সব তীর্থ বার-বার/গঙ্গাসাগর একবার

সব তীর্থ বার-বার

গঙ্গাসাগর একবার।

সব তীর্থ বার-বার

গঙ্গাসাগর একবার।

নিবেদনে—তপন দাস

——————————————-

এই তীর্থ স্নানটি এক সময়ে এতোই দুর্গম স্থানে অবস্থিত ছিলো যে অন্যান্য তীর্থের মতো সব সময় বা ইচ্ছামতো যাওয়া সম্ভব হতো না। নদীনালা, বন-জঙ্গল অতিক্রম করে যেতে হতো। তা ছাড়া চোর, ডাকাত ও জলদস্যুর ভয় তো ছিলই, এমনকি বন্য জন্তুর আক্রমণে মৃত্যুও পর্যন্ত ঘটত। সাগর দ্বীপটা শহর কলকাতা থেকে বেশ অনেকটা দূরে। আগে যানবাহনের তেমন সুবন্দোবস্ত ছিলো না। ইদানিং যানবাহনের প্রভুত উন্নতি হয়েছে। তৈরী হয়েছে প্রচুর রাস্তা ঘাট।

পূর্বে এই দ্বীপে যাতায়াতের জন্য নদীপথ বা জলাপথ ছিলো এক মাত্র ভরসা। বর্তমানের উন্নত যানবাহনের যুগেও জলপথে নৌকা, ভটভটি, লঞ্চ, ভেসেল, কুরুজ যোগে যাতায়াত চলছে। পৌষ মাসের একেবারে শেষ মকর সংক্রান্তির দিনে লক্ষ-লক্ষ নরনারী প্রচণ্ড শীতের দাপট উপেক্ষা করেও হাজির হয় এই সাগর সঙ্গমে। আজকাল অনেকেই যাচ্ছেন বত্‍সরের যে কোনো সময়ে। বলা যায় আগে মতো সেই ভয়াবহ দুর্গমতা আর নেই। প্রতিদিন নিত্য নতুন মানুষের পদার্পণে সাগর দ্বীপ এর তীর্থ স্নানটি কোলাহল মুখর হয়ে উঠে। তাই সারা বছর এখন অনেক জমজমাট।

তীর্থ স্নানের সন্নিকটে গড়ে উঠেছে জেলা প্রশাসনের সার্কিট হাউস, যুব আবাস, জেলা পরিষদ ভবন, দোকানপাট, হোটেল আরও কতো কি!

ভারত সেবাশ্রমের বিশাল বাড়ি ও অনেক ধর্মশালা গড়ে উঠেছে এই দ্বীপে। সরকারের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে সুন্দর বৃহত্‍ মন্দির। এই দুর্গম স্নানে মহা ঋষি কপিল মুনির আশ্রম ছিলো। মুনিবর এখানে সাধনা করতেন। সাগর দ্বীপে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী পৌষ সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে স্নান করেন। এই মেলার অধীনে তিন শতাধিক বিঘা জমি রয়েছে। ভরা কোটালে সাগর এর জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচাতে এক তলার সমান উঁচু থাম ওয়ালা বাড়ি তৈরী হয়েছে।

এই বাড়িটি কপিল মুনির মন্দির এখানে আছে ভগীরথের কোলে মা গঙ্গা, বীর হনুমান, সিংহবাহিনী, বিশালক্ষী ও ইন্দ্রদেব।

এক কালে সাগর দ্বীপ ছিলো ১৭০ বর্গ মাইলের এক সমৃদ্ধ জনপথ। ১৬৮৮ সালে সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচছাসে প্রায় দু লক্ষ মানুষ সমুদ্রে ভেসে যায়। সেই থেকে দ্বীপটি বহু কাল জনহীন হয়ে পড়ে। ইতিহাস ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে রানী সত্যভামা প্রথম কপিল মুনির মন্দিরটি তৈরী করেন। সেই মন্দিরটি বিলীন হয়ে যাবার পর আরও ছয়টি মন্দির তৈরী হয়, পরে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমান মন্দিরটি আদি মন্দির স্থল থেকে প্রায় ২ কিমি দূরে অবস্থিত। বর্তমানে এই কপিল মুনির মন্দির সংলগ্ন এলাকায় প্রভূত উন্নতি হয়েছে। কাকদ্বীপ, নামখানা ব্যতীত ডায়মণ্ড হারবার থেকে ক্রুজে করে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় গঙ্গাসাগরে।

***************************

উইকিপিডিয়া অনুসারে গঙ্গা ভারত ও বাংলাদেশে প্রবাহিত একটি আন্তর্জাতিক

নদী। এই নদী ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় নদী। গঙ্গার দৈর্ঘ্য ২,৭০৪

কিমি (১,৬৮০ মা); উৎসস্থল পশ্চিম হিমালয়ে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে।

দক্ষিণ ও পূর্বে গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা

মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। এক্ষেত্রে এর দুটি ধারা বা শাখা লক্ষনীয়– একটি

ফারাক্কা বাঁধ থেকে এসে ভাগীরথী ও হুগলী নদী নামে মূলত দক্ষিণে প্রবাহিত

হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে; অপরটি বাংলাদেশ সীমান্তে মহানন্দার সঙ্গে মিলিত

হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নামে গোয়ালন্দ পর্যন্ত প্রবাহিত

হয়েছে। পদ্মাকে মূলত গঙ্গার প্রধান শাখানদী বলা হয়। তবে ঐতিহাসিক

কারণবশত এর অববাহিকাকেও গাঙ্গেয় বদ্বীপের অন্তর্গত বিবেচনা করা হয়।

জলপ্রবাহের ক্ষমতা অনুযায়ী গঙ্গা বিশ্বের প্রথম ২০টি নদীর একটি।

গাঙ্গেয় অববাহিকার জনসংখ্যা ৪০ কোটি এবং জনঘনত্ব ১,০০০ জন/বর্গমাইল (৩৯০

/কিমি২)। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নদী অববাহিকা।

গঙ্গা হিন্দুদের কাছে পবিত্র নদী। তারা এই নদীকে গঙ্গা দেবীজ্ঞানে পূজা

করেন। (পূজা মানে সম্বর্দ্ধনা, অথচ আমরা তথাকথিত অমূর্ত মূর্তিপূজার নামে

পূজাবশিষ্ট বর্জ্য গঙ্গায় নিক্ষেপ করে গঙ্গাকে দূষিত করে চলেছি! যা সনাতন ধর্মনীতির বিরোধী।) গঙ্গার

ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম। একাধিক পূর্বতন প্রাদেশিক ও সাম্রাজ্যিক

রাজধানী (যেমন পাটলিপুত্র, কনৌজ, কাশী, এলাহাবাদ, মুর্শিদাবাদ, মুঙ্গের,

নবদ্বীপ ও কলকাতা) এই নদীর তীরেই অবস্থিত।

পরিবেশ বিভাগের রিপোর্ট অনুসারে গঙ্গা বিশ্বের পাঁচটি সবচেয়ে দূষিত নদীর

একটি। বারাণসীর কাছে এই নদীতে ফেসাল কলিফর্মের পরিমাণ ভারত সরকারের

নির্ধারিত সীমার চেয়ে একশো গুণ বেশি। গঙ্গাদূষণ শুধুমাত্র গঙ্গাতীরে

বসবাসকারী কয়েক কোটি ভারতীয়দেরই ক্ষতি করছে না, ১৪০টি মাছের প্রজাতি,

৯০টি উভচর প্রাণীর প্রজাতি ও ভারতের জাতীয় জলচর প্রাণী গাঙ্গেয়

শুশুক-এরও ক্ষতি করছে।গঙ্গাদূষণ রোধে গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান নামে একটি

পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি, প্রযুক্তিগত অদক্ষতা, সুষ্ঠু

পরিবেশ পরিকল্পনার অভাব, ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্য ও বিশ্বাস এবং ধর্মীয়

সংগঠনগুলোর অসহযোগিতার কারণে এই প্রকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।কিন্তু

বর্তমানে সরকারের তৎপরতায় গঙ্গা নদী অনেকটাই দূষণমুক্ত হয়েছে এবং

ভবিষ্যতে পুরো নদী দূষণ মুক্ত হবে, সেই আশা রাখা যায়।

দেবপ্রয়াগ, অলকানন্দা (ডানে) ও ভাগীরথী (বাঁয়ে) নদীর সঙ্গমস্থল, এখান

থেকে মূল গঙ্গা নদীর শুরু।

ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গাড়োয়াল অঞ্চলে গঙ্গার উৎস অঞ্চল।

মূল গঙ্গা নদীর উৎসস্থল ভাগীরথী ও অলকানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল। হিন্দু

সংস্কৃতিতে ভাগীরথীকেই গঙ্গার মূল প্রবাহ বলে মনে করা হয়। যদিও

অলকানন্দা নদীটি দীর্ঘতর। অলকানন্দার উৎসস্থল নন্দাদেবী, ত্রিশূল ও কামেট

শৃঙ্গের বরফগলা জল। ভাগীরথীর উৎস গোমুখের গঙ্গোত্রী হিমবাহ (উচ্চতা ৩,৮৯২ মি (১২,৭৬৯ ফুট))।

গঙ্গার জলের উৎস অনেকগুলো ছোট নদী। এর মধ্যে ছয়টি দীর্ঘতম ধারা এবং

গঙ্গার সঙ্গে তাদের সঙ্গমস্থলগুলোকে হিন্দুরা পবিত্র মনে করে। এই ছয়টি

ধারা হল অলকানন্দা, ধৌলীগঙ্গা, নন্দাকিনী, পিণ্ডার, মন্দাকিনী ও ভাগীরথী।

পঞ্চপ্রয়াগ নামে পরিচিত পাঁচটি সঙ্গমস্থলই অলকানন্দার উপর অবস্থিত।

এগুলি হল বিষ্ণুপ্রয়াগ (যেখানে ধৌলীগঙ্গা অলকানন্দার সঙ্গে মিশেছে),

নন্দপ্রয়াগ (যেখানে নন্দাকিনী মিশেছে), কর্ণপ্রয়াগ (যেখানে পিণ্ডার

মিশেছে), রুদ্রপ্রয়াগ (যেখানে মন্দাকিনী মিশেছে) এবং সবশেষে দেবপ্রয়াগ

যেখানে ভাগীরথী ও অলকানন্দার মিলনের ফলে মূল গঙ্গা নদীর জন্ম হয়েছে।

হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে গঙ্গার দৈর্ঘ্য ২৫০ কিলোমিটার (১৬০ মা)।

হৃষীকেশের কাছে গঙ্গা হিমালয় ত্যাগ করে তীর্থশহর হরিদ্বারে গাঙ্গেয়

সমভূমিতে পড়েছে। হরিদ্বারে একটি বাঁধ তৈরি করে গঙ্গা খালের মাধ্যমে

গঙ্গার জল উত্তরপ্রদেশের দোয়াব অঞ্চলে জলসেচের জন্য পাঠানো হয়ে থাকে।

এদিকে গঙ্গার মূলধারাটি হরিদ্বারের আগে সামান্য দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী হলেও

হরিদ্বার পেরিয়ে তা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে।

এরপর গঙ্গা কনৌজ, ফারুকাবাদ ও কানপুর শহরের ধার দিয়ে একটি

অর্ধ-বৃত্তাকার পথে ৮০০-কিলোমিটার (৫০০ মা) পার হয়েছে। এই পথেই রামগঙ্গা

(বার্ষিক জলপ্রবাহ ৫০০ মি৩/সে (১৮,০০০ ঘনফুট/সে)) গঙ্গায় মিশেছে।[২২]

এলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গমে যমুনা নদী গঙ্গায় মিশেছে। সঙ্গমস্থলে যমুনার

আকার গঙ্গার চেয়েও বড়। যমুনা গঙ্গায় ২,৯৫০ মি৩/সে (১,০৪,০০০ ঘনফুট/সে)

জল ঢালে, যা উভয় নদীর যুগ্মপ্রবাহের জলধারার মোট ৫৮.৫%।

এখান থেকে গঙ্গা পূর্ববাহিনী নদী। যমুনার পর গঙ্গায় মিশেছে কাইমুর

পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন নদী তমসা (বার্ষিক জলপ্রবাহ ১৯০ মি৩/সে (৬,৭০০

ঘনফুট/সে))। তারপর মিশেছে দক্ষিণ হিমালয়ে উৎপন্ন নদী গোমতী (বার্ষিক

জলপ্রবাহ ২৩৪ মি৩/সে (৮,৩০০ ঘনফুট/সে))। তারপর গঙ্গায় মিশেছে গঙ্গার

বৃহত্তম উপনদী ঘর্ঘরা (বার্ষিক জলপ্রবাহ ২,৯৯০ মি৩/সে (১,০৬,০০০

ঘনফুট/সে))। ঘর্ঘরার পর দক্ষিণ থেকে গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে শোন (বার্ষিক

জলপ্রবাহ ১,০০০ মি৩/সে (৩৫,০০০ ঘনফুট/সে)), উত্তর থেকে মিশেছে গণ্ডকী

(বার্ষিক জলপ্রবাহ ১,৬৫৪ মি৩/সে (৫৮,৪০০ ঘনফুট/সে)) ও কোশী (বার্ষিক

জলপ্রবাহ ২,১৬৬ মি৩/সে (৭৬,৫০০ ঘনফুট/সে))। কোশী , ঘর্ঘরা ও যমুনার পর

গঙ্গার তৃতীয় বৃহত্তম উপনদী। এলাহাবাদ থেকে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ পর্যন্ত।

গঙ্গা বারাণসী, পাটনা, গাজীপুর, ভাগলপুর, মির্জাপুর, বালিয়া, বক্সার,

সৈয়দপুর ও চুনার শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভাগলপুরে নদী

দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিকে বইতে শুরু করেছে। পাকুড়ের কাছে গঙ্গার

ঘর্ষণক্ষয় শুরু হয়েছে। এরপর গঙ্গার প্রথম শাখানদী ভাগীরথী-হুগলির জন্ম,

যেটি দক্ষিণবঙ্গে গিয়ে হয়েছে হুগলি নদী। বাংলাদেশ সীমান্ত পেরোনোর কিছু

আগে হুগলি নদীতে গড়ে তোলা হয়েছে ফারাক্কা বাঁধ। এই বাঁধ ও ফিডার খালের

মাধ্যমে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে হুগলি নদীকে আপেক্ষিকভাবে পলিমুক্ত রাখা

হয়। ভাগীরথী ও জলঙ্গী নদীর সঙ্গমের পর হুগলি নদীর উৎপত্তি। এই নদীর বহু

উপনদী রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় উপনদীটি হল দামোদর নদ (দৈর্ঘ্য্য

৫৪১ কিমি (৩৩৬ মা) অববাহিকার আয়তন ২৫,৮২০ কিমি২ (৯,৯৭০ মা২))। হুগলি

নদী সাগর দ্বীপের কাছে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।

ঋক্ বেদে (১০৷৭৬।৫ ) গঙ্গা ও অন্য কয়েকটি নদীর স্তব আছে । গঙ্গার স্তব ঋক্

বেদে একবার মাত্র। গঙ্গা মকরবাহিনী শুক্লবর্ণাচতুর্ভূজা। এক হাতে একটি

পাত্র ও এক হাতে পদ্মফুল। জ্যৈষ্ঠ শুক্লাদশমীতে এর পূজা হয়। এই দিনে গঙ্গা

স্নানে দশ রকম পাপ নষ্ট হয়, তাই এই তিথির নাম দশহরা । গঙ্গার জল স্নানে

পানে ও স্পর্শে পুণ্য এনে দেয় ৷ গঙ্গাতীরে বাস ও মৃত্যু গৌরব জনক। মৃতের

দগ্ধাবশিষ্ট অস্থি গঙ্গা জলে দেওয়ার নিয়ম আছে। গঙ্গার মাহাত্ম্য হিসাবে

কাহিনীর সীমা নাই । (সূত্র : পৌরাণিকা)

অদ্বৈত বেদান্তবাদের প্রবক্তা আচার্য্য শঙ্কর—

দেবি! সুরেশ্বরি! ভগবতি! গংগে ত্রিভুবনতারিণি তরলতরংগে ।

শংকরমৌলিবিহারিণি বিমলে মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে ॥ 1 ॥

ভাগীরথিসুখদায়িনি মাতস্তব জলমহিমা নিগমে খ্যাতঃ ।

নাহং জানে তব মহিমানং পাহি কৃপাময়ি মামজ্ঞানম্ ॥ 2 ॥

হরিপদপাদ্যতরংগিণি গংগে হিমবিধুমুক্তাধবলতরংগে ।

দূরীকুরু মম দুষ্কৃতিভারং কুরু কৃপয়া ভবসাগরপারম্ ॥ 3 ॥

তব জলমমলং যেন নিপীতং পরমপদং খলু তেন গৃহীতম্ ।

মাতর্গংগে ত্বয়ি যো ভক্তঃ কিল তং দ্রষ্টুং ন যমঃ শক্তঃ ॥ 4 ॥

পতিতোদ্ধারিণি জাহ্নবি গংগে খংডিত গিরিবরমংডিত ভংগে ।

ভীষ্মজননি হে মুনিবরকন্যে পতিতনিবারিণি ত্রিভুবন ধন্যে ॥ 5 ॥

কল্পলতামিব ফলদাং লোকে প্রণমতি যস্ত্বাং ন পততি শোকে ।

পারাবারবিহারিণি গংগে বিমুখযুবতি কৃততরলাপাংগে ॥ 6 ॥

তব চেন্মাতঃ স্রোতঃ স্নাতঃ পুনরপি জঠরে সোপি ন জাতঃ ।

নরকনিবারিণি জাহ্নবি গংগে কলুষবিনাশিনি মহিমোত্তুংগে ॥ 7 ॥

পুনরসদংগে পুণ্যতরংগে জয জয জাহ্নবি করুণাপাংগে ।

ইংদ্রমুকুটমণিরাজিতচরণে সুখদে শুভদে ভৃত্যশরণ্যে ॥ 8 ॥

রোগং শোকং তাপং পাপং হর মে ভগবতি কুমতিকলাপম্ ।

ত্রিভুবনসারে বসুধাহারে ত্বমসি গতির্মম খলু সংসারে ॥ 9 ॥

অলকানংদে পরমানংদে কুরু করুণামযি কাতরবংদ্যে ।

তব তটনিকটে যস্য নিবাসঃ খলু বৈকুংঠে তস্য নিবাসঃ ॥ 10 ॥

বরমিহ নীরে কমঠো মীনঃ কিং বা তীরে শরটঃ ক্ষীণঃ ।

অথবাশ্বপচো মলিনো দীনস্তব ন হি দূরে নৃপতিকুলীনঃ ॥ 11 ॥

ভো ভুবনেশ্বরি পুণ্যে ধন্যে দেবি দ্রবমযি মুনিবরকন্যে ।

গংগাস্তবমিমমমলং নিত্যং পঠতি নরো যঃ স জযতি সত্যম্ ॥ 12 ॥

যেষাং হৃদযে গংগা ভক্তিস্তেষাং ভবতি সদা সুখমুক্তিঃ ।

মধুরাকংতা পংঝটিকাভিঃ পরমানংদকলিতললিতাভিঃ ॥ 13 ॥

গংগাস্তোত্রমিদং ভবসারং বাংছিতফলদং বিমলং সারম্ ।

শংকরসেবক শংকর রচিতং পঠতি সুখীঃ তব ইতি চ সমাপ্তঃ ॥ 14 ॥

ইতি উক্ত গঙ্গা-স্তোত্রম্-এর বন্দনা মাধ্যমে গঙ্গাকে বিবিধ বিভূষণে ভূষিত

করে শঙ্করাচার্য্য অমর হয়ে আছেন।

এই স্তোত্রে সর্বত্রই গঙ্গাকে সম্বোধন করে কবি তাঁর স্তুতি করেছেন। দেবী

গঙ্গা সুরেশ্বরী, ত্রিভুবনের ত্রাণকর্ত্রী, দেবাদিদেব শংকরের জটায় আবদ্ধ

থেকে হয়েছেন ‘শংকরমৌলিবিহারিণী’ এবং তিনিই পবিত্র তরঙ্গবিশিষ্টা

চিরপ্রবাহিনী স্রোতস্বিনী গঙ্গা।

তিনি ভগীরথ কর্তৃক স্বর্গ থেকে আনীতা হয়ে ‘ভাগীরথী‘ নামে প্রবাহিতা।

ইনিই শ্রীবিষ্ণুর চরণ থেকে নির্গত হয়ে ‘হরিপাদপদ্মতরঙ্গিণী‘ হয়েছেন।

দেবী গঙ্গাই ‘জাহ্নবী’ রূপে পরিচিতা কারণ জহ্নু মুনি গঙ্গাকে গ্রাস করে

পরে তাঁর কর্ণ থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ইনিই ছিলেন শাপভ্রষ্ট অষ্টবসু

ভীষ্মের জননী।

দেবী গঙ্গা কল্পলতার মতো ফলদায়িনী, সমুদ্র বিহারিণী, দেববধূগণ কর্তৃক

কটাক্ষে দৃষ্ট হয়ে থাকেন।

ইনিই নরকত্রাণকর্ত্রী, কলুষ বিনাশিনী, সর্বদা সুখদায়িনী,

মঙ্গলপ্রদায়িনী, আর্তজনের সেবক জনের আশ্রয়দাত্রী।

ইনিই উজ্জ্বল অঙ্গ বিশিষ্টা, ত্রিভুবন শ্রেষ্ঠা, কৃপাকটাক্ষময়ী। দেবরাজ

ইন্দ্র ও গঙ্গার চরণে চিরপ্রণত।

পরমানন্দ স্বরূপিণী, আর্তুজনের বন্দিতা, স্বর্গের অলকানন্দা যেন জ্ঞানহীন

শংকরের প্রতি করুণাঘন দৃষ্টিতে দেখেন।

তাঁর পবিত্র ধারায় স্নাত হয়ে যারা জন্মরহিত হয়, তাঁর তটে বাস করে যারা

বৈকুণ্ঠের শান্তি ভোগ করে যেন তাঁরা গঙ্গার কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত না

হন।

তিনি যেন তাঁদের রোগ শোক তাপ পাপ কুমতি দূর করে সুমতি দেন, গঙ্গাদেবীর

মাহাত্ম্য বর্ণনায় সেই প্রার্থনা জানিয়েছেন কবি শংকরাচার্য।

শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর জন্মভূমি ও কর্মভূমি ছিল নবদ্বীপ গঙ্গাতীরে। ঠাকুর

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সাধনভূমিও দক্ষিণেশ্বর গঙ্গা তীরেই। শাস্ত্রমতে, উভয়

সাধনভূমির ভূমিভাগ ছিল কূর্ম পৃষ্ঠাকৃতির এবং রম্য পুষ্পশোভিত।

বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রেরও জন্মভূমি ও কর্মভূমি

ছিল ভাগিরথী-গঙ্গার মূল প্রবাহ পদ্মা তীরের পাবনা জেলার হিমাইতপুরে।

গঙ্গানদীর সৃষ্টি ও সাগরমেলার সূত্রপাতের কাহিনী

কথিত আছে দানবীর রাজা হরিশচন্দ্রের বংশে সগর নামে একজন খুব বিখ্যাত রাজা

ছিলেন। আর তাঁর ছিল ষাট হাজার একজন পুত্র। সেই সগর রাজা ঠিক করলেন তিনি

অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন। সেই মতো একটি ঘোড়ার কপালে জয়-পতাকা লিখে তিনি

ছেড়ে দিলেন বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। অপেক্ষা করতে লাগলেন ঘোড়াটি কবে

দেশ-বিদেশ ঘুরে ফিরে আসবে তারপর যজ্ঞ করে ইন্দ্রত্ব লাভ করবেন।

ওদিকে দেবরাজ ইন্দ্র ওই যজ্ঞের সংবাদ শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি

ভাবলেন, রাজা যদি রাজচক্রবর্তী হয়ে পুরো স্বর্গটাই চেয়ে বসেন, তখন কী হবে, তাই তিনি ফন্দি করে যজ্ঞের ঘোড়াটি পাতালে কপিল মুনির আশ্রমে বেঁধে রেখে এলেন।

ওদিকে ঘোড়াটিকে অনুসরণ করছিলেন রাজার ষাট হাজার পুত্র। (!) হঠাৎ ঘোড়াটি নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেই তাকে খুঁজতে শুরু করে দিলেন। আর খুঁজতে খুঁজতে তাঁরা পৌঁছে গেলেন কপিল মুনির আশ্রমে। ঘোড়াটিকে সেখানে দেখতে পেয়ে ক্রোধান্ধ হয়ে মুনিকে মারতে লাগলেন। মুনি যত বলেন ‘আমি ধ্যান করছিলাম, আমি জানি না

একে এখানে কে রেখে গেছে । ওঁর কথায় কর্ণপাত না করে সবাই মিলে আরও বেশি

করে মারতে লাগলেন। শেষে মুনি রেগে গিয়ে ক্রোধাবিষ্ট লোচনে তাঁদের দিকে

তাকাতেই তাঁরা সবাই ভষ্ম হয়ে গেলেন।

ওই সংবাদ পাওয়া মাত্র সগরের এক নাতি পাতালে গিয়ে মুনির পা ধরে

কান্নাকাটি শুরু করলেন। তাঁর চোখের জল দেখে মুনির মায়া হল। তিনি তখন

তাঁকে বললেন তোমার পৌত্র গিয়ে যদি স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে নিয়ে আসতে পারে

তবে গঙ্গা দেবীর পবিত্র স্পর্শে এরা আবার জীবন ফিরে পাবে।

তিনি ফিরে এসে সব কথা খুলে বলতে তাঁর পৌত্র ভগীরথ তপস্যা করতে রাজি হয়ে গেলেন। হাজার বছর ধরে তিনি এমন তপস্যা করলেন যে বিষ্ণু খুশি হয়ে তাঁর হাতে একটি শঙ্খ দিয়ে বললেন, তুমি শঙ্খ বাজিয়ে আগে আগে যাও, গঙ্গা

দেবী তোমার পিছনে পিছনে পৃথিবীতে যাবেন।

কথামতো ভগীরথ শঙ্খ বাজাতে বাজাতে চললেন, আর পিছনে গঙ্গা। কিন্তু মুশকিল

হল স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরন করার সময়। গঙ্গার গতি এতটাই বেড়ে গেল

যে, সেই গতিতে পৃথিবী ধ্বংস

হবার উপক্রম। তাই সেই গতি ধারণ করার জন্য ভগীরথ শিবের তপস্যা শুরু করলেন।

শিব তপস্যায় তুষ্ট হয়ে জটা খুলে মাথা পেতে

দাঁড়ালেন। গঙ্গাও তাঁর মাথায় পড়লেন। অমনি পৃথিবী কেঁপে উঠল।

আসলে গঙ্গা চেয়েছিলেন তাঁর স্রোতে মহাদেবকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন। গঙ্গার মনের

কথা বুঝে তাঁর অহংকার চূর্ণ করতে শিব তাঁকে জটায় আবদ্ধ করলেন। সেই দেখে

ভগীরথ পড়লেন বিপদে। তিনি আবার তপস্যা শুরু করলেন। মহাদেব তাতে খুশি হয়ে

গঙ্গাকে দিলেন ছেড়ে। অমনি গঙ্গা কল-কল রবে পৃথিবীতে বইতে শুরু করলেন।

কিছুদূর গিয়েই জহ্নুমুনির আশ্রম। সেখানে তিনি তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। গঙ্গার

স্রোতে তার আশ্রম গেল ভেসে। অমনি তিনি রেগে গিয়ে সমস্ত গঙ্গার

জল পান করে ফেললেন। এই দেখে ভগীরথ আবার পড়লেন চিন্তায়। তিনি মুনিকে

সাধ্যসাধনা করলেন। মুনিও তার কথায় খুশি হয়ে নিজের জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্ত

করে দিলেন। এইজন্যই গঙ্গার আরেক নাম জাহ্নবী।

এরপর গঙ্গার স্রোত পৃথিবী অতিক্রম করে গিয়ে পড়ল পাতালে সগর মুনির

ছেলেদের ভষ্মের উপর। অমনি তাঁরা কপিল মুনির কথামতো আবার জীবন ফিরে পেলেন।

এইভাবে গঙ্গার জলে সগর-বংশ উদ্ধার হয়েছিল বলে হিন্দুরা গঙ্গাকে অতি

পবিত্র মনে করেন।

কিংবদন্তী অনুসারে মা গঙ্গা যখন ভগবান শিবের জটা থেকে পৃথিবীতে

পৌঁছেছিলেন তখন তিনি ভগীরথকে অনুসরণ করেছিলেন এবং কপিল মুনির আশ্রমে

গিয়ে সমুদ্রে যোগ দিয়েছিলেন সেই দিনটি ছিল মকর সংক্রান্তির দিন। রাজা

সগরের ষাট হাজার অভিশপ্ত পুত্ররা মা গঙ্গার পবিত্র জলের প্রবাহে

পুণর্জীবন লাভ করেছিলেন। সেই ঘটনার স্মরণে এই গঙ্গা নদীর সাগরের সাথে

মিলন স্থলটি

গঙ্গাসাগর তীর্থ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সেই কাহিনীর স্মৃতিতে সেই

প্রাচীন কাল থেকে এখানে প্রতি বছর মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরে মেলার

আয়োজন করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এই শুভ দিনে স্নান করলে পুণ্য লাভ

হয়।

তথ্যঋণঃ পৌরাণিকা, উইকিপিডিয়া ও গোগুল।

May be an image of 5 people

  · 

Shared with Publ

Leave a comment