঠে,—
এবং তোমাদের পালন পরিচর্য্যায়
এমনতরই সম্বুদ্ধ ও সম্বৃদ্ধ হ’য়ে ওঠে—
যা’র ফলে, প্রতিটি গণের
আগ্রহ-উদ্দীপ্ত অবদানে
তোমাদের রাজকোষ
উচ্ছল চলনায় চলতে থাকে,
আর, তা’র ব্যবহারও যেন এমনতর হয়—
যাতে ঐ কোষ অবাধভাবে
উপচয়ী চলনে চলতে পারে
এবং ব্যয়টাই যেন উপচয়ের কারণ হয়ে ওঠে;
রাজকোষ যেখানে অপটু,
গণযোগ্যতাকে সম্বেগে প্রবুদ্ধ করে
উৎপাদন-হারকেই প্রবুদ্ধ করে তোল—
ক্রমচলনের ভিতর-দিয়ে,
আর, রাজকোষকে উচ্ছল করে
তুলতে চেষ্টা কর—
সমবেত সানুকম্পী পরিচর্য্যায় ;
গণসত্তার নিরাপত্তার জন্য
আয়ের একদশমাংশ সংরক্ষিত ক’রে
অন্যায্য-ব্যয়-সঙ্কোচে
ন্যায্য নিয়ন্ত্রণে
গণ-নিরাপত্তাকে অটুট ক’রে তোল,
আর, গণসত্তা-পোষণ ও প্রবর্দ্ধনের জন্য
‘যা’ প্রয়োজন
‘তা’ ঐ নয়-দশমাংশের ভিতর
নিষ্পন্ন করতে চেষ্টা কর;
যতক্ষণ পর্য্যন্ত কোন উৎপাদন
তেমনতর প্রাচুর্য্যে উপস্থিত না হয়—
যা’র ফলে, নিরাপত্তার ব্যয়
ঐ উপচিত ভাণ্ডার থেকেই
সচ্ছল হ’য়ে ওঠে,
ততদিন শ্রমপটুতাকে উপেক্ষা না ক’রে
উৎপাদনকে আরো-আরো
সম্বুদ্ধ করে তুলো;
তাতে তোমার রাষ্ট্রসত্তাও
পরাক্রমশীল হয়ে উঠবে।
১৭। নিজের দেশের দুর্ব্বলতা যেগুলি আছে,
সেগুলির সংস্কারে
জাতিকে সবল করে তুলতে হবে,
অনটনের অপনোদনে
দেশকে প্রাচুর্য্যে উদ্ভিন্ন করে তুলতে হবে,
অপটু যারা তা’দিগকে পটুত্বে
প্রকৃষ্ট করে তুলতে হ’বে,
যারা অপলাপের কোলে অবশায়িত
তাদিগকে উদ্গতিশীল করে তুলতে হবে,
সৎ-কে আরো আরোতে
উদ্দীপ্ত করে তুলতে হবে—
বৈধী বৈশিষ্ট্যপালী বিবৰ্ত্তন-পদক্ষেপী ক’রে সুকেন্দ্রিকতায় সুনিবদ্ধ করে।
১৮। অবিশ্বস্ততা ও কৃতঘ্নতাকে
উপযুক্ত উপায়ে
নিরোধ করবেই কি ক’রবে—
ক্ষিপ্র তৎপরতায়,
যা’র ফলে, মানুষের ঐ প্রবৃত্তি
বৃদ্ধিপর না হ’য়ে
ক্রমশঃই সঙ্কুচিত হয়ে
অপলাপে নিঃশেষ হয়ে ওঠে,
যেখানে দেখবে
অসৎ যা’, বিরোধী যা’
আদর্শ, ধৰ্ম্ম, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি-বিধ্বংসী যা’
নিয়তই ক্রুর ও সাংঘাতিকভাবে
তোমার সংস্থা ও সত্তার
অপঘাতী হয়ে চলেছে,—
সুদৃঢ় প্রস্তুতি নিয়ে
তাকে অনতিবিলম্বেই নিরোধ ক’রতে
একটুকুও ত্রুটি ক’রো না,
বিলম্বে তাকে হয়তো আয়ত্তে আনা
সুকঠিনই হয়ে উঠতে পারে;
সম, দান, ভেদ ও দণ্ডের প্রতি
বিশেষ বিবেচনা
ও অনুধ্যায়ী বিচারণার সহিত
যেখানে যখন যেমনটি প্রয়োজন
সত্তাসম্বর্দ্ধনা ও অসৎ-নিরোধে
সেখানে তেমনতরই
যথাসম্ভব প্রস্বস্তির আবহাওয়া নিয়ে
তা নিষ্পাদন করতে
একটুও অবহেলা করো না;
সাম-দানে যদি সমস্যা সমাধান লাভ করে
তবে ভেদ সৃষ্টি করতে যেও না,
ভেদেই যেখানে তা নিরাকৃত হয়
সেখানে দণ্ড দিতে যেও না;
কিন্তু দণ্ড যেখানে অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছে
সেখানে দণ্ডকে ত্যাগ করো না,
আবার, কোথাও প্রয়োজন হ’লে
যুগপৎ চতুঃ-পন্থাই অবলম্বন করতে পার;
ফলকথা, অবৈধ যা’, অসৎ যা’,
অন্যায় যা’,
তা’ যেন ভীত, ত্রস্ত শ্রদ্ধাবনত হ’য়ে থাকে
তোমাদের শাসন-নিয়ন্ত্রণের ফলে।
১৯। সর্ব্বোপরি, তোমাদের শাসন-সংস্থা যেন
বৈশিষ্ট্যপোষণী লোকপালী সংস্থা
ও সুসঙ্গত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিপোষণে
যত্নবান্ হয়,
বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মাণ বিজ্ঞ-মহানদের প্রতি
বিশেষ সম্ভ্রম ও অনুচর্য্যা নিয়ে চলে,
আর, শাসন-সংস্থার পরিচালকবর্গ যেন
দেশের পূরয়মাণ ধৰ্ম্ম-প্রবক্তা যাঁরা
তঁৎসংশ্রয়ে উপস্থিত হয়ে
সশ্রদ্ধ আগ্রহে
উন্মুখ আপ্রাণতা নিয়ে
আলাপ-আলোচনার ভিতর-দিয়ে
তাঁদের দূরদর্শী উপদেশ ও অনুশাসন-গ্রহণ
ও তৎপ্রবর্ত্তনায় মনোযোগী হন,
এতে শাসন সংস্থা স্বতঃই
অভ্যুদয়ী কল্যাণের পথে চলতে পারবে ।
২০। এইতো গেল সেগুলি—
মোটা কথায় যা আমার ইয়াদে আসে ;
তবে আরো মনে হয়,
শাসন-পরিষদ বা শাসন-সংস্থার বাহিরে
সব সময়ই এমনতর একজন প্রাজ্ঞ বহুদর্শী
ইষ্ট, কৃষ্টি ও ধর্মের অনুচর্য্যাপরায়ণ
বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মাণ
কেউ যদি থাকেন,
যিনি ঐ শাসন-সংস্থার
সমস্ত নিয়মন ও পরিচালনে
নিয়ত লক্ষ্য রেখে
বাষ্টিগত ও সমষ্টিগতভাবে
লোকের অভিধ্যায়ী প্রয়োজনগুলিকে
অবলোকন করে থাকেন—
সম্যক্ তাৎপর্যে অভিগমনশীল হ’য়ে
সুসঙ্গত সূত্রকে অনুভব করে—
শ্রদ্ধাবনত অন্তঃকরণে
আগ্রহদীপনার সহিত
বোধায়নী পরিচর্য্যায়
পরিপ্রশ্ন ও সেবার দ্বারা
আলোচনায়
সমস্ত ব্যাপারগলিকে অনুধাবন করে
যখন যে-ব্যাপারে যেমন প্রয়োজন
তাঁর মত
ও কুশলকৌশলী নিয়মনের মন্ত্রণা নিয়ে—
তা’ পূৰ্ত্তনীতি সম্বন্ধেই হো’ক
আর, কৌটিল্য-সম্বন্ধীয়ই হো’ক,
নিজদিগকে তদনুপাতিক
সংস্থ ক’রে চ’লতে পারলে
শাসন-সংস্থা
আরও সুষ্ঠু, সুকেন্দ্রিক
ও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে
অচ্যুত আদর্শাভিগমনে ;
কারণ, যা’রা দাবা খেলে,—
নিজেদের দুরাগ্রহ ঔৎসুক্য-বশতঃ
তাদের বোধদর্শিতা
অনেকখানি অবসন্ন হ’য়ে ওঠে,
ঐ কুশলকৌশলী তাৎপর্য্য-পরায়ণ
বোধিসম্পন্ন পৃষ্ঠপোষকের ইঙ্গিত
তখন সাফল্যের দিকেই নিয়ে যায়,
আমার বৃদ্ধি ও বিবেচনা-মাফিক
শাসন-সংস্থার বাহিরে
এমনতর একজন
মানুষের প্রয়োজন অপরিহার্য্য—
যদিও সব ক্ষেত্রে, সব সময়ে
এমনতর লোক পাওয়া দুষ্কর;
আর, এমনতর লোক থাকুন আর নাই থাকুন—
শাসন-সংস্থার বাইরে
সব সময়
এমন শক্তিশালী নাগরিক সংস্থার প্রয়োজন,
যে-সংস্থা
নাগরিকদের ভিতর থেকে
ইষ্ট, কৃষ্টি ও ধৰ্ম্ম-অনুশাসন-সম্বুদ্ধ
শ্রেয়-কুল-সম্ভূত
আদর্শপ্রাণ সৰ্ব্বসঙ্গত বোধসম্ভারসম্পন্ন
বেদ-বিজ্ঞানবিৎ,
কৰ্ম্মপ্রাজ্ঞ,
বৈশিষ্ট্যপালী-আপূরয়মাণ-শ্রেয়নিষ্ঠ
সভ্য দ্বারা সুসংহিত হবে,
সুনিবদ্ধ হ’য়ে রইবে,—
যা’রা ধর্ম্মানুগ অস্তিবৃদ্ধির নিয়মনে
গণজীবনকে
যেমনতরভাবে নিয়ন্ত্রিত করা উচিত
তা’ তো করবেনই,
আরো, শাসন-সংস্থার
যে-কোন বিধি প্রণয়ন করতে হলে
তাঁদের অনুমতি ছাড়া
তা ঐ বিধান-সভায়
উত্থাপিত হতে পারবে না;
পরিস্থিতি, দেশকালপাত্র ও প্রয়োজন-অনুপাতিক এমনতর ব্যবস্থা যদি না হয়,
পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রবর্তিত এই পবিত্র ধ্বনির মাধ্যমে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানাদি সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অবতার পুরুষদের বন্দনা করা হয়।
[আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস: United Nations Educational, Scientific and Cultural Organisation বা UNESCO-র তরফে জানানো হয়েছে, ১৯০৯ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। নারী শ্রমিকদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সেই বছর এই দিনটি পালন করা হয়েছিল। পরে রাশিয়াতেও ১৯১৭ সাল থেকে এই দিনটি পালিত হতে থাকে একই কারণ মাথায় রেখে। তবে রাশিয়াতেই প্রথম বার এই দিনটি পালিত হয় ৮ মার্চ। তার পর থেকে সেটিই রীতি হয়ে গিয়েছে। বছরের এই দিনটিকেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সকলের তরফে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের গুরুত্ব: লিঙ্গবৈষম্য দূর করার জন্য এই দিনটি পালিত হয়। এখনও সারা পৃথিবীতেই সমাজের বেশির ভাগ জায়গায় লিঙ্গবৈষম্য বর্তমান রয়েছে। পুরুষরা এখনও বহু ক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় সুবিধা ভোগ করেন। আর সেই কারণেই এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বৃপূর্ণ। শিল্প-সাহিত্য-সহ সব ধরনের ক্ষেত্রে এবং সমাজের সমস্ত কাজে মহিলাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই এই দিনটি পালিত হয়।
জাতিসংঘ 2024 সালের থিম হিসাবে মনোনীত করেছে ‘নারীতে বিনিয়োগ: অগ্রগতি ত্বরান্বিত করুন’ অর্থনৈতিক ক্ষমতাহীনতা মোকাবেলায় ফোকাস করে, যেখানে এই বছরের প্রচারের থিম হল ‘অন্তর্ভুক্তি অনুপ্রাণিত করা।’ ]
(Courtesy : Google)
*******************************************
বর্তমান যুগে নারীরা লেখাপড়া, শিক্ষা-সংস্কৃতি, কর্মক্ষেত্রে, অভিযানে, বিজ্ঞান গবেষণায় প্রভৃতি কোন ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই। এমন অনেক নারীদের কথা আপনারা জানেন, আমিও জানি। আবার এ-ও দেখেছি, বাহ্য জগতের সবক্ষেত্রে কৃতি নারীদের অন্তর্জগতের হাহাকার। মনের মত সন্তান না পাওয়ার জ্বালায়, সন্তানকে মনের মত করে মানুষ করতে না পারার জ্বালায়, থ্যালাসেমিয়া, স্কিজোফ্রেনিয়া, লিউকোমিয়া প্রভৃতি নামের দুরারোগ্য ব্যাধির জ্বালায় জ্বলতে গিয়ে জীবনের সুখ-শান্তির অনুভূতিটা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে।—যেন, ‘সব আছে তবু নেই’। মাতৃত্ব-পিয়াসী একজন সন্তানহীনা নারীর যে কি কষ্ট, কি বেদনা, তা ভুক্তভোগী ভিন্ন কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। একটি সন্তান পেতে সব-রকমের চিকিৎসা করার পরও যখন সন্তান-লাভে ব্যর্থ হয়, তখন অনেক টাকা খরচ করে গর্ভ ভাড়া নেয়, দত্তক সন্তান নেয়।—এমন অনেক কিছু করেন। ওই সব সমস্যার স্রষ্টাও কিন্তু নারী। ‘আত্মানং বিদ্ধি।’-র শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে সব কিছুকে জেনেছে, নিজেকে জানতে পারেনি। নিজের নারীত্বের-পূর্ণতার বিষয়ে জানা হয়ে ওঠেনি।
নারী হতে জন্মে জাতি। নারীই গৃহ, সমাজ ও রাষ্ট্রের ধাত্রী ও পালয়িত্রী। প্রাকৃতিক নিয়মে একজন নারীর চরম পরিণতি মাতৃত্বে। মুখে আমরা যতই নারী-স্বাধীনতার কথা বলি না কেন, এক্ষেত্রে কিন্তু পুরুষের উপর নির্ভরশীল হতেই হয়। (অবশ্য লেসবিয়ান আদর্শে বিশ্বাসীদের কথা আলাদা। তারা অবশ্যই ব্যতিক্রমী।) সেই পুরুষটি মাতৃত্বকামী নারীর তুলনায় শারীরিক-মানসিক-আত্মিকভাবে যত উন্নত হবে,— স্বাস্থ্যবান হবে, ভালো চরিত্রের হবে, নারীটির দাম্পত্য জীবন তত সুখের হবে, সন্তানও ভালো হবে। এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। তাই নয় কি? আর সেগুলো পেতে গেলে বর্ণে, বংশে, বয়সে, স্বাস্থে, শিক্ষায়-দীক্ষায়—সবদিক থেকে উন্নত সম-বিপরীত সত্তার একটা পুরুষকে, ভাবী সন্তানটির বাবাকে খুঁজে নিতে হবে, বিবাহের মাধ্যমে। বিবাহ মানে পুরুষের সত্তাকে বিশেষরূপে বহন করা। যে পুরুষটির কাছে নারীত্বকে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। তাই নির্ঝঞ্ঝাট সুখের দাম্পত্য জীবন পেতে গেলে, ভালো সন্তানের মা হতে গেলে, লেখাপড়া শেখার পাশাপাশি, কুমারী অবস্থা থেকেই একটা পরিকল্পনা করে নিতে হবে। কারণ প্রত্যেক নারীই চায় তার সন্তানটি সুস্থ থাকুক, ভালো হোক, কৃতী হোক। সেগুলো তো আর রেডিমেড পাওয়া যাবে না, আর স্টেজ মেক-আপও দেয়া যাবে না। নিয়ম মেনে অনুশীলন করতে হবে। মা-কেই মেপে মেপে সঞ্চয় করতে হবে ভবিষ্যতের সন্তানের ভালামন্দের সব উপকরণ। মা মানে মেপে দেওয়া। সন্তানের ভালো-মন্দ মেপে দেয় বলেই মা। ভাবী মায়ের চলন-চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত হয় নারী-জননকোষ, অপত্য-কোষ। সেইজন্যই সন্তান ধারন-পালন-লালন-এর জন্য আবশ্যিক প্রত্যঙ্গগুলোকে সযত্নে মেপে মেপে লালন-পালন করতে হবে, সংরক্ষণ করতে হবে ভবিষ্যতের সন্তানের মঙ্গলের জন্য। তা না করে ‘হেটেরো-সেক্সুয়াল’ কমপ্লেক্সের প্রলোভনে পড়ে ওগুলোকে যদি আম-পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করে ফেলা হয়, তাহলে তো ভাবী সন্তানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। যার জন্য সংরক্ষিত জিনিস, আত্মঘাতী উদারতার বশে অন্যকে ভাগ দেবার অপরাধে। এজন্য রোগ-ভোগেও ভুগতে হয়। Oncologist, Gynaecologist, Sexologist, Psychologist-দের শরণাপন্ন হতে হয়। নারী-দিবসকে প্রচার মাধ্যমে আনার জন্য ‘স্যানিটারি ন্যাপকিন’-এর ভেন্ডিং মেশিনগুলো ওই সমস্যা থেকে নারীদের কতখানি মুক্তি দেবে ! বরং পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, সনাতনী নিয়মে সাত্তিক চলন চরিত্রায়িত করে ঋতুধর্ম পালন করেছেন যে-সব নারীরা, তাঁরা ওইসব সমস্যা থেকে মুক্ত।
নারীত্বের বিশুদ্ধতা সংরক্ষিত করে সুসন্তান লাভ করা বিষয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জন্মকথা’ কবিতায় লিখছেন—
খোকা মাকে শুধায় ডেকে, ‘এলেম আমি কোথা থেকে
কোনখেনে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে ?’
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে খোকারে তার বুকে বেঁধে—
‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।।
ছিলি আমার পুতুল খেলায়, ভোরে শিবপূজার বেলায়
তোরে আমি ভেঙেছি আর গড়েছি।
তুই আমার ঠাকুরের মনে ছিলি পূজার সিংহাসনে,
তাঁরি পূজায় তোমার পূজা করেছি।।
আমার চিরকালের আশায়, আমার সকল ভালোবাসায়,
আমার মায়ের দিদিমায়ের পরাণে,
পুরানো এই মোদের ঘরে গৃহদেবীর কোলের ’পরে
কতকাল যে লুকিয়ে ছিলি কে জানে।।’
একটু বোধি-তাৎপর্য দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কবিগুরু তাঁর ওই কবিতায় জেনেটিক্সের, ইউজেনিক্সের, সুরত-সম্বেগের চরম এক তত্ত্বের অবতারণা করেছেন।
একটা উন্নত প্রজাতির আমগাছ লাগাতে গেলেও কিছু প্লান-প্রোগ্রাম নিতে হয়। আগে থেকে জমি নির্বাচন করতে হয়, উপযুক্ত সার দিয়ে জমি তৈরি করতে হয়, তারপর মাটির উপযুক্ত বীজ বা চারা বসাতে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান যুগের বেশিরভাগ লেখাপড়া শিখতে যাওয়া নারীরা, পুরুষের সাথে পা-মিলিয়ে, গলা-মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ‘হোক-কলরব’ আন্দোলনে পারদর্শী হলেও, নিজের আত্ম-বিস্তারের জন্য আবশ্যিক আত্ম-সম্পোষণ, আত্ম-সংরক্ষণ করার জন্য নির্দিষ্ট নারীত্বের অস্তিত্ব রক্ষার জমিটুকুকে সংরক্ষণ করা বিষয়ে উদাসীন। যারফলে কালেক্রমে মনুষ্যত্ব সম্পন্ন অসৎ-নিরোধে তৎপর সন্তান থেকে সভ্যতা বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব রামকৃষ্ণদেব, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র প্রমুখ মনীষীদের জন্মদাত্রীগণ ক্যাম্পাসে, অফিসে, মিটিংয়ে, মিছিলে কোন ‘কলরব’ না করেই, সনাতনী নারীধর্ম পালন করে রত্নগর্ভা হয়েছিলেন। ভারতীয় কৃষ্টি প্রদত্ত প্রকৃষ্ট-গতির পথ ভুলে, তথাকথিত প্রগতির নামে ছুটে চলা নারীবাদিরা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পারেন।
পরিবারকে উন্নতি বা অবনতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী প্রধানতঃ নারী। কথায় আছে, ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে। গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে।।’ আদর্শ একজন পুরুষের সাহচর্যে নারীর হাতেই গড়ে ওঠে আদর্শ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। নারীই হচ্ছে জাতির বল ও ভরসা। লক্ষী নারীদের উপরেই রয়েছে মহান জাতি গঠনের বিরাট দায়িত্ব। মহান আদর্শকে চরিত্রায়িত করে নারী যদি পরিবারকে সুন্দর ও সার্থক করে সাজিয়ে তুলতে পারে তবেই জগত-সংসার সুখের হয়। আদর্শ জাতি গঠন করার দায়িত্ব নারীদের উপর থাকার জন্য তাদের শিশুকাল থেকেই ভালো মা হবার সাধনায় অগ্রসর হতে হবে। নারী জীবনের বিভিন্ন পর্যায় আছে। ওই পর্যায়গুলো ভগ্নি, বধূ, স্ত্রী, জায়া, জননী ও গৃহিনী ও জননীত্ব। ওগুলোকে সমৃদ্ধ নারীরাই করতে পারেন, পুরুষেরা নয়। স্নেহ, মায়া, মমতা ও ভালবাসার দ্বারা পূর্ণ নারীর হৃদয়। নারীরা ইচ্ছা করলেই তাঁর অন্তর্নিহিত বিভিন্ন শক্তির দ্বারা জাগিয়ে তুলতে পারেন বিশ্বকে। নারীর মধ্যে সুপ্তভাবে থাকা গুণরাজিকে ইচ্ছে করলেই ব্যক্ত করা যায় ভালোবাসা বা ভালোতে বাস করার বিজ্ঞানসম্মত পাঠ নিয়ে। যারা প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞানকে মানতে আগ্রহী, তাদের নারীত্বকে সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রদত্ত কিছু জ্ঞানের কথা পরিবেশন করছি। চিন্তা-ভাবনা করে দেখে ভালো লাগলে মানবেন, না-হয় মানবেন না।
যদিও বেভুল-তালে চলতে অভ্যস্ত নারীবাদিরা সহজে মেনে নিতে চাইবেন না শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জীবনীয় অনুশাসন বিধিগুলোকে, তথাপি তাঁর নিদেশগুলো তুলে ধরলাম। বলা যায় না, আপনাদের মধ্যে কেউ না কেউ জেনে-বুঝে মননশীলতায় স্থান দিয়ে কাজে লাগাতে চেষ্টা করতেও তো পারেন। সেই আশা নিয়ে।
।। নারী-জীবনকে সার্থক করার আদর্শ শিক্ষা বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতবাদ ।।
ছেলেমেয়ে এক-যোগেতে
করলে পড়াশোনা
পড়ার সাথে বাড়ে প্রায়ই
কামের উপাসনা।
কুমারী একটু বড় হলেই
পুরুষ ছুঁতে নেই,
যথা সম্ভব এর পালনে
উন্নয়নের খেই ।
পরের বাবা পরের দাদা
পরের মামা বন্ধু যত
এদের বাধ্যবাধকতায়
সম্বন্ধটি যাহার যত
অনুরোধ আর উপরোধে
ব্যস্ত সারা নিশিদিন
কামুক মেয়ে তাকেই জানিস
গুপ্ত কামে করছে ক্ষীণ ।
বিয়ের আগে পড়লে মেয়ে
অন্য পুরুষে ঝোঁকের মন
স্বামীর সংসার পরিবার
করতে নারে প্রায়ই আপন ।।
পুরুষ নষ্টে যায় না রে জাত
নারী নষ্টে জাত কুপোকাত ।
নারী হতে জন্মে জাতি
থাকলে জাত তবেই জাতি ।
না মানালে হবেই ক্ষতি ।
ওই ক্ষতি থেকে আমাদের মুক্তির সোপান-পথ দেখালেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
সত্যম্-শিবম্-সুন্দরম্। সত্যই শিব, শিবই সুন্দর। সত্য মানে অস্তিত্ব। পরিবেশের সব অস্তিত্বের পালন-পোষণ করে এই সুন্দর পৃথিবীর সুন্দরত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার বাস্তব প্রক্রিয়ার নাম শিবপূজা। পূজা মানে সম্বর্দ্ধনা—সম্যকরূপে বর্দ্ধনার পথে চলা।
শিব একাধারে সার্থক যোগী, সন্ন্যাসী, নটরাজ। আবার গৃহস্থরূপে দেবী পার্বতীর স্বামী। গণেশ এবং কার্তিক দুই পুত্রের পিতা। সে-সব দিকগুলো বিচার করে শিবকে যোগ, ধ্যান ও শিল্পকলার দেবতা মনে করা হয়। কিছু গবেষণায় জানা যায় শিব নাকি চিকিৎসা বিদ্যার জনক ছিলেন। কৃষিবিদ্যার আবিষ্কারকও ছিলেন। নট-নটীরা শিবকে নটরাজ বলে পূজা করেন। রামায়ণে বর্ণিত, সংস্কৃতে রচিত শিব-বন্দনার ‘তাণ্ডব-স্তোত্র’ আর্য্যকৃষ্টিতে বন্দিত। পরমপুরুষ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তাঁর ভাববাণীতে বলেছেন।—‘‘তাণ্ডব-স্তোত্র মুখস্থ করিস্, এ্যাজমা সারবে।’’
শিবের পূজা বা আরাধনার নিমিত্ত যতগুলো প্রতিষ্ঠিত মন্দির রয়েছে, সে-সব মন্দিরগুলোতে শিবলিঙ্গকেই পূজা করা হয়। শিবলিঙ্গের সৃষ্টির বিষয়ে শাস্ত্রগুলোতে নানা মতভেদ রয়েছে। সবগুলোতেই রিরংসার নীলজল মেশানো আছে। সেগুলো থেকে নারদ পঞ্চরাত্রে বর্ণিত কাহিনী যেন একটু ফিকে, গ্রহণযোগ্য। নারদ পঞ্চরাত্র মতে শিব-পার্বতির প্রথম মিলনের সম্মিলিত তেজ থেকে উৎপন্ন হয় শিবলিঙ্গ। শিবলিঙ্গ-এর বেষ্টনীকে বলে গৌরীপট্ট। গৌরীপট্ট শিবলিঙ্গের আধার, জগতের যোনি। যোনি-সম্ভূত সৃষ্টি প্রকরণের প্রতীক হিসেবে মানা হয় শিবলিঙ্গকে। এর অন্তর্নিহিত অর্থ, পুরুষেরা শিবলিঙ্গকে প্রতীক রূপে মেনে, শিবের ন্যায় আদর্শ পিতা হবার নিমিত্ত তাদের প্রজন্ম সৃষ্টির উপাঙ্গ জননেন্দ্রিয়কে ব্যবহার করবেন, আর নারীরা গৌরীপট্টকে প্রতীক রূপে মেনে, গৌরীর ন্যায় আদর্শ মাতা হবার নিমিত্ত প্রজন্ম সৃষ্টির উপাঙ্গ জননেন্দ্রিয়কে ব্যবহার করবেন।
আমাদের ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের সাথে শিব অনেকটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামেও একটা না একটা শিবমন্দির দেখা যায়। যারা দৈনন্দিন জীবনে আর্যকৃষ্টির নিত্যকর্ম পদ্ধতির সদাচার, বর্ণাশ্রমধর্ম পালনে অভ্যস্ত নয়, তারাও সোমবার, শ্রাবণ মাস, চৈত্র মাস-এর পার্বনের দিনগুলোতে শিবলিঙ্গে ফুল-জল-বেলপাতা দিয়ে তথাকথিত পুজো করেন। শ্রাবণ মাস শিবের জন্মমাস হিসেবে পালন করেন অনেক ভক্ত। বাঁকে করে জল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দিরগুলোতে গিয়ে অনেক কসরৎ করে শিবলিঙ্গে জল ঢালতে যান। তাদের সেবা করার জন্য রাস্তার ধারে ধারে প্যাণ্ডেল করে, তারস্বরে মাইক বাজানো হয়। অনেক সাধকেরা আবার ‘ভোলে-ব্যোম’ ধ্বনি দিয়ে গঞ্জিকা, ভাঙ্-এর মৌতাতে শিবত্ব লাভ করতে চান। টিভি সিরিয়ালগুলোতেও শিবকে সিদ্ধিখোর, গাঁজাখোর হিসেবে তুলে ধরা হয়। শিব ছিলেন একজন পরমবৈষ্ণব, সিদ্ধ-পুরুষ, তাঁকে সিদ্ধিখোর, গাঁজাখোর না বানালেই কি চলছিল না!
তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া চলে আমাদের হিন্দু নারীদের শিবরাত্রির উপবাসকে। শুনেছি অনূঢ়া বা কুমারী মেয়েরা শিবের মতো স্বামী পাবার আশায় (অবশ্য বাস্তবে আমাদের কল্পনার শিবের মত,—বাঘছাল পরে, গলায় সাপ জড়িয়ে, ষণ্ডের পিঠে চেপে, কোন পুরুষ যদি স্বামীরূপে উপস্থিত হয়, তখন কি হবে?), কুমার পুরুষেরা (যদিও সংখ্যায় অনেক কম) গৌরীর মতো স্ত্রী লাভের আশায় শিবরাত্রির উপবাস করেন। আর বিবাহিতা মহিলারা কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীর ন্যায় সন্তান লাভ করে সুখে-শান্তিতে ঘর-সংসার করার আশায় শিবরাত্রির উপবাস করেন।
ওই আশাগুলোকে পূরণ করতে হলে শুধুমাত্র শিবরাত্রির উপবাস করলেই তো আর হবে না। উপ মানে নিকটে, বাস মানে অবস্থান। শিব-পার্বতীর আদর্শে নিত্য অবস্থান করতে হবে। আর সেজন্য সদগুরু গ্রহণ করতে হবে। শাস্ত্রানুসারে গুরু গ্রহণ না করা পর্যন্ত কোন দেবদেবীর পূজা করার অধিকার জন্মায় না।
পুরাণ অনুসারে গিরিরাজ দুহিতা উমা ছোটবেলা থেকেই ভক্তিমতী। শিবের ভক্ত। পণ করেছেন, শিবকে ছাড়া অন্য কাউকেই বিয়ে করবেন না। বাবা-মা-পরিজনেরা কত করে বোঝাল, শিবকে বিয়ে করলে আর কষ্টের শেষ শেষ থাকবে না। বাপের বয়সী, কাজকর্ম করে না। নারায়ণের ভুতের বেগার খেটে মরে। (অর্থাৎ, নারায়ণী-বার্তা যাজন করে প্রাণী নামক ভুতদের উন্নয়ন করে বেড়ান।) তথাপি উমা কিন্তু কারোর কথায় কান না দিয়ে, সৎ-স্বভাবে পরান পাগল, জ্ঞানবৃদ্ধ, বয়োবৃদ্ধ শিবকেই পতিত্বে বরণ করেন।
উমা বা পার্বতী, স্বামীকে মাথায়, অর্থাৎ জীবনের কেন্দ্রে রেখে, স্বামীর মনোবৃত্ত্যানুসারিনী স্ত্রী হয়ে সুসন্তানের মা হয়েছেন, মা হয়েছেন আমাদের, জগতের। উমা-মাকে আমরা দেবীর চাইতে অনেকটা বেশি করে ঘরের মেয়ে হিসেবে বরণ করে নিয়েছি। এই মর্ত্তধামের প্রতিটি ঘর তাঁর বাপের বাড়ি। তাই বাস্তব জীবন-চলনায় যদি শিব-গৌরীর ন্যায় আমাদের ভালোবাসার পবিত্র দাম্পত্যের পূজা-জাত কন্যারূপী সন্তানটিকে উমার মত করে, পুত্ররূপী সন্তানটিকে শিবের মত করে সৃষ্টি করতে পারি, তা হলেই তো ষোল-কলায় পূর্ণ হবে আমাদের শিব আরাধনা।
অবক্ষয় আমাদের দরজায় যতই কড়া নাড়াক না কেন লর্ড মেকলে সাহেবের দাক্ষিণ্যের দৌলতে আমাদের সমাজে শিক্ষিত হবার প্রবণতার হার কিন্তু ক্রমশঃ বর্দ্ধমান। আর্য্য-হিন্দু কৃষ্টির দশবিধ সংস্কারভুক্ত চূড়াকরণ, উপনয়ন প্রমুখ জীবনীয় সংস্কার ভুলে গেলেও মুখে বুলি ফুটতে না ফুটতেই সন্তান-সন্ততিদের লেখাপড়া শেখাতে এতটুকু কার্পণ্য করি না আমরা। এ বিষয়ে বাবাদের চাইতে মায়েদের আগ্রহ একটু বেশীই। লেখাপড়া শেখাতে স্কুলে ভর্তি করে, একাধিক প্রাইভেট টিউটর রাখে, পাশাপাশি হোম-ওয়ার্ক না করতে পারলে ‘মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বার করে দেব, মেরে ফেলব, কেটে ফেলব’ ইত্যাদি বিশেষণের শাসনবাক্যে যুগধর্মের শিক্ষায় সন্তানদের শিক্ষিত করতে মায়েরা যেভাবে পরিশ্রম করে চলেছেন তার তুলনা হয় না! লেখাপড়া মানেই বিদ্যার্জন করা। বিদ্যার্জন করতে স্কুল, টিচার, বই-খাতা-কলম ইত্যাদি আনুসঙ্গিকের পাশাপাশি বিদ্যাদেবীর আরাধনাটাও আবশ্যিক! তাই উত্তরায়ন-সংক্রান্তি পরবর্তী শুক্লা-পঞ্চমী বা শ্রীপঞ্চমী তিথিকে কেন্দ্র করে ঘরে-ঘরে, বিদ্যালয়ে-বিদ্যালয়ে, পাড়ার ক্লাবে, রাস্তাঘাটে সরস্বতী পুজোর সাড়া পড়ে যায়। এমনিতে একটু বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকা পড়ুয়ারাও সেদিন সকাল-সকাল উঠে নিম-হলুদ মেখে স্নান সেরে নেয়। (নিম-হলুদ মাখলে শরীরের রোগ-প্রতিরোধী শক্তি বৃদ্ধি পায়।) তারপর সেজেগুজে যে-যেখানে সুবিধা পায় আগেভাগে অঞ্জলি দেবার কাজটা সেরে নিতে বিদ্যাদাত্রী সরস্বতীর প্রতিকৃতির সামনে কঠিন বিষয়ের বইপত্রগুলো জমা দিয়ে অপেক্ষায় থাকে কতক্ষণে পুরুতঠাকুর অঞ্জলি দেবার জন্য ডাকবেন। অঞ্জলি দেওয়া শেষ করে সরস্বতী-ঠাকুরের কাছে পাশ করার আর্জিটা জানিয়ে, প্রসাদ খেয়ে পুজোর মুখ্যপর্বটা শেষ করে গৌণপর্বে প্রবেশ করে। কচিকাচারা পরিজনদের হাতধরা হয়ে, কিশোর-কিশোরীরা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বিদ্যালয়ে যায়, খাওয়া-দাওয়া হয়। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুড়ি ওড়ানো, দল বেঁধে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দেখে বেড়ানো। বড় হয়ে ওঠার সোপানে পা-রাখা হেটেরো-সেক্সুয়াল কমপ্লেক্সের অবদানের টেস্টোটেরন হরমোন-প্রপীড়িত ওভারস্মার্ট ছাত্ররা, ফলিকল-স্টিমুল্যাটিং হরমোন-প্রপীড়িত ওভারস্মার্ট ছাত্রীরা পছন্দের জনকে প্রপোজ করার সুযোগ খোঁজে, কেউ আবার একটু ঘনিষ্ট সান্নিধ্য পেতে চায় ভ্যালেনটাইন-উইক কালচারে সমৃদ্ধ হতে। সকাল থেকেই মাইকে চটুল গান বাজছে পাড়ায়, রাতে হবে মাংস-ভাতের পিকনিক। শুধু পাড়াতেই নয় সরকার পরিপোষিত অনেক প্রাথমিক বিদ্যোলয়েও (যেখানে হিন্দু শাস্ত্রমতে বিদ্যালাভের পরিপন্থী, অভক্ষ্য ডিম সহযোগে ছাত্রদের মিড-ডে মিল খাওয়ান হয়।) পুজোর দিনটির পবিত্রতা বজায় রেখে পরেরদিন মাংস-ভাতের পিকনিক করা হয়েছে। আসছে বছর আবার হবে!—কি হবে ?
‘‘ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ-বিদ্যাস্থান্যেভ্যঃ এব চ।। ……’’ পুরোহিতের বলা ইত্যাদি মন্ত্র অনুসরণ করে পুষ্পাঞ্জলি দিতে হবে।
‘‘জয় জয় দেবী চরাচর সারে কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে।
বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে ভগবতী ভারতি দেবী নমোহস্তুতে।।
(কোন পণ্ডিত উক্ত মন্ত্র রচনা করেছিলেন আমি জানি না । তবে এটুকু বুঝি, যে স্তনযুগল মাতৃত্বকে সমৃদ্ধ করার জন্য সৃষ্ট, বৃত্তিতন্ত্রীদের সুড়সুড়ি দিতে তাকে মুক্তার হারের আভরণে সজ্জিত না করলেই ভাল করতেন। কারণ বিদ্যালাভ মস্তিকের মেধানাড়ীতে সুপ্ত মানবিক-সাত্ত্বিক গুণের অনুশীলনে সম্পাদিত হয়, বক্ষ-সৌন্দর্যের সজ্জিত বিজ্ঞাপনে নয়।)
ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্বি বিদ্যাং দেহী নমোহস্তুতে।।’’— পুরোহিতের বলা ইত্যাদি মন্ত্র অনুসরণ করে প্রণাম জানাতে হবে। …….তারপর সেই,—খাওয়া-দাওয়া, হৈ-হুল্লোর— ছোটদের বড় হবার রিহার্সাল, বড়দের নস্টালজিয়ার স্মৃতিচারণ ……. আসছে বছর আবার হবে!
ওইসব উচ্চারিত মন্ত্র অনুযায়ী দেবী সরস্বতীই বিদ্যাদাত্রী, তাকে সাধনা করতে পারলেই বিদ্যার সিলেবাস বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ জ্ঞাত হওয়া যাবে। খুব ভালো কথা। সাধনা দিয়েই তো সিদ্ধি পেতে হবে।
* * * * * *
মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী আমরা যা বলি বা সংকল্প করি বাস্তবে তা যদি না করি স্নায়ুমন্ডলীতে জটিলতার সৃষ্টি হয়, আধ্যাত্মিক জগতে যাকে অনাগত প্রারব্ধ কর্মফল বলে। অথচ আমাদের শিক্ষকেরা এই পূজার দিনটিতে অঞ্জলিমন্ত্র, প্রণামমন্ত্র আওড়ানো ব্যতীত বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ শিক্ষা বিষয়ে ছাত্রদের উৎসাহ না দিয়ে প্রচলিত সিলেবাসের বিষয়ভিত্তিক খাতাবই কেনা, নোট কেনা, কোচিং-করানোর দিকে উৎসাহ দেয়। বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ জিনিসটা যে কি বেশিরভাগ পড়ুয়ারা জানেই না, অথচ শিক্ষার আবশ্যিক বিষয় জ্ঞানে বাধ্যতামূলকভাবে বছর-বছর আবৃত্তি করে চলে, সরস্বতী পূজার দিনটিতে। এর নাম দ্বন্দ্বীবৃত্তি, অর্থাৎ মুখে যা বলছি, কাজে তা করছি না। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতে যা মহাপাপের কারণ।
* * * * * *
সংস্কৃত বিদ্ִ ধাতু থেকে বেদ এবং বিদ্যা শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ জ্ঞান, বিচরণা, অস্তিত্ব, প্রাপ্তি। বিদ্যা লাভ যার হয়, অস্তিত্ব বজায় রাখার জ্ঞান তার হয়। তার বিচারশক্তি হয়, জীবনচলনায় ভালটাকে বেছে নিয়ে সে এগিয়ে চলে মূল প্রাপ্তি বা গন্তব্যের দিকে। যার চরম ঈশ্বরপ্রাপ্তি। ভাষাবিদ জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস মহোদয় কৃত অভিধানানুসারে, ‘‘যদ্দারা ব্রহ্ম হতে ব্রহ্মান্ড পর্য্যন্ত যাবতীয় পদার্থের সত্যবিজ্ঞান লাভ হইয়া যথাযোগ্য উপকার প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহাই বিদ্যা ; যদ্দারা অক্ষর পুরুষকে জানা যায়।’’ ওই বিদ্যায় বিদ্বান হয়ে ছাত্রদের জানাবার কাজটি যিনি করেন তিনি শিক্ষক বা আচার্য্য।
বেদ বা জ্ঞান-এর দুটো দিক, আধ্যাত্মিক ও জাগতিক। যা জানলে মানুষের জীবনের পূর্ণতা লাভ হয়, বিদ্যা লাভ হয়। বেদের বিদ্যা দু প্রকার পরা ও অপরা। শিক্ষা (phonetics), কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ, জ্যোতির্বিদ্যা (astronomy) ও নিরুক্ত (শব্দতত্ত্ব) ইত্যাদি নামের বেদের ৬টি শাখার নাম বেদাঙ্গ। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ্ নামে বেদকে চারভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যার অন্ত ভাগের নাম বেদান্ত বা উপনিষদ। ‘আত্মানং বিদ্ধি’ (Know Thyself,— who am ‘I’ ?) অর্থাৎ নিজেকে জানার চেষ্টার পাঠক্রমকে বলা হয়েছে পরাবিদ্যা। পরাবিদ্যার পাঠক্রমে আমাদের শিক্ষক আর্য-ঋষিগণ বলেছেন, ‘‘যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি।/সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।।’’ (ঈশোপনিষদ) অর্থাৎ, যিনি নিজের আত্মাকেই সর্বাত্মারূপে উপলব্ধি করেন, তিনি কাহাকেও ঘৃণা করেন না। সর্বভূতে নিজেকে, নিজের মধ্যে সর্বভূতকে উপলব্ধি করেন। কেননাক, আর্য্য হিন্দু শাস্ত্রমতে আমরা মানুষেরা ঐহিক জগতে দ্বৈত ভাবে অসম্পৃক্ত হয়েও সেই এক পরমাত্মার সাথে সম্পৃক্ত।
আবার তৈত্তরীয় উপনিষদের বিদ্যা দানের শান্তি পাঠে রয়েছে, ‘‘ওঁ সহ নাববতু। সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্য করবাবহৈ। তেজস্বি নাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।’’ যার মর্মার্থ হলো, আমরা (আচার্য্য ও বিদ্যার্থী উভয়ে) সহমত হয়ে চলব, প্রকৃতির উপাদান সকলে স-মান (Equitable) ভাবে ভাগ করে জীবন ধারণ করব। কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করব না। আর অপরাবিদ্যার বিষয় ছিল জাগতিক শিক্ষা, যা ৬৪ কলা বিদ্যার মধ্যে নিহিত ছিল। (অন্তরাসীজন ৬৪ কলাবিদ্যার সিলেবাস জানতে আগ্রহী হলে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস মহোদয়ের অভিধানে ‘কলা’ সবিশেষ পাঠ করে দেখতে পারেন। তা হলেই বুঝতে পারবেন বিদ্যা কাকে বলে।) পরাবিদ্যার শিক্ষকদের বলা হতো আচার্য্য আর অপরাবিদ্যার শিক্ষকদের উপাচার্য্য (তৈত্তিরীয় উপনিষদ)। বর্তমানের শিক্ষা ব্যবস্থায় সরস্বতী আরাধনা মন্ত্রক্তো বেদ-বেদান্ত-বেদান্তের সাথে বাস্তব সখ্যতা না থাকলেও বিদ্যার সাথে সম্পৃক্ত আচার্য্য এবং উপাচার্য্য শব্দদ্বয়কে এখনো বিদায় দেওয়া যায় নি।
* * * * * *
আমাদের বর্তমান যুগ যে যুক্তিবাদী সে কথা কোন চিন্তাশীল ব্যক্তি অস্বীকার করবেন না আশাকরি। যেমন, সন্তানের হয়ে মা খেলে সন্তানের পেট ভরবে না। ছাত্রের হয়ে শিক্ষক লেখাপড়া করলে ছাত্র পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে না। তেমনি বিদ্যালাভের জন্য বিহিত সাধনা না করে পুরোহিতের বলে দেওয়া দেবী সরস্বতীর অঞ্জলিমন্ত্র আওড়ালে বিদ্যার্থীদের বিদ্যা বা ঈপ্সিত ফললাভ হবে কি ?
অবশ্য পুরোহিতও জানেন না ফললাভের বিষয় সম্পর্কে। যদি জানতেন প্রতিমা-বিসর্জন মন্ত্রে বলতেন না—ওঁ আবাহনং ন জানামি, নৈব জানামি পূজনম্। বিসর্জনং ন জানামি ক্ষমস্ব পরমেশ্বরি ।–অর্থাৎ আমি আবাহনও জানিনা, বিসর্জনও জানিনা, আমাকে ক্ষমা করুন। (দ্রঃ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা)
বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকার মত অনুযায়ী পূজ্য-প্রতিমা চঞ্চল চিত্তের ধারণের জন্য একটি অবলম্বন। প্রতিমাকে ব্রহ্মের রূপ কল্পনা করে উপাসনা, সংযম, সাত্তিক আহার, সাত্তিক বিহার ইত্যাদি ক্রিয়াকাণ্ডের মাধ্যমে পূজা করা হয়।–যাতে পূজক বা উপাসক মনসংযোগ দ্বারা প্রতিমাকে হৃদয়ে ধারণ করে প্রতিমার গুণে গুণান্বিত হতে পারে। এই হলো প্রতিমা পূজার মূল কথা।
* * * * * *
আমাদের আলোচ্য দেবী সরস্বতী প্রতিমার চরণ পদ্মের উপর ন্যস্ত, এর দ্বারা সৃষ্টির বিবর্ত্তনের কথা রূপকে বর্ণিত হয়েছে। মা সরস্বতী হংসের উপর উপবিষ্ট। হংস পরমাত্মার প্রতীক। বীণা থেকে নাদ বা ধ্বনি উৎপন্ন হয়, তাই বীণা সুরত-শব্দযোগের প্রতীক । পুস্তক বা গ্রন্থ বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমের প্রতীক। দেবীর শুক্লবর্ণ সাত্তিকতার প্রতীক। পদ্ম, হংস, বীনা, পুস্তকাদি সজ্জিত শ্বেতবসনা দেবী সরস্বতীর উপাসনার বিষয় তাহলে বিদ্যা, ব্রহ্ম, পরব্রহ্ম, সৃষ্টিতত্ত্ব ইত্যাদি হওয়া উচিত। প্রতিমার অলঙ্কারের ওই গুণগুলোর সিলেবাস জানার পরে তো উপাসনার দ্বারা গুণান্বিত হবার প্রশ্ন! সেই সিলেবাসগুলো দেবী সরস্বতী কোন্ পুস্তকে, কোন্ সংহিতায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, সে বিষয়ে বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকা কোথাও কিছু বলে গেছে কিনা আমি জানি না। যদি কেউ জানেন দয়া করে জানালে বাধিত হব। তবে এটুকু জেনেছি, পরব্রহ্মের ব্যক্ত-প্রতীক ‘‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা’’ —‘‘তমসার পার অচ্ছেদ্যবর্ণ মহান পুরুষ ইষ্টপ্রতীকে আবির্ভূত’’ হয়েছেন যিনি, তিনি ওই সব বিষয়ের খুঁটিনাটি জানেন এবং সবাইকে জানিয়েও দিয়েছেন বিবিধ স্মৃতি এবং শ্রুতি বাণীর মাধ্যমে। যিনি মানুষের জীবনের বেঁচে থাকা ও বৃদ্ধি পাওয়ার জীবন্ত আদর্শ স্বরূপ। যিনি পঞ্চবর্হি ও সপ্তার্চ্চি মাধ্যমে সব দেবতার, সব আরাধনার, সব পূজার, সব বিদ্যার সূত্র সন্নিবেশিত করেছেন। যাঁর উপাসনা বাদ দিয়ে কোন পুতুল পূজা করে কোন কিছুই জ্ঞাত হওয়া সম্ভব নয়। তাঁর নাম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। যারজন্য সদদীক্ষার শুভ মুহূর্তে ‘‘ওঁ ব্রহ্ম পরব্রহ্ম ও কুলমালিক ……’’ মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে বাহ্যপূজার বিষয়ে উল্লেখ্য পরব্রহ্ম-এর প্রকৃত তত্ত্বকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
* * * * * *
বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকার মত অনুযায়ী সততা, সংযম, ন্যায়নীতি ইত্যাদি মানবিক গুণগুলোর প্রবহমানতাকে বৎসারান্তিক নবীকরণ করার জন্যই বাহ্যপূজা বা মূর্তিপূজা উদযাপনের উদ্দেশ্য। বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সরস্বতী পূজাই শুধু নয়, সব পূজার নামে হুজুগে মেতে আহার-বিহারে একটু বেশী করে অসংযমী হয়ে পড়ি আমরা। নাহলে সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যেও মাংসের দোকানে লাইন পড়ে যায়, যা হিন্দু শাস্ত্রে অভক্ষ্য, নিষিদ্ধ খাবার। যা খেলে আয়ুক্ষয় হয়। হিন্দুদের প্রামাণ্য গ্রন্থ মনু সংহিতা অনুযায়ী ‘মাং’ মানে আমাকে ‘স’ মানে সে, অর্থাৎ আমাকে সে খেলে আমিও তাকে খাব। আর আমরা ধর্ম পালনের অজুহাতে, পূজার অজুহাতে শাস্ত্রবিরোধী আচরণ করে হিন্দুত্বের বড়াই করতে চাইছি। এরফলে অহিন্দুরা আমাদের ওপর আঙুল তুলতে সাহস পাচ্ছে।
* * * * * *
ভাষা-বিজ্ঞান অনুযায়ী পূজা মানে পূরণ করা, সম্বর্দ্ধিত করা। যে আচার-আচরণ সাত্তিক জীবন-বর্দ্ধনার অভাবকে পূরণ করে, পরিবেশের জৈবাজৈব সবকিছুকে সম্যকরূপে বর্দ্ধিত করে, তার নাম পূজা। ‘শ্রেয়-সৃজনী সংহতি ও সমাবেশ’ যা, তার নাম উৎসব। আর যে আচার-আচরণ জীবনবৃদ্ধিকে নন্দিত করে তার নাম আনন্দ। এখন প্রশ্ন, আমাদের প্রচলিত পূজা, উৎসবের উদযাপন বৃহত্তর পরিবেশকে কতখানি নন্দিত করে ‘পূজা’ শব্দের যথার্থতাকে উপহার দিতে পেরেছে ? –এইসব বিষয়ে সত্তাপিয়াসী চিন্তাশীলদের চিন্তা করে দেখা উচিত। বিশেষ করে যাঁরা কুসংস্কার বিরোধী রূপে নিজেদের বোধ ও বোধিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।
* * * * * *
পূজা বিষয়ে হিন্দুদের প্রামাণ্য গ্রন্থগুলো কি বিধান রেখে গেছে, বাহ্য-পূজাবাদীদের তা একবার জেনে নেওয়া দরকার।
‘মহানির্ব্বাণতন্ত্র’ নামক তন্ত্রশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছেঃ
‘‘উত্তমো ব্রহ্মসদ্ভাবো ধ্যানভাবশ্চ মধ্যমঃ।
অধমস্তপোজপশ্চ বাহ্যপূজাহধমাধমঃ।।’’
ওই মহানির্ব্বাণতন্ত্রকে সমর্থন করে ‘ভারতে বিবেকানন্দ’ গ্রন্থের ৩৩৬ পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘সকলস্থলে ব্রহ্মদর্শন সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট। ধ্যান মধ্যম, স্তুতি ও জপ অধম, বাহ্যপূজা অধমেরও অধম।’’
‘‘যে-ব্যক্তি সর্ব্বভূতব্যাপী ঈশ্বরকে ত্যাগ করিয়া মূর্খতাবশতঃ প্রতিমার পূজা করে, সে ভস্মে হোম করে।’’ –শ্রীমদ্ভাগবত। ৩-২৯-২২
“ঈশ্বরঃ সর্ব্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জ্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্ সর্ব্বভূতানি যন্ত্ররূঢ়ানি মায়য়া।।“
–গীতা, ১৮। ৬৫
“যিনি এই সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহার নিজের স্বধর্মানুরূপ নিষ্কাম কর্মাচরণ দ্বারা (বাক্য বা ফুলজল দ্বারা নহে) পূজা করিয়া মানুষ সিদ্ধি লাভ করে । স্বধর্মানুরূপ (বর্ণানুগ সত্তাধর্ম পালন) নিষ্কাম কর্মই পরমেশ্বরের পূজার ডালি ।” (গীতা ১৮।৪৬)
“যে ব্যক্তি সর্বভূতব্যাপী ঈশ্বরকে ত্যাগ করিয়া মূর্খতাবশতঃ প্রতিমার পূজা করে, সে ভস্মে হোম করে ।“ (শ্রীমদ্ভাগবত ৩।২৯।২২)
* * * * * *
তাই একটা প্রশ্ন স্বভাবতঃই জাগে, বিদ্যার্জনের জন্য আমরা যদি বাহ্যপূজার ডালি সাজিয়ে দেবী সরস্বতীর উপর সত্যিসত্যিই নির্ভরশীল হতে পারতাম, তাঁকে বিশ্বাস করতাম, তাঁর প্রতি নিষ্ঠা থাকত, তাহলে বিদ্যা লাভের জন্য তাঁকে নিয়েই পড়ে থাকতাম। প্রভূত অর্থ ব্যয় করে, একে-ওকে ধরাধরি করে স্কুল-কলেজে ভর্তি হয়ে, বিষয় ভিত্তিক প্রাইভেট টিউটরের কাছে টুইশন নিতে যেতাম না, পরীক্ষার হলে অসদুপায়ের আশ্রয় নিতাম না। কারণ, এ-তো দ্বন্দ্বীবৃত্তি, বিশ্বাসকে অপমান করা। অবশ্য না করে উপায়ও তো নাই! বর্তমানের মোবাইল প্রীতির যুগে, প্রতিমা-পূজায় বিশ্বাসী এমন কি কাউকে পাওয়া যাবে,— যিনি পুরোহিতকে কিছু দক্ষিণা দিয়ে তার সাধের মোবাইলের প্রতিকৃতি বা প্রতিমার পুজো করিয়ে মোবাইলের সব ফিচার উপভোগ করতে পারবে, ডাউনলোড-আপলোড করতে পারবে, হোয়াটস্ অ্যাপে ছবি পাঠাতে পারবে? প্রতিমা-পূজায় বিশ্বাসী এমন কোন মেয়ে পাওয়া যাবে, যে তার পছন্দের বর-এর ছবি বা কাট্-আউট পুজো করিয়ে মা হতে পারবে, সুখের দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে পারবে? যদি পারে তাহলে পুরোহিতকে দক্ষিণা দিয়ে সরস্বতী প্রতিমার পূজা করিয়ে বিদ্যা লাভ সম্ভব! নচেৎ কোন পুতুল পুজো করার আগে একটু বোধ-বিবেককে কাজে লাগাতে হবে।
* * * * * *
বাস্তব বোধের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার-বিবেচনা করলে দেখা যাবে, সরস্বতী পূজার ওই মন্ত্রগুলোই শুধু নয়, আমাদের সব কথাই বাক্ হয়ে স্ফূরিত হয় বলে সরস্বতী বাগ্দেবী রূপে কল্পিত হয়েছেন। অতএব যুক্তি বা বিজ্ঞান অনুযায়ী দেবী সরস্বতী মেধানাড়ীতে সুপ্ত, কণ্ঠে এবং কলমে ব্যক্ত। একাগ্রতার অনুশীলনে মেধানাড়ী জাগ্রত না করতে পারলে, অর্থাৎ স্মৃতি যদি কাজ না করে মুখস্থ বলা যাবে না, লেখাও যাবে না। মেধানাড়ী ধ্রুবাস্মৃতির কাজ করে। উপনিষদে বর্ণিত আছে, আহার শুদ্ধৌ সত্ত্বাশুদ্ধিঃ, সত্ত্বাশুদ্ধৌ ধ্রুবাস্মৃতি …… । তাই, বিদ্যা লাভ করতে হলে মেধানাড়ীকে জাগ্রত রাখতে হবে। আর, মেধানাড়ীকে জাগ্রত রাখতে হলে সদাচার এবং বর্ণাশ্রমানুগ জীবন-যাপন—আহার-বিহার, জৈবিক তাগিদ পূরণ, জীবিকার্জন ইত্যাদি ইত্যাদি আহরণসমূহকে শুদ্ধ রাখতে হবে খেয়ালখুশীর প্রবৃত্তি-পরায়ণতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে।
বেদবিৎ আচার্য্যের বিধানকে উপেক্ষা করে শিক্ষার নামে, বিদ্যার নামে প্রবৃত্তি-পরায়ণতার বিধি-ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থায় বা সরস্বতীর মূর্তি পূজা করে যদি প্রকৃত বিদ্যা লাভ হতে পারতো, তাহলে তথাকথিত বিদ্যালয়গুলো থেকে অনেক অসৎ-নিরোধী আদর্শবান, বিদ্বান, শ্রদ্ধাবান, চরিত্রবান মানুষের সৃষ্টি হতে পারতো। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যকে ঘেরাও করে ‘হোক কলরব’ সংগঠিত হতো না। ‘মা বিদ্বিষাবহৈ’-এর দেশের বিদ্যালয়ে ছাত্র-রাজনীতির নামে মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ দেখতে হতো না। এসব উল্লেখ করার কারণ, বর্তমানে দুর্নিতীপরায়ণ মানুষদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যাঁরা একসময় বিদ্যাদেবীর আরাধনা করে সমাবর্তন মাধ্যমে আচার্য্য বা উপাচার্য্য স্বাক্ষরিত বিদ্বান আখ্যা বা শংসাপত্র বা ডিগ্রী নিয়েছেন! তাঁদের কি বিদ্বান বলা যাবে ?
অথচ এই ভারতবর্ষের রত্নাকর দস্যু সরস্বতীর কোন মূর্তি-পূজা না করেই, আহত-নাদ মর্যাদা-পুরুষোত্তম ‘রাম’-নামের (ম-রা, ম-রা, ম-রা ……..=রাম) সাধন করে দেবী সরস্বতীকে মেধানাড়ীতে জাগ্রত করে হয়েছিলেন বাল্মীকি।
* * * * * *
একদা তমসা নদী থেকে স্নান সেরে ফিরছিলেন। এক তরুশাখে ক্রৌঞ্চ-জুটি পরস্পর খেলছিল। এক ব্যাধ পুরুষ পাখিটিকে তীর মেরে হত্যা করলে স্ত্রী পাখিটি করুণ বিলাপ করতে থাকে। বাল্মীকি বিচলিত হয়ে ‘কোনদিন প্রতিষ্ঠা পাবে না’ বলে ব্যাধকে অভিসম্পাত করেন। সেই অভিশাপ বাণী স্বতঃস্ফূর্ত শ্লোকবদ্ধ হয়ে নির্গত হয়েছিল :–‘‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ/যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকম্ অবধী কামমোহিতম্।’’ এই শ্লোকটিকে পৃথিবীর সারস্বত সাধকেরা আদি শ্লোক বলে মান্য করেন। অতএব, সারস্বত সাধনার মূল বিষয় মস্তিষ্কে সুপ্ত থাকা মেধানাড়ী বা স্মৃতিবাহী চেতনার জাগরণ।
* * * * * *
মেধানাড়ীকে জাগ্রত করতে হলে লাগে অনাহত-নাদ বা সৎমন্ত্র সাধন। বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র আমাদের বিদ্বান করার জন্য দীক্ষার মাধ্যমে আজ্ঞাচক্রে অনাহত-নাদের সৎমন্ত্র সাধন, স্বতঃ-অনুজ্ঞার অনুশাসন এবং সদাচার মাধ্যমে আমাদের মেধানাড়ীকে জাগ্রত করার সহজ উপায় দান করেই ক্ষান্ত হন নি, ‘নিয়তং স্মৃতিচিদযুতে’-বাণীতে স্বস্ত্যয়নী ব্রতের মন্ত্রের মাধ্যমে স্মৃতিবাহী চেতনাকে জাগ্রত করার বিধান দিয়ে দেবী সরস্বতীর আরাধনার নিমিত্ত স্থায়ী একটা আসন পেতে দিলেন। যা’তে আমরা প্রতিনিয়ত সরস্বতী পূজায় ব্যাপৃত থাকতে পারি। আমরা একটু চেষ্টা করলেই সেই বিধিগুলোকে অনুশীলন মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে দেবী সরস্বতীকে সম্বর্দ্ধিত করে, প্রকৃত অর্থে পূজা করে নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ,পবিত্র হতে পারব, বিদ্বান হতে পারব।
এবার আমরা একটু দেখে নেব বর্তমান বেদবিৎ আচার্য্য শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সরস্বতী বিষয়ে কি নিদান রেখে গেছেন।
‘‘বিকাশ-ব্যাকুল গতিই যাঁর সংস্থিতি—
তিনিই সরস্বতী,
আর, বাক্ বা শব্দই
যাঁর সত্তা—
তিনিই বাগ্দেবী;
তাই, যিনিই বাগ্দেবী
তিনিই সরস্বতী। ২ ।
বাস্তব উপলব্ধিসম্ভূত
সার্থক অন্বিত-সঙ্গতিশীল জ্ঞানকেই
বিদ্যা বলে। ৩ ।
সার্থক সর্ব্বসঙ্গতিশীল জ্ঞানই
বিজ্ঞান,
আর, তা’ই বেদ,
প্রজ্ঞাও তা’ই। ১০ ।’’
(সংজ্ঞা সমীক্ষা)
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রদত্ত উপরোক্ত বাণীতে এটুকু বোঝা গেল যে সরস্বতী আরাধনার মাধ্যম বাক্ বা শব্দ সাধন। শ্রীশ্রীঠাকুর ভাব-সমাধিতে বাক্ বা শব্দের সন্ধান দিতে গিয়ে ব্যক্ত করলেন,—‘‘নাম-নামী অভেদ, ….. স্থূলে আমার প্রকাশ, সূক্ষ্মে আমার বাস।’’ মহাগ্রন্থ পুণ্যপুঁথির উক্ত বাণীকে স্বীকার করলে বাক্ বা শব্দের অস্তিত্বের আধারও শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। এবং সব দেবতার সমাহারে সৃষ্ট একমাত্র তিনিই ভগবানের অখন্ড সাকার মূর্তি। তিনি ইষ্ট, তিনি ধ্যেয়, তিনি জ্ঞেয় এবং তিনিই পূজ্য। তাঁর আদর্শ মেনে চলে ইষ্টপূজা করতে পারলে সব দেবতার পূজা করা হয়।
আপনারা আমার শ্রীপঞ্চমীর প্রণাম নেবেন। জয়গুরু বন্দে পুরুষোত্তমম্!