কুমারী পূজা

।। প্রসঙ্গঃ কুমারী পূজা ।।

শাস্ত্রানুসারে কুমারী পূজা না করলে দেবদেবীর পূজা ও হোম সফল হয় না। শক্তির আরাধনার নামে আদর্শ নারীশক্তির প্রতীক স্বরূপা দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী এবং বাসন্তী পূজার আয়োজন হয়ে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। যার উদ্দ্যেশ্য চিন্ময়ী নারীদেরও আমরা যেন আদ্যাশক্তির প্রতীক মনে করে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন করতে অভ্যস্ত হই, শ্রদ্ধা জানাই, নারীকে যেন কামনার, ভোগের বস্তু মনে না করি, নারীকে ভোগ্যা নয়, পূজ্যা রূপে স্বীকৃত দেবার জন্যই কুমারী পূজা। আদ্যাশক্তির প্রতীক নারীরা যদি রুষ্ট হয় তাহলে সৃষ্টির ছন্দে পতন অবশ্যম্ভাবী। ওই আদর্শকে সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠা দিতে মূর্ত্তিপূজার পাশাপাশি তন্ত্রশাস্ত্রকারেরা দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য দেবীজ্ঞানে কুমারী পূজারও প্রচলন করেছিলেন। ফলহারিনী কালীপূজার রাতে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।
পূর্বের তুলনায় হ্রাস পেলেও বর্তমানেও শক্তিপীঠ কামরূপ কামাক্ষ্যা, বেলু়ড় মঠসহ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনগুলোতে, আদ্যাপীঠ প্রভৃতি বিখ্যাত স্থানসহ ভারত ও বাংলাদেশের অনেক স্থানে রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া অনার্তবা অর্থাৎ অ-রজঃস্বলা—১৬ বছর সময়সীমার মধ্যে যে মেয়ে ঋতুমতী হয়নি এমন কুমারী মেয়েদের দেবীজ্ঞানে তন্ত্রমতে পূজা করা হয়।
শাস্ত্রমতে বয়স অনুযায়ী কুমারী মেয়েদের উপাধি—
১ বৎসরের কন্যাকে সন্ধ্যা
২ বৎসরের কন্যাকে সরস্বতী
৩ বৎসরের কন্যাকে ত্রিধামূর্তি
৪ বৎসরের কন্যাকে কালিকা
৫ বৎসরের কন্যাকে সুভগা
৬ বৎসরের কন্যাকে উমা
৭ বৎসরের কন্যাকে মালিনী
৮ বৎসরের কন্যাকে কুব্জিকা
৯ বৎসরের কন্যাকে কাল-সন্দর্ভা
১০ বৎসরের কন্যাকে অপরাজিতা
১১ বৎসরের কন্যাকে রূদ্রাণী
১২ বৎসরের কন্যাকে ভৈরবী
১৩ বৎসরের কন্যাকে মহালক্ষী
১৪ বৎসরের কন্যাকে পীঠনায়িকা
১৫বৎসরের কন্যাকে ক্ষেত্রজা
এবং
১৬ বৎসরের কন্যাকে অম্বিকা উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।
ইদানীংকালে হিন্দুত্বের বড়াই করা ভক্তরা সরকার স্বীকৃত ‘শক্তির আরাধনা’য় যে হারে ব্যাপৃত হয়েছে, সেই হারে শক্তি আরাধনার আয়োজকদের মধ্যে কুমারীপূজার আদর্শ যদি প্রতিষ্ঠা পেত তাহলে নারীদের কেউ লালসার বস্তু মনে করতে পারত না, আর নারীরাও নিজেদের লাস্যময়ী রূপে নিজেদের বিজ্ঞাপিত করে পুরুষের কামনার আগুনে ইন্ধন দিত না। কারণ দুর্গাপূজা, কালীপূজার নামে যত মানুষ মেতে ওঠে তারা যদি প্রকৃতই শক্তির আরাধনার শিক্ষাটাকে পোলিও প্রচারের মত সমাজে চারিয়ে দিতে পারতেন তাহলে কি ইভটিজিং, ধর্ষণ, ডিভোর্স, নারী নির্যাতনের মতো জ্বলন্ত সমস্যায় কি জর্জরিত হতে হতো আমাদের এই ভারতবর্ষকে ?

শাস্ত্র বর্ণিত অধমের চাইতেও অধম পূজায় মেতে উঠে আমাদের যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে জবাবদিহি করতে না হয়, তাই, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র আমাদের নিত্য-বাস্তবে কুমারীপূজার পূজারী করে তুলতে সৎসঙ্গীদের নিত্যপাঠ্য ‘সত্যানুসরণ’ নামক মহাগ্রন্থে নারীকে জগজ্জননী জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করতে নিদেশ দিয়ে বললেন, ‘‘প্রত্যেকের মা-ই জগজ্জননী । প্রত্যেক মেয়েই নিজের মায়ের বিভিন্নরূপ, এমনতর ভাবতে হয় ।’’ এবং পুণ্যপুঁথি গ্রন্থে বললেন, ‘‘স্ত্রীতে কামিনীবুদ্ধি করে যে-জন, তাহার হয় না ভবের বন্ধন মোচন । …..স্ত্রী চিন্ময়ী মা।’’—এই শিক্ষার ধারাকে বাস্তবায়িত করার নাম প্রকৃত কুমারীপূজা ।
।। অভিভাবকদের উদ্দেশ্য শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত কুমারীপূজার মন্ত্র।।
কুমারী একটু বড় হলেই
পুরুষ ছুঁতে নেই,
যথা সম্ভব এর পালনে
উন্নয়নের খেই ।
পরের বাবা পরের দাদা
পরের মামা বন্ধু যত
এদের বাধ্যবাধকতায়
সম্বন্ধটি যাহার যত
অনুরোধ আর উপরোধে
ব্যস্ত সারা নিশিদিন
কামুক মেয়ে তাকেই জানিস
গুপ্ত কামে করছে ক্ষীণ ।
বিয়ের আগে পড়লে মেয়ে
অন্য পুরুষে ঝোঁকের মন
স্বামীর সংসার পরিবার
করতে নারে প্রায়ই আপন ।।
কুমারী পূজাকে বাস্তবায়িত করতে তিনি নারীকে অবলা নয়, সবলারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন। নারীর সতীত্বই নারীকে সবলা করে তোলে। তাই তিনি কত আশা নিয়ে কুমারীদের উদ্দেশ্য করে বললেন—

‘‘মেয়ে আমার,
তোমার সেবা, তোমার চলা,
তোমার চিন্তা, তোমার বলা
পুরুষ-জনসাধারণের ভিতর
যেন এমন একটা ভাবের সৃষ্টি করে—
যা’তে তারা
অবনতমস্তকে, নতজানু হ’য়ে
সসম্ভ্রমে,
ভক্তিগদগদ কন্ঠে—
‘মা আমার,— জননী আমার’! ব’লে
মুগ্ধ হয়, বুদ্ধ হয়, তৃপ্ত হয়.কৃতার্থ হয়,—
তবেই তুমি মেয়ে.
—তবেই তুমি সতী।’’

‘‘সতীর তেজে ঝলসে দে মা
নিঠুর কঠোর অন্ধকারে
মদনভস্ম বহ্নিরাগে
বৃত্তি-রিপু দে ছারখারে ।
প্রণবতালে ইষ্টমন্ত্র
ঝঙ্কারি তোল সকলতন্ত্রে
বিষাণ হাঁকে রুদ্র দোলায়
বজ্রে হানি মৃত্যুদ্বারে।’’
তাই আসুন, পূজার নামে অনিত্য-বস্তুর প্রতিযোগিতায় না মেতে, সব দেবতার সমাহার-স্বরূপ যুগ-পুরুষোত্তমের বিধি মেনে, নিত্য-সিদ্ধ দেদীপ্যমান আদর্শের আলোকে, আমাদের ঘরের মেয়েরা যাতে রাষ্ট্রপূজার অর্ঘ্যস্বরূপ সুজননে সুসন্তানের উপহার সাজিয়ে, শক্তিরূপিণী-দশপ্রহরণধারিণী সাজে সজ্জিত হয়ে নরাসুরদের কিভাবে দমন করে অস্তিত্ব রক্ষার পূজার পূজারী হতে পারে,– সেই চেষ্টায় যত্নবান হই।
জয়গুরু ! বন্দে পুরুষোত্তমম্!

Leave a comment