।। শক্তির আরাধনা ও কালীপূজা।।

শক্তি মানে সমর্থ হওয়া, আর আরাধনা মানে আয়ত্ত করা। সাত্তিক দৈবীশক্তির বিহিত প্রয়োগে মানুষ কাঙ্খিত জীবনবৃদ্ধির পথে অগ্রসর হতে এবং হওয়াতে পারে। আবার, প্রবৃত্তির আসুরিক শক্তির অবিহিত প্রয়োগে সপার্ষদ জীবনহানির পথে অগ্রসর হওয়াটাও স্বাভাবিক।–রাবন, দুর্যোধন যার সহজ দৃষ্টান্ত।

শুম্ভ-নিশুম্ভদের অবস্থাও তাই হয়েছিল। প্রবৃত্তির শক্তির দম্ভের যবনিকা পতন ঘটালেন আদ্যাশক্তির প্রতীকস্বরূপা নারীশক্তি মাকালী। তাই হ্লাদিনী শক্তিরূপিনী নারী জাতিকে আদ্যাশক্তির প্রতীক জ্ঞানে সম্মান, শ্রদ্ধা বা পূজা (সম্বর্দ্ধনা) না করলে পুরুষের শক্তি খর্ব হয়।

আমরা যে মা-কালীর পূজা করি, তিনি তো দিগম্বরী! বাস্তবে আমরা সকলেই আমাদের দিগম্বরী মায়েদের অপত্য পথ বেয়ে একদা ভূমিষ্ট হয়েছিলাম। ভারতীয় আর্য্য মনীষা যে পথকে যজ্ঞকুণ্ড, যজ্ঞবেদী বলে বর্ণনা করেছেন, শুধুমাত্র কাম ভোগের যন্ত্রস্বরূপ নয়! সৃষ্টি প্রকরণের আগম-নিগম দ্বার। অতএব যে যোনী আমার জন্মস্থান, যে স্তনযুগলের অমৃতধারা পান করে আমি শক্তিশালী হয়েছি, সেই যোনী এবং সেই স্তনযুগল তো আমার শক্তির আরাধনার প্রতীকস্বরূপ!—এই ভাবে ভাবিত না হতে পারলে মা কালীর সাধনা করা সম্ভব না!

আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষোত্তম শ্রীরামকৃষ্ণ, সাধক রামপ্রসাদ প্রমুখগণ প্রচলিত তন্ত্রমতের পঞ্চ ম-কারের পূজা-পদ্ধতিকে অগ্রাহ্য করেই শুধু শুদ্ধাভক্তি দিয়েই মা-কালীকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আর শ্রীরামকৃষ্ণদেব তো ফলহারিণী কালী পূজার পুণ্য লগ্নে সারদা দেবীকে সাত্তিক শুদ্ধাভক্তির উপাচারে সারদাদেবীকে পূজা করে চিন্ময়ী নারী শক্তিকে আদ্যাশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত করলেন! মাতৃ-সাধনাকে ধরে রাখতে ঠাকুর কামিনী-কাঞ্চন থেকে তফাত্—তফাত্—খুব তফাত্ থাকতে বলেছেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সত্যানুসরণে বললেন, “প্রত্যেকের মা-ই জগজ্জননী । প্রত্যেক মেয়েই নিজের মায়ের বিভিন্নরূপ, এমনতর ভাবতে হয় ।”

এবং পুণ্যপুঁথি গ্রন্থে বললেন, “স্ত্রীতে কামিনীবুদ্ধি করে যে-জন, তাহার হয় না ভবের বন্ধন মোচন । স্ত্রী চিন্ময়ী মা ।”

তিনি নারী-সাধারণকে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েই ক্ষান্ত হন নি, স্ত্রীকেও চিন্ময়ী মা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে শেখালেন । কারণ, স্ত্রীর মাধ্যমে স্বামী নিজেকে জন্মান, তাই স্ত্রীকে জায়া বলা হয়েছে । আর্য্য বিধির গর্ভাধান কালে স্ত্রীর নাভিমূল স্পর্শ করে “প্রসীদ মা জগজ্জননী” মন্ত্রে অভিষিক্ত করে স্ত্রীর গর্ভে নিজেকে প্রবেশ করাতে হয় । আর্য্য ভারতের প্রজা-সৃষ্টি প্রকরণের কি অপূর্ব ব্যঞ্জনা । যৌন জীবনে পুরুষদের শিব, আর নারীদের শক্তি জ্ঞানে অভিষিক্ত করে কাম (lust) কে আসুরিক প্রবৃত্তির কবল থেকে মুক্ত করে দৈবীপ্রেমে (love) রূপান্তরিত করলেন । ব্যবহারিক ক্ষেত্রের বাস্তব জীবনে শুদ্ধভাবের কালী পূজা করতে শেখালেন। তাই, পুরুষ এবং নারী সাধারনকে প্রবৃত্তি-প্ররোচিত শিক্ষার অঙ্গন থেকে মুক্ত করে, এই সত্তাধর্মী ব্যবহারিক কালীপূজার তুক না শেখাতে পারলে কিছুতেই ট্রিট্ করা যাবে না কুতসিত যৌবন-উন্মত্ততার ফলস্বরূপ নারী নির্যাতন, ডিভোর্স, ধর্ষণ নামের সামাজিক ব্যাধিদের! যে নারীশক্তি শুম্ভ-নিশুম্ভকে দমন করেছিলেন, সেই নারীরা যদি অসুর-পুরুষদের কামনার বলি হয় এর চাইতে সভ্যতার সংকটের আর কিছু হতে পারে না!

তাই আসুন আমরা আমাদের অন্তরের কালিমা থেকে নিজেদের মুক্ত করে যথার্থতায় সার্থক করে তুলি সমাগত কালী পূজাকে।

‘পূজা’ মানে তো সত্তা বা অস্তিত্বের অভাব পূরণ করার সম্বর্দ্ধিত করার একটা মাধ্যম । এর সাথে সাধনা, উপাসনা, সংযম জড়িয়ে আছে । যাতে আমরা সুস্থ শরীর, সুস্থ মানসিকতা অর্জন করে পরিবেশকে বাঁচিয়ে রেখে নিজেরা সুস্থভাবে বাঁচতে পারি, বৃদ্ধি পেতে পারি । কালিপুজোর অজুহাতে বাজি, শব্দবাজি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে আকাশ, বাতাস, ইন্দ্রিয়সকল কলুষিত করার অনুষ্ঠান কোন অস্তিত্বের পরিপোষক ? কোন শাস্ত্র, কোন মহাপুরুষ পূজার নামে এ ধরণের অবৈজ্ঞানিক তাণ্ডবের বিধি দিয়েছেন ? ‘সত্যমেব জয়তে’র আধিকারিকেরা জানালে বাধিত থাকবো ।

“খাওয়া-দাওয়া, বাজী পোড়ানো,

অঢেল ঢালা আয়োজনে,

পূজা সার্থক হয় না,

বিনা দৈব গুণের সংসাধনে ।

(শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র)

পূজা ও ধর্ম্ম

।। পূজা ও ধর্ম্ম ।।
নিবেদনে—তপন দাস
***********************************
আমাদের প্রচলিত ধারণায় প্রচলিত পূজা হচ্ছে ধর্ম পালনের একটা মাধ্যম। তথাকথিত পুরোহিত বা ঠাকুর মহাশয়ের ফর্দ মেনে, একটু দর কষাকষি করে উপকরণ সংগ্রহ করে এনে দিলেই হলো। (লাইট, মাইক, প্যাণ্ডেল, থিম, বাজি-বাজনা ইত্যাদি ফর্দ-অন্তর্ভূক্ত কিনা বলতে পারব না।) আয়োজকের প্রতিনিধি হয়ে দেবদেবীকে তুষ্ট করবেন তথাকথিত পুরোহিত মহোদয়। আহুত, অনাহুত, রবাহুত দর্শকেরা আয়োজনের বিচার-বিশ্লেষণ করবেন। এইরকম একটা আয়োজনকে আমরা পুজো বলতে অভ্যস্ত।
বাস্তবে, শব্দার্থ এবং মর্মার্থ অনুযায়ী পূজা মানে সম্বর্ধনা। পূজ্য চরিত্রের গুণ অনুশীলন করে নিজেকে সম্বর্ধিত করা। আর ধর্ম মানে ধারণ করা। নিজের এবং অপরের অস্তিত্বের ধারক, পালক ও পোষক হবার জন্য যা যা করা হয়, তাই ধর্ম। জীবনবর্দ্ধনার অপচয়ী অনিত্যকে ত্যাগ করে, জীবনবর্দ্ধনার উপচয়ী নিত্য-এর উপাসনা করা, আরাধনা করা। যার যার, তার তার, পালনীয়। কোনো ভায়া-মিডিয়া দিয়ে হবে না। যার ক্ষিদে তাকেই খেতে হবে, ক্ষুধার্তের হয়ে অন্য কেউ খেলে ক্ষুধার্তের কি পেট ভরবে? অথচ আমরা এই কাজটাই করে চলেছি। যাঁর পুজোর নামে মেতে উঠছি, তাঁর আদর্শ কি, তাও জানিনা, কিভাবে অনুশীলন করতে হয়, তাও করি না। আমাদের কাজ চাঁদা দেওয়া, নতুন পোশাক পরা, ধুপহীন ধুপকাঠি, ফল-মিষ্টি মণ্ডপে দিয়ে প্রতিমার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে সমস্যার সমাধান চাওয়া। আর খাওয়া দাওয়া, ভিড় ঠেলে চেঁচামেচি, মাইকের আওয়াজ, হৈ-হট্টগোলকে সাথী করে এ প্যাণ্ডেল থেকে ও প্যাণ্ডেলে পর্যটন করা! ব্যস্!
*****************************************
যাইহোক এবার একটু গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করি।
ভারতের আর্য্য-ঋষিগণ, অবতার-বরিষ্ঠগণ প্রত্যেকেই সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির
উপাসনার কথা বলেছেন ধর্মের নামে, পূজার নামে। বর্তমান পুরুষোত্তম
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র আরও একটু সহজ করে দিয়ে বললেন, ‘‘ধর্ম্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে/সম্প্রদায়টা ধর্ম্ম না-রে। অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে/ধর্ম্ম
বলে জানিস্ তাকে। পূর্বতনে মানে না যারা/জানিস্ নিছক ম্লেচ্ছ তা’রা।’’
‘‘পূজা-আর্চ্চা মানেই কিন্তু /দৈবগুণ যা সেধে নেওয়া। হাতে-কলমে মক্স
করে/বাস্তবে তার রূপটি দেওয়া।।’’
ইত্যাদি ছড়াবাণীগুলো সহজ, সরল, ওজস্বী
আবেদনে সমৃদ্ধ হলেও একটা নির্দিষ্ট গণ্ডীর ভাষা-ভাষীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ওই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিতে বললেন,
‘Upholding urge of existence is Dharmma.’ বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্তা বা
অস্তিত্বকে ধারণ এবং পালন করে উৎকর্ষতায় রক্ষা করার নাম ধর্ম। তথাপিও
আমরা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার, কু-সংস্কারের, অজ্ঞানতার আবরণ ভেদ করে
শুদ্ধ আমিটাকে বের করতে ব্যর্থ হলাম। তথাকথিত ইনটেলেকচ্যুয়াল হওয়া সত্বেও
ধর্মের নামে ফুল, বেলপাতা, ধূপবিহীন ধূপকাঠি, ফল-মিষ্টান্নাদির অঢেল
আয়োজনে, মাইক বাজিয়ে, শব্দবাজির আওয়াজ দিয়ে পরিবেশবিদদের চিন্তার
বলিরেখায় ভাঁজ ফেলে দিতে ইন্ধন যোগাচ্ছি। আর আমাদের গর্বের রবীন্দ্রনাথ
আমাদের দ্বিচারিতা দেখে কষ্ট পাচ্ছেন আর ভাবছেন, যে মানুষগুলো ‘তোমার
পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার
তলে’ ইত্যাদি ছন্দের ডালি সাজিয়ে ভক্তির আবেদন জানায়, তারাই আবার পূজার
নামে কু-সংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে বিশ্বাত্মাকে দূষিত করে চলেছে।
আমাদের বর্তমান যুগ যে যুক্তিবাদী সে কথা কোন চিন্তাশীল ব্যক্তি
অস্বীকার করবেন না আশাকরি। যেমন, সন্তানের হয়ে মা খেলে সন্তানের পেট ভরবে
না। ছাত্রের হয়ে শিক্ষক লেখাপড়া করলে ছাত্র পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে
না।–তেমনি প্রচলিত পূজার আয়োজকদের হয়ে কোন পুরোহিত পূজা করলে আয়োজকদের
কিছু ফললাভ হবে কি ?
অবশ্য পুরোহিতও জানেন না ফললাতের বিষয় সম্পর্কে। যদি জানতেন বিসর্জন
মন্ত্রে বলতেন না—ওঁ আবাহনং ন জানামি, নৈব জানামি পূজনম্। বিসর্জনং ন
জানামি ক্ষমস্ব পরমেশ্বরি (পরমেশ্বর)।–অর্থাৎ আমি আবাহনও জানিনা,
বিসর্জনও জানিনা, আমাকে ক্ষমা করুন। (দ্রঃ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা)
বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকার মত অনুযায়ী পূজ্য-প্রতিমা চঞ্চল চিত্তের
ধারণের জন্য একটি অবলম্বন। প্রতিমাকে ব্রহ্মের রূপ কল্পনা করে উপাসনা,
সংযম, সাত্তিক আহার, সাত্তিক বিহার ইত্যাদি ক্রিয়াকাণ্ডের মাধ্যমে পূজা
করা হয়।–যাতে পূজক বা উপাসক মনসংযোগ দ্বারা প্রতিমাকে হৃদয়ে ধারণ করে
প্রতিমার গুণে গুণান্বিত হতে পারে। এই হলো প্রতিমা পূজার মূল কথা।
এ থেকে এটুকু বোঝা গেল যে সততা, সংযম, ন্যায়নীতি ইত্যাদি মানবিক
গুণগুলোর প্রবহমানতাকে বৎসারান্তিক নবীকরণ করার মাধ্যম বাহ্য-পূজা
উদযাপনের উদ্দেশ্য। অথচ বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজার আয়োজন
বিশ্লেষণ করলে এর বিপরীত চিত্রটাই আমাদের বোধে ধরা পড়ে।
বিজ্ঞানের বিধি অনুযায়ী একটা নির্ভুল অংক কষতে গেলেও একটা শান্ত পরিবেশ
প্রয়োজন, একাগ্রতার প্রয়োজন। কিন্তু পূজার নামে, বেশীরভাগ
পূজা-প্রাঙ্গনগুলোতে ঢাকের আওয়াজ, মাইকের আওয়াজ, আয়োজকদের অহংকারের
আওয়াজে কোন সুস্থ মানুষের একটি ঘণ্টার জন্যও একাগ্রভাবে, স্থিরচিত্তে বসে
থাকতে পারার কথা নয়! অবশ্য দেবদেবীর ব্যাপারটা আলাদা। মাটির পুতুল বলেই
আমাদের সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে পারে! তাই কবিগুরুর ভাষার ‘তোমার
পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’ বাণীগুলো এক নির্মম সত্যের বার্তা দেয় না
কি ?
বাঙালিদের মানস-দেবী মা দুর্গা। ‘যা দেবি সর্বভূতেষু’ মন্ত্রে যাঁর
অস্তিত্বের স্বরূপ প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ দেবী সর্বভূতের প্রাণশক্তি
স্বরূপা, সর্বভূতে দেবী অধিষ্ঠিতা। এবার প্রশ্ন, যে দেবী সর্বভূতে
অধিষ্ঠিতা সেই পঞ্চ-মহাভূত পরিপোষিত স্বেদজ, ক্লেদজ, অণ্ডজ, জরায়ুজ-জাত
ভূতগুলোকে, বেঁচে থাকার জৈবাজৈব আবশ্যিক উপাদানগুলোকে দেবীর প্রতিভূ মনে
করে সম্বর্দ্ধিত না করে, সুস্থভাবে টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা না করে, কোন
যুক্তিতে মাটির প্রতিমা পূজার নামে প্রাণী হত্যা করে, নানাভাবে পরিবেশকে
দূষিত করার জন্য কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হয়!
ভাষা-বিজ্ঞান অনুযায়ী পূজা মানে পূরণ করা, সম্বর্দ্ধিত করা। যে
আচার-আচরণ পরিবেশের সাত্তিক জীবন-বর্দ্ধনার অভাবকে পূরণ করে, জৈবাজৈব
সবকিছুকে সম্যকরূপে বর্দ্ধিত করে, তার নাম পূজা। উৎকৃষ্ট প্রসব করে যা,
তার নাম উৎসব। আর যে আচার-আচরণ জীবনবৃদ্ধিকে নন্দিত করে তার নাম আনন্দ।
এখন প্রশ্ন, আমাদের প্রচলিত পূজা, উৎসবের উদযাপনকে কেন্দ্র করে আনন্দের
প্রকাশ বৃহত্তর পরিবেশকে কতখানি নন্দিত করে ‘পূজা’ শব্দের যথার্থতাকে
উপহার দিতে পেরেছে ? –এইসব বিষয়ে সত্তাপিয়াসী চিন্তাশীলদের চিন্তা করে
দেখা উচিত। বিশেষ করে যাঁরা কুসংস্কার বিরোধী রূপে নিজেদের বোধ ও বোধিকে
প্রতিষ্ঠিত করতে চান।
বাহ্য পূজাবাদীদের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী পূজা শুরুর আগে মৃন্ময়ী
মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। আয়োজকদের বিশ্বাস, পুরোহিতের
মন্ত্রবলে নিষ্প্রাণ মূর্তিগুলো প্রাণবন্ত হয়। তর্কের খাতিরে বিষয়টাকে
সত্য বলে যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে একটা প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে,
জীববিজ্ঞান অনুযায়ী জীবন্ত প্রাণীদের চলন, গমন, ইত্যাদি অভিব্যক্তি থাকা
আবশ্যিক। অতএব বিজ্ঞানসম্মত কারণেই পুরোহিতের মন্ত্রবলে দুর্গাঠাকুরের
চালচিত্রের জীবন্ত দেবদেবী, অসুর, সিংহ, ময়ূর, সাপ, পেঁচা, ইঁদুরেরা নিজ
নিজ অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে। কেউ চুপচাপ স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে পারবে
না। ফলে শুরু হয়ে যাবে মহিষাসুর মর্দিনীর বাস্তব উপস্থাপনা। অসুর,
দুর্গাকে আক্রমণ করবে, সিংহ গর্জন করতে করতে দেবীকে নিয়ে অসুরের দিকে
ধাবিত হবে, বাহনসহ অন্যান্য দেবদেবীরাও যোগদান করবে যুদ্ধে।–এবার
প্রশ্ন–ওই অবস্থায় পুরোহিত, আয়োজকেরা, ভক্তেরা, উদ্বোধন করতে আসা
সেলিব্রিটিরা, নেতা-মন্ত্রীরা কোন পক্ষে যোগদান করবেন? দেবীর পক্ষে না
অসুরের পক্ষে ?
আর একটা প্রশ্ন, যে পুরোহিত আদ্যিকালের দেবদেবীদের কল্পিত মাটির
মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম, তিনি মানুষের প্রাণহীন দেহে আরো
সহজে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন বা পারা উচিত। কারণ, বিজ্ঞান মতে,
মাটির মধ্যে থাকা অণু-পরমাণুর তুলনায় সদ্য মৃতদেহের অণু-পরমাণু বেশী
সক্রিয় থাকে, বেশী জীবন্ত থাকে। মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী সরকারের স্বাস্থ্য
বিভাগ এ বিযয়টা নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। তাহলে অনেক অকালমৃত্যু সহজে রোধ
করা যাবে।
সনাতন ধর্মীয় মতবাদ অনুযায়ী মানুষ অমৃতের পুত্র, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’
বলা হয়েছে। সেই মানুষ যাতে দশবিধ-সংস্কারে সংস্কৃত হয়ে প্রকৃষ্ট জাতক বা
প্রজা হয়, অকালে নিষ্প্রাণ না হয়, সন্ত্রাসবাদী না হয়, রেপ-কেসের আসামী
না হয়, নারীদের মা-দুর্গার প্রতীক জ্ঞানে সম্মান জানায়, ‘অসতো মা সদ্গময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যুর্মামৃতম্ গময়’-এর আদর্শ অনুসরণে সমৃদ্ধ
হয়,–সমাজের পুরোভাগে থেকে, ওইসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে পরিবেশের
হিতসাধন যাঁরা করতেন তাঁদের বলা হতো পুরোহিত।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত ঋষি বশিষ্ঠ রামচন্দ্রের রাজসভায়
অকালমৃত্যু-দেহে প্রাণ সঞ্চার করার স্পর্দ্ধা দেখান নি। বিজ্ঞান-যুগের
পুরোহিতেরা যদি পুতুলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, মৃতদেহেও পারা
উচিত! যদি না পারেন, ততঃ কিম্!
ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি, ‘পূজা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ সম্বর্দ্ধনা।
পূজ্য ব্যক্তিত্বের গুণে গুণান্বিত হয়ে নিজেকে এবং পরিবেশকে সম্বর্দ্ধিত
করা। এতদিন ধরে হাজার-হাজার দুর্গাপূজা করে আমাদের চিন্ময়ী নারীরা
কতখানি সমৃদ্ধ হয়েছে মা দুর্গার আদর্শ চরিত্রের চরিত্রায়নে ? আমাদের
চিন্ময় পুরুষেরা নারী সাধারণকে কতটা মা-দুর্গার প্রতীক মনে করে শ্রদ্ধা
করতে বা পূজা করতে শিখেছে ? আমরা সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির পথে কতটা এগিয়েছি?
আমাদের কতখানি দুর্গতি নাশ হয়েছে? আমাদের সার্বিক জীবন-চলনা দুর্গ-সম
পরিরক্ষিত হয়েছে কতটা?—তথ্য জানার অধিকার বলে এ বিষয়ে জানতে চাওয়াটা
নিশ্চয়ই অপরাধ হবে না! যদিও প্রচলিত তথ্য এর বিপরীত মত প্রকাশ করে চলেছে
দীর্ঘদিন ধরে। পূজাকে কেন্দ্র করে সাত্তিকতা বৃদ্ধি না পেলেও, তামসিকতা
বেড়ে যায় বহুগুণ। পুজোকে কেন্দ্র করে ভক্তদের অনিত্য দেহটাকে
পূজা-বিপরীত সাধের নানা বেশভূষায় সাজিয়ে দিতে বিকিকিনির পসরা সাজিয়ে
যারা বসেন, তারা কি পূজা-সদৃশ সততার দৃষ্টান্ত উপহার দেন সমাজকে ? পূজাই
যদি উদ্দেশ্য তবে ইভটিজিং, আদমটিজিং কেন হবে ? অপরাধ কেন বৃদ্ধি পাবে ?
দূষণ কেন বৃদ্ধি পাবে পূজাকে কেন্দ্র করে ?— এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে
?
দুর্গাপূজার বিষয়টাকে বাস্তববোধে চিন্তা করলে দেখা যাবে, আমাদের আলোচ্য
মা-দুর্গা পূজ্য তাঁর চরিত্রগুণে। মা দুর্গার সমার্থক, মা উমাকে আমরা
কন্যা জ্ঞান করি। তাইতো ফি বছর কৈলাস থেকে নিয়ে আসি। যদিও তাঁকে আনতে এবং
দিতে কে বা কারা যান। কোন রুটে দোলায়, নৌকায়, ঘোটকে এবং গজে যাতায়াত
করেন, সে খবর দেবার দায়িত্ব তথ্যাধিকারীদের, আমার নয়! তবে বাস্তবে মৃৎশিল্পীর কাছ থেকে মণ্ডপে আনা এবং মণ্ডপ থেকে জলাশয়ের বিসর্জনে নেওয়ার সময় পূজাসম সাত্তিকভাব পরিলক্ষিত হয় না।

তবে যাঁরা একটু সাত্তিক ভাবাপন্ন, তাঁরা
দশভুজার চাইতেও দ্বিভুজা উমাকে বেশী পছন্দ করেন বলেই না উমাকে নিয়ে কতই না
আগমনী গানের ডালি সাজিয়ে তাঁকে বরণ করে নিতে চায়। কামনা করি, ঘরে ঘরে
উমার মত আদর্শ মেয়ে যেন জন্মায়। উমাই তো আমাদের মা দুর্গা! ভারতেই শুধু
নয়, সারা বিশ্বের সংস্কৃত মনীষায় নারীজাতির আদর্শরূপে স্বীকৃত, পূজিত।
স্বীকৃতি পাবেনই না বা কেন, পূজিত হবেনই না বা কেন,–কারো কান-ভাঙানিতে
কান না দিয়ে পরমভক্ত-পরমজ্ঞানী শিবকে পতিরূপে বরণ করে, স্বামীর
মনোবৃত্যানুসারিণী স্ত্রী হয়ে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীদের ন্যায়
কৃতি সন্তানদের জননী হয়েছেন। তিনি একজন আদর্শ সংসারী নারী হয়েও অসৎ
নিরোধী তৎপর,–অশুভ শক্তিকে সমুচিত দণ্ড দেবার জন্য রণসাজে সজ্জিত
হয়েছেন। পশুরাজকে করেছেন বাহন। পারস্পরিক শত্রু খাদ্য-খাদক সম্পর্কের
পেঁচা-ইঁদুর, ময়ুর-সাপকে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। দুটি হাত দিয়েই
বৃহত্তর সংসারের দশদিক সামলাতেন। তাই তো তিনি দ্বিভূজা হয়েও দশ
ইন্দ্রিয়কে বশ করে হতে পেরেছেন দশভূজা। তাই তো তিনি দশপ্রহরণধারিণী। তাই
তো তিনি পূজ্য। –এহেন চরিত্র ‘দেবী’ জ্ঞানে, ‘জগজ্জননী’ জ্ঞানে স্বীকৃতি
তো পাবেনই। তাই তো আমাদের ঋষিরা দেবতাদের সম্মিলিত শক্তিতে সৃষ্ট দেবী
দুর্গা কাত্যায়ন অঙ্গনে মহিষাসুরকে বধ করার পর তাঁর প্রদর্শিত শক্তিকে
দৃষ্টান্ত স্বরূপ চিরস্থায়ী একটা আদর্শে রূপ দিয়েছিলেন। দেবী দুর্গাকে
স্ত্রীজাতির এক আদর্শ প্রতীক রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁরা দেবী দুর্গার ওই
অসৎ-নিরোধী তৎপরতাকে দৃষ্টান্ত বূপে তুলে ধরে নারীসাধারণকে দেবী রূপে,
জগন্মাতা রূপে মর্যাদা দিয়েছেন, কামিনীরূপে নয়। তাইতো বর্তমানেও
সম্ভ্রান্ত হিন্দু নারীদের মধ্যে দেবী পদবি প্রচলিত। ঋষিরা ছিলেন
বিজ্ঞানী। তাই তো তাঁরা দুর্গাপূজার বিধান দিলেন বাস্তব অনুশাসনের
মাধ্যমে। আত্মবিস্তার কল্পে গর্ভাধান-সংস্কারের সময় স্বামী, নিজের
স্ত্রীকে জগন্মাতা জ্ঞানে স্ত্রীর নাভিমূল স্পর্শ করে বলবেন, প্রসীদ মা
জগজ্জননী,–হে জগন্মাতার প্রতীকস্বরূপা চিন্ময়ী মা, তুমি প্রসন্ন হয়ে
আমাকৃত গর্ভাধান মাধ্যমে দেদীপ্যমান আত্মাকে আকর্ষণ কর।–ওই স্বীকৃতির
মাধ্যমে স্ত্রীকেও মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছেন, কামিনীজ্ঞানে নয়।
এর কারণ, স্বামী, স্ত্রীর মাধ্যমে নিজেকে জন্মান, তাই তিনি জায়া।
জীববিজ্ঞান অনুসারে প্রজনন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্ম-প্রতিলিপি গঠন করা
হয়। পুরুষ-বীজ ধারণ করে, বীজের প্রতিলিপি গঠন করে ভূমি-স্বরূপা নারী। জনন
করেন বলে জননী। তাই কৃষকেরা ফসল ফলাতে জমি কর্ষণ করে, কর্ষণ মানে আকর্ষণ,
যাতে জমি বীজ থেকে ভালো সন্তান (ফসল) আকর্ষণ করতে পারে। জমি অনুযায়ী
উপযুক্ত শুদ্ধ-বীজ বপনের আগে ভূমিকে আগাছা মুক্ত করে, সার দেয়, জল দেয়,
জমি জননক্ষম হলে জো বুঝে বীজ বোনে।–জমিকে মাতৃজ্ঞানে পোষণ দিয়ে ভূমিকে
পূজা করে—যাতে জমি বীজের অন্তর্নিহিত সত্তাকে ভালোভাবে পুষ্ট করতে পারে,
বীজের সত্তাকে ধারণ করে আদর্শ মা হয়ে ভালো ফসল ফলাতে পারে। ফসল ফলাতে যদি
গর্ভাধান প্রক্রিয়া থাকতে পারে, মানুষ ফলাতে তো আরও বেশী বিধি-নিয়ম থাকা
উচিত! আমাদের ঋষিরা ছিলেন প্রকৃত বিজ্ঞানী। বিজ্ঞান শব্দটিও উপনিষদ থেকে
উৎপত্তি হয়েছে। তাই ঋষিরা নারীদের জগন্মাতাজ্ঞানে ব্যবহার (treat) করতে,
শ্রদ্ধা (honour) করতে শিখিয়েছেন।–যার নাম প্রকৃত পূজা। যার মাধ্যমে
স্বভাবের স্ফূরণ হয়ে সব অভাবের পূরণ হয়।
এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন, “Accident-এ (আকস্মিকভাবে) যা’ জন্মে, তা
বুনো, বিহিত সুফলপ্রদ চাষে যা’ জন্মে তা’ পুণো (পুণ্য)। প্রবৃত্তি লালসায়
অবিধিপূর্বক উপগতি হয়ে যে সন্তান জন্মে, তার চরিত্রের কোন ঠিক ঠিক থাকে
না। গর্ভাধান সংস্কারের ভিতর দিয়ে উন্নত চিন্তাপ্রসূত বিধিমাফিক পবিত্র
যে জন্ম, তার রকমই আলাদা। ঘরে ঘরে ভগবান জন্মে। তেমনি ছিল আমাদের
বিধান।’’ (আঃ প্রঃ ১৮/১৩) অতএব আমাদের ঘরের মা দুর্গারা যেদিন আবার ঘরে
ঘরে ভগবান জন্মাতে পারবেন সেদিন সার্থক হবে আমাদের দুর্গাপূজা।
দুর্গাপূজার বাস্তবতা তুলে ধরতে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেনঃ
“….যে মৃন্ময় মূর্ত্তি
আমরা পূজা করি—
কল্পনায় প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করে,–
তিনি দশভূজা,
দশপ্রহরণ-ধারিণী—
ঐ আমাদের মায়েরই প্রতীক—
আমাদের ঘরে ঘরে
যে মা অধিষ্ঠিতা
তাঁরই বিনায়িত সুসঙ্গত প্রতীক;
তাই ঐ মায়ের পূজা মানেই হচ্ছে—
যে মা আমার,
যে মা তোমার,
যে মা ঘরে ঘরে
দুর্গা হয়ে অধিষ্ঠিতা,
দুর্গতিনাশিনী হয়ে
দশপ্রহরণ ধারণ করে
সন্তান-সংরক্ষণায় নিয়োজিতা,
সেই মায়েরই পূজা;………..”
(আশীষ বাণী, ৬২/শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র)
“মা আমাদের দশভুজা,
প্রতি ঘরে ঘরে
যদিও তাঁকে
দ্বিভুজাই দেখতে পাই,
তিনি
দশদিক্ আবরিত করে রেখেছেন—
তাঁর স্নেহ-উৎসারিত
স্বস্তি-উৎসারিণী উদাত্ত অনুচর্য্যায়,
কায়মনোবাক্যে
প্রতিটি কর্ম্মের ভিতর-দিয়ে
ব্যষ্টির পথে
সমষ্টিকে আন্দোলিত করে,
সাত্বত উৎসর্জ্জনায়
আপূরিত করে সবাইকে,
কৃতি-উদ্দীপনার অনুপ্রেরণায়—
তাই মা আমার দশভূজা;……”
(আশীষ বাণী, ৫৯/শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র)
“পূজা মানেই হল বর্দ্ধনা। (আঃ প্রঃ ১২-১২-১৯৪১)
আমি আপনার পূজা করছি মানে, আপনার গুণ চিন্তা করছি এবং নিত্য অনুশীলনের
মাধ্যমে ঐ গুণগুলি আমার চরিত্রগত করে তুলছি, আমার ভিতরে বাড়িয়ে তুলছি।
স্তব করি মানে গুণ বর্ণনা করি। তা কিন্তু শুধু মুখে বা মনে-মনে করলেই
হবে না, প্রতিদিনকার অভ্যাস ও অনুশীলনের ভিতর দিয়ে ঐ গুণগুলি আমার
চরিত্রে মূর্ত্ত করে তোলা চাই।’’ (দীপরক্ষী ৪/১৮২)
।। পূজা কেমন করে করতে হবে ।।
“দেবতার পূজা-অর্চনা করতে গেলে আগে ইষ্টের ভাব অন্তরে জাগ্রত করে সেই
ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে, দেবতার স্মরণ মনন করতে হয়। তাঁকে স্মরণ করা
মানে—তাঁর চলন-চরিত্র ও গুণ গরিমা স্মৃতিতে এনে অনুশীলনের ভিতর দিয়ে
আয়ত্ব করা। চরণ-পূজা মানে চলন পূজা। ইষ্টের চলনাকে নিজের জীবনে আয়ত্ত
ক’রে ঐ চলনের প্রসারতা ও সম্বর্দ্ধনা যদি না ঘটাই বাস্তবে, তাহলে তাঁর
চরণ-পূজা সার্থক হয় না। আমরা ফাঁকতালে কাম সারতে চাই, কিন্তু বিধি বড়
কঠিন বান্দা, কোন চালাকি চলে না তাঁর কাছে।” —শ্রীশ্রীঠাকুর
অনুকূলচন্দ্র
(আ. প্র. ২৯. ১২. ১৯৪২)
“প্রশ্ন। হিন্দুরা দেবদেবীর পূজা করেন কিন্তু মুসলমানেরা একমাত্র
খোদাতায়ালার পূজা ক’রে থাকেন। হজরত ত’ ছবি ও পুতুল-পূজা একেবারেই নিষেধ
ক’রে গেছেন, কিন্তু আপনি এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য করছেন কেমন-ক’রে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর । ধর্ম্ম-আচরণের দিক দিয়ে হজরত রসুলও যা’ ব’লে গেছেন,
আর্য্যদের ধর্ম্মশাস্ত্র চিরকালই ঋষির নিদেশরূপে তাই বহন ক’রে আসছে।
আর্য্য-ধর্ম্মশাস্ত্র ছবি বা পুতুল-পূজা এমনতর বিকট তাচ্ছিল্যের সহিত
নিরস্ত করতে ঘোষণা ক’রেছেন—এমন-কি অধমাধম বলতেও ক্ষান্ত হন নি। তবে
আর্য্য-ঋষিদের প্রত্যেক মানুষকে উন্নতির পথে নিয়ন্ত্রণ করবার এমনতর একটা
ঝোঁক ছিল—যা-নাকি হজরত রসুলের ভিতর দেখেত পাওয়া যায়–………..”
(ইসলাম-প্রসঙ্গে/শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র/পৃঃ ২৮-২৯)
‘‘ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ, ভক্ত রামপ্রসাদ, সাধক রামকৃষ্ণ, সর্ব্বানন্দ
ঠাকুর প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ প্রতিমা পূজা করেছেন বটে, তাঁদের ঐ
পূজার পিছনে ছিল গুরু-পূজা, ইষ্ট-আরাধনা ; ঐ প্রতিমার পরিকল্পনার ভেতর
দিয়ে ছিল অশেষ ও অঢেলভাবে ইষ্টানুরক্তি। তাই, ঐ অধম অবলম্বনও তাঁদিগকে
অধমভাবে আটকে রাখতে পারে নি। তাঁদের ঐ চলনার পথে একটা সময় এসেছিল, তখন
তাঁদের ঐ প্রতিমা তাঁদের দর্শনের সম্মুখে আর ও-রকম ছিল না। ভগবান
রামকৃষ্ণদেবেরও শোনা গিয়েছে—তাঁর এমনতর সময় এসেছিল, যখন
মূর্ত্তি-টুর্ত্তি তাঁর সাধনার পথে বাধাই সৃষ্টি করতো। তিনি এমন-কি তাঁর
ঘরে যে-সমস্ত ছবি-টবি ছিল, সেগুলিকেও সরিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি না-কি এই
বলেছিলেন—‘মেয়েরা ততদিন পুতুলখেলা করে, যতদিন তার বে’ না হয়,
স্বামী-সহবাস না করে।’ সাধক রামপ্রসাদ তাঁর স্বরচিত গানের ভেতরেই তো
বলেছেন—
‘‘ধাতু-পাষাণ মাটির মূর্ত্তি
কাজ কি রে তোর আরাধনে
তুই মনোময় প্রতিমা গড়ি’
বসা হৃদি-পদ্মাসনে।।’’
এমন কত কি যে আছে, তার ইয়ত্তা নেই।’’
(–শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, কথা প্রসঙ্গে, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৭৬, ১৭-১০-১৩৪২)
এবার আমরা এক়টু দেখে দেখে নেব, পূজা প্রসঙ্গে ‘মেরা ভারত মহান’-এর
অন্যান্য মহানেরা এবং মহান গ্রন্থগুলো কি নিদেশ রেখে গেছেন।
পূজা বিষয়ে মহানির্ব্বাণতন্ত্র নামক তন্ত্রশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছেঃ
‘‘উত্তমো ব্রহ্মসদ্ভাবো ধ্যানভাবশ্চ মধ্যমঃ।
অধমস্তপোজপশ্চ বাহ্যপূজাহধমাধমঃ।।’’
মহানির্ব্বাণতন্ত্রকে সমর্থন করে ভারতে বিবেকানন্দ গ্রন্থের ৩৩৬
পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘সকলস্থলে ব্রহ্মদর্শন সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট।
ধ্যান মধ্যম, স্তুতি ও জপ অধম, বাহ্যপূজা অধমেরও অধম।’’
‘‘যে-ব্যক্তি সর্ব্বভূতব্যাপী ঈশ্বরকে ত্যাগ করিয়া মূর্খতাবশতঃ
প্রতিমার পূজা করে, সে ভস্মে হোম করে।’’ –শ্রীমদ্ভাগবত। ৩-২৯-২২
“ঈশ্বরঃ সর্ব্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জ্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্ সর্ব্বভূতানি যন্ত্ররূঢ়ানি মায়য়া।।“
–গীতা, ১৮।৬৫
“যিনি এই সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহার নিজের স্বধর্মানুরূপ
নিষ্কাম কর্মাচরণ দ্বারা (বাক্য বা ফুলজল দ্বারা নহে) পূজা করিয়া মানুষ
সিদ্ধি লাভ করে । স্বধর্মানুরূপ (বর্ণানুগ সত্তাধর্ম পালন) নিষ্কাম কর্মই
পরমেশ্বরের পূজার ডালি । (গীতা ১৮।৪৬)
“যে ব্যক্তি সর্বভূতব্যাপী ঈশ্বরকে ত্যাগ করিয়া মূর্খতাবশতঃ প্রতিমার
পূজা করে, স (শ্রীমদ্ভাগবত ৩।২৯।২২)
পূজা বিষয়ে মহানির্ব্বাণতন্ত্র নামক তন্ত্রশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছেঃ
‘‘উত্তমো ব্রহ্মসদ্ভাবো ধ্যানভাবশ্চ মধ্যমঃ।
অধমস্তপোজপশ্চ বাহ্যপূজাহধমাধমঃ।।’’
মহানির্ব্বাণতন্ত্রকে সমর্থন করে ভারতে বিবেকানন্দ গ্রন্থের ৩৩৬
পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘সকলস্থলে ব্রহ্মদর্শন সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট।
ধ্যান মধ্যম, স্তুতি ও জপ অধম, বাহ্যপূজা অধমেরও অধম।’’
তাই, শাস্ত্র বর্ণিত অধমের চাইতেও অধম পূজায় মেতে উঠে আমাদের যাতে
ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে জবাবদিহি করতে না হয়, তাই, শ্রীশ্রীঠাকুর
অনুকূলচন্দ্র আমাদের নিত্য বাস্তব দুর্গাপূজার পূজারী করে তুলতে
সৎসঙ্গীদের নিত্যপাঠ্য ‘সত্যানুসরণ’ নামক মহাগ্রন্থে নারীকে জগজ্জননী
জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করতে নিদেশ দিয়ে বললেন, ‘‘প্রত্যেকের মা-ই জগজ্জননী ।
প্রত্যেক মেয়েই নিজের মায়ের বিভিন্নরূপ, এমনতর ভাবতে হয় ।’’ এবং
পুণ্যপুঁথি গ্রন্থে বললেন, ‘‘স্ত্রীতে কামিনীবুদ্ধি করে যে-জন, তাহার হয়
না ভবের বন্ধন মোচন । …..স্ত্রী চিন্ময়ী মা।’’—এই শিক্ষার ধারাকে
বাস্তবায়িত করার নাম প্রকৃত দুর্গাপূজা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর শুধু পুরুষদেরই প্রতিনিয়ত দুর্গাপূজা করার বিধান দিয়েই
ক্ষান্ত হননি, নারী-সাধারণের মধ্যেও দেবী দুর্গার এক স্থায়ী আসন পেতে
দিতে অনুশ্রুতির বাণীতে বললেন—
‘‘শার্দ্দুলেরে বাহন করে
সাপের ফণার মালা পরে
কালবোশেখী ঝঞ্ঝাবেগে
ছোটরে নারী ছোটরে ছোট্ ।
দত্যিদানার নীচ বাহানা
আর্য্যাবর্তে দিয়ে হানা
ঘূর্ণিপাকের বেতাল গাঁথায়
হুলিয়ে ভুলিয়ে দিচ্ছে চোট্ ।
দশ প্রহরণ দশ হাতে ধর
বক্ষবিদরি ধ্বংসি ইতর
সূর্য্যরাগী বজ্রতেজে
আর্য্যনারী শত্রু টোট্ ।”
তিনি নারীকে অবলা নয়, সবলারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন । নারীর সতীত্বই
নারীকে সবলা করে তোলে। তাই তিনি কত আশা নিয়ে বললেন—
‘‘সতীর তেজে ঝলসে দে মা
নিঠুর কঠোর অন্ধকারে
মদনভস্ম বহ্নিরাগে
বৃত্তি-রিপু দে ছারখারে ।
প্রণবতালে ইষ্টমন্ত্র
ঝঙ্কারি তোল সকলতন্ত্রে
বিষাণ হাঁকে রুদ্র দোলায়
বজ্রে হানি মৃত্যুদ্বারে।’’
মা দুর্গার আদর্শে অনুরঞ্জিত উক্ত বাণীগুলো যাতে তার সন্তানদের মননশীলতায়
মা দুর্গার
তাই আসুন, পূজার নামে অনিত্য-বস্তুর প্রতিযোগিতায় না মেতে, সব দেবতার
সমাহার-স্বরূপ যুগ-পুরুষোত্তমের বিধি মেনে, মা দুর্গার নিত্য-সিদ্ধ
দেদীপ্যমান আদর্শের আলোকে, আমাদের ঘরের মেয়েরা যাতে রাষ্ট্রপূজার
অর্ঘ্যস্বরূপ সুজননে সুসন্তানের উপহার সাজিয়ে,
শক্তিরূপিণী-দশপ্রহরণধারিণী সাজে সজ্জিত হয়ে নরাসুরদের কিভাবে দমন করে
অস্তিত্ব রক্ষার পূজার পূজারী হতে পারে,– সেই চেষ্টায় যত্নবান হই।
জয়গুরু ! বন্দে পুরুষোত্তমম্!
***************************************

পূজা ও ধর্ম

।। পূজা ও ধর্ম ।।

নিবেদনে—তপন দাস

***********************************

আমাদের প্রচলিত ধারণায় প্রচলিত পূজা হচ্ছে ধর্ম পালনের একটা মাধ্যম। তথাকথিত পুরোহিত বা ঠাকুর মহাশয়ের ফর্দ মেনে, একটু দর কষাকষি করে উপকরণ সংগ্রহ করে এনে দিলেই হলো। (লাইট, মাইক, প্যাণ্ডেল, থিম, বাজি-বাজনা ইত্যাদি ফর্দ-অন্তর্ভূক্ত কিনা বলতে পারব না।) আয়োজকের প্রতিনিধি হয়ে দেবদেবীকে তুষ্ট করবেন তথাকথিত পুরোহিত মহোদয়। আহুত, অনাহুত, রবাহুত দর্শকেরা আয়োজনের বিচার-বিশ্লেষণ করবেন। এইরকম একটা আয়োজনকে আমরা পুজো বলতে অভ্যস্ত।

বাস্তবে, শব্দার্থ এবং মর্মার্থ অনুযায়ী পূজা মানে সম্বর্ধনা। পূজ্য চরিত্রের গুণ অনুশীলন করে নিজেকে সম্বর্ধিত করা। আর ধর্ম মানে ধারণ করা। নিজের এবং অপরের অস্তিত্বের ধারক, পালক ও পোষক হবার জন্য যা যা করা হয়, তাই ধর্ম। জীবনবর্দ্ধনার অপচয়ী অনিত্যকে ত্যাগ করে, জীবনবর্দ্ধনার উপচয়ী নিত্য-এর উপাসনা করা, আরাধনা করা। যার যার, তার তার, পালনীয়। কোনো ভায়া-মিডিয়া দিয়ে হবে না। যার ক্ষিদে তাকেই খেতে হবে, ক্ষুধার্তের হয়ে অন্য কেউ খেলে ক্ষুধার্তের কি পেট ভরবে? অথচ আমরা এই কাজটাই করে চলেছি। যাঁর পুজোর নামে মেতে উঠছি, তাঁর আদর্শ কি, তাও জানিনা, কিভাবে অনুশীলন করতে হয়, তাও করি না। আমাদের কাজ চাঁদা দেওয়া, নতুন পোশাক পরা, ধুপহীন ধুপকাঠি, ফল-মিষ্টি মণ্ডপে দিয়ে প্রতিমার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে সমস্যার সমাধান চাওয়া। আর খাওয়া দাওয়া, ভিড় ঠেলে চেঁচামেচি, মাইকের আওয়াজ, হৈ-হট্টগোলকে সাথী করে এ প্যাণ্ডেল থেকে ও প্যাণ্ডেলে পর্যটন করা! ব্যস্!

*****************************************

যাইহোক এবার একটু গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করি।

ভারতের আর্য্য-ঋষিগণ, অবতার-বরিষ্ঠগণ প্রত্যেকেই সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির

উপাসনার কথা বলেছেন ধর্মের নামে, পূজার নামে। বর্তমান পুরুষোত্তম

শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র আরও একটু সহজ করে দিয়ে বললেন, ‘‘ধর্ম্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে/সম্প্রদায়টা ধর্ম্ম না-রে। অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে/ধর্ম্ম

বলে জানিস্ তাকে। পূর্বতনে মানে না যারা/জানিস্ নিছক ম্লেচ্ছ তা’রা।’’

‘‘পূজা-আর্চ্চা মানেই কিন্তু /দৈবগুণ যা সেধে নেওয়া। হাতে-কলমে মক্স

করে/বাস্তবে তার রূপটি দেওয়া।।’’

ইত্যাদি ছড়াবাণীগুলো সহজ, সরল, ওজস্বী

আবদনে সমৃদ্ধ হলেও একটা নির্দিষ্ট গণ্ডীর ভাষা-ভাষীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

ওই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিতে বললেন,

‘Upholding urge of existence is Dharmma.’ বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্তা বা

অস্তিত্বকে ধারণ এবং পালন করে উৎকর্ষতায় রক্ষা করার নাম ধর্ম। তথাপিও

আমরা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার, কু-সংস্কারের, অজ্ঞানতার আবরণ ভেদ করে

শুদ্ধ আমিটাকে বের করতে ব্যর্থ হলাম। তথাকথিত ইনটেলেকচ্যুয়াল হওয়া সত্বেও

ধর্মের নামে ফুল, বেলপাতা, ধূপবিহীন ধূপকাঠি, ফল-মিষ্টান্নাদির অঢেল

আয়োজনে, মাইক বাজিয়ে, শব্দবাজির আওয়াজ দিয়ে পরিবেশবিদদের চিন্তার

বলিরেখায় ভাঁজ ফেলে দিতে ইন্ধন যোগাচ্ছি। আর আমাদের গর্বের রবীন্দ্রনাথ

আমাদের দ্বিচারিতা দেখে কষ্ট পাচ্ছেন আর ভাবছেন, যে মানুষগুলো ‘তোমার

পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার

তলে’ ইত্যাদি ছন্দের ডালি সাজিয়ে ভক্তির আবেদন জানায়, তারাই আবার পূজার

নামে কু-সংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে বিশ্বাত্মাকে দূষিত করে চলেছে।

আমাদের বর্তমান যুগ যে যুক্তিবাদী সে কথা কোন চিন্তাশীল ব্যক্তি

অস্বীকার করবেন না আশাকরি। যেমন, সন্তানের হয়ে মা খেলে সন্তানের পেট ভরবে

না। ছাত্রের হয়ে শিক্ষক লেখাপড়া করলে ছাত্র পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে

না।–তেমনি প্রচলিত পূজার আয়োজকদের হয়ে কোন পুরোহিত পূজা করলে আয়োজকদের

কিছু ফললাভ হবে কি ?

অবশ্য পুরোহিতও জানেন না ফললাতের বিষয় সম্পর্কে। যদি জানতেন বিসর্জন

মন্ত্রে বলতেন না—ওঁ আবাহনং ন জানামি, নৈব জানামি পূজনম্। বিসর্জনং ন

জানামি ক্ষমস্ব পরমেশ্বরি (পরমেশ্বর)।–অর্থাৎ আমি আবাহনও জানিনা,

বিসর্জনও জানিনা, আমাকে ক্ষমা করুন। (দ্রঃ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা)

বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকার মত অনুযায়ী পূজ্য-প্রতিমা চঞ্চল চিত্তের

ধারণের জন্য একটি অবলম্বন। প্রতিমাকে ব্রহ্মের রূপ কল্পনা করে উপাসনা,

সংযম, সাত্তিক আহার, সাত্তিক বিহার ইত্যাদি ক্রিয়াকাণ্ডের মাধ্যমে পূজা

করা হয়।–যাতে পূজক বা উপাসক মনসংযোগ দ্বারা প্রতিমাকে হৃদয়ে ধারণ করে

প্রতিমার গুণে গুণান্বিত হতে পারে। এই হলো প্রতিমা পূজার মূল কথা।

এ থেকে এটুকু বোঝা গেল যে সততা, সংযম, ন্যায়নীতি ইত্যাদি মানবিক

গুণগুলোর প্রবহমানতাকে বৎসারান্তিক নবীকরণ করার মাধ্যম বাহ্য-পূজা

উদযাপনের উদ্দেশ্য। অথচ বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজার আয়োজন

বিশ্লেষণ করলে এর বিপরীত চিত্রটাই আমাদের বোধে ধরা পড়ে।

বিজ্ঞানের বিধি অনুযায়ী একটা নির্ভুল অংক কষতে গেলেও একটা শান্ত পরিবেশ

প্রয়োজন, একাগ্রতার প্রয়োজন। কিন্তু পূজার নামে, বেশীরভাগ

পূজা-প্রাঙ্গনগুলোতে ঢাকের আওয়াজ, মাইকের আওয়াজ, আয়োজকদের অহংকারের

আওয়াজে কোন সুস্থ মানুষের একটি ঘণ্টার জন্যও একাগ্রভাবে, স্থিরচিত্তে বসে

থাকতে পারার কথা নয়! অবশ্য দেবদেবীর ব্যাপারটা আলাদা। মাটির পুতুল বলেই

আমাদের সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে পারে! তাই কবিগুরুর ভাষার ‘তোমার

পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’ বাণীগুলো এক নির্মম সত্যের বার্তা দেয় না

কি ?

বাঙালিদের মানস-দেবী মা দুর্গা। ‘যা দেবি সর্বভূতেষু’ মন্ত্রে যাঁর

অস্তিত্বের স্বরূপ প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ দেবী সর্বভূতের প্রাণশক্তি

স্বরূপা, সর্বভূতে দেবী অধিষ্ঠিতা। এবার প্রশ্ন, যে দেবী সর্বভূতে

অধিষ্ঠিতা সেই পঞ্চ-মহাভূত পরিপোষিত স্বেদজ, ক্লেদজ, অণ্ডজ, জরায়ুজ-জাত

ভূতগুলোকে, বেঁচে থাকার জৈবাজৈব আবশ্যিক উপাদানগুলোকে দেবীর প্রতিভূ মনে

করে সম্বর্দ্ধিত না করে, সুস্থভাবে টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা না করে, কোন

যুক্তিতে মাটির প্রতিমা পূজার নামে প্রাণী হত্যা করে, নানাভাবে পরিবেশকে

দূষিত করার জন্য কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হয়!

ভাষা-বিজ্ঞান অনুযায়ী পূজা মানে পূরণ করা, সম্বর্দ্ধিত করা। যে

আচার-আচরণ পরিবেশের সাত্তিক জীবন-বর্দ্ধনার অভাবকে পূরণ করে, জৈবাজৈব

সবকিছুকে সম্যকরূপে বর্দ্ধিত করে, তার নাম পূজা। উৎকৃষ্ট প্রসব করে যা,

তার নাম উৎসব। আর যে আচার-আচরণ জীবনবৃদ্ধিকে নন্দিত করে তার নাম আনন্দ।

এখন প্রশ্ন, আমাদের প্রচলিত পূজা, উৎসবের উদযাপনকে কেন্দ্র করে আনন্দের

প্রকাশ বৃহত্তর পরিবেশকে কতখানি নন্দিত করে ‘পূজা’ শব্দের যথার্থতাকে

উপহার দিতে পেরেছে ? –এইসব বিষয়ে সত্তাপিয়াসী চিন্তাশীলদের চিন্তা করে

দেখা উচিত। বিশেষ করে যাঁরা কুসংস্কার বিরোধী রূপে নিজেদের বোধ ও বোধিকে

প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

বাহ্য পূজাবাদীদের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী পূজা শুরুর আগে মৃন্ময়ী

মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। আয়োজকদের বিশ্বাস, পুরোহিতের

মন্ত্রবলে নিষ্প্রাণ মূর্তিগুলো প্রাণবন্ত হয়। তর্কের খাতিরে বিষয়টাকে

সত্য বলে যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে একটা প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে,

জীববিজ্ঞান অনুযায়ী জীবন্ত প্রাণীদের চলন, গমন, ইত্যাদি অভিব্যক্তি থাকা

আবশ্যিক। অতএব বিজ্ঞানসম্মত কারণেই পুরোহিতের মন্ত্রবলে দুর্গাঠাকুরের

চালচিত্রের জীবন্ত দেবদেবী, অসুর, সিংহ, ময়ূর, সাপ, পেঁচা, ইঁদুরেরা নিজ

নিজ অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে। কেউ চুপচাপ স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে পারবে

না। ফলে শুরু হয়ে যাবে মহিষাসুর মর্দিনীর বাস্তব উপস্থাপনা। অসুর,

দুর্গাকে আক্রমণ করবে, সিংহ গর্জন করতে করতে দেবীকে নিয়ে অসুরের দিকে

ধাবিত হবে, বাহনসহ অন্যান্য দেবদেবীরাও যোগদান করবে যুদ্ধে।–এবার

প্রশ্ন–ওই অবস্থায় পুরোহিত, আয়োজকেরা, ভক্তেরা, উদ্বোধন করতে আসা

সেলিব্রিটিরা, নেতা-মন্ত্রীরা কোন পক্ষে যোগদান করবেন? দেবীর পক্ষে না

অসুরের পক্ষে ?

আর একটা প্রশ্ন, যে পুরোহিত আদ্যিকালের দেবদেবীদের কল্পিত মাটির

মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম, তিনি মানুষের প্রাণহীন দেহে আরো

সহজে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন বা পারা উচিত। কারণ, বিজ্ঞান মতে,

মাটির মধ্যে থাকা অণু-পরমাণুর তুলনায় সদ্য মৃতদেহের অণু-পরমাণু বেশী

সক্রিয় থাকে, বেশী জীবন্ত থাকে। মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী সরকারের স্বাস্থ্য

বিভাগ এ বিযয়টা নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। তাহলে অনেক অকালমৃত্যু সহজে রোধ

করা যাবে।

সনাতন ধর্মীয় মতবাদ অনুযায়ী মানুষ অমৃতের পুত্র, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’

বলা হয়েছে। সেই মানুষ যাতে দশবিধ-সংস্কারে সংস্কৃত হয়ে প্রকৃষ্ট জাতক বা

প্রজা হয়, অকালে নিষ্প্রাণ না হয়, সন্ত্রাসবাদী না হয়, রেপ-কেসের আসামী

না হয়, নারীদের মা-দুর্গার প্রতীক জ্ঞানে সম্মান জানায়, ‘অসতো মা সদ্গময়,

তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যুর্মামৃতম্ গময়’-এর আদর্শ অনুসরণে সমৃদ্ধ

হয়,–সমাজের পুরোভাগে থেকে, ওইসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে পরিবেশের

হিতসাধন যাঁরা করতেন তাঁদের বলা হতো পুরোহিত।

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত ঋষি বশিষ্ঠ রামচন্দ্রের রাজসভায়

অকালমৃত্যু-দেহে প্রাণ সঞ্চার করার স্পর্দ্ধা দেখান নি। বিজ্ঞান-যুগের

পুরোহিতেরা যদি পুতুলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, মৃতদেহেও পারা

উচিত! যদি না পারেন, ততঃ কিম্!

ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি, ‘পূজা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ সম্বর্দ্ধনা।

পূজ্য ব্যক্তিত্বের গুণে গুণান্বিত হয়ে নিজেকে এবং পরিবেশকে সম্বর্দ্ধিত

করা। এতদিন ধরে হাজার-হাজার দুর্গাপূজা করে আমাদের চিন্ময়ী নারীরা

কতখানি সমৃদ্ধ হয়েছে মা দুর্গার আদর্শ চরিত্রের চরিত্রায়নে ? আমাদের

চিন্ময় পুরুষেরা নারী সাধারণকে কতটা মা-দুর্গার প্রতীক মনে করে শ্রদ্ধা

করতে বা পূজা করতে শিখেছে ? আমরা সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির পথে কতটা এগিয়েছি?

আমাদের কতখানি দুর্গতি নাশ হয়েছে? আমাদের সার্বিক জীবন-চলনা দুর্গ-সম

পরিরক্ষিত হয়েছে কতটা?—তথ্য জানার অধিকার বলে এ বিষয়ে জানতে চাওয়াটা

নিশ্চয়ই অপরাধ হবে না! যদিও প্রচলিত তথ্য এর বিপরীত মত প্রকাশ করে চলেছে

দীর্ঘদিন ধরে। পূজাকে কেন্দ্র করে সাত্তিকতা বৃদ্ধি না পেলেও, তামসিকতা

বেড়ে যায় বহুগুণ। পুজোকে কেন্দ্র করে ভক্তদের অনিত্য দেহটাকে

পূজা-বিপরীত সাধের নানা বেশভূষায় সাজিয়ে দিতে বিকিকিনির পসরা সাজিয়ে

যারা বসেন, তারা কি পূজা-সদৃশ সততার দৃষ্টান্ত উপহার দেন সমাজকে ? পূজাই

যদি উদ্দেশ্য তবে ইভটিজিং, আদমটিজিং কেন হবে ? অপরাধ কেন বৃদ্ধি পাবে ?

দূষণ কেন বৃদ্ধি পাবে পূজাকে কেন্দ্র করে ?— এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে

?

দুর্গাপূজার বিষয়টাকে বাস্তববোধে চিন্তা করলে দেখা যাবে, আমাদের আলোচ্য

মা-দুর্গা পূজ্য তাঁর চরিত্রগুণে। মা দুর্গার সমার্থক, মা উমাকে আমরা

কন্যা জ্ঞান করি। তাইতো ফি বছর কৈলাস থেকে নিয়ে আসি। যদিও তাঁকে আনতে এবং

দিতে কে বা কারা যান। কোন রুটে দোলায়, নৌকায়, ঘোটকে এবং গজে যাতায়াত

করেন, সে খবর দেবার দায়িত্ব তথ্যাধিকারীদের, আমার নয়! তবে আমি এবং আমরা

দশভুজার চাইতেও দ্বিভুজা উমাকে বেশী পছন্দ করি বলেই না উমাকে নিয়ে কতই না

আগমনী গানের ডালি সাজিয়ে তাঁকে বরণ করে নিতে চাই। কামনা করি, ঘরে ঘরে

উমার মত আদর্শ মেয়ে যেন জন্মায়। উমাই তো আমাদের মা দুর্গা! ভারতেই শুধু

নয়, সারা বিশ্বের সংস্কৃত মনীষায় নারীজাতির আদর্শরূপে স্বীকৃত, পূজিত।

স্বীকৃতি পাবেনই না বা কেন, পূজিত হবেনই না বা কেন,–কারো কান-ভাঙানিতে

কান না দিয়ে পরমভক্ত-পরমজ্ঞানী শিবকে পতিরূপে বরণ করে, স্বামীর

মনোবৃত্যানুসারিণী স্ত্রী হয়ে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীদের ন্যায়

কৃতি সন্তানদের জননী হয়েছেন। তিনি একজন আদর্শ সংসারী নারী হয়েও অসৎ

নিরোধী তৎপর,–অশুভ শক্তিকে সমুচিত দণ্ড দেবার জন্য রণসাজে সজ্জিত

হয়েছেন। পশুরাজকে করেছেন বাহন। পারস্পরিক শত্রু খাদ্য-খাদক সম্পর্কের

পেঁচা-ইঁদুর, ময়ুর-সাপকে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। দুটি হাত দিয়েই

বৃহত্তর সংসারের দশদিক সামলাতেন। তাই তো তিনি দ্বিভূজা হয়েও দশ

ইন্দ্রিয়কে বশ করে হতে পেরেছেন দশভূজা। তাই তো তিনি দশপ্রহরণধারিণী। তাই

তো তিনি পূজ্য। –এহেন চরিত্র ‘দেবী’ জ্ঞানে, ‘জগজ্জননী’ জ্ঞানে স্বীকৃতি

তো পাবেনই। তাই তো আমাদের ঋষিরা দেবতাদের সম্মিলিত শক্তিতে সৃষ্ট দেবী

দুর্গা কাত্যায়ন অঙ্গনে মহিষাসুরকে বধ করার পর তাঁর প্রদর্শিত শক্তিকে

দৃষ্টান্ত স্বরূপ চিরস্থায়ী একটা আদর্শে রূপ দিয়েছিলেন। দেবী দুর্গাকে

স্ত্রীজাতির এক আদর্শ প্রতীক রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁরা দেবী দুর্গার ওই

অসৎ-নিরোধী তৎপরতাকে দৃষ্টান্ত বূপে তুলে ধরে নারীসাধারণকে দেবী রূপে,

জগন্মাতা রূপে মর্যাদা দিয়েছেন, কামিনীরূপে নয়। তাইতো বর্তমানেও

সম্ভ্রান্ত হিন্দু নারীদের মধ্যে দেবী পদবি প্রচলিত। ঋষিরা ছিলেন

বিজ্ঞানী। তাই তো তাঁরা দুর্গাপূজার বিধান দিলেন বাস্তব অনুশাসনের

মাধ্যমে। আত্মবিস্তার কল্পে গর্ভাধান-সংস্কারের সময় স্বামী, নিজের

স্ত্রীকে জগন্মাতা জ্ঞানে স্ত্রীর নাভিমূল স্পর্শ করে বলবেন, প্রসীদ মা

জগজ্জননী,–হে জগন্মাতার প্রতীকস্বরূপা চিন্ময়ী মা, তুমি প্রসন্ন হয়ে

আমাকৃত গর্ভাধান মাধ্যমে দেদীপ্যমান আত্মাকে আকর্ষণ কর।–ওই স্বীকৃতির

মাধ্যমে স্ত্রীকেও মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছেন, কামিনীজ্ঞানে নয়।

এর কারণ, স্বামী, স্ত্রীর মাধ্যমে নিজেকে জন্মান, তাই তিনি জায়া।

জীববিজ্ঞান অনুসারে প্রজনন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্ম-প্রতিলিপি গঠন করা

হয়। পুরুষ-বীজ ধারণ করে, বীজের প্রতিলিপি গঠন করে ভূমি-স্বরূপা নারী। জনন

করেন বলে জননী। তাই কৃষকেরা ফসল ফলাতে জমি কর্ষণ করে, কর্ষণ মানে আকর্ষণ,

যাতে জমি বীজ থেকে ভালো সন্তান (ফসল) আকর্ষণ করতে পারে। জমি অনুযায়ী

উপযুক্ত শুদ্ধ-বীজ বপনের আগে ভূমিকে আগাছা মুক্ত করে, সার দেয়, জল দেয়,

জমি জননক্ষম হলে জো বুঝে বীজ বোনে।–জমিকে মাতৃজ্ঞানে পোষণ দিয়ে ভূমিকে

পূজা করে—যাতে জমি বীজের অন্তর্নিহিত সত্তাকে ভালোভাবে পুষ্ট করতে পারে,

বীজের সত্তাকে ধারণ করে আদর্শ মা হয়ে ভালো ফসল ফলাতে পারে। ফসল ফলাতে যদি

গর্ভাধান প্রক্রিয়া থাকতে পারে, মানুষ ফলাতে তো আরও বেশী বিধি-নিয়ম থাকা

উচিত! আমাদের ঋষিরা ছিলেন প্রকৃত বিজ্ঞানী। বিজ্ঞান শব্দটিও উপনিষদ থেকে

উৎপত্তি হয়েছে। তাই ঋষিরা নারীদের জগন্মাতাজ্ঞানে ব্যবহার (treat) করতে,

শ্রদ্ধা (honour) করতে শিখিয়েছেন।–যার নাম প্রকৃত পূজা। যার মাধ্যমে

স্বভাবের স্ফূরণ হয়ে সব অভাবের পূরণ হয়।

এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন, “Accident-এ (আকস্মিকভাবে) যা’ জন্মে, তা

বুনো, বিহিত সুফলপ্রদ চাষে যা’ জন্মে তা’ পুণো (পুণ্য)। প্রবৃত্তি লালসায়

অবিধিপূর্বক উপগতি হয়ে যে সন্তান জন্মে, তার চরিত্রের কোন ঠিক ঠিক থাকে

না। গর্ভাধান সংস্কারের ভিতর দিয়ে উন্নত চিন্তাপ্রসূত বিধিমাফিক পবিত্র

যে জন্ম, তার রকমই আলাদা। ঘরে ঘরে ভগবান জন্মে। তেমনি ছিল আমাদের

বিধান।’’ (আঃ প্রঃ ১৮/১৩) অতএব আমাদের ঘরের মা দুর্গারা যেদিন আবার ঘরে

ঘরে ভগবান জন্মাতে পারবেন সেদিন সার্থক হবে আমাদের দুর্গাপূজা।

দুর্গাপূজার বাস্তবতা তুলে ধরতে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেনঃ

“….যে মৃন্ময় মূর্ত্তি

আমরা পূজা করি—

কল্পনায় প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করে,–

তিনি দশভূজা,

দশপ্রহরণ-ধারিণী—

ঐ আমাদের মায়েরই প্রতীক—

আমাদের ঘরে ঘরে

যে মা অধিষ্ঠিতা

তাঁরই বিনায়িত সুসঙ্গত প্রতীক;

তাই ঐ মায়ের পূজা মানেই হচ্ছে—

যে মা আমার,

যে মা তোমার,

যে মা ঘরে ঘরে

দুর্গা হয়ে অধিষ্ঠিতা,

দুর্গতিনাশিনী হয়ে

দশপ্রহরণ ধারণ করে

সন্তান-সংরক্ষণায় নিয়োজিতা,

সেই মায়েরই পূজা;………..”

(আশীষ বাণী, ৬২/শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র)

“মা আমাদের দশভুজা,

প্রতি ঘরে ঘরে

যদিও তাঁকে

দ্বিভুজাই দেখতে পাই,

তিনি

দশদিক্ আবরিত করে রেখেছেন—

তাঁর স্নেহ-উৎসারিত

স্বস্তি-উৎসারিণী উদাত্ত অনুচর্য্যায়,

কায়মনোবাক্যে

প্রতিটি কর্ম্মের ভিতর-দিয়ে

ব্যষ্টির পথে

সমষ্টিকে আন্দোলিত করে,

সাত্বত উৎসর্জ্জনায়

আপূরিত করে সবাইকে,

কৃতি-উদ্দীপনার অনুপ্রেরণায়—

তাই মা আমার দশভূজা;……”

(আশীষ বাণী, ৫৯/শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র)

“পূজা মানেই হল বর্দ্ধনা। (আঃ প্রঃ ১২-১২-১৯৪১)

আমি আপনার পূজা করছি মানে, আপনার গুণ চিন্তা করছি এবং নিত্য অনুশীলনের

মাধ্যমে ঐ গুণগুলি আমার চরিত্রগত করে তুলছি, আমার ভিতরে বাড়িয়ে তুলছি।

স্তব করি মানে গুণ বর্ণনা করি। তা কিন্তু শুধু মুখে বা মনে-মনে করলেই

হবে না, প্রতিদিনকার অভ্যাস ও অনুশীলনের ভিতর দিয়ে ঐ গুণগুলি আমার

চরিত্রে মূর্ত্ত করে তোলা চাই।’’ (দীপরক্ষী ৪/১৮২)

।। পূজা কেমন করে করতে হবে ।।

“দেবতার পূজা-অর্চনা করতে গেলে আগে ইষ্টের ভাব অন্তরে জাগ্রত করে সেই

ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে, দেবতার স্মরণ মনন করতে হয়। তাঁকে স্মরণ করা

মানে—তাঁর চলন-চরিত্র ও গুণ গরিমা স্মৃতিতে এনে অনুশীলনের ভিতর দিয়ে

আয়ত্ব করা। চরণ-পূজা মানে চলন পূজা। ইষ্টের চলনাকে নিজের জীবনে আয়ত্ত

ক’রে ঐ চলনের প্রসারতা ও সম্বর্দ্ধনা যদি না ঘটাই বাস্তবে, তাহলে তাঁর

চরণ-পূজা সার্থক হয় না। আমরা ফাঁকতালে কাম সারতে চাই, কিন্তু বিধি বড়

কঠিন বান্দা, কোন চালাকি চলে না তাঁর কাছে।” —শ্রীশ্রীঠাকুর

অনুকূলচন্দ্র

(আ. প্র. ২৯. ১২. ১৯৪২)

“প্রশ্ন। হিন্দুরা দেবদেবীর পূজা করেন কিন্তু মুসলমানেরা একমাত্র

খোদাতায়ালার পূজা ক’রে থাকেন। হজরত ত’ ছবি ও পুতুল-পূজা একেবারেই নিষেধ

ক’রে গেছেন, কিন্তু আপনি এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য করছেন কেমন-ক’রে ?

শ্রীশ্রীঠাকুর । ধর্ম্ম-আচরণের দিক দিয়ে হজরত রসুলও যা’ ব’লে গেছেন,

আর্য্যদের ধর্ম্মশাস্ত্র চিরকালই ঋষির নিদেশরূপে তাই বহন ক’রে আসছে।

আর্য্য-ধর্ম্মশাস্ত্র ছবি বা পুতুল-পূজা এমনতর বিকট তাচ্ছিল্যের সহিত

নিরস্ত করতে ঘোষণা ক’রেছেন—এমন-কি অধমাধম বলতেও ক্ষান্ত হন নি। তবে

আর্য্য-ঋষিদের প্রত্যেক মানুষকে উন্নতির পথে নিয়ন্ত্রণ করবার এমনতর একটা

ঝোঁক ছিল—যা-নাকি হজরত রসুলের ভিতর দেখেত পাওয়া যায়–………..”

(ইসলাম-প্রসঙ্গে/শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র/পৃঃ ২৮-২৯)

‘‘ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ, ভক্ত রামপ্রসাদ, সাধক রামকৃষ্ণ, সর্ব্বানন্দ

ঠাকুর প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ প্রতিমা পূজা করেছেন বটে, তাঁদের ঐ

পূজার পিছনে ছিল গুরু-পূজা, ইষ্ট-আরাধনা ; ঐ প্রতিমার পরিকল্পনার ভেতর

দিয়ে ছিল অশেষ ও অঢেলভাবে ইষ্টানুরক্তি। তাই, ঐ অধম অবলম্বনও তাঁদিগকে

অধমভাবে আটকে রাখতে পারে নি। তাঁদের ঐ চলনার পথে একটা সময় এসেছিল, তখন

তাঁদের ঐ প্রতিমা তাঁদের দর্শনের সম্মুখে আর ও-রকম ছিল না। ভগবান

রামকৃষ্ণদেবেরও শোনা গিয়েছে—তাঁর এমনতর সময় এসেছিল, যখন

মূর্ত্তি-টুর্ত্তি তাঁর সাধনার পথে বাধাই সৃষ্টি করতো। তিনি এমন-কি তাঁর

ঘরে যে-সমস্ত ছবি-টবি ছিল, সেগুলিকেও সরিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি না-কি এই

বলেছিলেন—‘মেয়েরা ততদিন পুতুলখেলা করে, যতদিন তার বে’ না হয়,

স্বামী-সহবাস না করে।’ সাধক রামপ্রসাদ তাঁর স্বরচিত গানের ভেতরেই তো

বলেছেন—

‘‘ধাতু-পাষাণ মাটির মূর্ত্তি

কাজ কি রে তোর আরাধনে

তুই মনোময় প্রতিমা গড়ি’

বসা হৃদি-পদ্মাসনে।।’’

এমন কত কি যে আছে, তার ইয়ত্তা নেই।’’

(–শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, কথা প্রসঙ্গে, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৭৬, ১৭-১০-১৩৪২)

এবার আমরা এক়টু দেখে দেখে নেব, পূজা প্রসঙ্গে ‘মেরা ভারত মহান’-এর

অন্যান্য মহানেরা এবং মহান গ্রন্থগুলো কি নিদেশ রেখে গেছেন।

পূজা বিষয়ে মহানির্ব্বাণতন্ত্র নামক তন্ত্রশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছেঃ

‘‘উত্তমো ব্রহ্মসদ্ভাবো ধ্যানভাবশ্চ মধ্যমঃ।

অধমস্তপোজপশ্চ বাহ্যপূজাহধমাধমঃ।।’’

মহানির্ব্বাণতন্ত্রকে সমর্থন করে ভারতে বিবেকানন্দ গ্রন্থের ৩৩৬

পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘সকলস্থলে ব্রহ্মদর্শন সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট।

ধ্যান মধ্যম, স্তুতি ও জপ অধম, বাহ্যপূজা অধমেরও অধম।’’

‘‘যে-ব্যক্তি সর্ব্বভূতব্যাপী ঈশ্বরকে ত্যাগ করিয়া মূর্খতাবশতঃ

প্রতিমার পূজা করে, সে ভস্মে হোম করে।’’ –শ্রীমদ্ভাগবত। ৩-২৯-২২

“ঈশ্বরঃ সর্ব্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জ্জুন তিষ্ঠতি।

ভ্রাময়ন্ সর্ব্বভূতানি যন্ত্ররূঢ়ানি মায়য়া।।“

–গীতা, ১৮।৬৫

“যিনি এই সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহার নিজের স্বধর্মানুরূপ

নিষ্কাম কর্মাচরণ দ্বারা (বাক্য বা ফুলজল দ্বারা নহে) পূজা করিয়া মানুষ

সিদ্ধি লাভ করে । স্বধর্মানুরূপ (বর্ণানুগ সত্তাধর্ম পালন) নিষ্কাম কর্মই

পরমেশ্বরের পূজার ডালি । (গীতা ১৮।৪৬)

“যে ব্যক্তি সর্বভূতব্যাপী ঈশ্বরকে ত্যাগ করিয়া মূর্খতাবশতঃ প্রতিমার

পূজা করে, স (শ্রীমদ্ভাগবত ৩।২৯।২২)

পূজা বিষয়ে মহানির্ব্বাণতন্ত্র নামক তন্ত্রশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছেঃ

‘‘উত্তমো ব্রহ্মসদ্ভাবো ধ্যানভাবশ্চ মধ্যমঃ।

অধমস্তপোজপশ্চ বাহ্যপূজাহধমাধমঃ।।’’

মহানির্ব্বাণতন্ত্রকে সমর্থন করে ভারতে বিবেকানন্দ গ্রন্থের ৩৩৬

পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘সকলস্থলে ব্রহ্মদর্শন সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট।

ধ্যান মধ্যম, স্তুতি ও জপ অধম, বাহ্যপূজা অধমেরও অধম।’’

তাই, শাস্ত্র বর্ণিত অধমের চাইতেও অধম পূজায় মেতে উঠে আমাদের যাতে

ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে জবাবদিহি করতে না হয়, তাই, শ্রীশ্রীঠাকুর

অনুকূলচন্দ্র আমাদের নিত্য বাস্তব দুর্গাপূজার পূজারী করে তুলতে

সৎসঙ্গীদের নিত্যপাঠ্য ‘সত্যানুসরণ’ নামক মহাগ্রন্থে নারীকে জগজ্জননী

জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করতে নিদেশ দিয়ে বললেন, ‘‘প্রত্যেকের মা-ই জগজ্জননী ।

প্রত্যেক মেয়েই নিজের মায়ের বিভিন্নরূপ, এমনতর ভাবতে হয় ।’’ এবং

পুণ্যপুঁথি গ্রন্থে বললেন, ‘‘স্ত্রীতে কামিনীবুদ্ধি করে যে-জন, তাহার হয়

না ভবের বন্ধন মোচন । …..স্ত্রী চিন্ময়ী মা।’’—এই শিক্ষার ধারাকে

বাস্তবায়িত করার নাম প্রকৃত দুর্গাপূজা ।

শ্রীশ্রীঠাকুর শুধু পুরুষদেরই প্রতিনিয়ত দুর্গাপূজা করার বিধান দিয়েই

ক্ষান্ত হননি, নারী-সাধারণের মধ্যেও দেবী দুর্গার এক স্থায়ী আসন পেতে

দিতে অনুশ্রুতির বাণীতে বললেন—

‘‘শার্দ্দুলেরে বাহন করে

সাপের ফণার মালা পরে

কালবোশেখী ঝঞ্ঝাবেগে

ছোটরে নারী ছোটরে ছোট্ ।

দত্যিদানার নীচ বাহানা

আর্য্যাবর্তে দিয়ে হানা

ঘূর্ণিপাকের বেতাল গাঁথায়

হুলিয়ে ভুলিয়ে দিচ্ছে চোট্ ।

দশ প্রহরণ দশ হাতে ধর

বক্ষবিদরি ধ্বংসি ইতর

সূর্য্যরাগী বজ্রতেজে

আর্য্যনারী শত্রু টোট্ ।”

তিনি নারীকে অবলা নয়, সবলারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন । নারীর সতীত্বই

নারীকে সবলা করে তোলে। তাই তিনি কত আশা নিয়ে বললেন—

‘‘সতীর তেজে ঝলসে দে মা

নিঠুর কঠোর অন্ধকারে

মদনভস্ম বহ্নিরাগে

বৃত্তি-রিপু দে ছারখারে ।

প্রণবতালে ইষ্টমন্ত্র

ঝঙ্কারি তোল সকলতন্ত্রে

বিষাণ হাঁকে রুদ্র দোলায়

বজ্রে হানি মৃত্যুদ্বারে।’’

মা দুর্গার আদর্শে অনুরঞ্জিত উক্ত বাণীগুলো যাতে তার সন্তানদের মননশীলতায়

মা দুর্গার

তাই আসুন, পূজার নামে অনিত্য-বস্তুর প্রতিযোগিতায় না মেতে, সব দেবতার

সমাহার-স্বরূপ যুগ-পুরুষোত্তমের বিধি মেনে, মা দুর্গার নিত্য-সিদ্ধ

দেদীপ্যমান আদর্শের আলোকে, আমাদের ঘরের মেয়েরা যাতে রাষ্ট্রপূজার

অর্ঘ্যস্বরূপ সুজননে সুসন্তানের উপহার সাজিয়ে,

শক্তিরূপিণী-দশপ্রহরণধারিণী সাজে সজ্জিত হয়ে নরাসুরদের কিভাবে দমন করে

অস্তিত্ব রক্ষার পূজার পূজারী হতে পারে,– সেই চেষ্টায় যত্নবান হই।

জয়গুরু ! বন্দে পুরুষোত্তমম্!

***************************************

Like

Comment

Share

মহালয়া

।। মহালয় বা মহান আলয় ।।
নিবেদনে—তপন দাস


পণ্ডিতদের মতে মহালয়ার দিনে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে দেবতা ও ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্যাদি উৎসর্গ করা প্রকৃতপক্ষে পিতৃপুরুষের ঋণস্বীকার ছাড়া আর কিছুই নয় ।

ভারতকোষ গ্রন্থে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী মহালয়াকে ‘পিতৃপুরুষের উৎসবের আধার’ বলেছেন। লয় প্রাপ্তি অর্থাত চন্দ্রের লয় হয় এই অমাবস্যা তিথিতে আর দর্শণশাস্ত্র মতে আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি অর্থাত পরমাত্মার রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ এই মহতাদির লয় হয় । তাঁরা তৃপ্ত হন তর্পণের দ্বারা । জাগতিক অনুভূতিগুলি থেকে মুক্ত হয়ে আত্মারা পরমানন্দে ফিরে যান স্বর্গলোকে। পিতৃপুরুষেরা নাকি এই সময়ে পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন জল ও পিণ্ডলাভের আশায়। শাস্ত্রজ্ঞের অভিমতে, প্রয়াত পিতৃপুরুষদের জল-পিণ্ড প্রদান করে তাঁদের ‘তৃপ্ত’ করার উদ্দেশ্যেই এই তর্পণ ।

পণ্ডিত সতীনাথ পঞ্চতীর্থের মতে মহালয়ায় যে তর্পণ করা হয়, তা শুধুই পিতৃপুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দেব তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্য-পিতৃ তর্পণ ইত্যাদির সঙ্গে থাকে রাম ও লক্ষ্মণ তর্পণ এবং জগতে সকল প্রয়াতকে জলদানের মাধ্যমে তৃপ্ত করার কথা বলা আছে। এমনকি জন্ম-জন্মান্তরে যাঁদের আত্মীয়-বন্ধু কেউ কোথাও নেই এরূপ সকল প্রয়াতকে জলদান করে তাঁদের আত্মার তৃপ্তি সাধন করা যায়।

প্রথমে তাম্রপাত্রে কৃষ্ণ তিল এবং অন্য আরেকটি তাম্রকুন্ডে তর্পণের জল ফেলতে থাকে ব্রতী । মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা প্রথমে সে তার জল নিয়ে পৌঁছে যায় দেবলোকে…ওঁ ব্রহ্মা, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ রুদ্র, ওঁ প্রজাপতিস্তৃপত্যাম্‌। তারপর ঋষিলোকে সপ্ত ঋষিকে প্রণতি পূর্বক তর্পণের দ্বারা তৃপ্ত করে।
দেবলোক, ঋষিলোকের পর “এতত্‌ সতিলোগঙ্গোদকং ওঁ যমায় নমঃ’ …এই বলে মন্ত্রোচ্চারণ করে যমতর্পণ । এবার মহাভারতের সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় ভীষ্ম পিতামহের তর্পণ, রামতর্পণ এবং সবশেষে স্বর্গত আত্মীয় পরিজনের নামে জলদান করার রীতি এই তর্পণে।


এ থেকে জানা গেল ওইদিন মৃত আত্মাদের উদ্দেশ্যে তর্পণ বা শ্রাদ্ধ করা হয়। এরসাথে কোন দেবী-আরাধনার সম্পর্ক নেই। তাছাড়া কোন দেবীর এমন কোন জীবন্ত আদর্শ পাওয়া যায় না, যেখানে জীবাত্মার গতি-প্রকৃতি বর্ণিত হয়ছে। জীবাত্মা, পরমাত্মার সন্ধান বেদে, উপনিষদে পাওয়া গেলেও পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ গীতা গ্রন্থে বিশদে বর্ণনা করেছেন। সেখানেও আমরা কোন দেবীর যোগ খুঁজে পাই না।
মহাভারতে পুরুষোত্তম কেন্দ্রিক জীবন চলনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কোন দেবীর সাহায্য ছাড়াই ভক্ত যতীশ ঘোষ, ভক্ত নফর ঘোষ প্রমুখদের লিঙ্গ- শরীরের সাথে বার্তালাপ করেছেন। এগুলো প্রামাণ্য সত্য।
শ্রীশ্রীঠাকুর পিণ্ডদেহ এবং লিঙ্গদেহের গতিপ্রকৃতি সকলের সামনে সহজভাবে উপস্থাপন ক‍রেছেন। তার দু-একটা উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।


যোগন -” মরার সময় কিভাবে বুঝতে পারবো কোন্ দেশে বা যাচ্ছি আর কিরকমই বা হ’চ্ছে? “

শ্রীশ্রীঠাকুর – চিত্রগুপ্তের কথা শুনেছেন তো? সারাজীবনের কার্য্য ও চিন্তার চিত্র মৃত্যুকালে মূর্ত্তিমান হ’য়ে একে- একে দেখা দেয়, তারপর সব চিত্র গুপ্ত হ’য়ে গেলে light (জ্যোতি) দেখা যায়। যাদের সেই জ্যোতির সঙ্গে পরিচয় আছে ( অর্থাৎ মৃত্যুকালের পূর্ব্বেও যারা সাধন দ্বারা সেই জ্যোতি দর্শন করেছে) তাদের সে-সময় ভয় হয় না; তারা তাই ধ’রে ব’সে থাকে, আর সদগুরু সেই জ্যোতির মধ্যে এসে দাঁড়ান, তখন পরিচয় হ’য়ে যায়। আর ভয় থাকে না।

যোগেন -আচ্ছা, মরার সময় ভয় পায় কি? এই যে সব যমদূতের বিকট চেহারা দর্শনে ভয় পাবার কথা শুনা যায়, তা’ সত্য নাকি?

শ্রীশ্রীঠাকুর – মনের ভাব সব মৃত্যুকালে এক- একটা form ( আকার) নিয়ে তো সম্মুখে আসে। ধরুন, কোনও স্ত্রীলোকের প্রতি খারাপ নজর যদি থাকে, তবে মরার সময় ঐ খারাপ ভাবটা form নিয়ে সামনে আসবে, আর, খারাপ ভাব যে form নেবে তা’ মনোহর তো হবে না, বিকটই হবে, কাজেই তা’ দেখে ভয় হ’তেই পারে।

যোগেন – আচ্ছা, সদগুরু ধরায় অবতীর্ণ হ’লে যারা তাঁকে আশ্রয় করে তারা কি সকলেই মুক্ত হয়?

শ্রীশ্রীঠাকুর – হ্যাঁ, যারা তাঁকে প্রকৃতই আশ্রয় করে, তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে, তাদের সকলকেই তিনি মুক্তি দেন।

(অমিয়বাণী, পৃষ্ঠা -১৫
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র)

** মরো না, মেরো না, যদি পার মৃত্যুকে অবলুপ্ত কর **
।। প্রসঙ্গ মৃত্যু : –অমিয়বাণী গ্রন্থ থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বাণী ।।
অশ্বিনীকুমার বিশ্বাস—আচ্ছা, যাদের সদগুরু লাভ হয়েছে তারা তো
মৃত্যুকালে সদগুরুর সাক্ষাৎ পাবে? তারফলে তারা তৎক্ষণাৎ মুক্ত হবে? যদি
তা না হয় তবে সাক্ষাৎ পাওয়ায় লাভ কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর—এখানে জীবন্মুক্ত না হয়ে যারা মরবে তারা মৃত্যুকালে
সদগুরুর সাক্ষাৎ পেয়ে এই লাভবান হবে যে, একাকী অনির্দ্দিষ্ট পথে যাবার
জন্য ভয় পাবে না, আধারে ঘুরবে না, তাঁর আশ্রয় পেয়ে তৎকালে ভীত হবে না, আর
এ-জীবনে যতদূর উন্নত হয়েছিল, যেরূপ জীবন পেলে তারপর থেকে কাজ করতে পারে,
সেইরূপ জন্মলাভ করবে। যে-সমস্ত অসৎ কর্মফল ছিল তা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তদ্
দরুন নিম্নতর যোনিতে জন্মাতে হবে না। ওরূপ মানুষ ম’রে মানব ছাড়া অন্য
জন্ম তো পাবেই না, বরং মানবের মধ্যে উন্নত চরিত্রের মানব হ’য়ে জন্মাবে।


মৃত্যু সম্বন্ধে বলিতেছেন-“Hundred twenty years-এ যে মৃত্যু সেইটাই natural। তার পূর্বে যে সমস্ত মৃত্যু হয়, সেগুলো unnatural। ব্যক্তিগত সাধনা দ্বারা, উন্নত প্রণালীর চিকিৎসা দ্বারা লোকের এই অকালমৃত্যু control করা যায়। মৃত্যুতে cells-এর পরিবর্তন হয়, অর্থাৎ একরকমের cells আর এক রকমের cells-এ transformed হয়, কিন্তু প্রত্যেক cell-এরই consciousness আছে। এই হিসেবে মৃত্যু আর কিছুই নয় কেবল diffusion of crystallised consciousness—cell এর জড়ীভূত এক individual consciousness হারিয়ে cell-এর consciousness গুলি ছড়িয়ে যাওয়া। একটা idea-য় যেন cell গুলি দানা বেঁধে থাকে। মৃত্যুতে cell-এর disintegration হয়। সেই আত্মার উপলব্ধি যার হয়েছে তার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই—এটা real; আর আমাদের কাছে পূর্বজন্ম পরজন্ম অস্তিত্বহীন, মিথ্যা, কারণ, আমরা আত্মার সঙ্গে নিজেদের এখনও identified করিনি বলে, আত্মাই যে নানা ঘূর্ণিপাক সৃষ্টি করে করে জীবন-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চলছে তা বুঝিনা এবং অনুভব করি না।”

যতীনদা—“তা হলে তো আমাদের পূর্বজন্ম, পরজন্ম নেই। তবে আর শ্রাদ্ধাদির কি প্রয়োজন ?”

শ্রীশ্রীঠাকুর—“Individual consciousness cell consciousness-এ বিকীর্ণ হয়ে পড়ে। বহু cell চতুর্দিকে তাদের consciousness নিয়ে বিচ্ছুরিত হয়, এক জটিল আমিত্ব ভেঙ্গে খান খান হয়ে বহু কোষের বহু, আমিত্বে পরিণত হয়, আর তাই মৃত্যু। আমরা যে শ্রাদ্ধাদি করি তাতে আমাদের idea প্রসারিত হয়। তাতে ভাবজগতে idea-র জগতে ঝঙ্কার তোলে। Idea-র পুষ্টি sympathetic idea-তেই। তাই শ্রাদ্ধে উপনিষদাদির উচ্চভাবের স্মৃতিকে জাগরণ করা হয়।” (চির-স্মরণীয় ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত জীবনীগ্রন্থের ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪৫)

আত্মা, ‘অত’’ ধাতু ‘মন্’ করে হয়েছে। ‘অত’ মানে নিয়তগতিশীল হওয়া। আত্মা কি ? আত্মা চিরচঞ্চল। Nerve-এর মধ্য দিয়ে vital energyর যে flow তাই আত্মা। দেখা যায় vital energy-তে হয় বাইরের জগতের impression বা photograph। তাই বলে, আত্মা হতে হয় মন। আর তাই মন নিয়তচঞ্চল। Vital current-এর break আর make করছে যা, তাই মন । মন তা হলে কিছুতেই স্থির হতে পারে না।

(চির-স্মরণীয় ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত জীবনীগ্রন্থের ২য় খণ্ড, পৃঃ ১১৩)


শ্রীশ্রীঠাকুর —চিত্রগুপ্তের কথা শুনেছেন তো? সারাজীবনের কার্য্য ও চিন্তার চিত্র মৃত্যুকালে মূর্ত্তিমান হ’য়ে একে- একে দেখা দেয়, তারপর সব চিত্র গুপ্ত হ’য়ে গেলে light (জ্যোতি) দেখা যায়। যাদের সেই জ্যোতির সঙ্গে পরিচয় আছে ( অর্থাৎ মৃত্যুকালের পূর্ব্বেও যারা সাধন দ্বারা সেই জ্যোতি দর্শন করেছে) তাদের সে-সময় ভয় হয় না; তারা তাই ধ’রে ব’সে থাকে, আর সদগুরু সেই জ্যোতির মধ্যে এসে দাঁড়ান,তখন পরিচয় হ’য়ে যায়। আর ভয় থাকে না।

যোগেন (প্রশ্ন কর্তা) —আচ্ছা, মরার সময় ভয় পায় কি? এই যে সব যমদূতের বিকট চেহারা দর্শনে ভয় পাবার কথা শুনা যায়, তা’ সত্য নাকি?

শ্রীশ্রীঠাকুর — মনের ভাব সব মৃত্যুকালে এক-একটা form ( আকার) নিয়ে তো সম্মুখে আসে। ধরুন, কোনও স্ত্রীলোকের প্রতি খারাপ নজর যদি থাকে, তবে মরার সময় ঐ খারাপ ভাবটা form নিয়ে সামনে আসবে, আর, খারাপ ভাব যে form নেবে তা’ মনোহর তো হবে না, বিকটই হবে, কাজেই তা’ দেখে ভয় হ’তেই পারে।

যোগেন — আচ্ছা, সদগুরু ধরায় অবতীর্ণ হ’লে যারা তাঁকে আশ্রয় কর তারা কি সকলেই মুক্ত হয়?

শ্রীশ্রীঠাকুর — হ্যাঁ, যারা তাঁকে প্রকৃতই আশ্রয় করে, তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে, তাদের সকলকেই তিনি মুক্তি দেন।

(সূত্র : অমিয়বাণী, পৃষ্ঠা-১৫)

জন্ম ও মৃত্যুর আগম-নিগম-এর স্বরূপ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেনঃ “সম্বেগ জীবের বা মানুষের মধ্যে gene-এর (জনির) ভিতর দিয়ে যে pitch-এ (স্তরে) ওঠে, মরে যাওয়ার সময় psycho-plasm-এ (মানস দেহে) engraved ( মুদ্রিত) হয়ে থাকে সেই pitch-এ wave-এর (তরঙ্গের) আকারে। মিলনেচ্ছু sperm-এর (শুক্রকীটের) ভিতর সেই জাতীয় সম্বেগ সৃষ্টি হলে tuning (সঙ্গতি) হয় এবং মৃত ব্যক্তি পুনরায় শরীর গ্রহণ করার সুযোগ পায়। জন্ম ও মৃত্যুর এটাই revolving process (ঘুর্ণায়মান পদ্ধতি)।” (আ. প্র. ২১/১০৭) *মৃত্যুর স্বরূপ প্রসঙ্গে* শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন : “আমাদের consciousness (চেতনা) ধৃতি যেটা, যা’ নিয়ে আমরা থাকি, সেটা হ’ল সম্বেগ। যে-সম্বেগ দ্বারা আমরা বাঁচি, বাড়ি, সেটা যদি কোন কারণে blocked হয়ে যায় তাহলে আমরা

মরে যাই।” “আপূরয়মান ইষ্টে কারও যদি প্রকৃত টান জন্মে, এবং তাই নিয়ে যদি সে বিগত হয় তবে সে মহান জীবন লাভ করবেই। আবার, এ জীবনে যে যতই হোমরা-চোমরা হোক না কেন, সে যদি সুকেন্দ্রিক না হয়, প্রবৃত্তিই যদি তার জীবনের নিয়ামক হয়, তবে ঐ বিচ্ছিন্ন বিকেন্দ্রিকতা তার মৃত্যুকালীন ভাবভূমি ও পরজন্মকে যে অপগতিতে অপকৃষ্ট ক’রে তুলবে, তা’তে সন্দেহ কমই।” (আঃপ্রঃ ১/ ১৯.১১.১৯১৪)

শ্রীশ্রীঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে বললেন—”মানুষের আত্মা যেমন অমর, নিষ্ঠাও তেমনি অমর। আমরা যে অমৃত-অমৃত করি, তার চাবিকাঠি হ’ল ইষ্টনিষ্ঠা। ইষ্টনিষ্ঠা যেই একজনকে পেয়ে বসে, তখন এক-একটা প্রবৃত্তির সিন্দুকের ডালা খুলে যেতে থাকে এবং বিভিন্ন প্রবৃত্তি ইষ্টমুখী অর্থাৎ একমুখী হ’তে থাকে। তখন বােঝা যায় কামের স্বরূপ কী, ক্রোধের স্বরূপ কী, লােভ-মােহ- মাৎসর্য্যের স্বরূপ কী! এবং এগুলির প্রত্যেকটির সপরিবেশ নিজের সত্তাপােষণী বিনিয়ােগ করা যায় কিভাবে। তখন মানুষ প্রবৃত্তির হাতে গিয়ে পড়ে না, বরং প্রবৃত্তিগুলি তার হাতে খেলার পুতুলের মত হয়ে দাঁড়ায়। বেফাঁস চলন বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে মানুষের ভিতরে অখণ্ড ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা হয়। সে প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠে। বােধিসত্ত্ব হয়ে ওঠে।”

আলোচনা-প্রসঙ্গে
উনবিংশ খন্ড
ইং ১৭.৪.১৯৫০


এখানে কোন দেবীর সাহায্য গ্রহণ করেন নি শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। অতএব পুরুষোত্তমের দৃষ্টি দিয়ে আমাদের সবকিছু দেখতে হবে।

HISTORY OF SATSANG PABNA

** সৎসঙ্গের পুরানো সেই দিনের কথা **

ভক্তপ্রবর ধীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নিবন্ধ
একটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত

(যুগপ্রহরী, ৫ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, মাঘ ১৩৭৯)

।। পাবনাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের অবদান।।                             [এই নিবন্ধের লেখক ভক্তপ্রবর ধীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, যাঁর যাজনে উদ্বুদ্ধ হয়ে সৎমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য মহোদয়। লেখাটি ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র গ্রন্থ-এর ২য় খণ্ড থেকে সংগৃহীত।]

———————————————————————————————–

সেই ইংরেজী ১৯২৫ খৃষ্টাব্দের কথা। হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গায় তখন বাংলার মাটী রক্তাক্ত। পাবনা জেলার লোক-সংখ্যার ৭৫ ভাগ মুসলমান। বাদ বাকী অন্য ধর্মাবলম্বী—তন্মধ্যে  হিন্দুর সংখ্যা খুবই অল্প। নগণ্য সংখ্যক হিন্দুদের মধ্যে কোন সংহতি নাই । প্রভাব ও প্রতিপত্তির মোহে হিন্দুগণ পরপর বিদ্বিষ্ট। ঈর্ষান্বিত হিন্দুগণ প্রতিদ্বন্দ্বী হিন্দুকে পর্যুদস্ত করবার জন্য মুসলমানগণের সাহায্য নিতেও দ্বিধা বোধ করেন না। মুসলমান দ্বারা কোন হিন্দু নারীর নারীত্বের লাঞ্ছনা হলেও হিন্দু প্রতিবেশী ক্ষুব্ধ হওয়া তো পরের কথা বরং সেই লাঞ্ছনার সুযোগ নিয়ে সেই গৃহস্থকে কি করে আরও বিপদে ফেলা যায় সে চেষ্টাতেও কুণ্ঠিত নন। সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দুগণের আত্মরক্ষার জন্য যেখানে তাঁদের সংহতির একান্ত প্রয়োজন—ঈর্ষার নীচতায় সেখানে তাঁরা পরস্পর বিদ্বিষ্ট। 

এই নিকৃষ্টতম পরিবেশে মহামানব শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের  আবির্ভাব। বাংলার প্রতি জেলায় জাতিধর্ম নির্বিশেষে অগণিত নরনারী তাঁর চরণাশ্রয়ে অভিনব চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠল। প্রেমের বন্ধনে তারা হল একাত্ম।

ক্রমে ক্রমে বহু বিদ্বজ্জন, বরেণ্য নেতাগণ, বৈজ্ঞানিক ও শিল্পবিদ মনীষিগণের আগমনে হিমাইতপুর সৎসঙ্গবাটী মুখর হয়ে উঠল। অত্যল্পকাল মধ্যেই সেই জঙ্গলাকীর্ণ শ্বাপদসঙ্কুল আশ্রমবাটী হর্ম্যসঙ্কুল নগরে হল পরিণত। নানাবিধ শিল্পবাটী, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, বিদ্যায়তন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের জন্য সৎসঙ্গ আশ্রমের পরিধি বিস্তৃত হয়ে চলল। শ্রী ও সম্পদে এই তীর্থ অভিনব সৌন্দর্যে হল প্রস্ফুটিত। বাংলার লক্ষ লক্ষ নরনারী শ্রীগুরু  দয়ালের জয়গানে হল মুখরিত। পাবনা জেলাতেও কিছু-সংখ্যক হিন্দু এই মহামন্ত্রে হলেন দীক্ষিত।

কিন্তু ঈর্ষা যাঁদের সহজাত, প্রভাব ও প্রতিপত্তির মোহ যাঁদের মনুষ্যত্ব বা বিবেককে পীড়িত করে রেখেছে — তাঁদের পক্ষে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ঐশী প্রভাব সহ্যের বাইরে! তাঁরা এই মহামানবের দেবচরিত্রের উপর নানাবিধ কলঙ্ক আরোপ করে তাঁর ও সৎসঙ্গের অপপ্রচারে হয়ে উঠলেন উন্মত্ত। বাংলার জেলায় জেলায় আশ্রমের অপপ্রচারের তাঁরা এজেন্সী খুলে দিলেন। তাঁদের মাত্রাতিরিক্ত নিন্দাবাদে কিন্তু বাংলার জনসাধারণ শ্রীশ্রীঠাকুরের বিষয়ে অতিশয় অনুসন্ধিৎসু হয়ে অবশেষে দীক্ষা গ্রহণ করে ধন্য হলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস মহাশয় শ্রীশ্রীঠাকুরকে বলেছিলেন–‘আমি আপনার এতো নিন্দা শুনেছি যে তাতেই ধরে নিয়েছিলাম যে—এখানেই মিলবে সত্যের সন্ধান। এটা আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা।’

হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ পল্লীগ্রামে তখনো বিস্তৃত হয় নি। পাবনার আতঙ্ক কেবল শহরেই সীমাবদ্ধ। আশ্রম-বিদ্বেষী হিন্দুগণের মনে এই সময়ে আশ্রমকে অবলুপ্ত করবার এক চক্রান্ত উঠল জেগে। এই সংঘর্ষের সুযোগে তাঁরা গ্রামস্থ মুসলমানগণকে আশ্রম আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিতে তৎপর হয়ে উঠলেন।

কিন্তু হিমাইতপুরের দরিদ্র মুসলমানগণ আশ্রমের দ্বারাই প্রতিপালিত, শ্রমের বিনিময়েই তাদের গ্রাসাচ্ছাদন। উপরন্তু অসুখে বিসুখে বিনা পয়সায় তাদের চিকিৎসা, পূজা পার্বণে তাদের পরিবারবর্গের সকলকেই পরিচ্ছদাদি বিতরণ, দায়-অদায়ে অর্থ সাহায্য হোত এই আশ্রম থেকেই। সর্বোপরি . শ্রীশ্রীঠাকুরের উপর তাদের শ্রদ্ধা ছিল নিবিড়। আশ্রমের ধ্বংস-সাধন ছিল তাদের  স্বপ্নেরও অগোচর ।

আশ্রম-বিদ্বেষী হিন্দুগণ মুসলমানদের দিয়ে এই সংঘর্ষের সুযোগে আশ্রমের অবলুপ্তি ঘটাবার জন্য হয়ে পড়লেন উন্মত্ত। তাঁরা গ্রামস্থ মুসলমানদের একত্রিত করে গোপনে গোপনে উত্তেজিত করে তুলতে লাগলেন।

গ্রাম্য মুসলমানদের তাঁরা বোঝালেন—‘অনুকূলঠাকুর যে ভাবে এই হিমাইতপুর গ্রামে হিন্দু বসবাস আরম্ভ করাচ্ছেন, বাংলার নানাস্থানের বিত্তবান ও প্রভাবশালী হিন্দুরা যেভাবে এখানে স্থায়ী ঘরবাড়ী নির্মাণ করে আশ্রমের আয়তন বিস্তৃত করে চলেছে তাতে এখানে হিন্দুর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দরিদ্র মুসলমানদের এই গ্রাম থেকে উৎখাত হতে হবে। মুসলমানদের কল্যাণের জন্যই আশ্রম ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আর যত নষ্টের মূল ঐ অনুকূল ঠাকুরকে নিকেশ করে সৎসঙ্গের একান্ত সমাধির প্রয়োজন।

আরও একটা কথা—আশ্রমে যাঁরা আছেন তাঁরা সকলেই সম্পন্ন ঘরের সস্তান। তাঁদের স্ত্রী-কন্যাগণ অভিজাত বংশসম্ভূতা। এই আক্রমণের সুযোগে আশ্রমবাসীদের ধনসম্পদ আর অনন্যা সুন্দরীদের অবাধ লুণ্ঠনেরও সুবিধা হবে।’

স্বল্পবুদ্ধি গ্রাম্য মুসলমানগণ হিমাইতপুরের হিন্দুগণের অসার বক্তৃতায় হয়ে পড়ল অভিভূত। আশ্ৰম আক্রমণের সুযোগ-সন্ধানে তারা রইল প্রতীক্ষায়। সে সুযোগ অচিরেই তাদের উপস্থিত হল অপ্রত্যাশিতভাবে।

আমাদের পরম পূজনীয়া  বড়মায়ের এক সহোদরার অন্তিমকালে তাঁর তিনটি শিশু সন্তানের ভার দিয়ে গেলেন বড়মায়ের হাতে। সেই তিনটি সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র সন্তানটির সেদিন অকালে হল প্রাণবিয়োগ। তার ডাক নাম ছিল পচা। শব নীত হল শ্মশানে । নফরদা শবদাহের কাষ্ঠ প্রভৃতি নিয়ে গেলেন সেখানে । 

এই গ্রাম্য শ্মশানটি ছিল আশ্রমের অনতিদূরে পূর্বদিকে। বাঁধের উপর থেকে বেশ দেখা যায়। শবদাহের উদ্যোগপর্ব যখন চলছে সেই সময় কতিপয় অতিপরিচিত ঐ গ্রামেরই মুসলমান যুবক এসে দাহকার্য নিষেধ করে বললে যে, সে স্থানটি শ্মশান নয়, তাদের কবর স্থান। সুতরাং দাহকার্য সে স্থানে চলবে না। বিস্মিত শববাহিগণের প্রতিবাদে মুসলমান যুবকগণ অধিকতর উত্তেজিত হ’য়ে নফরদাকে প্রহারে করল জর্জরিত। যারা নফরদার তত্ত্বাবধানে আশ্রমের কাজে এতোদিন একান্ত অনুগত ছিল তারাই আজ তাঁকে প্রহারে করল জর্জরিত।

বাঁধের উপর থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর পরিস্থিতি দেখে আদেশ করে পাঠালেন শব আশ্রমে ফিরিয়ে আনতে। নির্বিচারে তাঁর আদেশ হল প্রতিপালিত, শব নিয়ে আসা হল আশ্রমে। এইখানেই পরিসমাপ্তি হওয়া উচিত ছিল ঐ পরিস্থিতির। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মুসলমানগণ অন্যান্য মুসলমানগণকে উত্তেজিত করে তুলল এই বলে যে, আশ্রমবাসিগণ তাদের কবরস্থানকে শ্মশান বানিয়ে সেইখানে কাফেরের শবদাহ করতে চায় গায়ের জোরে। পাবনা শহরের সেই উত্তেজনার মুহূর্তে এই রটনায় মুসলমানগণ হল ক্ষিপ্তপ্রায়। তারা দলে দলে এসে সমবেত হতে লাগল সেই শ্মশানভূমিতে—আশ্ৰম আক্রমণ করে উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে। পাবনা শহরে হিন্দুগৃহ আক্রমণের কোন সুযোগ না পেয়ে তাদের আক্রোশ ছিল প্রবল। এখানে কোন পুলিশ প্রহরা না থাকাতে নিরীহ আশ্রমবাসীদের উপর তাদের প্রতিশোধ-স্পৃহা হল প্রবল। ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনিতে স্তব্ধ শ্মশানভূমি হল মুখরিত — হিন্দু-নিধনের উল্লাসে।

আশ্রমের আজ মহাতঙ্কের দিন। মৃত্যুর বিভীষিকায় সকলেই বিহ্বল। আতঙ্কিত জননীগণের জন্যই সকলের চিন্তা, কখন কার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায় সেই ভয়ে। অনন্ত মহারাজ, গোঁসাইদা, কিশোরীদা সকলেই ব্যস্ত হলেন জননীগণের সাহসসঞ্চারে। এদিকে পুরুষগণ ব্যস্ত হলেন পা, কুড়ুল, লাঠি প্রভৃতি সংগ্রহে।

শ্রীশ্রীঠাকুর সম্পূর্ণ একাকী। তাঁর ভাবগম্ভীর মৌন মূর্তির সন্নিকটে কারো যাওয়ার সাধ্য নাই। কি যেন এক অব্যক্ত নিষেধবাণী তাঁর শ্রীমুখকান্তিতে উদ্ভাসিত। সমস্ত দিন তিনি কখনো মায়ের কটেজের বারাণ্ডায়, কখনো বা সেই শ্মশানভূমি পরিদর্শন মানসে বাঁধের উপর অস্থিরভাবে পদচারণা করছেন।

বেলা গেল গড়িয়ে। বর্ষাকালের বেলা কিছু বোঝা যায় না, আকাশও মেঘাচ্ছন্ন। শ্মশান থেকে আশ্রমের রাস্তাটী পদ্মার স্ফীত জলে নিমজ্জিত। যে সময়ের কথা বলছি সে সময়টা ছিল বোধ হয় ১৯২৫ সালের শ্রাবণ মাস। আশ্রমের সম্মুখভাগে বাঁধ পর্যন্ত কারো উপস্থিতি শ্রীশ্রীঠাকুর পছন্দ করছেন না বরং নিষেধ করে দিলেন। শেষে স্বয়ং এসে দাঁড়ালেন সেই শ্মশানের দিকে বাঁধের উপর । এমন স্থানে দাঁড়ালেন যে আক্রমণকারীদের প্রথম বলি হবেন তিনিই । স্থির দৃষ্টে চেয়ে আছেন ক্রুদ্ধ মুসলমান জনতার দিকে। মুর্তি নিশ্চল—দৃষ্টি উদাস, নির্ভরতায় একাত নির্ভয়।

তিনি আদেশ করে পাঠালেন যেন কারো কাছে কোন অস্ত্র বা হাতিয়ার না থাকে। আসন্ন মৃত্যুর এই চরম মুহুর্তে  অস্ত্র পরিত্যাগের এই আদেশে সৎসঙ্গিগণ হলেন বিচলিত। ডাঃ যতীন রায়, মনোহর বসু, প্রভৃতি কতিপয় বিশিষ্ট ভক্ত ক্ষুব্ধ অন্তরে কেষ্টদাকে বললেন ।—

“কেষ্টদা ! ঠাকুরের এ কী রকম আদেশ! ঐ সব দুর্বৃত্ত পিশাচদের প্রধান লক্ষ্যই হলেন তিনি। ঐ হিংস্র পশুর দলের তীক্ষ্ণধার ছুরিকায় তাঁর দেবদেহ হবে রুধিরালিপ্ত, আর আমরা থাকব নীরব দর্শকের ভূমিকায় দূর ব্যবধানে ! দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত তাদের বাধা দিতে পারব না। না, না, এ হতে পারে না। হাতিয়ার আমরা ত্যাগ করব না।’ 

কেষ্টদা বললেন,

‘কী বলছেন আপনারা! এই অন্তিম মুহূর্তে  তাঁর আদেশ বর্ণে বর্ণে প্রতিপালিত না হলে আমরাই হব তাঁর এবং আমাদের নিধনের কারণ। তাঁর দিকে চেয়ে দেখুন, কী একান্ত নির্ভরতায় তিনি নির্ভয় । আমাদেরও বলে দিলেন—

মামেকং শরণং ব্রজ।’ 

কেষ্টদা (ভট্টাচার্য্য)র এই একটা মাত্র কথায় সকলের সম্বিৎ এলো ফিরে। নির্ভরতায় সকলেই হল মরণজয়ী নির্ভীক । সকল কণ্ঠে ধ্বনিত হল— “মামেকং শরণং ব্রজ।” মৃত্যুভয় সকলের অন্তর থেকে হল অন্তর্হিত।

ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার এলো ঘনিয়ে। অটল ভাইকে শ্রীশ্রীঠাকুর আদেশ করলেন, হুজুর মহারাজের মন্দিরের সুউচ্চ চূড়ায় একগাছি লম্বা বাঁশ বেঁধে তারই ডগায় একটা হাজার বাতির বৈদ্যুতিক আলো জ্বেলে দিতে।

তখন আশ্রমে আমাদের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। অটল ভাই অচিরে তাঁর আদেশ প্রতিপালন করে বহুদূর পর্যন্ত করে দিল আলোকিত । আশ্রম আগমনের রাস্তাটী জলে নিমজ্জিত থাকাতে হয়ে আছে যেমন পিচ্ছিল তেমনি কর্দমাক্ত। শ্রীশ্রীঠাকুরের দয়ায় আক্রমণকারীদের আগমনপথ হয়ে গেল বেশ সুগম।

সমস্ত দিনের প্রস্তুতির পর আততায়িগণ আশ্রমের পথে হল অগ্রসর । মুহুর্মূহু  আকাশ বাতাস হল মুখরিত ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনিতে। স্রোতের মত ভেসে আসছে তাদের উল্লাসের কোলাহল। কিন্তু পথের পিচ্ছিলতায় তাদের গতি হল মন্থর ।

লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে আশ্রমবাসিগণ উৎকণ্ঠিত অন্তরে রদ্ধশ্বাসে অপেক্ষমাণ। সর্বনাশা মুহূর্ত আসছে ঘনিয়ে। বহুদিনের ঘটনা—স্মৃতির অন্তরালে ঝাপসা হয়ে গেলেও সে দিনের সেই রোমাঞ্চ কেউ ভুলতে পারবে না।

তারা আসছে অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে, আছাড়ের আঘাত বাঁচিয়ে। অপরের জীবন হননে যারা উন্মত্ত—নিজের সামান্য আঘাতটুকুতেও তারা এমনই সতর্ক। ধীরে ধীরে তারা হল উপস্থিত আশ্রমের বাঁধের কাছে। আশ্রম বাটিকার সম্মুখভাগ উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত। জনবহুল আশ্রমপ্রাঙ্গণে জনমানবের চিহ্নমাত্র নাই। কোলাহলমুখর আশ্রমে আজ মরণের স্তব্ধতা। সম্মুখভাগে দণ্ডায়মান দিব্যকান্তি শ্রীশ্রীঠাকুরের নিশ্চল মূর্তি— একাকী, সম্পূর্ণ  অরক্ষিত।

এই বিসদৃশ পরিবেশ সন্দৰ্শনে অনিশ্চিত বিপদাশঙ্কায় আততায়িগণ হল নিশ্চল। পশ্চাতের জনতা ঠেলছে অগ্রবর্তী জনতাকে, কিন্তু অগ্রবর্তী জনতা দ্বিধাগ্রস্ত। এইখানে তাদের চলছে একটা হুড়োহুড়ি, একটা জটলা, একটা কোলাহল।

আক্রমণকারীদের দ্বিধাগ্রস্ত নিশ্চলতা আর কতক্ষণই বা স্থায়ী হবে। ক্ষণকাল মধ্যেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে ঐ দেবদেহের উপর। কম্পিত অন্তর আশ্রমবাসিগণের শ্বাসরুদ্ধ, বিস্ফারিত নয়নের অপলক দৃষ্টি ঐ দেবদেহে নিবদ্ধ। সর্বনাশা মুহূর্তের ব্যবধান আর কতটকুই বা।  চেতনার আর সাড়া নাই কোন দেহে—সম্বিৎহারা ভক্তবৃন্দ নিস্পন্দ ।

কিন্তু এ কী! পিছনে এ কিসের শব্দ ! ছ্যাব্-ছ্যাব্ -ছ্যাব্। প্রায় দশ-বার জন গুর্খা মিলিটারী কুইক মার্চে এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানালো অভিবাদন— মিলিটারী কায়দায়। পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল বন্দুক উদ্যত করে আততায়ীদের দিকে। অপেক্ষায় রহিল শ্রীশ্রীঠাকুরের আদেশের জন্য।

অকস্মাৎ এই মিলিটারীর আবির্ভাবে সোরগোল পড়ে গেল আততায়িগণের মধ্যে। সকলের মুখে, মিলিটারী, মিলিটারী, পালাও পালাও । পরের প্রাণ হননের উল্লাসে যারা ছিল উন্মত্ত নিজের প্রাণের মমতায় তারা হল দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। পথের কাদায় হল কর্দমাক্ত, আছাড় খেয়ে ভাঙ্গলো কারো হাত পা, নিজেদের অস্ত্রশস্ত্রে কেউ বা হল ক্ষতবিক্ষত — প্রাণরক্ষার-ব্যাকুলতায় ভ্রূক্ষেপের সময় নাই কারো। নিমেষের মধ্যেই সেই দল হল উধাও।

মিলিটারীগণ সমস্ত আশ্রম নিরীক্ষণ করে শ্রীশ্রীঠাকুরকে অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল ।

আশ্রমবাসিগণের উৎকণ্ঠায় অবসন্ন মনে এতক্ষণে এলো প্রশান্তির স্বাচ্ছন্দ্য। সকলের মুখে ফুটে উঠল মুক্তির আনন্দ। 

কিন্তু হঠাৎ ঐ মিলিটারীর আবির্ভাব এবং অন্তর্ধান প্রশ্নটা জেগে রইল সকলের মনে। পরে শ্রীশ্রীঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন—

‘কমু ক্যামনে, কনে থেকে এলো তারা’। 

প্রশ্নের জবাব আজো মেলেনি । 

সারাদিনব্যাপী আশ্রমের সেই চরম উৎকণ্ঠার সময় হিমাইতপুরের চক্রান্তকারী হিন্দু বাসিন্দাগণ উৎকর্ণ হয়ে স্ব-স্ব গৃহেই আছেন তাঁদের মনোরথ-সিদ্ধির আনন্দে। আশ্রম থেকে ওই বুঝি ভেসে আসছে মুহুর্মূহু অন্তিম আর্তনাদ ৷ মোক্ষম আঘাতের সার্থক চরিতার্থতায় সন্তুষ্ট অন্তরে তাঁরা নিশ্চিত। তাঁদের চক্রান্তের অব্যর্থ স্বপ্নে আজ তাঁরা গর্বিত।—পাবনা · শহরবাসী হিন্দুগণেরও স্বস্তিবোধ স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁরাও চরম সংবাদের আশায়  অপেক্ষমাণ।

কিন্তু শয়তানী চক্র ব্যর্থতায় হল ম্রিয়মাণ।

রাত্রি তখন বোধ হয় দশটা। পাবনা শহর থেকে উচ্চপদস্থ পুলিস কর্মচারি-গণ আশ্রমে হলেন উপস্থিত। শহর থেকে হিমাইতপুরের ব্যবধান মাত্র দু’মাইল । সৎসঙ্গের মত বিখ্যাত ধর্ম প্রতিষ্ঠানের আক্রমণ-সংবাদ পাবনার ঘরে ঘরে পড়েছে ছড়িয়ে। দলে দলে মুসলমান আসছে শহর থেকে এই গ্রামে। পুলিস কর্তৃপক্ষের তা না জানার কথা নয় । সমস্ত দিন ধরেই যেখানে চলছে প্রস্তুতি সেখানে তাদের বাধা দেবার সময় তো যথেষ্ট ছিল, কিন্তু তারা সমস্ত দিন রইলেন নিষ্ক্রিয়। পাবনার পুলিশ কর্মচারিগণ প্রায় সকলেই মুসলমান-সম্প্রদায়ভুক্ত। হয়ত সম্প্রদায়গত নীচতায় তাদেরও অন্তর ছিল কলুষিত। এখন বোধ হয় এসেছেন হতাহতের সংখ্যা ও সম্পত্তি লুঠতরাজের পরিমাণ ইত্যাদির তথ্য সংগ্রহে। 

     যাই হোক, তাঁরা এসে উপস্থিত হলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে। এই ঘটনার সূত্রপাতের কথায় বললেন, এ কী অন্যায় আবদার, শ্মশানে শবদাহ হবে না ? আমরা উপস্থিত থেকে শবদাহ করিয়ে যাব। শব নিয়ে চলেন শ্মশানে। 

শ্রীশ্রীঠাকুর সহাস্যে বললেন, আপনাদের উপস্থিতিতে শবের দাহ হতে পারে বটে, কিন্তু তাতে কি ভ্রান্ত প্রতিবাসীদের মনের দাহ প্রশমিত হবে ? শবদাহ আশ্রমের মধ্যেই হবে— আপনারা সে জন্য চিন্তিত হবেন না।

পাবনার পুলিশ কর্মচারীদের সঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুরের বোধ হয় এই প্রথম পরিচয়। তাঁরা মুগ্ধ হয়ে গেলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের কথার সারবত্তায়। পুলিস-সুপার বললেন, এমন লোকের নিধন সাধনে যারা উদ্যত হয় তাদের উচিতমত শিক্ষার প্রয়োজন। আপনি অনুগ্রহ করে তাদের নামগুলো আমাদের দিন— আমরা তাদের উচিতমত শিক্ষা দেব।

একটু বিনীত হাসি হেসে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, শারীরিক শাস্তি দিয়ে কি মানুষের পরিবর্তন করা যায় ? আমার শাসন হল ক্ষমার—ভালবাসার। 

এই অপ্রত্যাশিত উক্তিতে পুলিশ কর্মচারিগণ হলেন অধিকতর সশ্রদ্ধ। বললেন, আপনার সম্বন্ধে আমাদের পূর্বধারণার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। আপনি হিন্দুদের যাই হোন না কেন— আমাদের পীর। আশ্রমের কেশাগ্র যাতে স্পর্শ করতে কেউ সাহস না পায় সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি থাকবে। 

প্রলয়ের বিধ্বংসী দুর্যোগের পর আশ্রমে ফিরে এলো প্রশান্তির আনন্দ । একমাত্র শরণ শ্রীশ্রীঠাকুরের উপর সকলের শ্রদ্ধা নিবিড় হয়ে উঠল।

কথায় বলে, খাল কেটে কুমীর আনা । এখন পাবনাতে হয়েছে তাই। ঈর্ষান্বিত হিমাইতপুর-গ্রামবাসী হিন্দুগণের আশ্রম আক্রমণের প্ররোচনায় পাবনার উন্নত মুসলমানগণ এখন ঝাঁপিয়ে পড়ল গ্রামাঞ্চলের দিকে। পাবনা শহরে ইংরাজ কর্তৃপক্ষের শাসনে তাদের অবাধ উচ্ছৃঙ্খলতায় বাধা পেয়ে তারা গ্রামাঞ্চলের হিন্দু-নিধনে হল উন্মত্ত। বহু হিন্দু গৃহস্থ এখানে মুসলমান প্রতিবেশী দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রতিবেশিসুলভ সখ্য থাকা সত্ত্বেও তাদের পক্ষে প্রতিবেশী হিন্দুদের রক্ষার জন্য বহিরাগত মুসলমান ভাইদের বাধা দেবার কোন উপায় নাই। গ্রামের মুসলমান মণ্ডলগণেরও তাদের বাধা দানের সামর্থ্য নাই ।

দিনের পর দিন সুদূর গ্রামাঞ্চল থেকে মর্মান্তিক ঘটনাবলীর সংবাদ শোনা গেল। ইতিমধ্যে হিমাইতপুর গ্রামের মুসলমানগণের অর্থাগমকেন্দ্র আশ্রমে অর্থোপার্জনের কোন উপায় না থাকাতে দুর্বিষহ দুর্দশার মধ্যেই তাদের চলেছে উপবাস। ক্রমে তারা প্ররোচনাদাতা হিন্দু অধিবাসীদের উপর হয়ে পড়ল ক্রুদ্ধ।  গুজব শোনা গেল হিমাইতপুর গ্রামটাও আক্রান্ত হবে। ঈর্ষাপ্রসূত কর্মফল এখন হিমাইতপুর গ্রামের হিন্দুদের হবে ভোগ করতে। তাঁরা সকলেই হয়ে পড়লেন আতঙ্কিত। পাবনা শহর তখনো উত্তপ্ত—সুতরাং সেখানেও তাঁরা নিরাপদ নন—আবার ভিন্ন পল্লীতে ততোধিক দুরবস্থা। যাঁরা গ্রামস্থ মুসলমানগণকে আশ্রমধ্বংসের প্ররোচনা দিয়েছিলেন তাঁরা অত্যন্ত বিপন্ন বোধে অবশেষে হলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের শরণাপন্ন । বললেন, আজ আমরা সকলেই বিপদাপন্ন। হিমাইতপুর গ্রাম নাকি আক্রান্ত হবে। ছেলেপুলে নিয়ে যাই বা কোথায় ? আশ্রমে তবু পুলিশ প্রহরা আছে। আর কোথাও তো নিরাপদ মনে করি না । এখানে আমাদের একটা আশ্রয় দিতে হবে। এইজন্য আমরা এলাম ।

শ্রীশ্রীঠাকুর অত্যন্ত সহানভূতির সঙ্গে তাদের বক্তব্য শুনে বললেন, ‘শুধু আপনারা বিপন্ন নন । বিপন্ন আজ সমস্ত গ্রামাঞ্চল। পাবনার সকল হিন্দু আজ অসহায়। সকলের কথাই ভাবতে হবে।’ হিমাইতপুরের হিন্দুগণ শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা উপলব্ধি করতে না পেরে তাঁকে ভুল বুঝলেন। তাঁরা মনে করলেন হিন্দু জনসাধারণের জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদছে এই বলে তাঁদের আবেদন তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। মনঃক্ষুণ্ণ   হয়েই তাঁরা নিলেন বিদায়।

গ্রামাঞ্চলের অসহায় হিন্দুদের জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর ছিলেন খুবই উদ্বিগ্ন। সেদিন সকালেই তিনি শ্রদ্ধেয় কিশোরীদা আর আকুদাকে আদেশ দিলেন পাবনার গ্রামাঞ্চলের মুসলমান মোড়লদের কাছে সেইদিনই তাদের আমন্ত্রণ করে আশ্রমে নিয়ে আসতে!

আদেশ প্রাপ্তিমাত্র তাঁরা দুজন বহির্গত হলেন এই আদেশ প্রতিপালনে। সে সময়ে মুসলমান অধ্যুষিত জনপদ পরিক্রমা সাক্ষাৎ মৃত্যুর নামান্তর। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুরের কণ্ঠনিঃসৃত আদেশই তাঁদের কর্ম । কারো সাধ্য নাই সেই রক্ষা-কবচ ভেদ করে তাঁদের কোন অনিষ্ট সাধন করতে পারে। তাঁরা নির্ভয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের মণ্ডলগণকে শ্রীশ্রীঠাকুরের আমন্ত্রণ বিজ্ঞাপিত করে চলেছেন। অকুতোভয় এই দুজন সম্মানীয় ব্যক্তির সাহসিকতায় মণ্ডলগণ হলেন মুগ্ধ। তাঁরা শ্রীশ্রীঠাকুরের উপর বরাবরই সশ্রদ্ধ। আমন্ত্রণ গ্রহণে তাঁরা আগ্রহী হলেন বটে, কিন্তু অন্তরায় হল মৌলভী-ভীতি। কারণ এ সময়ে যদি মৌলভীগণ জানতে পারেন যে তাঁরা শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে গেছেন পরামর্শের জন্য, তাহলে তাঁদের প্রাণসংশয়। অবশেষে ঠিক হল যে তাঁরা শেষ রাত্রের গভীরে সকলের অজ্ঞাতসারে  আশ্রমে উপস্থিত হবেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের উপদেশ শোনবার  জন্য । 

মণ্ডলগণ একে একে আশ্রমে হলেন সমবেত। সৎসঙ্গ মন্দিরের বড় ঘরটায় তাঁদের সমাবেশের স্থান ছিল নির্দিষ্ট। সেই স্বল্পবিদ্য গ্রাম্য মণ্ডলগণের সমাবেশে করুণাঘনবিগ্রহ শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর আসনে হলেন সমাসীন। তাঁর ব্যথাতুর মুখমণ্ডলের বর্ণনার ভাষা নাই ।

হন্তার মুষ্টিবদ্ধ তীক্ষ্মধার সংহারিকার মুখে আক্রান্তের আসন্ন মৃত্যুর বিভীষিকার ভয়ার্ত মুখখানি কি দেখেছেন ? দেখেছেন কি, ‘আমায় মেরো না, আমায় বাঁচাও—বাঁচাও’ বলে সে মুখে প্রাণভিক্ষার কী ব্যাকুল আবেদন ? যদি না দেখে থাকেন তাহলে আসুন মণ্ডলগণের এই নিশীথ-পরিবেশে। দেখুন শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীমুখমণ্ডলে অসহায় হিন্দুগণের নিষ্ঠুরতম হত্যার সে কী পুঞ্জীভূত বেদনা বিগলিত ধারায় ঝরে পড়ছে তাঁর নয়নে! জীবনরক্ষার কী কাতর আবেদনের আকুতি ফুটে উঠছে তাঁর বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে। এ দৃশ্যে পাষাণেরও হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। আবেগাপ্লুত কম্পিত কণ্ঠের সেই প্রাণবন্ত ভাষণটী কালের ব্যবধানে যদিও এখন ঝাপসা হয়ে গেছে তবু যতটকু স্মৃতিপথে টেনে আনতে পারি তাই সংক্ষেপে এখানে উদ্ধৃত করে যাই। ভাষণটী সংক্ষেপতঃ এইরূপে।—

“জীবনকে রক্ষা করে চলাই খোদার সৃষ্ট জীবমাত্রেরই সহজ ধর্ম। রক্ষার এই প্রচেষ্টা তার দুর্নিবার, নতুবা তার অস্তিত্বই থাকে না। শিশু ভূমিষ্ঠ  হয়েই কেঁদে ওঠে প্রাণহানির আশঙ্কায়। যতই সে বড় হয়— জ্ঞান ও বুদ্ধিকে সজাগ করে রাখে জীবনটাকে ধরে রাখতে। খোদার আশীর্বাদপূত সেই জীবনের অস্তিত্বকে হননের উল্লাসে যারা নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে তারা শয়তানের সহচর তাতে সন্দেহ নাই। খোদার সৃষ্টিকে শয়তান ধ্বংস করতে চায়, তাতেই তার উল্লাস। জিঘাংসার উন্মত্ততায় শয়তানের সহচরগণ হয় নিষ্ঠুর, হিংস্রতায় তারা হয়ে ওঠে দুর্মদ। প্রাণরক্ষার কাতর আবেদনে জাগায় না কোন সাড়া— দয়া, স্নেহ, মমতা প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তিগুলো তাদের মধ্যে নিরেট হয়ে যায়। এই সব হিংস্র পশুর দল যে জাতির মধ্যে গজাতে থাকে পরস্পর হানাহানিতে সে জাতি নিঃশেষ হয়ে যায়।

প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করলেই— সে নেবে তার প্রতিশোধ । উন্মত্ত হয়ে আমি আজ যা করব ভবিষ্যতে তাই তোলা থাকবে আমারই জন্য। খোদার দুনিয়ায় অবিচার নাই।”

বিগলিত-অন্তর মণ্ডলগণ সাশ্রুলোচনে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে করজোড়ে প্রতিজ্ঞা করলেন যে তাঁরা জীবন দিয়েও হিন্দু ভাইদের রক্ষা করবেন।

রাত্রির শেষযামে মণ্ডলগণ গেলেন চলে, পরদিন থেকেই পরিস্থিতির হল অদ্ভুত পরিবর্তন । আশ্রম থেকে পাকশী পর্যন্ত প্রায় ষোল মাইল ব্যাপী অঞ্চলে আর কোন অপ্রীতিকর সংবাদ পাওয়া যায়নি। হিন্দুমেধযজ্ঞের হল পরিসমাপ্তি। পাবনা শহরও হল শান্ত ।

কিন্তু হিমাইতপুর গ্রামের মুসলমানদের দুর্দশার আর অন্ত নাই। তাদের অর্থাগমের একমাত্র স্থান সৎসঙ্গ আশ্রম, সেখানে মুখ দেখানোর পথ নাই। গ্রামস্থ হিন্দুগণের ত সহানুভূতি তারা হারিয়েছে ।

আবার আশ্রম আক্রমণ-জনিত অপরাধে তারা যে দায়রা সোপর্দ হবে না তা কে বলতে পারে ? মোট কথা ধনে প্রাণে পুত্র পরিবার সহ তারা এখন মরতে বসেছে। কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত, মার্জনার কোন পথই খোলা নেই তাদের।

সে দিন সকালে অনন্ত মহারাজ গ্রামের পথ দিয়ে চলেছেন এক বাড়ীতে রোগী দেখতে। পথিমধ্যে ঘিরে ধরল বুভুক্ষিত মুসলমানগণ। ক্ষীণকণ্ঠে তারা বললে, ডাক্তার বাবু ! আমাগো মারি ফ্যালায়ে দ্যান। 

পাবনার ভাষায় তাদের বক্তব্য হল, তারা যে পাপকর্ম করেছে তার মার্জনা নাই। সারা জীবন তাদের জেলে পচতে হবে, পোলাপান অর্থাৎ ছেলে-পিলে গুলোর কি হবে সেই ভাবনা। তারা তো না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরে যাবে। তাদের প্রার্থনা ছেলেগুলোকে ঠাকুর যেন দেখেন। তারা তো কোন অপরাধ করে নি।

বিশীর্ণদেহ গ্রামস্থ মুসলমানদের কাতর প্রার্থনায় মহারাজের চক্ষু সজল হয়ে উঠল, তিনি বললেন, ‘তোরা সকলে মিলে তাঁর কাছে ক্ষমা চা গা। তোদের অপরাধ তিনি মার্জনা করেছেন। পুলিশ তোদের শাস্তি  দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি বললেন, ওরা যে আমার আশ্রিত। ওদের শাস্তি হলে ওদের পরিবারবর্গের সকলেই মরে যাবে।’

অনুতপ্ত মুসলমানগণ শ্রীশ্রীঠাকুরের অশেষ করুণার সংবাদে বিগলিত অন্তরে তাঁর পুরোভাগে লুটিয়ে পড়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তাদের কৃতকর্মের জন্য চাহিল মার্জনা।

করুণাময় ঠাকুর তাদের আশস্ত করে বললেন,

‘অমন কাম আর কখ্খনো করিস নে বুঝলি তো ? কাল সকাল থেকে আশ্রমের কাজে লেগে যা। আর কিছু টাকা মহারাজের কাছ থেকে নিয়ে ছেলেপেলেগুলোকে বাঁচিয়ে তোল্। পরে না হয় খেটে শোধ করে দিস।’

জীবনবেদই যাঁর বেদ, সর্বপ্রকার দুঃখদুর্দশা থেকে মানবের উদ্ধারসাধনই যাঁর সাধনা আপামরে মৃত্যুঞ্জয়ী মহামন্ত্রদানে যিনি মুক্তহস্ত, তাঁর অপার করুণায় হিন্দুগণ সে যাত্রা হলেন নির্বিঘ্ন, নারীগণের মর্যাদা হল নিরাপদ, সকলের উৎকণ্ঠা-আতঙ্কের হল অবসান। কিন্তু তবু কি মানুষে দেয় তার সামান্যতম কৃতজ্ঞতার পরিচয়।

                                 ———

ARYA MAHASABHA

।। আর্য্য মহাসভা — পরমরাষ্ট্রিক সমবায় সমিতি গঠনের পরিকল্পনা ।।
                                  নিবেদনে—তপন দাস

                      ******************************

      [শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তাঁর ভাগবত আন্দোলনের  সদস্যদের উদ্দেশ্যে এক যুগান্তকারী বাণীতে বললেন,  ‘‘ঘটে ঘটে ইষ্টস্ফূরণ যখনই তোর হবে,/ব্রহ্ম-বোধের প্রথম ধাপটি ঠিক পাবি তুই তবে।’’ অর্থাৎ, পঞ্চ-মহাভূত বেষ্টিত বৃহত্তর পরিবেশের জৈবাজৈব যা’-কিছু আছে সব-কিছুর মধ্যে ইষ্ট স্ফূরণের বা মঙ্গল প্রতিষ্ঠার ভাবে ভাবিত হয়ে  চলতে পারলে তবেই তুমি ব্রহ্মবোধ বা ধর্মবোধের সোপানপথের প্রথম ধাপের সন্ধান পাবে। তারপর সোপানপথ বেয়ে ঈশ্বরপ্রাপ্তির গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম  হবে।

            শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আদর্শের আবশ্যিক পালনীয় প্রাথমিক বিষয়সমূহ— অভক্ষ্যভোজী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুনাদি তামসিক আহার করা যাবে না। যারা করেন, আর্য্য হিন্দুমতে তাদের অভক্ষ্যভোজী বলা হয়েছে। অগম্যাগামী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ যারা প্রতিলোম, সগোত্র এবং সপিণ্ড সম্বন্ধীয়দের সাথে অবিধি পূর্বক ধর্মবিরুদ্ধ বিবাহের মাধ্যমে কামাচার করে, হিন্দুমতে তাদের অগম্যাগামী বলা হয়েছে। এরা কদাচারী, এদের প্রদত্ত আহার ও পানীয় অশুদ্ধ। (দ্রঃ সম্বিতী)

শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্য হতে হলে ঊষানিশায় মন্ত্রসাধন করতে হবে, চলাফেরায় নাম জপ করতে হবে।  আহ্বানীসহ সন্ধ্যা ও প্রার্থনা, ইষ্টভৃতি (ইষ্টনীতির ভরণ), কমপক্ষে ৩ বার শবাসন প্রভৃতির নিত্য-সাধন করতে হবে। বর্ণধর্মানুযায়ী সদাচারী হতে হবে। বর্ণাশ্রম মেনে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে, বৃত্তিহরণ করা চলবে না। ‘পঞ্চবর্হিঃ’ এবং ‘সপ্তার্চ্চিঃ’-র বিধান মেনে চলতে হবে, সকলকেই। ওই নিয়মাবলী, ওই বিধিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমের নাম দীক্ষা গ্রহণ করা।

যাঁরা এস. পি. আর., পি. আর. উপাধির বলে দীক্ষা সঞ্চারণা করেন, তাঁরা যজমানদের দিয়ে ‘‘এই দীক্ষা গ্রহণ করিয়া আমি সর্বান্তকরণে শপথ করিতেছি যে—মানুষের জীবন ও বৃদ্ধির পরম উদ্ধাতা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে প্রতিষ্ঠা করাই এইক্ষণ হইতেই আমার জীবনের যজ্ঞ হউক। ……’’ ইত্যাদি উচ্চারণ করিয়ে সংকল্প-শপথ গ্রহণ করান। এবং দীক্ষাপত্রের ২টি স্তবকে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। এর উদ্দেশ্য যজমান যা’তে ঠাকুরের আদর্শ মেনে চলে তারজন্য একেবারে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থাপত্র স্বয়ং শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্তদীক্ষাদাতার কর্তব্য, দীক্ষা গ্রহিতাকে শ্রীশ্রীঠাকুরের উপরোক্ত আদর্শের বিষয়ে সম্যকভাবে অবগত করিয়ে দীক্ষা দান করা। তা’ না করিয়ে দীক্ষাদাতা যদি তড়িঘড়ি করে যেনতেন প্রকারেণ মন্ত্র দিয়ে সই-সাবুদ করিয়ে নেয়, তাহলেই মুশকিল। কপটাচার এবং দ্বন্দ্বীবৃত্তি দোষে দুষ্ট হতে হবে। শ্রীশ্রীঠাকুর কপট ব্যক্তিদের ধর্ম্মরাজ্যে প্রবেশের অধিকার দেন নি (সত্যানুসরণ)।  আর দ্বন্দ্বীবৃত্তির জন্য কোন প্রায়শ্চিত্ত নেই (আঃ প্রঃ ২য় খণ্ড, ৬ই পৌষ, রবিবার, ১৩৪৮/ইং ২১-১২-৪১)অথচ দীক্ষা সঞ্চারণার ক্ষেত্রে সেই প্রবহমানতা চলছে। যারফলে বেশিরভাগ দীক্ষিতগণ মনে করেন, সকালবেলা উঠে ঠাকুরের নামে পয়সা রাখা, শুক্রবার নিরামিষ খেলেই শ্রীশ্রীঠাকুরের শিষ্য হওয়া যায়। অথচ, সত্যানুসরণ গ্রন্থের প্রথমেই তিনি এ বিষয়ে সাবধান বাণী দিয়ে রেখেছেন। “অর্থ, মান, যশ ইত্যাদি পাওয়ার আশায় আমাকে ঠাকুর সাজিয়ে ভক্ত হ’য়ো না, সাবধান  হও—ঠকবে ; তোমার ঠাকুরত্ব না জাগলে কেহ  তোমার কেন্দ্রও নয়, ঠাকুরও নয়—ফাঁকি দিলেই পেতে হবে তা’” অর্থাৎ, আমার মধ্যে যদি তাঁর আদর্শের প্রকাশ না হয়প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী অর্থ, মান, যশ ইত্যাদি চাহিদার পূর্তি করতে গিয়ে তাঁর প্রদত্ত বিধি অমান্য করে চলি। ইষ্টনীতির ব্যতিক্রমী চলনে চলে  ঠাকুরত্বকে  জাগাতে ব্যর্থ হই,  তাহলে তিনি আমার কেন্দ্রও নন, ঠাকুরও নন, আমার ভালো-মন্দের দায়িত্ব তাঁর নেইএকেবারে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন।

সেই হিসেবে বিচার করে দেখলে দেখা যাবে, তাঁর আদর্শ মেনে চলেন যাঁরা, যজনসিদ্ধ যাঁরা, একমাত্র তাঁদেরই অধিকার রয়েছে, যাজন করার, প্রচার করার। অথচ, আমরা এসব মূল বিষয়টিকে উপেক্ষা করে, অনেক কিছুতে, যথা, সদাচার, বর্ণাশ্রম, ঠাকুরের বলা পরিচ্ছদ, ইত্যাদিতে ছাড় দি‌য়ে, নিয়মের শিথিল করে অধিবেশন করে চলেছি। সেই বিষয়ে সকলকে সচেতন হবে, নচেৎ কপটাচার ও দ্বন্দীবৃত্তি দোষে দুষ্ট হতে হবে।]

*         *         *

বলতে দ্বিধা নেই, আমি ব্যক্তিটি দ্বন্দ্বীবৃত্তি-দোষে দুষ্ট। আমার কথায়-কাজে  মিল নেই।  আমি ব্যক্তিটি নিয়মিত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র রচিত প্রার্থনা করতে অভ্যস্ত হলেও প্রার্থনার মাধ্যমে উচ্চারিত মন্ত্রগুলোর প্রকৃষ্টরূপে অর্থ মনন করে সেই অনুযায়ী বাস্তব-চলনায় চলতে আমি চেষ্টা করিনি। যেমন, প্রার্থনা মন্ত্রের  ‘পুরুষোত্তম  বন্দনা’ স্তবকে  “……..ব্যক্তি-দম্পতি-গৃহ-সমাজ-রাষ্ট্রোদ্ধারণে যজন-যাজনেষ্টভৃতি-স্বস্ত্যয়নী-প্রবর্ত্তকম্ প্রাচ্য-প্রতীচ্য-নিয়ন্ত্রণে বর্ণাশ্রমানুশাসকম্ আর্য্য-চিরায়ণম্!

আৰ্য্যকৃষ্টিতূর্য্যধ্বনিত-পল্লীনিকেতনম্ আর্য্যভূমিধূলিপাবনচিদানন্দকম্ সকলশিল্পবিজ্ঞানযুতং পূর্ণং পুরাণং পরাৎপরকম্! ……… ” দীর্ঘদিন  ধরে উচ্চারণ করা সত্বেও ওই মন্ত্রের মর্মস্থলে প্রবেশ করার চেষ্টা করিনি। যেমন চেষ্টা করিনি সৎসঙ্গ অধিবেশন অন্তে  উচ্চারিত—

“আর্য্যস্থান পিতৃস্থান

উচ্চ সবার পূর্য্যমান।

অমর রহুক  আর্য্যবাদ

জাগুক উঠুক আর্য্যজাত।

ফুলিয়ে তোল দুলিয়ে তোল

তাথৈ তালে আর্য্যরোল।

আর্য্যকৃষ্টির যা ব্যাঘাত

খড়্গে তোরা  কর নিপাত।”—ইত্যাদি

আহ্বান ধ্বনিগুলোর ভাবার্থ  বা মর্মার্থের বাস্তবায়ন নিয়ে—এ আমার অযোগ্যতা! আমি যুগধর্মের হাতছানির কবলে পড়ে আর্য্যকৃষ্টি সম্পর্কে কোন পরিচ্ছন্ন ধারণাও এতদিন ধরে অর্জন করতে পারিনি।

     কোন্  ভাগ্যবলে একদিন শ্রীশ্রীঠাকুরের  ‘সম্বিতী’ গ্রন্থের একটি বাণী—

“বর্ণাশ্রম ভারতীয় বৈশিষ্ট্যানুপাতিক

আর্য্যকৃষ্টি-পরিরক্ষণের এক প্রকৃষ্ট দুর্গ,

ভারতীয় আর্য্যেরা যে এখনও আছেন–

তা’র ঐতিহ্য ও কৃষ্টির কঙ্কালকে

গোঁড়া-আগলানিতে আগলে ধ’রে

তা’র কারণ ঐ বর্ণাশ্রম,

যতটুকু ভেঙ্গেছ ওকে

ভাঙ্গাও পড়েছ তেমনি ;

যদি পার পরিমার্জিত কর,

উজ্জীবিত ক’রে তোল,

বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে,

বাঁচবে এখনও, আর দুনিয়াকে বাঁচাবে;

আর যদি ভাঙ্গ, হারাবে,–

সাবাড় হবে নিজেরাও।” ৪৫৫।

      বাণীটি আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে আর্য্যকৃষ্টি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়।   ভাবতে            ভাবতে সমাধানী সূত্র খুঁজে পেয়ে  যাই আলোচনা প্রসঙ্গে গ্রন্থের ৮ম খণ্ডে।

শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন— আদর্শ নিষ্ঠার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য নিয়ে সহজাত সংস্কার-অনুযায়ী জীবিকা অর্জ্জন ক‘রে, সুবিবাহ ও সুজননে ক্রমোন্নত হ’য়ে সেবায় সমাজকে সমুন্নত ক’রে, সব্যষ্টি সমষ্টির সুকেন্দ্রিক ক্রমবিবর্ত্তনই আর্য্যকৃষ্টির মূল কথা।

(আঃ প্রঃ ৮/১৮৪)

      ভাবতে ভাবতে ভাবনার বিস্তারে বোধে ধরা দিল, ‘আর্য্য’ শব্দটি গুণবাচক। যাঁরা বর্ণাশ্রম, চতুরাশ্রম পরিপূরণী দশবিধ সংস্কারে সংস্কৃত হতেন তাঁদেরই আর্য্য অভিধায় ভূষিত করা হতো । তাঁরাই ক্রমে আর্য্য জাতিভুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমান যুগধর্মে সম্মানিত ব্যক্তিদের যেমন সম্বোধনে ‘স্যর’, ‘ম্যাডাম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেসময় সদাচারী বর্ণাশ্রমানুগজীবন যাপন কারীদের উদ্দেশ্যে ‘আর্য্য’, ‘আর্য্যপুত্র’, ‘আর্য্যা’ ইত্যাদি ব্যবহৃত হতো। শ্রীশ্রীঠাকুর সেই হৃত গৌরব পরিশীলিত রূপে প্রতিষ্ঠা করতে ‘পঞ্চবর্হি’ এবং ‘সপ্তার্চ্চি’র প্রবর্তন করলেন দৈনন্দিন প্রার্থনামন্ত্রে।  আমাদের ব্রাত্যদোষ মুক্ত করে প্রকৃত আর্য্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে। ‘আর্য্যকৃষ্টি’ নামক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। তাই, প্রকৃত আর্য্য হতে হলে যুগ পুরুষোত্তমের সাথে সংযুক্ত হয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে তদগতিসম্পন্ন জীবনচলনায় অভ্যস্ত হতে হবেই। এছাড়া কোন পথ নেই।

                                           * * *

        অবতার বরিষ্ঠমাত্রেই পূর্বাপূর্ব অবতারদের পরিপূরণকারী হন,  পূর্ববর্তীদের আচার্য্যজ্ঞানে মান্য করেন এবং করান। দৈনন্দিন প্রার্থনার পুরুষোত্তম বন্দনা স্তবকে  ‘‘……মৎস্য-কূৰ্ম্ম-কোল-নৃসিংহ-বামন শরীরম্ রাম-কৃষ্ণ-বুদ্ধ-যীশু-মোহম্মদ রূপায়িতম্ চৈতন্য-রামকৃষ্ণানুকূলং পূর্ব্বর্তনীপূরণম্ শাশ্বতং বৰ্ত্তমানম্।…….’’ উচ্চারণ করিয়ে আমাদের পূর্ববর্তী আচার্য্যদের প্রণাম করতে শেখালেন। এই হচ্ছে  আচার্য্য-পরম্পরাকে স্মরণ-মনন  করার প্রকৃত শিক্ষা।    

       শ্রীশ্রীঠাকুরের পূর্ববর্তী আচার্য্য  ‘‘যেই রাম সেই কৃষ্ণ, এক দেহে রামকৃষ্ণ’’ রূপে এসে বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য স্থাপনের জন্য গীর্জায় গিয়ে যীশুর, মসজিদে গিয়ে রসুলের আরাধনা করেছিলেন। তিনি লোকশিক্ষার জন্য বহু ধর্মীয় মতবাদের গুরুদের কাছে দীক্ষাও নিয়েছিলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুন্ন রেখেই। তথাপিও সাধারণ মানুষেরা মনের মণিকোঠায় জমে থাকা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ একেবারে মুছে ফেলতে পারে নি। এবার অনুকূলচন্দ্র রূপে এসে ‘‘ঈশ্বর এক, ধর্ম এক, প্রেরিতগণ সেই এক-এরই বার্তাবাহী’’ বাণীর মর্মার্থ বোঝাতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ভেদাভেদ ঘোচাতে, এক অভিনব ব্যবস্থা করেছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য কুষ্টিয়ার ভক্তদের শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবুদ্ধ, প্রভু যীশু, হজরত রসুল, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ প্রমুখ পূর্ববর্তী অবতার-বরিষ্ঠদের জন্মোৎসব পালন করতে উৎসাহিত করেছিলেন। ঠাকুরের নির্দেশ মেনে কুষ্টিয়ার ভক্তরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের থেকে শুরু করে সাধারণ অনুরাগীদের শ্রদ্ধার সাথে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলাপ-আলোচনা-কথকতা ও অন্নব্যঞ্জনাদির সেবার ব্যবস্থা করতেন। ওইভাবে পূর্বাপূর্ব অবতার বরিষ্ঠদের জন্মোৎসব পালন করার ফলে সারা কুষ্টিয়ায় এক অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে গিয়েছিল। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে শ্রদ্ধা-প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠেছিল।

      পুরুষোত্তমগণের প্রধান বৈশিষ্ট্য, তাঁরা সম্বেগসিদ্ধ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন। আত্মপ্রচার না করে সমাগতদিগের বৈশিষ্ট্যের পালন ও পোষণ করেন। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কাছে শ্রীরামচন্দ্রের ভক্ত গেলে তিনি আলাপ-আলোচনায় শ্রীরামচন্দ্রের, শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত গেলে শ্রীকৃষ্ণের, বুদ্ধদেবের ভক্ত গেলে বুদ্ধদেবের, প্রভু যীশুর ভক্ত গেলে প্রভু যীশুর, রসুল ভক্ত গেলে হজরত মহম্মদের, চৈতন্যদেবের ভক্ত গেলে চৈতন্যদেবের, শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত গেলে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গুণগান করে তাঁদের ইষ্টানুরাগ বাড়িয়ে দিতেন। তাঁরা তাঁদের ঈপ্সিত ইষ্টকে খুঁজে পেতেন পূর্বতন পূরয়মান বর্তমান পুরুষোত্তমের মধ্যে। অনুরূপভাবে প্রভু যীশুখ্রীষ্টের ভক্ত রে. আর্চার হাউজারম্যান, ই. জে. স্পেনসার প্রমুখ যীশুখ্রীস্টের ভক্তগণ,  খলিলুর রহমান প্রমুখ হজরত রসুলের ভক্তগণ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মধ্যে তাঁদের আরাধ্য নবী, প্রফেট, পরমপিতা পুরুষোত্তমকে খুঁজে পেয়ে সারাটা জীবন তাঁর সান্নিধ্যে কাটিয়ে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত সমন্বয়ী ধর্মাদর্শ প্রচার করে গেছেন।

       শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন, ‘‘একজন সত্যকার হিন্দু, একজন সত্যকার মুসলমান, একজন সত্যিকার খ্রীষ্টান—পরমপিতার চোখে এরা সবাই সমান। …… প্রকৃত ধার্ম্মিক যারা তারাই সমাজের গৌরব।

      একজন খ্রীষ্টানের প্রথম যীশুখ্রীষ্টকে ভালবাসা উচিত এবং তাঁর মাধ্যমে সব প্রেরিতপুরুষকে ভালবাসা উচিত। একজন হিন্দুর শ্রীকৃষ্ণকে বা যে-প্রেরিতপুরুষকে সে অনুসরণ করে তাঁকে ভালবাসা উচিত এবং তাঁর মাধ্যমে অন্য সব প্রেরিত পুরুষকে ভালবাসা উচিত। কোন প্রেরিত পুরুষকে ভালবাসা মানে তিনি যেমন ছিলেন, সেইভাবে তাঁকে বোঝা। আমাদের সুবিধা অনুযায়ী তাঁর মতের বিকৃত ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। যদি কেউ বলে—যীশুকে নয়, আামি মা মেরীকে ভালবাসি, তাহলে সে মা মেরীকে ভালবাসে কি না, তা সন্দেহযোগ্য। (সূত্রঃ আ. প্র. ১১ খণ্ড, ইং তাং ৭. ২. ১৯৪৮)

                                      *   *    *

 জীবনবাদের বাদী শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তাঁর প্রতিষ্ঠিত সৎসঙ্গের আদর্শ এবং উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে  বলেছেন—

‘‘সৎসঙ্গ চায় মানুষ,

ঈশ্বরই বল

খোদাই বল

ভগবান্ বা God–ই বল

অস্তিত্বই বল—

ভূত ও মহেশ্বর যিনি এক—তাঁরই নামে

সে বোঝে না হিন্দু

সে বোঝে না খ্রীষ্টান

সে বোঝে না মুসলমান

সে বোঝে না বৌদ্ধ

সে বোঝে প্রতি প্রত্যেকে তাঁরই সন্তান,

সে আনত করে তুলতে চায়

সকলকে সেই একে,

সে পাকিস্তানও বোঝে না

হিন্দুস্তানও বোঝে না

রাশিয়াও বোঝে না

চায়নাও বোঝে না

ইউরোপ, আমেরিকাও বোঝে না–

সে চায় মানুষ,

সে চায় প্রত্যেকটি লোক

সে হিন্দুই হোক

মুসলমানই হোক

খ্রীষ্টানই হোক

বৌদ্ধই হোক

বা যেই যা হোক না কেন

যেন সমবেত হয় তাঁরই নামে

পঞ্চবর্হির উদাত্ত আহবানে—

অনুসরণে—পরিপালনে

পরিপূরণে উৎসৃজী উপায়নে

পারস্পরিক সহৃদয়ী সহযোগিতায়

শ্রমকুশল উদ্বর্দ্ধনী চলনে

যাতে খেটেখুটে প্রত্যেকে

দুটো খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে

সত্তা স্বাতন্ত্র্যকে বজায় রেখে

সম্বর্দ্ধনার পথে চলে,

প্রত্যেকটি মানুষ যেন বুঝতে পারে

প্রত্যেকেই তার,

কেউ যেন না বুঝতে পারে

সে অসহায়, অর্থহীন, নিরাশ্রয়,

প্রত্যেকটি লোক যেন বুক ফুলিয়ে

বলতে পারে

আমি সবারই—

আমার সবাই—

সক্রিয় সাহচর্য্যী অনুরাগোন্মাদনায় ,

সে চায় একটা পরম রাষ্ট্রীক সমবায়

যাতে কারও সৎ-সম্বর্দ্ধনায়

এতটুকু ত্রুটি না থাকে

অবাধ হয়ে চলতে পারে প্রতিপ্রত্যেকে

এই দুনিয়ার বুকে

এক সহযোগিতায়

আত্মোন্নয়নী শ্রমকুশল

সেবা সম্বর্দ্ধনা নিয়ে

পারস্পরিক পরিপূরণী সংহতি উৎসারণায়

উৎকর্ষী অনুপ্রেরণায় সন্দীপ্ত হয়ে

সেই আদর্শ পুরুষে

সার্থক হতে সেই এক—অদ্বিতীয়ে।’’ (ধৃতি–বিধায়না, ১ম খণ্ড)

      বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার সর্বজনীনতায় সমৃদ্ধ ওই আবেদন অগ্রাহ্য করে তৎকালিন প্রবৃত্তি-পীড়িত কতিপয় উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে দেশভাগ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত  হতে চাইলে মানবসভ্যতার এক পরম বিস্ময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র জ্ঞান গরিমায় গরবিনী আর্য্য ভারতবর্ষের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন।  মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার নেতাদের সাথে কথা বলেছেন সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধি নিরসনের জন্য। হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘হিন্দু মহাসভা’র নাম বদলে ‘আর্য্য মহাসভা’ রাখতে। মুসলমানরাও আর্য্য। তাদেরও আর্য্য মহাসভার সদস্য করতে হবে। ইসলাম মতবাদের প্রকৃত তথ্য জানার জন্য আরবী শিখে কোরান পাঠ করতে হবে।  (শ্রীশ্রীঠাকুর সে ব্যবস্থাও করেছিলেন পাবনা আশ্রমে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা উপহার পেয়েছি ‘ইসলাম প্রসঙ্গে’ নামক এক  প্রামাণ্য গ্রন্থ।) মুসলীম লীগ যদি ইসলাম বিরোধী কিছু করে ‘প্রীভি কাউন্সিলে’ (ব্রিটিশ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত।) শত শত কেস করতে হবে মহানবীর আদর্শের  বিকৃতি প্রতিরোধ করতে। আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ করার জন্য হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে মুসলমানদের, মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে  হিন্দুদের স্থানান্তর করে সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এই যদি করে ফেলতে পারেন দেখবেন দেশ ভাগ হবে না। এজন্য টাকার অভাব হবে না। বড় বড় জমিদারদের বোঝান। তাদের সাহায্যে এ কাজ আপনি করতে পারবেন । অত বড় বাবার ছেলে আপনি। আমি আমার সব কিছু দিয়ে আপনাকে সহায়তা করব। আমাদের চেষ্টার ত্রুটিতে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে যদি দেশ ভাগ হয়, তা’তে হিন্দু মুসলমান উভয়ের ক্ষতির সম্ভাবনা। শ্রীশ্রীঠাকুর হিন্দু-মুসলমানের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য দেশ নেতাদের এবং বড় বড় জমিদারদের সাথে আলাপ-আলোচনা যেমন করেছেন, তেমনি নিজ-উদ্যোগে বাংলা থেকে পারশবদের এবং বিহার থেকে হৈ-হৈ ক্ষত্রিয়দের পাবনাতে এনে বসতি স্থাপন এবং কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন, জীবন-পিয়াসী মানুষদের সব রকমের স্বস্তি দেবার জন্য ‘স্বস্তিসেবক বাহিনী’ তৈরি  করিয়েছিলেন। প্রবর্তন করেছিলেন স্বস্ত্যয়ণী ব্রতের  ও ইষ্টভৃতি মহাযজ্ঞের।—তথাপিও দেশভাগ আটকানো যায়নি!

।।  হিমাইতপুর থেকে দেওঘরে আগমনের প্রেক্ষাপট ।।

     পরিবেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে পরমরাষ্ট্রিক সমবায় গঠনের লক্ষ্যে,  অখ্যাত পল্লী হিমাইতপুরে বায়ু থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করে পরম বিস্ময় সৃষ্টি
করেছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।  গড়ে তুলেছিলেন—তপোবন ও মাতৃ বিদ্যালয়—যা
শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। গড়ে তুলেছিলেন
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত ‘মনোমোহিনী ইনষ্টিউট অফ সায়েন্স এণ্ড
টেকনোলজি’ নামের বিজ্ঞান কলেজ। কেমিক্যাল ওয়ার্কসের জীবনদায়ী ঔষধসমূহ
দেশে এবং বিদেশে সমাদৃত হয়েছিল। বৈদ্যুতিক এবং যন্ত্রশিল্পের আধুনিক সব
ধরণের কাজ হতো ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল ওয়ার্কসপে। যথা,–ঢালাই,
ঝালাই, লেদের কাজ, ডাইস, ইলেক্ট্রোপ্লেটিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ফিটিং,
আরমেচার, ব্যাটারি প্লেট তৈরি ও মেরামত, ডায়নামো মেরামত ইত্যাদি।
ছিল—ময়দার কল, আটার কল, চালের কল, তেলের কল, চিনির কল, মেডিকেটেড ওয়াটার
মেশিন, স্পাইস পাউডারিং, সুতার গুটি তৈরি, টেলারিং, বোতাম তৈরি, গ্লাস
ব্লোয়িং, পটারী ওয়ার্কস্, বেকারী, লজেন্স তৈরি, গ্রোসারী প্রোডাক্ট
ইত্যাদির শিল্প। ছিল—কার্ডবোর্ড কারখানা, স্টীমলণ্ড্রী, কটন
ইণ্ডাস্ট্রিজ, হোশিয়ারী শিল্প, ব্যাঙ্ক, ইঞ্জিনীয়ারিং ওয়ার্কস্,
বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্র, স্বাস্থ্য বিভাগ, গৃহনির্মাণ বিভাগ, কলাকেন্দ্র,
প্রেস (যেখানে বাংলা, হিন্দী, সংস্কৃত, উর্দু, আরবী, ফারসী হরফের কাজ
হতো, দেশ ভাগের পর পাকিস্তান সরকার জবরদখল করে ঢাকাতে নিয়ে যায়।),
পাব্লিশিং হাউস, ফিলানথ্রপি, মাতৃসঙ্ঘ ইত্যাদি।
      পরিবেশের জন্য এতকিছু করা সত্বেও আশ্রমের ভেতরে-বাইরে উপকৃত মানুষেরাই
ঠাকুরের সাথে শত্রুতা করেই চলেছিল, এমনকি ঠাকুরকে অপহরণ করতে চেয়েছিল,
বিষ প্রয়োগ করে মারতেও চেয়েছিল। খুন হয় আশ্রমের কর্মী, তপোবনের ছাত্র।
পিতৃ-বিয়োগ, দেশবন্ধু-বিয়োগ, মাতৃ-বিয়োগ, আবাল্যের সাথী নফর ঘোষ, অনন্ত
মহারাজ, কিশোরীমোহন-দের বিয়োগ-ব্যথায় ব্যথাহারী হলেন ব্যথিত।

১৩৫৩ সালের প্রথম দিকে মুসলিম লীগের ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষিত হবার সাথে সাথে কলকাতায় যে পৈশাচিক হত্যালীলা হয়েছিল (গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস্) সে সংবাদ শুনে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন ঠাকুর। দেশ-নেতাদের আগাম সতর্ক করা সত্ত্বেও, প্রতিরোধী-ব্যবস্থাপত্র
দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। বিপন্ন দেশবাসীদের
রক্ষা করতে না পারার বেদনায় বিপর্যস্ত তিনি। বেড়ে গেল রক্তচাপ, হয়ে
পড়লেন অসুস্থ। খবর শুনে পাবনার বিশিষ্ট মুসলমান নেতৃবৃন্দ ঠাকুরকে দেখতে
আসেন, পাবনায় সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াতে দেবেন না বলে আশ্বস্ত করেন।
একটু সুস্থ বোধ করেন, আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঠাকুরের প্রিয়, কলকাতার
বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ গুপ্ত প্রয়োজনীয় ঔষধ এবং সম্পূর্ণ বিশ্রামের
ব্যবস্থাপত্র দিয়ে যান। বাঁধের ধারে নিভৃত নিবাসের মনোরম পরিবেশে ঠাকুরের
বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন ঋত্বিগাচার্য্য। চাপমুক্ত রাখতে দর্শনার্থীদের
প্রবেশ নিষেধ করে দেন। কিন্তু ঠাকুর রাজী হন না। মনের কথা, প্রাণের ব্যথা
নিয়ে যারা যারা আসবে, তাদের তিনি কিছুতেই ফেরাতে নারাজ। আগন্তুকদের
দুঃখ-বেদনার কথা শুনতে শুনতে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। সংবাদ পেয়ে ডাঃ গুপ্ত
আসেন, ঠাকুরকে দূরে কোথাও বায়ু পরিবর্তনের জন্য নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন।
অবশেষে আশ্রম কর্তৃপক্ষ ঠাকুরকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ঠাকুর বিহার প্রদেশের দেওঘরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
      “৩০শে আগষ্ট (১৯৪৬) শ্রীশ্রীঠাকুর পাবনা শহরের হিন্দু-মুসলমান নেতৃবর্গকে
ডেকে অনুমতি চান দেওঘর যাওয়ার. তখন সবার কাছ থেকে, বিশেষতঃ মুসলিম নেতা
হাকিম সাহেবের কাছে অনুমতি নেন ও কথা কাড়িয়ে নেন যাতে তিনি আশ্রমের
সামগ্রিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রসঙ্গতঃ ঠাকুর বলেন—হাকিম সাহেব! এখন
আমার বাইরে যাবার সময় নয়। আমার মার নামে– ‘মনমোহিনী ইনস্টিটিউট্ অফ্
সায়েন্স য়্যাণ্ড টেকনোলজি’ কলকাতা ইউনিভার্সিটির অধীনে নূতন কলেজ হয়েছে
আমার। কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির পরিকল্পনা আমার আজন্মের। সেই সুযোগ হাতে
এসে গেছে আমার। কেষ্টদা (ভট্টাচার্য্য) হচ্ছেন কলেজের প্রিন্সিপাল।
কেষ্টদা সঙ্গে না থাকলে তো আমি কানা, তাই কেষ্টদাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। আমার
এই বাচ্চা প্রিন্সিপাল থাকবে প্রফুল্ল দাস। বাচ্চা দেখালে কি হয়, এলেম
আছে। আপনি ওকে দেখবেন যাতে আমার মার নামের বিজ্ঞান কলেজ ভাল করে চলে।
হাকিম সাহেব বললেন—আপনি নিশ্চিন্ত মনে যান। কখনও কোনও অসুবিধা হলে
বঙ্কিমবাবু (রায়) ও প্রফুল্লবাবু যেন আমাদের জানান। ফোনে একটা খবর পেলেও
যা করার করতে পারি। খোদাতালার দয়ায় আপনি সুস্থ হয়ে সদলবলে তাড়াতাড়ি
ফিরে আসুন। আপনি ফিরে আসা না পর্য্যন্ত আমরা শান্তি পাব না।
পরিবেশটা তখন আবেগে ও মমতায় থরথর করে কাঁপছে। শ্রীশ্রীঠাকুরের চক্ষু
অশ্রুভারাক্রান্ত। বেদনাহত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সবার পানে। পূজনীয় খেপুদার
বাইরের ঘরে বসে এই ঐতিহাসিক শেষ বৈঠক।“ (তথ্যসূত্রঃ কুমারকৃষ্ণ
ভট্টাচার্য্য প্রণীত মহামানবের সাগরতীরে/১ম/৩)
     ঠাকুরের নির্দেশমত, “রওনা হলেন সুশীলচন্দ্র, সঙ্গে রাজেন্দ্রনাথ ও
বীরেন্দ্রলাল। কলকাতা এসে ভোলানাথ সরকারের সঙ্গে রাজেন্দ্রনাথ আপ্রাণ
চেষ্টা করে ৩১শে আগষ্ট বগী রিজার্ভ করলেন। ঠিক হল ১লা সেপ্টেম্বর সকালে
ঈশ্বরদী থেকে আসাম মেলের সঙ্গে বগী দেওয়া হবে। ৩১শে আগষ্ট আশ্রমে পৌঁছে
রাজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানালেন সমস্ত সংবাদ। বীরেন্দ্রলাল মিত্রকে সঙ্গে
নিয়ে সুশীলচন্দ্র ৩১শে আগষ্ট রাত্রে রওনা হলেন দেওঘরে বাড়ী ঠিক করার
জন্য। আশ্রমে বিদ্যুত বেগে প্রস্তুতি পর্ব্ব চলতে থাকলো। খবর রাখা হল বিশেষ
গোপনে, যাতে জনসমুদ্র এসে কেঁদে কেটে ঠাকুরের মত বদলে না ফেলে। পূজনীয়
বড়দা বিভিন্ন বিভাগের কর্ম্মীদের দিলেন যথোপযুক্ত উপদেশ ও
নির্দ্দেশাদি—যাতে তাঁদের অনুপস্থিতি কালেও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় সমস্ত
কাজ। নির্দ্ধারিত দিনে যথাসময়ে রওনা হলেন শ্রীশ্রীঠাকুর আশ্রম
ছেড়ে—সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের সবাই, শ্রীশ্রীঠাকুরের পরিচর্য্যাকারিগণ
প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিবারবর্গসহ, সপরিবারে স-সহচর ঋত্বিগাচার্যদেব,
রাজেন্দ্রনাথ এবং আশ্রমের আরও কতিপয় বিশিষ্ট কর্মী। বিষণ্ণ বদনে যাত্রা
করলেন শ্রীশ্রীঠাকুর—অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে তাঁর প্রিয়জনদের ছেড়ে
যেতে—ছেড়ে যেতে জনক-জননীর পবিত্র স্মৃতিতীর্থ। ব্যথাতুর চিত্তে সজল
নেত্রে নির্ব্বাক নিস্তব্ধ হয়ে পাষাণ মূর্ত্তির মত দাঁড়িয়ে থাকল
আশ্রমবাসী নরনারী—আবাল-বৃদ্ধ-শিশু-যুবা ঠাকুরের এই ঐতিহাসিক যাত্রাপথের
দিকে তাকিয়ে। সূচনা হল পুরুষোত্তমের নবতর দ্বারকা-লীলার।” (তথ্যসূত্রঃ
শ্রীমৎ আচার্য্য সতীশচন্দ্র গোস্বামী ও সৎসঙ্গ আন্দোলন, পৃঃ ১৪৩)
      “এর আগেও কয়েকবার শ্রীশ্রীঠাকুরের বায়ু-পরিবর্তনের জন্য বাইরে যাওয়ার কথা
হয়েছিল । কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবারেও শেষ
পর্যন্ত তাঁর যাওয়া হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় ছিল। কিন্তু ১লা সেপ্টেম্বর
সকালে মাতৃমন্দিরের সামনে গিয়ে দেখি শ্রীশ্রীঠাকুর যাওয়ার জন্য প্রস্তুত
হচ্ছেন। তাঁকে ঈশ্বরদী ষ্টেশনে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ী প্রস্তুত। বেলা
দশটা নাগাদ তিনি রওনা হবেন। শ্রীশ্রীঠাকুর গাড়ীতে ওঠার আগে তাঁর পিতা ও
মাতার প্রতিকৃতির সামনে প্রণাম নিবেদন করলেন। তারপর আশ্রম প্রাঙ্গণে
মন্দিরে গিয়ে হুজুর মহারাজ এবং সরকার সাহেবের প্রতিকৃতির সামনে প্রণাম
নিবেদন করলেন। …..তাঁর চোখে জল। চোখের জল ফেলতে ফেলতে ফেলতে তিনি মোটরে
উঠলেন। ….চোখের জল ফেলতে ফেলতে তিনি জন্মভূমি থেকে শেষ যাত্রা
করেছিলেন।” (তথ্যসূত্রঃ কুমারকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য প্রণীত মহামানবের সাগরতীরে/১ম/৩-৪)
        “২রা সেপ্টেম্বর বেলা ১০টা নাগাদ শ্রীশ্রীঠাকুর বৈদ্যনাথধাম স্টেশনে
পৌঁছলেন। সঙ্গে পরিবার-পরিজন, পার্ষদগণ এবং সেবকগণ। তাঁর বাসের জন্য
প্রথমে ‘বড়াল-বাংলো’ বাড়ীটি ভাড়া নেওয়া হয়। পরে ‘ওয়েস্ট এণ্ড হাউস’
(মনোমোহিনী ধাম), গোলাপবাগ, রঙ্গনভিলা , অশোক-আশ্রম, হিলস ওয়ে ,
শশধর-স্মৃতি (শিবতীর্থ), দাস-ভিলা, প্রসন্ন-প্রসাদ প্রভৃতি বাড়ী ভাড়া করা
হয়। রঙ্গনভিলায় শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যমভ্রাতা পূজনীয় প্রভাসচন্দ্র
চক্রবর্তী (ক্ষেপুকাকা) হিলস্ ওয়েতে শ্রীশ্রীঠাকুরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা
পূজনীয় শ্রীকুমুদরঞ্জন চক্রবর্তী (বাদলকাকা) এবং গোলাপবাগে পূজ্যপাদ বড়দা
সপরিবারে বাস করতে থাকেন।” (মহামানবের সাগরতীরে, ১ম পৃঃ ৪)


        শ্রীশ্রীঠাকুরের দেওঘর আগমনের সংবাদ জানতে পেরে, নিরাপত্তার কারণে,
পূর্ববঙ্গের অনেক সৎসঙ্গী পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে ঠাকুরের শরণাপন্ন হন।
ওদিকে, ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির থাবায় ১৯৪৭ এর ১৫ আগষ্ট
দ্বিজাতি-তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে দেশবিভাগের ফলে আরো ছিন্নমূল সৎসঙ্গী
পরিবারের দল দেওঘরে চলে আসেন। দেওঘরে ঠাকুর নবাগত। নিজেই পরিবার পরিজনদের
নিয়ে প্রভূত কষ্ট স্বীকার করে ভাড়া বাড়ীতে থাকেন। নিদারুণ অর্থকষ্টের
মধ্যেও প্রশাসন বা সমাজসেবী সংস্থাদের কাছ থেকে সাহায্য না নিয়ে, কাউকে
বিব্রত না করে, আত্মত্যাগী ইষ্টভ্রাতাদের সাহায্যে দুর্গতদের আশ্রয়দান ও
ভরণপোষণ করেছিলেন।


।। দেশভাগ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের আক্ষেপ ।।
      ‘‘চেষ্টা করেছিলাম প্রাণপণ যাতে হিমাইতপুর না ছাড়তে হয়, কিন্তু অত্যাচারিত হলাম ভীষণ, পারলাম না কিছুতেই। বাড়ী আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল, মানুষ খুন করে ফেল্ল। ওখানকার সব লোকের বিরুদ্ধতার জন্য পারলাম না। সকলের ভাল করতে গিয়ে আমি একেবারে জাহান্নামে গেলাম।’’
      ‘‘আমরা হিন্দুরাই  পাকিস্তানের স্রষ্টা। আমরা আরো চেষ্টা করেছি, যাতে আমরা সকলে মুসলমান হয়ে যাই। আমরা মুসলমান মেয়ে বিয়ে করতে পারি না। কিন্তু মুসলমানরা হিন্দুর মেয়ে বিয়ে করতে পারে। আমরা materialise   করেছি তাই যাতে পাকিস্তান হয়, আর materialise করি নাই তা যাতে  পাকিস্তান না হয়।….. কিন্তু আগে যদি হায়দ্রাবাদের দিক থেকে বাংলায় হিন্দুদের নিয়ে আসা যেতো, তবে পাকিস্তান হতো না। কিন্তু তা তো হলো না। পাকিস্তান হওয়ায়
হিন্দু মুসলমান উভয়েরই কী ভীষণ ক্ষতিই না হল। …….. ’’ (ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত জীবনীগ্রন্থ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৯৪)

                                        *      *      *
।। খণ্ডিত ভারতবর্ষ ও তাঁর জনগণের শাসনতন্ত্রের অবস্থান  ।।
       দ্বিজাতিতত্ত্বের  ভিত্তিতে খণ্ডিত গণপ্রজাতন্ত্রী আধুনিক ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ধর্মকে রক্ষা করে চলার কর্তব্যকে। আমাদের রাষ্ট্রীয় মন্ত্র ‘সত্যমেব জয়তে’ স্মরণ করিয়ে দেয় উপনিষদীয় আচার্য্য অনুসরণের শাশ্বত অবলম্বনকে। রাষ্ট্রের কর্ণধার রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রীবর্গ প্রত্যেকেই ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করে ঈশ্বরের প্রতিভূ জীবগণের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হয়। ঈশ্বরের প্রতিনিধি স্বরূপ জাগতিক ন্যায়দণ্ডধারী বিচারকেরা ধর্মাধিকরণ নামে চিহ্নিত। বিচারালয়কে বলা হয় ধর্মস্থান।—কেন?

        ভারতীয় অনুশাসনের সাম, দান, ন্যায়, দণ্ড, নীতি ও ভেদ-এর রাজধর্ম রক্ষার পবিত্র কর্তব্যে যাতে এতটুকু অন্যায়, অধর্ম প্রবেশ করতে না পারে তার জন্যই ওইসব মহাভারতীয় নীতির অনুসরণ। বিধিবৎ প্রকৃষ্ট-জাতক সৃষ্টি করে  ধর্ম পালনের স্বার্থেই ওই অনুশাসনকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। রাজনীতির জন-প্রতিনিধিরা পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যার জীবনবৃদ্ধির নীতিসমূহ পালন যাতে হয় সেটা দেখবে। অসৎ নিরোধী তৎপরতার সাথে  রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হবে।  তথাপি যখন ভারতীয় শাসন সংহিতা বা সংবিধান ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সম্প্রদায় নিরপেক্ষ ধর্মপ্রাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ না করে, ধর্ম এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়কে এক করে ফেলে ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদ’,––অর্থাৎ রাষ্ট্র ধর্মের অনুবর্তী নয়’-এর মতবাদকে প্রতিষ্ঠা দেয়, তখন কি মনে হয় না, আমরা জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েও এক পরস্পর বিরোধী আচরণ করে চলেছি !

        যে নীতি-বিধি পদার্থের অস্তিত্ব রক্ষার সহায়ক তাই তো ধর্ম। পদার্থের স্বকীয়তা ধারণ করে রাখার সহায়ক যা’ তাই ধর্ম। ধর্ম পালন করলেই পদার্থ টিঁকে থাকবে, নচেৎ থাকবে না। সংসদ প্রকাশিত ইংরেজী অভিধানে ধর্মের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘It is an action, one is bound to do.’ সেই ধর্মের আবার পক্ষ আর নিরপেক্ষ কি? বেঁচে থাকার অজৈব উপকরণ বায়ু, জল, মাটি ইত্যাদির যদি ধর্ম থাকতে পারে, এবং তা’ যদি বিজ্ঞানের বইতে পাঠ্য হতে পারে, তাহলে মানুষের কি ধর্ম নেই? মনুষ্যত্ব প্রকাশের মাধ্যমেই তো মানুষ ধার্মিকতার পরিচয় দেয়। মানুষের মনুষ্যত্বের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার নীতিবিধি-সমন্বিত ভারতের নিজস্ব সংহিতাগুলোর বিধানসমূহ ভারতীয় শাসনতন্ত্রের সংহিতায় স্থান পাবে না কেন, প্রজাদের শিক্ষা দিতে পাঠ্য করা হবে না কেন?

        বর্তমান যুগ-পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কথিত ধর্মের যুগান্তকারী সংজ্ঞা ‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে/ধর্ম বলে জানিস তাকে। ধর্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে/সম্প্রদায়টা ধর্ম না-রে।’ ওই সম্প্রদায় নিরপেক্ষ সমন্বয় বার্তাবহ বাণীকে গুরুত্ব না দিয়ে ধর্মের নামে, ভারতীয় সংহিতার নীতি বহির্ভূত ডিজে বাজানো, বাজী ফাটানো, মদ্যপান প্রভৃতি প্রবৃত্তি পরায়ণতার আস্ফালনকে, কতগুলো অনিত্য, অসার পৌত্তলিকতার কু-সংস্কারকে যদি ‘ধর্ম’ নামে প্রতিষ্ঠা দিতে চাই, তা’ কি বিচক্ষণতার পরিচায়ক হবে, না ভারতবর্ষের কৃষ্টির পরিপূরক হবে? ওই ভুলের বোঝা কি আমাদের চিরদিন বইতে হবে? আমাদের বুদ্ধি, বোধ কি নিরেটই থেকে যাবে?

       রাষ্ট্রের সৃষ্টিই তো প্রজাদের অধর্ম বা দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে ধার্মিক, অর্থাৎ সু-নীতি পরায়ণ করে তোলার জন্য। সেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলো যদি ওই মহান কর্তব্য ভুলে তার প্রজাবর্গকে, তাদের পিতৃ-পিতামহের আদর্শ অনুসারী ধর্ম-পরায়ণ, কৃষ্টি-পরায়ণ হতে উৎসাহ না দিয়ে, প্রবৃত্তি-পরায়ণতায় উৎসাহ দেয়, সেটা ভারতবর্ষের জাতীয় উত্তরাধিকারত্বের অস্তিত্বকে বিপন্ন করার বার্তা ভিন্ন আর কিছু নয়।

‘‘প্রজা মানেই হচ্ছে—
প্রকৃষ্টরূপে জাত—
সর্ব্বসম্ভাব্য উদ্বর্দ্ধনী সার্থকতায় ;
আর প্রকৃষ্ট জন্ম পেতে হলেই চাই—
প্রজনন পরিশুদ্ধি—
সর্ব্ব-সম্ভাব্যতার বৈধানিক সংস্থিতিতে. …. ’’
(‘সম্বিতী’ গ্রন্থ থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বাণী)

      প্রজা কথাটি আসিয়াছে প্র-পূর্ব্বক জন্-ধাতু হইতে । প্র মানে perfectly, আর জন্ ধাতু মানে to grow. তাই বলা হইয়াছে “প্রজা কথায় আছে–to grow perfectly instinct with life.” (Nana-Prasange, 2nd part, page 50)

       যে জনগণ বা প্রজারা মানুষের সেবা করার অধিকার পেতে ভোটে জেতার জন্য বুথ দখল করে, ছাপ্পা ভোট দেয়, ব্যালট চুরি  করে, ব্যালটবক্স চুরি করে, ভোটারদের হুমকি দেয়, প্রার্থীকে মারধোর করে, আশ্রয়হীন করে, বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, হত্যা পর্যন্ত করতে কুণ্ঠিত হয় না!—তারা কি ধরণের প্রজা ? তারা জন-প্রতিনিধি হয়ে জনগণের কি ধরণের সেবা করবে ?

    প্রকৃষ্ট জাতক বা  প্রজার জন্মদাত্রী হচ্ছে নারী। সেই নারী যদি ভারতীয় আর্য্যকৃষ্টিতে পূজ্যা মাকালী, মাদুর্গা, দেবী লক্ষ্মী, দেবী সরস্বতীর ন্যায় শুদ্ধ, বুদ্ধ, পবিত্রতায় সমৃদ্ধ না হয়ে প্রবৃত্তি-প্ররোচিত চলনে অভ্যস্ত হয়, তাহলে প্রকৃষ্ট জাতক বা প্রজা সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব হবে? রাষ্ট্র-নেতাদের এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত  করার কি প্রয়োজন নেই? তারা যদি নজর দিতেন টিভি, সিনেমা, ইণ্টারনেটের  মাধ্যমে দর্শকাম, শ্রুতকাম বারতা  প্রচারিত হয়ে অবৈধ স্পর্শকামে  পরিণতি লাভ করতে পারত না। প্রজা সৃষ্টির মূল আধান দূষিত  হতে পারত না।  

      রাষ্ট্র-নেতারা প্রবৃত্তি-পোষণী নারী-স্বাধীনতার নামে ওই মুখ্য  বিষয়ে  গুরুত্ব না দিলেও যুগ-পুরুষোত্তমের দিব্যদৃষ্টি থেকে এই মূল বিষয়টাও কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারে নি।

       এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর সুস্পষ্ট মতবাদ প্রকাশ করে গেছেন।

“দেশের অবনতির

প্রথম পদক্ষেপই হ’চ্ছে—

মেয়েদের উচ্ছৃঙ্খলতা,

পারিবারিক সঙ্গতির প্রতি

বিদ্রূপাত্মক অবহেলা,—

যা’ দেশের শুভদৃষ্টিটাও

ভেঙ্গেচুরে চুরমার করে

সর্ব্বনাশকে আমন্ত্রণ ক’রে থাকে;

তাই বলি,

মেয়েরা যেন

তাদের পবিত্রতা হ’তে

এতটুকুও স্খলিত না হয়,

ব্যবস্থা ও বিধানগুলি

এমনতরই বিনায়িত করে

তাদের ভিতর সঞ্চারিত করে তোল;

তুমি যদি দেশের স্বস্তিকামীই হও—

এদিক থেকে

তোমার দৃষ্টি ও কৃতিচর্য্যার

একটুও অবহেলা যেন না থাকে,

স্বস্তিই হ’চ্ছে

শান্তির শুভ আশীর্ব্বাদ,

আর, স্বস্তি মানেই হ’চ্ছে

সু-অস্তি—

ভাল থাকা।”

(বিধান-বিনায়ক, বাণী সংখ্যা ৩৭৩)   

 *      *      *

             
       মূণ্ডক উপনিষদের পবিত্র মন্ত্র ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শকে সম্বল করে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট গণ প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের যাত্রা সুরু হলেও ‘‘Of the people, by the people, for the people—জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।’’-এর লক্ষ্যে রচিত কতগুলো বিধিবদ্ধ নিয়ম, শাসন সংহিতা বা সংবিধান ১৯৪৯ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী স্বীকৃতি লাভ করে, যে দিনটাকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। প্রজা শব্দের অর্থ প্রকৃষ্ট জাতক। আর তন্ত্র মানে কতগুলো বিধিবদ্ধ নিয়ম বা system।

        প্রজাতন্ত্রের মর্মার্থ হচ্ছে, যে তন্ত্র বা system মেনে আদর্শ প্রজা নির্মাণ, পালন, পোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষায় প্রযত্নশীল থেকে পরম রাষ্ট্রিক সমবায়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা যায়। ভারতের ব্রহ্মসূত্র, মহাকাব্য, বেদ, উপনিষদ, সংহিতা, আদর্শপুরুষ শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ বলে যা কিছু বর্তমান,—সবকিছুই ওই ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।

       সত্য মানে অস্তিত্ব। যার অস্তিত্ব আছে যার বিকাশ আছে তাই সত্য (real)। ঋষি প্রদর্শিত এই সত্যের পথই আর্য্য ভারতবর্ষের মূলধন। আমাদের আদর্শ ছিল– ‘আত্মানং বিদ্ধি’, নিজেকে জানো, know thyself, ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু, মাতৃবৎ পরদারেষু, লোষ্ট্রবৎ পরদ্রব্যেষু।’ সকলকে নিজসত্তার প্রতীক মনে কর, মেয়েদের নিজের মায়ের প্রতিরূপ ভেবে শ্রদ্ধা কর, অন্যের জিনিসকে মাটির ঢেলার মত দ্যাখ। ‘মা গৃধ’, লোভ কর না। তথাপি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রজাগণ, নেতা-মন্ত্রী-জনপ্রতিনিধিগণ কেন সত্যভ্রষ্ট হচ্ছে, ভেবে দেখার প্রয়োজন নেই? নির্বাচনের নামে  প্রহসন, উপ-নির্বাচনের  নামে অযথা অর্থের অপব্যয়  কি চলতেই থাকবে? প্রজাতন্ত্রের আঁতুড়ঘরটাই যদি  অসত্যের সংক্রমণে সংক্রামিত হয়ে পড়ে তাহলে প্রজারা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে কোন্ প্রতিষেধকে?—সত্যের পূজারীদের ভেবে দেখার কি কোন প্রয়োজন  নেই? এই বিষয়টাকেও উপেক্ষা করেন নি শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। তিনি বিধান-বিনায়ক গ্রন্থের বাণীতে বলছেন—

“যখনই দেখবে—

শাসকমণ্ডলী ও প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তিরা

সৎ-এর পীড়নে

দুষ্কৃতকারীদের সাহায্য করতে ব্যগ্র,

এবং তাদের উদ্ধত ক’রে তুলবার

সরঞ্জাম সরবরাহে ব্যাপৃত—

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে,—

বুঝে নিও—

সেই দেশ

সেই জনপদ

সেই সাম্রাজ্য

অধঃপাতের দিকে ক্ষিপ্র চলৎশীল; … (সংক্ষিপ্ত)”

              *      *      *

       ব্রহ্মসূত্র থেকে জাত ভারতের নিজস্ব সংবিধান কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে।


‘‘সুখস্য মূলম্ ধর্মম্,
ধর্মস্য মূলম্ রাষ্ট্রম্,
রাষ্ট্রস্য মূলম্ অর্থম্,
অর্থস্য মূলম্ ইন্দ্রিয়-বিজয়ম্,
ইন্দ্রিয়-বিজয়স্য মূলম্ জ্ঞানবৃদ্ধসেবয়া,
জ্ঞানবৃদ্ধসেবয়া বিজ্ঞানম্।।”


      অর্থাৎ সুখী হতে হলে ধর্ম পালন করতে হবে। প্রকৃত ধার্মিক হতে হলে পুরুষার্থের চতুর্বর্গ সমন্বিত আশ্রমধর্ম (বর্ণাশ্রম এবং চতুরাশ্রম) পালন করতে হবে। সঠিকভাবে আশ্রমধর্ম পালন করার স্বার্থে রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। ইন্দ্রিয় বিজয়ী প্রজাদের দিয়ে রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। ইন্দ্রিয় বিজয়ী হবার জন্য গুরু গ্রহণ করতে হবে। গুরুর আদেশ-নিদেশ পালন করলে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করা যাবে। তবেই জীবনে সুখী হওয়া যাবে। এই হলো ভারতবর্ষের সনাতনী ধর্মের মূল কথা। ভারতীয় আর্য্যকৃষ্টি অনুসারে, ‘‘যেনাত্মন্ স্তথান্যেষাং জীবনংবর্দ্ধাঞ্চপি ধ্রীয়তে য স ধর্ম্মঃ।’’ অর্থাৎ, অন্যের বাঁচা এবং বৃদ্ধি পাওয়াকে অক্ষুন্ন রেখে, মানুষ বাঁচার জন্য, বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য যা’ যা’ করে, তাই ধর্ম। ধর্ম শব্দের অর্থ ধারণ করা। ধর্ম আচরণের মাধ্যমে পালন করার জিনিস, অনুভব করার জিনিস, যা’তে প্রতিটি সত্তা তার অস্তিত্বকে ধারণ এবং পালন করতে পারে, তার অনুশীলন করা। অথচ বাস্তব চিত্রটার সাথে মেলানো যাচ্ছে না ধর্মকে। বর্তমানে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মের নামে চলছে বাহ্যপূজা, পৌত্তলিকতার প্রকাশ, হৈ-চৈ, প্রকাশ্যে প্রাণীহত্যা, পরিবেশ-দূষণ, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। রাস্তা আটক করে, চাঁদার জুলুম করে, জনজীবন বিপর্যস্ত করে, তারস্বরে মাইক বাজিয়ে, বাজি ফাটিয়ে, অবধ্য, নিরীহ প্রাণীদের হত্যা করে ধর্ম উদযাপন করার বিধি কোন মহাপুরুষ, কোন সাধক, কোন নবী, কোন ঋষি, প্রবর্তন করেছেন কি? যদি না করে থাকেন, তাহলে রাষ্ট্রের কর্তব্য সব সম্প্রদায়কে প্রকৃত ধর্ম পালনে উৎসাহিত করা। ধর্মের নামে বিধি-বহির্ভূত অসদাচারের অনুষ্ঠানের উদযাপনকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা।
        ওইসব বিধি, নিয়ম বা সংবিধান পালন করে প্রকৃষ্ট জাতক বা প্রজা সৃষ্টির প্রবহমানতাকে রক্ষা করে চলাই ছিল আর্য্য ভারতের আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্য।
                                 *           *        *

।। প্রাচীন আর্য্য-ভারতের শাসন-সংস্থা  প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতবাদ ।।

      শ্রীশ্রীঠাকুর—আর্য্যদের যে কী জিনিস ছিলো তা’ কল্পনায়ই আনা যায় না। Cabinet formed (মন্ত্রীপরিষদ গঠন) হ’ত বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যদের প্রধানদের নিয়ে। প্রধানের প্রধান, তাদের প্রধান, এইরকমভাবে একটা সুন্দর gradation (পর্য্যায়) ছিলো। যারা যত বেশীকে পূরণ করতো তারা তত বড় প্রধান। প্রধানমন্ত্রী সর্ব্বদা ঠিক হ’য়েই থাকতো, উপযুক্ত লোক নির্ব্বাচন নিয়ে কোন গণ্ডগোল উপস্থিত হ’তো না। অন্যদেশ ভারতবর্ষকে আক্রমণ করার সাহসই পেতো না। সব জাতটা দারুণ compact (সংহত) থাকতো। অনুলোম বিয়ে থাকার দরুন সারা জাতটা যেন দানা বেঁধে থাকতো, আর এতে evolution–এর (ক্রমোন্নতির) সুবিধা হ’তো—যথাক্রমে পাঁচ, সাত ও চৌদ্দপুরুষ ধরে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের ভিতর যদি Brahmanic instinct (ব্রহ্মণ্য-সংস্কার) দেখা যেতো—তাদের বিপ্র ক’রে দেওয়া হ’তো। উন্নতির পথ সব দিক থেকে খোলা ছিল। আগের কালে টাকা দিয়ে একজনের সামাজিক position (অবস্থান) ঠিক করা হ’তো না। কারও হয়তো ৫০ লাখ টাকা আছে, কিন্তু কেউ হয়তো পাঁচ টাকায় সংসার চালাচ্ছে—অথচ instinct (সহজাত-সংস্কার) বড়—সেই বড় ব’লে গণ্য হ’তো। Instinct, habit, behaviour, activity (সংস্কার, অভ্যাস, ব্যবহার ও কর্ম)—এইগুলিই ছিল মাপকাঠি। Learning (লেখাপড়া)-কে কখনও শিক্ষা বলা হ’তো না। চরিত্রগত না হ’লে তথাকথিত পাণ্ডিত্যের কোন মূল্য দেওয়া হ’তো না। সব সময় লক্ষ্য ছিল—জ্ঞান, গুণ যাতে জন্মগত সংস্কার ও সম্পদে পরিণত হয়। বর্ণাশ্রমধর্ম্ম এত সূক্ষ্ম, উন্নত ও বৈজ্ঞানিক ব্যাপার যে অনেকে এর অন্তর্নিহিত তথ্য বুঝতে না পেরে একে বৈষম্যমূলক বলে মনে করে—এর চেয়ে বড় ভুল আার নেই। যারা বিজ্ঞানসম্মত বর্ণাশ্রমধর্ম্মকে বিপর্য্যস্ত করবার উদ্দেশ্যে generous pose (উদারতার ভঙ্গী) নিয়ে inferior (অসমর্থ)-দের ক্ষেপিয়ে তোলে, তারা সমাজের মহাশত্রু। শ্রীরামচন্দ্র শম্বুকের প্রতি কঠোর হয়েছিলেন—কারণ, শম্বুকের movement (আন্দোলন)-টা বর্ণাশ্রম-ধর্ম্মের বিরুদ্ধে একটা passionate raid (প্রবৃত্তি-প্ররোচিত অভিযান) বই আর-কিছু নয়। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড, ৩২শে জৈষ্ঠ্য, বৃহস্পতিবার, ১৩৪৬, ইং ১৫।৬।১৯৩৯) 

***
        গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন ভারতবর্ষ ১৯৪৯ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী ‘সত্যমেব জয়তে’র আদর্শকে মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, যাকে আমরা আজও রাষ্ট্রের পবিত্র মন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছি। তথাপি ওইসব বিধিকে আড়াল করে  প্রবৃত্তি-পরিপোষিত শিক্ষায় প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের প্রজাদের শিক্ষিত করতে চাইছি। ফলে সন্ত্রাসবাদ, ভ্রষ্টাচার, যৌন-ব্যভিচার ক্রমবর্দ্ধমান। এর কারণ ‘সত্যমেব জয়তে’ কে বাস্তবে মূর্ত করে তোলার মত কোন ইন্দ্রিয়জয়ী সৎপুরুষের জীবন্ত আদর্শ অনুসরণ করছে না রাষ্ট্র। ফলে দেশে মহানগরের বাড়বাড়ন্ত হলেও মনুষ্যত্বের পরিচয় সম্পন্ন ‘পিতামাতার সুজননের সুসন্তান, সন্তানের সুমাতা-সুপিতা, সমাজের সুবন্ধু, রাষ্ট্রের সুনাগরিক’ এমন মহান নাগরিকের সংখ্যা ক্রমশঃ যেন অবলুপ্তির পথে।
       তাই তো বর্তমান সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানবৃদ্ধ পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সভ্যতাকে সংকট থেকে মুক্ত করতে নিদান দিলেন :
“শাসন-সংস্থা যেমনই হোক,
যাতেই মাথা ঘামাও না,
যৌন-ব্যাপার শুদ্ধ না হলে
দেশের জীবন টিঁকবে না।”

        শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রদত্ত উক্ত সাবধান বাণীটি আমাকে খুবই পীড়া দেয়। এ বিষয়ে আপনাদেরও একটু ভেবে দেখতে হবে, যদি সুস্থভাবে বাঁচতে চান।

        বর্তমান সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা পেটের অসুখ থেকে বাঁচতে অরক্ষিত জলপান করে না, সুরক্ষিত, পরিশ্রুত, বোতল বন্দী শুদ্ধ জল পান করে। কাটা ফল খায় না। অরক্ষিত কোর্মা, কোপ্তা, পোলাও, বিরিয়ানীর মতো যুগধর্ম স্বীকৃত দামী দামী খাবার ছেড়ে সুরক্ষিত ডাল-ভাতেই সন্তুষ্ট থাকে। উল্টোপাল্টা খেয়ে শরীর খারাপ করার রিস্ক নিতে চায় না। একটা সার্বজনীন মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে যে, অরক্ষিত নয়, সুরক্ষিত জিনিষ দিয়েই জৈবিক তাগিদ পূরণ করতে হবে নিজের সত্তাকে দূষণ মুক্ত রাখতে। তাইতো বর্তমানে কারো ছোঁয়া স্পর্শদোষ বিকীরিত, ব্লেড, সিরিঞ্জ, তোয়ালে, রুমাল, গামছা ইত্যাদি ব্যবহার করে না। স্বাস্থ্যসম্মত বিধি মেনে চলে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়, সেই সমাজেরা ছেলেরা যদি রক্ষণশীলতার মর্যাদা না দেয়। খোলামেলা স্পর্শ-দোষে দুষ্ট নারী সংসর্গ প্রয়াসী হয় তার কপালে জোটে অশেষ দুঃখ। এইডস্ সহ নানাবিধ যৌনরোগ, মনোবিকারের শিকার হতে হয়। আর অনিয়ন্ত্রিত চলনের অভ্যাসের জন্য ধর্ষণে অভিযুক্ত হলে তো কথাই নেই!

অপরপক্ষে, সেই সমাজের মেয়েরা যদি কাম নামক জৈবিক তাগিদ প্রবৃত্তির তাড়নার কাছে নতিস্বীকার করে বসনে-ভুষণে, আচার-আচরণে পণ্যরূপে যৌবনকে প্রজ্ঞাপিত করে নিজেদের অরক্ষিত করে, কামুক পুরুষদের কাম-বিকীরণে সত্তাকে দুষ্ট করে, এবং একাধিক পুরুষদের প্রোফাইল স্মৃতির ফোল্ডারে জমা করে,—তার দুর্গতির আর শেষ নেই। মা হওয়ার সময় স্বামীকেন্দ্রিক হতে পারবে না। কারণ, মা হতে গেলে একটা পুরুষই লাগে, একাধিক নয়। অথচ নিজেকে অরক্ষিত রাখার কারণে পাড়ার, রাস্তার, কলেজের, আপিসের একাধিক পছন্দের পুরুষ স্মৃতিতে ভীড় জমাবে এবং সেই সম্মিলিত মানসিকতার psycho-somatic disordered সন্তান জন্ম নেবে! এ বিষয়ে সতর্ক না হলে দুর্গতির আর ইতি হবে না কোনদিন!

       আর্য্যকৃষ্টির  ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের প্রবহমানতা টিঁকিয়ে রাখতে হলে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে আদর্শ প্রজা সৃষ্টির মাধ্যম, সুবিবাহ ও সুপ্রজননের ওপর। বর্তমান রাষ্ট্রীয়  ব্যবস্থায় যে বিষয়টি উপেক্ষিত।       

      তাই প্রকৃত অর্থে প্রজাতন্ত্রকে  বাস্তবায়িত করতে হলে শ্রীশ্রীঠাকুর কথিত আর্য্যকৃষ্টির আদর্শকে মুখ্য করে  আর্য্য মহাসভা নামে এক পরমরাষ্ট্রিক সমবায় সমিতি গঠন   করার প্রয়োজন আছে ‘মেরা ভারত মহান’, ‘India is great.’ অভিধায় ভূষিত  জাতীয়তাবাদকে টিঁকিয়ে রাখার  স্বার্থে।    

                                          *      *      *

।। গুরুকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী চলনে কিভাবে চলতে হবে ।।

       কেষ্টদা (ঋত্বিগাচার্য্য)— ম্যাগডুগাল বলেছেন, কৃষ্টিগত আদর্শ, আচার, অনুষ্ঠান, শ্রদ্ধা, আভিজাত্যবোধ ইত্যাদি যদি না থাকে, তবে জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। 

        শ্রীশ্রীঠাকুর—যদি এখনও সাবধান না হই , ফিরে না দাঁড়াই, আমাদেরও হয়তো তাই হবে। যখন মানুষের দেওয়ার থাকে না, শুধু নেয়, তখন সে captive(বন্দী) হ’য়ে পড়ে। আগে পুরুষোত্তমকে কেন্দ্র করে সবকিছু পরিচালনা করার রীতি ছিল। তাই বলত ‘সর্ববদেবময়ো গুরুঃ’। তিনিই প্রভু তিনিই সর্বোত্তম পরিপুরক তাঁকে বাদ দিলে নানা-বাদ প্রধান হয়। মানুষ সুকেন্দ্রিক হ’তে পারে না। ছন্নতা এসে পড়ে। নানা জিনিস ঠেসে ধরে। বুদ্ধদেব যখন এসেছিলেন তখন সাহিত্য, শিল্প, সমাজ, — সব জাগলো সব দিক দিয়ে। শ্রীকৃষ্ণ যখন এসেছিলেন তখনও তাই হ’য়েছিল। তিনিই ছিলেন সব যা-কিছুর প্রাণ-প্রেরণা । ঐ প্রেরণা সব যা-কিছুতে স্ফুরিত ক’রে তুলেছিল তার বৈশিষ্ট্য-অনুযায়ী। আমরা যদি পুরুষোত্তমকে না চাই, তাহ’লে নানা জিনিসের উপাসনা ক’রে পরমপদ লাভ করতে পারি না। আমাদের চলতে হবে পুরুষোত্তমকে কেন্দ্র ক’রে। 

(আলোচনা-প্রসঙ্গে ১৯ই অগ্রহায়ণ ১৩৬০)

পুরুষোত্তমকে কেন্দ্র করে জাতি গঠন করতে হলে প্রচলিত রাজনীতিতে সংশোধন আনা প্রয়োজন সর্বাগ্রে, জাতীয়তাবাদের স্বার্থে।   শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র রাজনীতির সংজ্ঞায় বলেছেন— “রাজনীতি বলে তায়/পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যায়/সংহতি আনে যায়।” যে নীতি সকলের অভাব পূরণ করে, সবাইকে অভীষ্ট মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় পোষণ দিয়ে সব্বাইকে প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ করে সংহতির  প্রতিষ্ঠা করতে  সমর্থ, সেই নীতির নাম রাজনীতি। তাহলে রাজনীতির সেবকদের সংজ্ঞা-নির্দিষ্ট গুণের অধিকারী  হতে হবে। সকলের অভাব পূরণ যিনি বা যারা করবেন তাদের বৈশিষ্ট্যপালী হতে হবে। বৈশিষ্ট্য মানে বিশিষ্টতা। যুক্তি অনুযায়ী ওই বিশিষ্টতার পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা সংহতির প্রতিষ্ঠা যিনি করতে পারবেন তিনি হতে পারবেন রাজনীতিবিদ। বর্তমান দলীয় রাজনীতিতে যা এক বিরল চরিত্র।   অপরাধ দমনের স্বার্থে টেণ্ডার দিয়ে ভালো জাতের  বিশ্বাসী কুকুর আমদানি করা সম্ভব হলেও সৎ-এর পূজারী বিশ্বাসী  ভালো মানুষ আমদানি করা সম্ভব কি? ভালো জাতের কুকুরের মতো, ভালো জাতের মানুষকেও বিধিমাফিক জন্মাতে হয়।   

                                       *      *     *

      একজন গোপালক বা রাখাল বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের গোরু—ষাড়, বলদ, গাভী, দামড়া, বকনা নামের গোরুর পাল নিয়ে মাঠে চড়াতে যায়। একটা ছোট লাঠি বা পাচনের সাহায্যে সে গোরুর পালকে পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা সংহত রেখে আবার  গোধূলি বেলায় গোয়ালে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তেমনি একজন চাষী তার বিভিন্ন জমির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য  মেনে ভূমিকে কর্ষণ করেন বা চাষ দেন। জমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ‘জো’ বুঝে বীজ বপন  করেন, চারা রোপন করেন। তারপর উপযুক্ত জলসেচ, সার, কীটনাশক, পাহারা দিয়ে পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা ফসল উৎপাদন  করেন। সমাজবদ্ধ মানুষের জন্য কি ওই শাশ্বত নীতি প্রযোজ্য নয়?
                                               *      *     *


     শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতে, বৈশিষ্ট্য মানে—তদনুপাতিক organic adjustment (বৈধানিক বিন্যাস)। তার আবার (group) গুচ্ছ আছে। এইগুলিকে বলা হয় বর্ণ, এর কোনটাই আমরা নষ্ট করতে চাই না। নষ্ট করা মানে যুগ যুগ ধরে, তিল তিল করে, যা গড়ে উঠেছে তা হারান। ন্যাংড়া আম আছে, ফজলি আম আছে আরো কত রকমের আম আছে। এর একটা জাত যদি নষ্ট করে ফেলি তাহলে তা’ আর ফিরে পাব না—হারাব চিরতরে। সেকি ভালো? ফজলি আমের মধ্যে তো আর ন্যাংড়া আমের স্বাদ পাব না। তাই যেন আমরা বুঝে চলি। 

 (আলোচনা প্রসঙ্গে, ১৬শ খণ্ড, পৃঃ ১০৯)

      আমাদের ভারতের গ্রামীন অর্থনীতি কৃষি  ও গোপালনের উপর নির্ভরশীল। ভালো কৃষকেরা কখনোই  যেমন খুশি তেমনভাবে, নিজের খেয়ালখুশি মত চাষ করেন না। সরকারী  কৃষি বিভাগের পরামর্শ মেনে জমি অনুযায়ী উন্নত জাতের বীজ বপন করেন, চারা রোপন করেন। গোপালন ক্ষেত্রেও  তাই। সরকারী পশু পালন বিভাগের বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মেনে গাভীর জাতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সম-বিপরীত উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ দিয়ে উন্নত জাতের সুস্থ, সবল বাচ্চা উৎপাদন করেন। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ পুলিশ,  মিলিটারী বিভাগে অপরাধী সনাক্ত  করতে জন্মগত সমৃদ্ধ ভালো জাতের কুকুরের বাচ্চা সংগ্রহ করে। ওদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যের পালন এবং পোষণ করার জন্য অনেক টাকা খরচ  করে ট্রেনার রাখে, রাস্তার কুকুরের বাচ্চাদের নিয়ে এসে ট্রেনিং দেয় না! জন্মগত যোগ্যকে যোগ্য  মর্যাদা দেয়। মানুষের মত সংরক্ষণের নামে জন্মগত অযোগ্যকে বিশেষ মর্যাদা দেয় না!
       আমরাও দৈনন্দিন জীবন-যাপনে সকলেই কিছু-না-কিছু বৈশিষ্ট্যের পালন-পোষণ  করেই থাকি। সচেতন ব্যক্তি মাত্রেই বাজার থেকে ভালো জাতের বা কোয়ালিটির আলু, বেগুন, পটল, মুলো, আম,  চাল, ডাল, চা কিনতে অভ্যস্ত।  এমন কোন  সুস্থ মানুষ নেই যে  উদারতার নামে হিমসাগর আমের দাম দিয়ে আঁশযুক্ত টোকো আঁটিসার আম কিনে  আনবেন। মিনিকীট, বাঁশকাঠি, গোবিন্দভোগ, দেরাদুন রাইসের দাম দিয়ে রেশন দোকানে প্রদত্ত মোটা চাল কিনে আনবেন।

     এ থেকে প্রমাণিত হলো গাছপালা, পশুপাখি সবকিছুর জাত, বর্ণ আছে। জীব বিজ্ঞানের পুস্তকেও জাতি, প্রজাতি, বর্ণ, গোত্র-এর উল্লেখ আছে। তাহলে মানুষের কি নেই?  অবশ্যই আছে।  মানুষ তো সব জাতহীন হয়ে যায় নি! সহজাত সংস্কারের প্রবহমানতা  টিঁকিয়ে রাখতে হলে বিবাহ ও সুপ্রজনন মাধ্যমে রাখতে হবে। সংবিধানে মানবসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এর বিজ্ঞানসম্মত মাধ্যম আর্য্য বিবাহনীতিকে গুরুত্ব না দিয়ে, সংরক্ষণ প্রথা অবৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ প্রথা জীইয়ে রাখতে জাতের নামে বজ্জাতি চলছে!—শিডিউলড, আন-শিডিউলড, ট্রাইব নিয়ে দলীয় রাজনীতি করতে গিয়ে জনগণের সহজাত-সংস্কারের বৈশিষ্ট্যটাকে নাকাল হতে  হচ্ছে ! মানুষের  সহজাত সংস্কার এবং তাদের জৈবিক তাগিদগুলো প্রবৃত্তির কবলে পড়ে মনুষ্যত্বের অপলাপ যাতে না হতে পারে, বিহিত ব্যবস্থায় রক্ষা করা বা রাখালী করা ভারতীয় রাজনীতির নির্দিষ্ট কর্ম ছিল বর্তমান পরিস্থিতিকে সামলাতে হলে বর্তমান পুরুষোত্তম প্রদত্ত সংবিধান ‘বিধান-বিনায়ক’ গ্রন্থের নিদেশ  মেনে বিধিবৎ নীতি প্রণয়ণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার প্রয়োজন আছে শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুকূলচন্দ্রের ইষ্ট, ধর্ম্ম ও সঙ্ঘ নীতির আদর্শ অনুযায়ী এই ইষ্টকর্ম করার জন্য উদ্যোগী হতে হবে ইষ্টার্ঘ্য গ্রহীতাদের।

*   *   *

     নৃতাত্ত্বিক গঠনের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী মানুষকে আল্পাইন, ব্রাকিসেফাল, মেডিটেরিয়ান, মঙ্গোলয়েড, নর্ডিক, নিগ্রোয়েড প্রভৃতি নামে শ্রেণী বিভাজন করা হয়েছে।  প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সহজাত সংস্কার গুণ ও কর্মভিত্তিক বর্ণাশ্রম বিভাজনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন আর্য্য ঋষিরা।  শাস্ত্রে গুণ এবং কর্ম দেখে বর্ণ নিরূপণ করার বিধান রয়েছে। সত্ত্ব গুণে বিপ্র। সত্ত্ব মিশ্রিত রজোগুণে ক্ষত্রিয়। রজোমিশ্রিত তমোগুণে বৈশ্য এবং তমোগুণাধিকারে শূদ্র চিহ্নিত করা হয়েছিল। এবং তদনুযায়ী কর্ম নির্ধারিত হয়েছিল। সকলেই স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান অধিকার  করে আছে।

শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন—“শূদ্রই তো জাতির চাকা/বৈশ্য জোগায় দেশের টাকা,/ক্ষত্রিয়েরা  রাজার জাত/সবার পূরণ বিপ্র ধাত।”





।। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র  প্রদত্ত বিজ্ঞানসম্মত উদাহরণ ।।
      ” …… আর্য্য জাতির uphill motion-এর (উর্ধগামী গতির) acceleration (ত্বরান্বিত করা)-ই হ’চ্ছে front-(সম্মুখে) ব্রাহ্মণ আর back-এ (পিছনে) শূদ্র। চাতুর্বর্ণ্য বিভাগ কতকটা আমাদের body system-এর (শরীর বিধানের) মতন। শূদ্র হ’চ্ছে এই whole system-এর (সমুদয় বিধানের) carrier (বাহক) এবং supporter (সহায়ক), যা’র উপর ভর দিয়ে এই সমাজদেহ চলছে। বৈশ্যদের function (কর্তব্য) হ’ল সমাজদেহকে সুস্থ রাখা by the supply of proper nutrition and food (যথোপযুক্ত পুষ্টি এবং খাদ্য সরবরাহ দ্বারা)।  বৈশ্যশক্তি এই function discharge (কর্তব্য সম্পাদন) করতে যেদিন পরাঙ্মুখ হ’ল, সেদিন এই সমাজদেহ ভেঙ্গে পড়লো। Stomach (পাকস্থলী) যদি boycott (অসহযোগ) করে, আমাদের body-system-এর (শরীর বিধানের) যে অবস্থা হয় তাই হ’ল। এই বৈশ্যশক্তি যদি আবার জাগে এবং legs, heart ও brain-কে (পা, হৃৎপিন্ড ও মস্তিষ্ককে) proper nutrition supply করে (উপযুক্ত পুষ্টি যোগায়), তবে আবার সমাজদেহ জেগে উঠবে। Body system-এর মধ্যে heart (হৃৎপিন্ড) যেমন, সমাজদেহের মধ্যে ক্ষত্রিয় তেমন। Heart-এর মধ্যে দু’রকম cells (কোষ) আছেঃ (১) white cells (সাদা কোষ) (২) Red cells (লাল কোষ)। Red cells-এর (লাল কোষের) কাজ হ’চ্ছে body-কে fit (কার্যক্ষম) রাখা এবং maintain (পরিপোষণ) করা by the proper distribution of red blood (লাল রক্ত উপযুক্ত ভাবে বিতরণ দ্বারা); এবং white cells-এর (সাদা কোষের) কাজ হ’চ্ছে body-কে protect (রক্ষা) করা। ক্ষত্রিয়ত্বের মধ্যে এই দু’টি function (কার্য) আছে; একটি সমাজদেহকে fit (কার্যক্ষম) রাখা ও maintain (প্রতিপালন) করা, আর একটি disease-এর(রোগের) হাত থেকে protect(রক্ষা) করা। কিন্তু এই দুই blood-এর supply (যোগান) নির্ভর করছে stomach-এর (পাকস্থলীর) উপর। সমাজদেহের brain (মস্তিষ্ক) হ’চ্ছেন ব্রাহ্মণ (বিপ্র), যাঁদের working (কার্যতা) নির্ভর করছে ক্ষত্রিয়শক্তি বৈশ্যশক্তি এবং শূদ্রশক্তির উপর। তাঁরা যেমন-তেমন এই তিন শক্তির নিকট support and help (সাহায্য ও সহানুভূতি) পা’চ্ছেন, তেমন-তেমন এই তিনকে regulate, control (নিয়মিত ও আয়ত্ত) করতে পারছেন। এই চারিশক্তির মধ্যে কেহই ছোট-বড় নয়। একটা harmony (সমন্বয়) ও co-ordination-এর (সমবায়ের) যোগে এদের মধ্যে একযোগে একতানে কাজ হ’চ্ছে। কিন্তু body এর মধ্যে brain-এর স্থান যেমন সর্বোচ্চ এবং সর্ব উচ্চে থাকাটা legs, stomach ও heart-এর existence-এর পক্ষে নিতান্ত দরকার, তেমন ব্রাহ্মণকে উচ্চ place দেওয়াতে, যে উচ্চতা তাঁ’র মধ্যে inherent (স্বাভাবিক) হ’য়ে আছে, অন্যান্য বর্ণ চলতে পারছে ঠিকমত তাঁরই guidance-এ (নির্দেশে)। Head-কে বড় স্বীকার করা যেমন body-র অন্যান্য অঙ্গের পক্ষে লজ্জার নয়, বরং পরম গৌরবের, তেমনি অন্যান্য বর্ণের পক্ষে ব্রাহ্মণকে বড় ব’লে মানা তাঁদের বাঁচা-বাড়ার পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। Superior (শ্রেয়)-এর উপর শ্রদ্ধা রে’খে যদি তুমি সমাজকে পুনর্গঠন করতে লেগে যাও,তবে সে সমাজ টিঁকবে-তার growth (বৃদ্ধি) হবে healthy.” (ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃঃ-৬৮-৬৯)
     

     উপরোক্ত বাণী থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, বর্ণাশ্রমের বিন্যস্ত বিভাজন আমাদের শরীর বিধানেও বিদ্যমান। আমাদের পদযুগল দেহটাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায়  তাই  শূদ্র  বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বৈশ্যরা কৃষি ও বাণিজ্য দ্বারা সকলের উদরপূর্তি করছে। সেই উদরকে  বয়ে  বেড়াচ্ছে জানু বা জঙ্ঘা। জঙ্ঘা  বৈশ্যত্বের প্রতীক। বাহুর শক্তি আমাদের দেহটাকে বিপদ-আপদ  থেকে আগলায়, ক্ষত থেকে ত্রাণ  করে, তাই ক্ষত্রিয় বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আমাদের মস্তিষ্ক বিবেক, বিচার-বুদ্ধি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমগ্র দেহটাকে পরিচালনা করে, তাই মাথাকে বিপ্র বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এইভাবে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিন্যস্ত মেলবন্ধনে দেহটাকে সুস্থভাবে পরিচালিত  করতে সাহায্য করে। ওই শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়মকে অগ্রাহ্য করে  কেহ যদি মাথার কাজ পা-কে দিয়ে, পায়ের  কাজ মাথাকে দিয়ে করাতে যায় তাহলে দেহটাই রক্ষা করা যাবে না। তেমনি বিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থা রক্ষার স্বার্থে আর্য্য  ঋষিরা প্রতিটি বর্ণের জন্য নির্দিষ্ট কর্ম ও আইডেনটিটি বা স্মারক চিহ্নের বিধান দিয়েছেন।  শ্বেত বর্ণে বিপ্র, লোহিত বর্ণে ক্ষত্রিয়, পীত বর্ণে বৈশ্য এবং নীল বর্ণে শূদ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই জীবনীয়  বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ করার করার বিধির নাম ধর্ম। ধর্মকে রক্ষা করার জন্য রাজনীতি। শ্রীমদ্ভগবতগীতা যার প্রকৃষ্ট  উদাহরণ।  বর্ণাশ্রম বিধায়িত বিন্যস্ত সমাজের ওই চারটি বর্ণের চিহ্ন শ্বেত, লোহিত, পীত ও নীল। বর্তমান পুরুষোত্তম  যাকে আর্য্যকৃষ্টির স্মারক পতাকা হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন।—সেই পতাকার অনুসরণে  পতাকা  নির্বাচন করতে হবে।

      ।। আর্য্য শব্দের  বিশেষত্ব ।।
      ‘আর্য্য’ শব্দটি গুণবাচক। যাঁরা বর্ণাশ্রম, চতুরাশ্রম পরিপূরণী দশবিধ সংস্কারে সংস্কৃত হতেন তাঁদেরই আর্য্য অভিধায় ভূষিত করা হতো । তাঁরাই ক্রমে আর্য্য জাতিভুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমান যুগধর্মে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যেমন সম্বোধনে ‘স্যর’, ‘ম্যাডাম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেসময় সদাচারী বর্ণাশ্রমানুগজীবন যাপন কারীদের উদ্দেশ্যে ‘আর্য্য’, ‘আর্য্যপুত্র’, ‘আর্য্যা’ ইত্যাদি সম্বোধনসূচক শব্দ ব্যবহৃত হতো। এই ব্যবস্থা সকলের জন্য প্রযোজ্য ছিল। যার দৃষ্টান্ত জন্ম পরিচয়হীন জাবালা-সত্যকাম-এর ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমে প্রবেশের অধিকার।  এখানে জাতপাত, ধনীগরীব, সম্প্রদায়ের কোন স্থান নেই। এ বিষয়ে বর্তমান পুরুষোত্তম এক  যুগান্তকারী বিধান দিলেন।

মঙ্গোলীয় নিগ্রো যারা
দ্রাবিড়ী কোল ম্লেচ্ছাবধি
আর্য্যীকৃত হলেই তারা
আর্য্যদেরই সুসন্ততি।

বর্ণাশ্রমী নয়কো যা’রা

আর্য্যকৃষ্টি মেনে চলে

কিম্বা আর্য্যকৃত হয়ে

বর্ণাশ্রম প্রার্থী হ’লে

গুণ বঞ্চনা-সক্রিয়তায়

বংশক্রমে ব্যক্তিগত

অনুক্রমে যথাবর্ণে

করবি তারে সুসংহত।

উপরোক্ত বাণীসমূহের মাধ্যমে  শ্রীশ্রীঠাকুর বাহ্য জাতপাতকে ভেদাভেদের গণ্ডী থেকে উদ্ধার করে বৈশিষ্ট্যানুপাতিক গুণ ও কর্মের বিভাগ মেনে বর্ণাশ্রমভুক্ত করার বিধান দিলেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর মৌখিক বিধান দিয়েই ক্ষান্ত হননি, দৈনন্দিন দিনচর্য্যায় পঞ্চবর্হিঃ ও সপ্তার্চ্চি  প্রার্থনা বিধির মাধ্যমে ব্রাত্যদোষ কাটিয়ে আর্য্য বা আর্য্যীকৃত হবার অধিকার দিলেন।   

“পঞ্চবর্হিঃ যা’রা স্বীকার করে, আর সপ্তার্চ্চি অনুসরণ করে, তারা যেই হোক আর যা’ই হোক– আর্য্য বা আর্য্যীকৃত। ৬০১ । (শাশ্বতী অখণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৭)

       মানব সভ্যতাকে আর্য্যকৃষ্টিতে সমৃদ্ধ করতে পঞ্চবর্হিঃ এবং সপ্তার্চ্চি-র অনুশাসন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্য অবদান।
।। পঞ্চবর্হিঃ ।।

১। একমেবাদ্বিতীয়ং শরণম্।
২। পূর্ব্বেষামাপূরয়িতারঃ প্রবুদ্ধা ঋষয় শরণম্।
৩। তদ্বর্ত্মানুবর্ত্তিনঃ পিতরঃ শরণম্।
৪। সত্তানুগুণা বর্ণাশ্রমাঃ শরণম্।
৫। পূর্ব্বাপূরকো বর্ত্তমানঃ পুরুষোত্তমঃ শরণম্ ।
   এতদেবার্য্যায়ণম্, এষ এব সদ্ধর্ম্মঃ,
   এতদেব শাশ্বতং শরণ্যম্।’’
।। বঙ্গানুবাদ ।।
১। এক এবং অদ্বিতীয়ের শরণ লইতেছি।
২। পূর্ব্বপূরণকারী প্রবুদ্ধ ঋষিগণের শরণ  লইতেছি।
৩। তাঁহাদের পথ অনুসরণকারী পিতৃপুরুষগণের শরণ লইতেছি।
৪। অস্তিত্বের গুণপরিপোষক বর্ণাশ্রমের শরণ লইতেছি।
৫। পূর্ব্ব-পূরণকারী বর্ত্তমান পুরুষোত্তমের শরণ লইতেছি।
    ইহাই আর্য্যপথ, ইহাই সদ্ধর্ম্ম, আর ইহাই চিরন্তন শরণযোগ্য।


।। পঞ্চবর্হিঃ-র গুরুত্ব প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ।।
        “আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেল সেইদিন যেদিন থেকে আমরা পঞ্চবর্হির মূল নির্দ্দেশ অবজ্ঞা করতে শুরু করলাম। তখন থেকে আমরা অপরের  খোরাক হলাম কিন্তু নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখে পরকে আপন ক’রে নেবার সামর্থ্য হারিয়ে ফেললাম।” (আঃ প্রঃ ১১। ১০০)


       ।। সপ্তার্চ্চিঃ ।।
১। নোপাস্যমন্যদ্ ব্রহ্মণো ব্রহ্মৈকমেবাদ্বিতীয়ম্।
২। তথাগতাস্তদ্বার্ত্তিকা অভেদাঃ।
৩। তথাগতাগ্র্যোহি বর্ত্তমানঃ পুরুষোত্তমঃ
    পূর্ব্বেষামাপূরয়িতা বিশিষ্ট-বিশেষ বিগ্রহঃ।
৪। তদনুকূলশাসনং হ্যনুসর্ত্তব্যন্নেতরৎ।
৫। শিষ্টাপ্তবেদপিতৃপরলোকদেবাঃ শ্রদ্ধেয়া নাপোহ্যাঃ।
৬। সদাচারা বর্ণাশ্রমানুগজীবনবর্দ্ধনা নিতং পালনীয়াঃ।
৭। বিহিতসবর্ণানুলোমাচারাঃ পরমোৎকর্ষ হেতবঃ
   স্বভাবপরিদ্ধংসিনস্তু প্রতিলোমাচারাঃ।’’

।। বঙ্গানুবাদ ।।
১। ব্রহ্ম ভিন্ন আর কেহ উপাস্য নহে, ব্রহ্ম এক–অদ্বিতীয়।
২। তথাগত তাঁর বার্ত্তাবহগণ অভিন্ন।
৩। তথাগতগণের অগ্রণী বর্ত্তমান পুরুষোত্তম, পূর্ব্ব-পূর্ব্বগণের পূরণকারী বিশিষ্ট বিশেষ বিগ্রহ।
৪। তাঁহার অনুকূল শাসনই অনুসরণীয়—তাহা ভিন্ন অন্য কিছু অনুসরণীয় নহে।
৫। ঋষি-অনুশাসিত প্রামাণ্য জ্ঞান, পিতৃপুরুষ, পরলোক, দেবতাগণ শ্রদ্ধেয়— অবহেলার যোগ্য    নহে।
৬। বর্ণাশ্রমের অনুকূল বাঁচাবাড়ার পরিপোষক সদাচার-সমূহ-নিত্যপালনীয়।
৭। বিহিত সবর্ণ ও অনুলোমক্রমিক (বিবাহাদি) আচারসমূহ পরম উৎকর্ষের কারণ— প্রতিলোম-আচার স্বভাব-ধ্বংসকারী।

।। মানব জীবনে ‘পঞ্চবর্হিঃ’ ও ‘সপ্তার্চ্চিঃ’ অনুশাসনের গুরুত্ব ।।
শ্রীশ্রীঠাকুর সম্বিতী গ্রন্থে বলছেন—
মতবাদ যাই হোক না,—
আর, যে-কোন সম্প্রদায়ই হোক,
যা’ মুখ্যতঃ ‘পঞ্চবর্হিঃ’ ও ‘সপ্তার্চ্চিঃ’কে
স্বীকার করেনিকো—
কোন-না-কোন রকমে,—
তা’ কখনও অনুসরণ করতে যেও না,
তা’ কিন্তু জঘন্য—অসম্পূর্ণ,
সত্তা-সম্বর্দ্ধনার পরিপন্থী তা’;
আর, ঐ ‘পঞ্চবর্হিঃ’ ও ‘সপ্তার্চ্চিঃ’ই হ’চ্ছে
সেই রাজপথ—
যা’কে স্বীকার ও গ্রহণ করে চললে
ক্রমশঃই তুমি সার্থকতায় সমুন্নত হ’তে পার। ২৩৪
      এই বাণী বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকে মনুষ্যত্বে উত্তরণের পথ দেখিয়েছে। আর্য্যীকৃত হতে  চাইলে মানতেই হবে।  তথাকথিত স্বঘোষিত আচার্য্য-পরম্পরা পন্থীরা যদি  নিজেদের সৎসঙ্গী মনে করেন, আর শ্রীশ্রীঠাকুর  প্রদত্ত “সৎ-এ সংযুক্তির সহিত তদ্-গতিসম্পন্ন যারা তা’রাই সৎসঙ্গী আর, তা’দের মিলনক্ষেত্রই হ’ল সৎসঙ্গ।”—বাণীটিকে স্বীকার করেন, তাহলে না মেনে কিন্তু উপায় নেই। কারণ ওই বাণীকে দৈনন্দিন সাধনায় স্থান না দিয়ে সৎ-এ সংযুক্তি এবং  তদ্-গতিসম্পন্ন হওয়া অসম্ভব!

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার বাস্তব উদাহরণঃ
“ধর্ম্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে
সম্প্রদায়টা ধর্ম্ম না রে।।”
      আমি বুঝিনা–কোন হিন্দু শুচিশুদ্ধভাবে মসজিদে যেয়ে প্রার্থনা করতে পারবে না কেন, আবার একজন সদাচারী মুসলমান হিন্দুর প্রার্থনা-মন্দিরে বসে প্রার্থনা করতে পারবে না কেন ! ভগবান মানুষকে তার language (ভাষা) দিয়ে চেনেন না, তিনি চেনেন তাকে তার feeling (বোধ) ও activity (কর্ম্ম) দিয়ে। (আঃ প্রঃ ৯ম খণ্ড)

       শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন—হজরত যীশু, হজরত মহম্মদ আমাদেরও prophet (প্রেরিতপুরুষ)। আর্য্যধারা যদি জীবন্ত থাকত, তা’হলে হজরত যীশু, হজরত মহম্মদ হয়তো একাদশ অবতার, দ্বাদশ অবতার ব’লে পরিগণিত হ’তেন। Anti-Biblism (বাইবেল-বিরোধী), Anti-Quranism (কোরাণ-বিরোধী), Anti-Vedism (বেদ-বিরোধী)-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তার নিরাকরণ করতে হবে। শাক্ত বিপ্র এবং বৈষ্ণব বিপ্র-পরিবারে যেমন বিয়ে-সাদির কোন নিষেধ নেই—সৌর বিপ্র ও গাণপত্য বিপ্রে যেমন বিয়ে চলতে পারে, ইষ্ট, কৃষ্টি ও পিতৃপুরুষের ঐতিহ্যবাহী রসুল-ভক্ত বিপ্র, বুদ্ধভক্ত বিপ্র, খ্রীষ্টভক্ত বিপ্রের সঙ্গেও তেমনি বিধিমাফিক বিয়ে-থাওয়া হ’তে পারে—এতে কোন বাধা নেই। কারণ, স্বধর্ম্ম ও কৃষ্টি-নিষ্ঠ থেকে যে-কোন পূরয়মাণ মহাপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধানতি নিয়ে চলা ধর্ম্মের পরিপন্থী তো নয়ই বরং পরিপোষক। তবে প্রত্যেকটি বিয়ের ব্যাপারে খুব হিসাব ক’রে চলতে হবে, যাতে কোন রকমের ব্যত্যয়ী কিছু বা প্রতিলোম-সংস্রব না ঘটে। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড, ২। ৭। ১৯৪০)
       একটা সভ্যতাকে স্বমহিমায় টিঁকিয়ে রাখতে হলে আর্য্যকৃষ্টির সুবিবাহ ও সুপ্রজনন বিধির  প্রয়োগ মাধ্যমে প্রকৃষ্ট জাতক সৃষ্টি, বৈশিষ্ট্যের পালন-পোষণ  মাধ্যমে ব্যক্তি নির্মাণ সর্বাগ্রে প্রয়োজন। বর্তমান পুরুষোত্তম যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়ণী ও  সদাচার প্রভৃতি পঞ্চনীতি পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি, দম্পতি, গৃহ, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের মাধ্যমে এক পরমরাষ্ট্রিক সমবায় প্রতিষ্ঠা করতে  চাইলেন। বর্ণাশ্রম ধর্ম্মের অনুশাসন মাধ্যমে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যকে  নিয়ন্ত্রণ করতে  বললেন। মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে চাইলে যুগ-পুরুষোত্তমের বিধানকে  মানতে এবং মানাতে সৎসঙ্গীদের সচেষ্ট হতে হবে।  সৎসঙ্গী মানে সকলের অস্তিত্বের সঙ্গী।  শুধুমাত্র তথাকথিত সৎসঙ্গ নামাঙ্কিত সঙ্ঘপ্রীতি-প্রাধান্য অধিবেশন ও উৎসবে আবদ্ধ থাকলে তা বাস্তবায়িত হবার নয়।

        ইষ্ট বা পুরুষোত্তম কথিত নীতিবিধি মেনে চলার নাম ধর্ম পালন।  ইষ্ট বা পুরুষোত্তম নির্দিষ্ট ধর্ম পালনে সবাইকে উৎসাহিত ও একত্রিত করার জন্য সঙ্ঘ গঠন। তাই, বড়-আমি স্বরূপ পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে, ব্যষ্টি ছোট-আমিদের সঙ্ঘপ্রীতির  গুটি কেটে বেরিয়ে এসে মহাসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে।


      ** প্রস্তাবিত আর্য্য মহাসভা নামের  পরমরাষ্ট্রিক সমবায় সমিতির  সদস্যদের আবশ্যিক পালনীয় প্রাথমিক বিষয়সমূহ **

অভক্ষ্যভোজী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুনাদি তামসিক আহার করা যাবে না। অগম্যাগামী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ  প্রতিলোম, সগোত্র এবং সপিণ্ড সম্বন্ধীয়দের সাথে অবিধি পূর্বক ধর্মবিরুদ্ধ বিবাহের মাধ্যমে কামাচার করা যাবে না। শারিরীক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সদাচার পালন করতে হবে। অসৎ পথ বর্জন করতে হবে। কদাচারী প্রদত্ত আহার ও পানীয় গ্রহণ করা যাবে না।
                           *             *      *
      আমাদের জীবধর্মের এক আবশ্যিক জৈবিক তাগিদ হলো আহার বা খাদ্য। যদিও
ব্যাপক অর্থে আহার মানে আহরণ। যার মধ্যে সবকিছুই আছে। খাওয়া-দাওয়া,
শোয়া-বসা, চলাফেরা, কথাবার্তা, কাজকর্ম, তথাকথিত প্রেম-ভালবাসা, বিয়ে
করা, বাবা-মা হওয়া ইত্যাদি। আমাদের উপনিষদের ঋষিরা ওই সবগুলোকে একত্রিত
করে আহার নামকরণ করে বললেন, ‘‘আহারশুদ্ধৌ সত্তাশুদ্ধিঃ, সত্তাশুদ্ধৌ ধ্রুবাস্মৃতিঃ …… ’’—অর্থাৎ জীবন ধারণের নিমিত্ত আহরণগুলো শুদ্ধ হলে সত্তা শুদ্ধি হয়, সত্তা শুদ্ধি হলে স্মৃতি নিশ্চল হয়। স্মৃতি নিশ্চল হলে জাতিস্মর হওয়া যায়। জীবনভূমির এপার-ওপার নিরীক্ষণ করা যায়। যারা দেশসেবক হবেন, তারা যদি আদর্শ চলন-চরিত্র দিয়ে আত্মশুদ্ধির পথে চলতে অভ্যস্ত না হন, দেশের নাগরিকদের কোন সম্পদের উপহার দেবেন?  তাই প্রতিটি সদস্যদের বিশুদ্ধ চলন-চরিত্রের ওপর নির্ভর  করছে  ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। এবং ওই  দৃষ্টান্তই  ভারতকে  মহান ভারতের শিরোপায় অধিষ্ঠিত করবে ভবিষ্যতে। ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠাপন্ন জীবনপিয়াসী সব্বাইকে বিষয়টা  নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করছি।

জয়গুরু ও প্রণামান্তে—

তাঁরই  একান্ত দীন

তপন দাস

বিচিত্র লীলা

।। নানাবিধ প্রাণী সৃষ্টি বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্যবাণী ।।

শ্রীশ্রীঠাকুর বলিতেছেন—“আচ্ছা, আপনার কি মেয়ে-ছেলে হতে ইচ্ছা যায় ? মেয়েদের কি ব্যাটা-ছেলে হতে ইচ্ছা যায় ? আমার মনে হয় কারও হতে ইচ্ছা যায় না। পেতে ইচ্ছা হয়। আপনি জিজ্ঞাসা করে দেখবেন।” যতীনদার দিকে চাহিয়া বলিলেন— “Mucus secretionএ যদি energyর push দেওয়া যায়, তবে cells created হয়ে তাতে living being grow করে। খানিকটা semen নিয়ে তাতে artificial stimulation দ্বারা নানাবিধ প্রাণী সৃষ্টি করা যায়। মেয়েদের চিন্তার রকম-ফেরে cells এর change হয়ে spermatozo হয়ে আপনা আপনি Conception possible। Mind-এর passive ভাব কোন মতে জাগিয়ে দিতে পারলে যে কোন ideaতে কাজ করা সম্ভব হয়। যেমন সন্ন্যাসীরা কোন বিধবা স্ত্রীলোককেও ‘পুত্রবতী হও’ বল্লে, মনটাও passive থাকলে, ঐ idea work করে পুত্রের সৃষ্টি করেছে।”

(সূত্র : ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জীবনী গ্রন্থ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৫১-৫২)

।। সুসন্তান লাভ প্রসঙ্গে ।।

নিবেদনে—তপন দাস

************************************

শ্রীশ্রীঠাকুর – ….. ঈশ্বর যেমন এক, ধর্মও তেমনি এক, এবং প্রেরিতপুরুষগণও একবার্তাবাহী। প্রকৃত হিন্দু,

প্রকৃত মুসলমান ও প্রকৃত খ্রীস্টানে কোন ভেদ নেই। প্রত্যেকেই ঈশ্বর তথা ইষ্টের পূজারী, সত্তার পূজারী, তাই তারা পরস্পর পরস্পরের বান্ধব। আবার, সত্তার বিরােধী যা’, তা’ তারা কখনও বরদাস্ত করে না। এক-কথায়, তারা অসৎ-বিরােধী। ধার্মিক যারা, তাদের চরিত্রগত লক্ষণ হল নিষ্ঠানন্দিত উদারতা। তাই, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোন স্থান নেই তাদের মধ্যে। ধর্ম বলছে ছােটকে বড় করে তােল, বড়কে ছােট কর না। প্রতিলােম

বিয়ে দিও না। নিচু ঘরে তােমার মেয়ে দিও না, বরং তার মেয়ে তুমি নিতে পার। কেষ্ট ঠাকুরকে আমরা ভগবান বলে মানি, তিনি বহুবিবাহ করেছেন, কিন্তু একটাও বামুনের মেয়ে বিবাহ করেন নি। বুদ্ধদেব বিয়ে করে সন্ন্যাসী হলেন, তিনিও প্রতিলােম করেন নি, বলেনও নি করতে। বৈশিষ্ট্য নষ্ট করার কথা কোন মহাপুরুষই বলেন না। সবটার একটা বিধি আছে। বুনাে আমের কলম দিতে হয় ভাল আমের সঙ্গে। গরুটা পাল দেওয়ার সময় ভাল ষাঁড়ের খোঁজ করে, যাতে দুধ বেশি দেয়, বাচ্চাটা ভাল হয়। কুকুর ভেড়ার বেলায়ও তা’ করে। মানুষের বেলায় ছেড়ে দিলাম, যেমন খুশি করলেই হল। বিয়ে একটা মস্ত জিনিস। সবর্ণ ও অনুলােম বিয়ে দিতে গেলেও বিধিমাফিক দিতে হবে। এসব ঠিকমত না করলে কষ্ট পেতেই হবে। স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু তার একটা আঁচও বােধ করতে

পারলাম না। এক রাজা চলে যাবে, অন্য রাজা হবে, ভারতের সিংহাসন কভু শূন্য নাহি

রবে। তাই মনে হয়, হস্তান্তর হয়েছে মাত্র। তথাকথিত independence (অনধীনতা)

হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু প্রকৃত freedom (স্বাধীনতা) হয় নি, যার ভিতর দিয়ে ভারত

আবার দেবভারতে পরিণত হতে পারে।

(আলোচনা প্রসঙ্গে, পঞ্চদশ খন্ড,

ইং তাং 14.01.1949)

 ।। বিজ্ঞান গবেষণা বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্যবাণী ।।

*******************************

Artificial production of a living being—সমস্ত condition গুলো observe করে সেগুলোকে artificially produce করতে পারলেই সম্ভব। সমস্ত facts-এর উপর control আনলেই তা possible হবেই। Human বা যেকোন animals-এর spermatozoaর সৃষ্টিই হয় তখনই যখন mind or vital energy দ্বারা spermated cells charged হয়। তা হলে এই spermatozoa artificially culture করে ovum-এর সহিত মেলাতে পারলেই হয়। Ovum বা ovaryটার food supply ছাড়া অন্য কোন function নাই। ৩/৪ মাস পর্যন্ত embryo easily করা যেতে পারে। তবে foetal circulation-এর সময় একটু difficulty আছে। তাও মায়ের blood embryoতে যায় না, আর placentaটা একটা temporary being-এর কাজ করে।

ডিমের সাদাটার ভিতরে spermatozoa culture করা সম্ভব। একটা ডিম ভেঙ্গে একটা কাচের vessel-এ ডিমের সাদাটা collect করে তার মধ্যে রেখে দেখা যেতে পারে natural intercourse-এ যে embryo হয়েছে তা artificially grow করান যায় কিনা। তাতে vessel টা antiseptic ও completely vacuous করতে হবে। এই experiment প্রথম করলে হয়। কলার বীচি পেপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলে হয় কি হয়।

• Vital energy আমাদের body-র ভিতর দিয়ে flow করছেই। এই flow-এর উপর যে disturbances external cause-এর দ্বারা হয় সেই waves গুলিই ideas বা brain expression রূপে persist করে।”…….

(সূত্র : ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জীবনী গ্রন্থ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৮১)

।। ভজন প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ।।

“প্রকৃত সরস্বতী-পূজা হ’চ্ছে ভজন। অনাহত সদাবিরাজিত শব্দ-ধারা, যাহা সাধন-ফলে নিজ অভ্যন্তরে জাগরিত হয় এবং শ্রুত হয় তাতে প্রক্রিয়াবিশেষ যোগে মনোনিবেশ করাকে ভজন কহে। আজ বাইরে বৈখরী শব্দযোগে গীতবাদ্যাদি এবং ভজনযোগে খুব অভ্যন্তরস্থ শব্দে মনোনিবেশ করাই সেই পরাবাক্ বা পরশব্দরূপিণী সরস্বতীর পূজা। কিন্তু সকলে তো এ বোঝে না এবং জানে না—তাদের অধম হলেও বাহ্যপূজা করা বাদ নয়।”

(অমিয়বাণী, ১২ই মাঘ, ১৩২৩)

  ।। অমিয়বাণী গ্রন্থ থেকে মুক্তি প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্যবাণী।।

১১ই মাঘ, ১৩২৩, রবিবার— কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—সব position-এরই একটা যেন magnetism আছে, আর তাতে sympathy ক’রে attention দিলে সেরূপ ভাবদ্বারা আক্রান্ত হ’তে হয় । যেমন শিশু, যে কোনও বাক্যের অর্থ বোঝে না, তার কাছে গিয়ে মুখে বেদনাব্যঞ্জক ভাব-সহকারে ‘আহা’, ‘আহা’, বললে সে তাতে আক্রান্ত হ’য়ে কেঁদে ফেলে । আবার বললেন—-কর্ম্মফল, দৈব, এও সত্য, আবার চেষ্টা দ্বারা তাহা খণ্ডন এও সত্য, pre-destination-ও সত্য, free-will-ও সত্য। দেখুন, ব্রহ্ম নিজে কতকগুলি ভাবে ক্রমে আক্রান্ত হ’য়ে তজ্জাত কৰ্ম্ম-সমষ্টি ভাব-সমষ্টি রূপে এই অশ্বিনীদা হ’য়ে আছেন। পূৰ্ব্বকৃত কর্মসংস্কার আপনার ভেতর দৈব বা pre-destination-রূপে রয়েছে—সময় হলে তা’ প্রকাশ পায় এবং পাচ্ছে। কিন্তু পুরুষকার বা free-will-ও আছে যদ্দারা ঐ পূর্ব্বসংস্কারজাত কর্ম্মকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন—যাতে তাহা বন্ধনের কারণ না হ’য়ে মুক্তির কারণ হয়। পূর্ব্বকৃত যেমন কৰ্ম্মফল বা দৈব বা অদৃষ্ট, pre-destination, যাহাই বলুন তাহা আপনার এমন রয়েছে যে, আপনাকে সৰ্ব্বস্বান্ত হ’তে হবে। এখন আপনি (নিজে পারেন ভালই বা কারো সহায়ে ) আপনাকে এমন ক’রে নিজের চেষ্টা দ্বারা, free-will দ্বারা, সাধনরূপ কর্ম্মের দ্বারা গ’ড়ে তুললেন যে সৰ্ব্বস্বান্ত হ’লেন বটে কিন্তু তদ্দারা আরও গরীয়ান হ’য়ে উঠলেন— তীব্র বৈরাগ্য স্থায়ী হ’য়ে অভয়পদ পেলেন । সর্ব্বস্বান্ত হবার দরুন কোনও কষ্টই হ’ল না, বরং তদ্দারা জীবন্মুক্তির আস্বাদন পেলেন । আর, যদি free-will বা চেষ্টা-সাধনাদি দ্বারা তা’ না করেন, তবে সর্ব্বস্বান্ত হ’য়ে দুঃখে অধীর হ’লেন এবং ঐ দুঃখ আর না পাই, সুখ যেন পাই ইত্যাদি আরও বাসনা বা সংস্কার সৃষ্টি করলেন। ক্রমে আরও কৰ্ম্ম-জালে জড়িয়ে পুনঃ-পুনঃ জন্ম-মৃত্যুকে বরণ করার পথ সুগম করতে লাগলেন । তাহ’লেই দেখুন, দৈব বা pre-destined যা’ আছে তাকে নিজ চেষ্টা দ্বারা এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করা যায়— যদ্দারা প্রকৃতিকে বশ ক’রে আপনি তার control-এর বাইরে গিয়ে জীবন্মুক্ত হ’তে পারেন বা ঐ একই pre-destined কাজের দ্বারা তাকে সাধনাদি দ্বারা মুক্তিমুখী ক’রে নিয়ন্ত্রিত না করলে, প্রকৃতির বশে থেকে পুনঃ-পুনঃ সুখ-দুঃখ ভোগ ক’রে থাকতে পারেন ।

 

।। সৎ চরিত্র গঠনের শ্রেষ্ঠ উপায় ।।

নিবেদনে—তপন দাস

**********************

পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর ভক্তদের উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “তোমাদের চৈতন্য হোক!”

বলেছিলেন, কিন্তু দিয়ে যেতে পারেন নি, দেবার জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র রূপে অবতীর্ণ হয়ে

দিলেন চৈতন্য লাভ মন্ত্র —

স্বতঃ-অনুজ্ঞা (auto-suggestion) মাধ্যমে।

“আমি অক্রোধী

আমি অমানী

আমি নিরলস

কাম-লোভজিৎ-বশী

আমি ইষ্টপ্ৰাণ

সেবাপটু

অস্তি-বৃদ্ধি-যাজন-জৈত্র

পরমানন্দ

উদ্দীপ্ত শক্তি-সংবৃদ্ধ

তোমারই সন্তান

প্রেমপুষ্ট, চির-চেতন,

অজর, অমর

আমায় গ্রহণ কর,

প্ৰণাম লও ।”

গুরু প্রদত্ত উক্ত অনুজ্ঞার সাহায্যে নিজেই নিজেকে আদেশ ক’রে অন্তঃস্থ চৈতন্যের জাগরণ ঘটানো যায়। দুর্নীতির কারক বন্ধুরূপী শত্রু লোভ, কাম, ক্রোধাদি বৃত্তিগুলোর লাগাম টেনে নিজেকে নিজেই দুর্নীতিমুক্ত রাখা যায়। কোন শাসকের প্রয়োজন হয় না।

শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র আমাদের দুর্নীতির ছায়া থেকে মুক্তি দিতে বাণী দিয়ে বললেন—

ইষ্ট ভরণ পিতৃপোষণ

পরিস্থিতির উন্নয়ন

এই না করে

যাই না করিস

অধঃপাতেই তোর চলন।

পরম কারুণিক ঈশ্বর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষকে সবকিছু দিয়ে পূর্ণরূপে তৈরি করেছেন, স্বাধিকার দিয়েছেন। যা দিয়ে মানুষ ইচ্ছে করলে মরতে পারে, মারতে পারে, আবার বাঁচতে পারে, বাঁচাতেও পারে। আমরা কোন কারণে যদি একটু ভুল করে বসি, সাথে সাথে আমাদের অভিভাবকেরা, প্রিয়জনেরা, বন্ধুবান্ধবেরা উপদেশ দিয়ে বলতে সুরু করে দেবেন, তুমি একটু কমন সেন্স অ্যাপ্লাই করতে পারলে না! অবশ্য যারা এই কমন সেন্স অ্যাপ্লাই করতে বলেন, তারাও অ্যাপ্লাই করতে গিয়ে কেন জানি বেসামাল হয়ে পড়েন। নইলে সুস্থভাবে বাঁচার জন্য, আহার, নিদ্রা, অপত্যোৎপাদনের জৈবধর্ম পালন করতে এত কেরামতি করতে হয়। দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে টাকা রোজগার করতে হয়! জেল খাটতে হয়!

আমরা যদি জৈবিক তাগিদগুলোকে ওই কমন সেন্স অ্যাপ্লাই করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তাহলে তো স্বর্গে অর্থাৎ সুখে বাস করতে পারতাম। এত দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করতে হতো না। যেমন, বাঁচতে হলে খেতে হয়, সেই খাওয়াটা যদি সত্তাপোষণী না হয়ে প্রবৃত্তিপোষণী হয় তাহলে অসুখ হবেই। সাধারণভাবে সিদ্ধ ভাত খেয়েও তৃপ্তির ঢেকুর তোলা যায়, আবার পাঁচতারা হোটেলের দামী খাবার খেয়ে অতৃপ্তির ঢেকুর তুলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়।

তাই খাওয়ার ব্যাপারে আমরা যদি ঠাকুরের দেওয়া ‘‘পেটের জন্য জীবন নয়কো,/জীবনের জন্য পেট/তাই জীবন—/পেটকে জীবন্ত করে রাখ।’’ বাণীর কমন সেন্সটাকে অ্যাপ্লাই করে সত্তাপোষণী নিরামিষ আহার গ্রহণে অভ্যস্ত হতে পারি তাহলে আমাদের অভাবও ঘুচে যাবে, অসুখ-বিসুখ থেকেও বেঁচে যাব। দুর্নীতির কবলে পড়ে থানা, পুলিশ, আদালত, জেলখানার খপ্পরে পড়তে হবে না।

আমরা নিজেরা নীতিহীনতাকে আশ্রয় করে যতই ভগবানের নাম করি না কেন, ‘‘ভগবান আমাদের বাঁচাতে পারেন না, ভগবানের উপর আমাদের যে টান ঐ টানটাই বাঁচায়।’’

‘‘কেউ কারও যম নয়রে, তোর যম তুই।’’

God (ঈশ্বর)-এর opposite pole (বিপরীত মেরু) হ’ল Satan (শয়তান) যা’ disintegrate (বিশ্লিষ্ট) করে। ভগবানের প্রতি বিমুখ হ’য়ে, তাঁকে অস্বীকার করে, তাঁর বিরুদ্ধ যা’ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, তাকে প্রাধান্য দিয়ে চলার স্বাধীনতাটুকু মানুষের আছে। এই স্বাধীনতার উপর তিনি হস্তক্ষেপ করেন না। তিনি যেমন ইচ্ছাময়, প্রত্যেকটা মানুষকে তেমনি ইচ্ছাময় করে ছেড়ে দিয়েছেন। যে ইচ্ছাময় যেমন ইচ্ছা করে, সে ইচ্ছাময় তেমন হয়, তেমন পায়—বিধির অনুবর্তনে। পরমপিতা বিশ্ববিধাতা, আর, আামরা হলাম স্ব-স্ব ভাগ্য-বিধাতা। স্রষ্টার বেটা সেও এক স্বতন্ত্র স্রষ্টা। যার প্রাণে যেমন চায়, সে তেমনি সৃষ্টির মালিক হয়।’’ (আ. প্র. ১০ম খণ্ড/ ৮. ১. ৪৮)

আমরা যখন স্ব-স্ব ভাগ্য-বিধাতা, তখন ওইসব দুরাবস্থা থেকে রেহাই পেতে হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে বিশ্ববিধাতা পরমপিতার বলা আদেশ-নিদেশ মেনে কমন সেন্স অ্যাপ্লাই করে আমাদের স্ব-স্ব ভাগ্য-বিধাতার কর্তব্যটুকু পালন করে যাওয়া, সকলকে পালন করতে উৎসাহিত করা— মনুষ্যত্বের মূল বুনিয়াদকে রক্ষা করতে হলে।

দুর্নীতির আতুড়ঘর হচ্ছে যৌনজীবন। ওই যৌন জীবনের সিড়ি বেয়ে একজন পুরুষ আদর্শ পিতা এবং একজন নারী আদর্শ মাতার পরিচয় বহন করে সুখ্যাত হতে পারে, আবার কুখ্যাতও হতে পারে । অথচ ওই সিড়ি-চরার বিষয়ে আমরা সবচাইতে বেশী উদাসীন। ভাল বাবা হবার জন্য আদর্শ চরিত্র গঠনের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করার জন্য যেনতেনপ্রকারেণ টাকা রোজগার করার দিকেই আমাদের ঝোঁক বেশি। টাকার খনির সন্ধান পেয়েও নানারকম অশান্তি, দুঃখ, মনস্তাপ, অবসাদে ভুগতে হয়। থানা, পুলিশ, উকিল, ডাক্তার, রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারস্থ হতে হয়। আমরা যদি একটু বিচার করে দেখি তাহলে দেখা যাবে, সন্তানের শিক্ষার জন্য টাকা দিয়ে বই কেনা যায়, নামী স্কুলে ভর্তি করানো যায়, অনেক টিউটর রাখা যায় কিন্তু মেধা কেনা যায় না, বিদ্যা কেনা যায় না। মেধা এবং বিদ্যা পিতৃ-মাতৃদত্ত উপহার, যা জন্মগত সংস্কারে নিহিত থাকে। মেধা এবং বিদ্যা, মা, বাবার কাছ থেকে নিয়ে যেমন যেমন মেপে দেন তাই সন্তানে মূর্ত হয়। টাকা দিয়ে গৃহ নির্মাণ করা যায় কিন্তু উপযুক্ত গৃহিনী না হলে গৃহসুখ পাওয়া যায় না। টাকা দিয়ে ওষুধ কেনা যায়, স্বাস্থ্য কেনা যায় না, স্বাস্থ্য যদি কেনাই যেত তাহলে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া থ্যালাসেমিয়াদি রোগগুলো থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যেত। স্বাস্থ্য পিতামাতার অবদান, জন্মগত সমৃদ্ধির বিষয়। এবার একটু হিসেব করে দেখুনতো, টাকা উপার্জনের দিকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে দীক্ষা, শিক্ষা, বিবাহ বিষয়ক গুরু প্রদত্ত বিদ্যাকে উপার্জন করে মনুষ্যত্ব নির্মাণের দিকে গুরুত্ব দিলে অতি সহজেই সুখের জীবন লাভ করা যায় না কি? আর দুর্নীতি থেকে মুক্তি পেতে চাইলে, সুনীতিপরায়ণ আচার্য্য অনুসরণে ব্যক্তি, দম্পতি, গৃহ ও সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি মুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব! “নান্যপন্থাঃ বিদ্যতে হয়নায়।”

জয়গুরু! বন্দে পুরুষোত্তমম্!

————————————————–

“Common sense is the most uncommon things in this world.”

—Shree Shree Thakur Anukulchandra

।। মাতৃ-সম্মেলনের বাস্তব তাৎপর্য ।।

নিবেদনে—তপন দাস

*************************

শ্রীশ্রীঠাকুর—‘‘………. ‘নারীর নীতি’, ‘নারীর পথে’ ও স্বাস্থ্য, সদাচার, আহার, গর্ভচর্য্যা ইত্যাদি বিষয়ক বই পড়তে দিবি। একা-একা পড়ার থেকে, সে (বধূ) পড়লো আর তোরা পাঁচজনে শুনলি, একসঙ্গে আলোচনা করলি, এমন হলে আরো ভাল হয়। প্রত্যেকটা পরিবারে এই সব চর্চা যত হয়, ততই ভাল। জীবন চলনায় সাধারণভাবে যা’-যা’ লাগে, সব বিষয়েই পড়াশুনা, আলোচনা, চর্চা, হয় সেই-ই ভাল। আর, এগুলি শুধু জেনে রাখলে চলবে না। করবার জন্য জানতে হবে, আর না করলে জানাও হবে না। এইভাবে যদি চল, তা’হলে দেখবে, পাড়ার অন্যান্য পরিবারেও এসব ছড়িয়ে যাবে, তারাও উপকৃত হবে। সবাই যে দীক্ষা নেবে এবং সবাইকে যে এখানে দীক্ষা নিতে হবে, এমন কোন কথা নয়। কিন্তু তোমাদের দৃষ্টান্তে মানুষের বাঁচার পথ নিরাবিল ও প্রশস্ত যদি না হ’লো, তা’হলে তোমরা করলে কী? (আলোচনা-প্রসঙ্গে ৩য় খণ্ড, ৩য় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২২৩)

।। বিবাহ সংস্কারের বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের নিদান ।।

করুণাদা (মুখোপাধ্যায়)—সৎসঙ্গের মধ্যে কোথায় কোন্ উপযুক্ত ছেলে আছে, তাও তো আমরা সবসময় খবর পাই না।

শ্রীশ্রীঠাকুর—তাইতো আমি বলি, বিবাহের উপযুক্ত ছেলে ও মেয়েদের বর্ণ, বংশ, গোত্র, নাম, ধাম, জন্মকুণ্ডলী ইত্যাদি-সম্বলিত একটা তালিকা এখানে তৈরী করা ভাল। তা’ছাড়া ভাল-ভাল চাকুরিয়া, ব্যবসাদার, জমিদার, জোদ্দার, কণ্ট্রাকটর, শিল্পপতি ও বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী ও গুণীলোক যারা আছে, তাদেরও নাম, ধাম, ঠিকানাসহ তালিকা প্রস্তুত করা দরকার। এদের ভিতর-দিয়ে আমরা অনেককে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি ও অনেককে বিশেষ-বিশেষ বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলতে পারি, আবার এখানকার জন্য যে-সব মানুষ প্রয়োজন তা’ও পেতে পারি।

(আলোচনা-প্রসঙ্গে ৩য় খণ্ড, ১৫ই পৌষ, মঙ্গলবার, ১৩৪৮, ইং ৩০-১২-১৯৪১)

 প্রশ্ন— সৎসঙ্গী কাদের বলা যায়?

শ্রীশ্রীঠাকুর— প্রত্যেকটা মানুষই কার্যতঃ সৎসঙ্গী, কারণ অস্তিত্বের বিধি অল্পবিস্তর না মানলে কারও অস্তিত্ব থাকে না। (আঃ প্রঃ ১১, পৃঃ ১৮৪)

আমি সৎসঙ্গী তার মানে হ’চ্ছে আমি প্রত্যেকের জীবন-বৃদ্ধির সঙ্গী। সৎসঙ্গী হওয়া মানে সবার বাঁচা-বাড়ার সেবক হওয়া। (আঃ প্রঃ ৯, পৃঃ ৫৫)

  ।। স্বাস্থ্যই সম্পদঃ কিভাবে পাওয়া যাবে, সেই বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের অমৃত নিদান ।।

মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে গেলে, প্রথম চাই উপযুক্ত বিবাহ, উপযুক্ত দাম্পত্য জীবন । পিতামাতার বিবাহ ও দাম্পত্য জীবনে যদি অসঙ্গতি থাকে, তবে ছেলেমেয়ে শরীর-মনে সুস্থ হ’তে পারে না । তারপর, মেয়েদের জানা চাই, ঋতুকালে ও গর্ভাবস্থায় কিভাবে চলতে হয় । সহবাস কা’কে বলে–পুরুষ, মেয়ে কেউই জানে বলে মনে হয় না । ক্ষণিক উত্তেজনার বশে মিলনটাই সহবাস নয় । . . . . . স্বামী-স্ত্রী যেখানে আদর্শপরায়ণ, তাদের যৌন মিলনের পিছনেও বুদ্ধি থাকে. . . তাদের মিলনজাত সন্তান যেন ইষ্টের পূজায় লাগে । . . . . পিতামাতার . . . . শ্রদ্ধানুগ অনুশীলন- তত্‍পরতার ভিতর দিয়ে যে বৈধী মিলন সংগঠিত হয়, তার ভিতর-দিয়ে সন্তান সুষ্ঠু জৈবী-সংস্থিতির অধিকারী হয়ে ওঠে । ঐ জৈবী-সংস্থিতিই হচ্ছে জীবনের আকর । জাতকের রোগ-নিরোধ- ক্ষমতা, আয়ু ও বর্দ্ধন- তত্‍পরতা ঐ জৈবী-সংস্থিতির উপরই নির্ভর করে ।

(সূত্রঃ আ. প্র. ২ (২৩. ১২. ৪১)

   ।। আমিষ আহারের কুফল প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতবাদ।।

শ্রীশ্রীঠাকুর—‘‘আমার নিজের সরল বুদ্ধির থেকে মনে হয় নিরামিষ খেলে পরে নাম-ধ্যান ভালভাবে করা যায়। আর জ্যোতি দেখা যায় ও নানারকম শব্দ শোনা যায়। ……. আমিষ খেলে শরীরের মধ্যে একটা হিংসার সৃষ্টি হয়। আমার মাংস ও পশুর মাংস একত্রে সংঘর্ষ হয়ে স্বাস্থ্য খারাপ করে। আমার মনে হয়, যে কোনদিন আমিষ খায়নি তাকে জোর করে আমিষ খাওয়ালে সুফলের থেকে কুফলই বেশী হয়। আমার বড় মেয়ে সাধনাকে সুপ খেতে দিয়ে আরও তাড়াতাড়ি মেরে ফেলা হল।’’

সাধনাদির কথা মনে হওয়ায় শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখ দুটো ছল ছল করে জলে ভরে আসল।

শ্রীশ্রীঠাকুর একটু থেমে আবার বললেন, ‘‘আমার বড় মেয়ে সাধনা খুব ভাল মেয়ে ছিল। নিজের মেয়ে বলে হয়তো বেশী ভাল মনে হতে পারে। কিন্তু, আজকাল ওরকম ভাল মেয়ে ……. (এইটুকু বলে আর বললেন না) তা ছাড়াও আমার মনে হয়, ও খুব ভাল মেয়ে ছিল। ও আমার মা’র রকমটা ফুটিয়ে তুলতে চাচ্ছিল।’’ প্যারীদা বললেন, পড়াশুনায় খুব ভাল ছিল। Distinction-এ B.A. পাশ করেছিল।’’ (সূত্রঃ গুরুপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য প্রণীত ‘তাঁর কথা

 

 

প্রশ্ন — আচ্ছা, হজরত মহম্মদ যেমন মহাকর্মী ছিলেন, তেমনই সরল স্বভাব ছিলেন । একটু জল আর কয়েকটি খেজুর মাত্র ছিল তাঁ’র দৈনন্দিন খাদ্য । খলিফাগণও অনেকে ছিলেন নিরামিষাশী — তাঁ’দের খাদ্য ছিল ঋষিদেরই মত — রুটি আর খেজুর । তাঁ’দের জীবনের আদর্শ তো আমাদের অনুসরণীয় ? তবে আমাদের সমাজে পশুবলি আর মাছ-মাংস খাওয়া বিধি হ’ল কি-করে ?

শ্রীশ্রীঠাকুর — সহজ,সরল ও অক্লান্ত কর্মী হ’য়ে থাকাটাকে পছন্দ করেন যা’রা, তাঁ’দের প্রকৃতি ও প্রবৃত্তিই চায় ঐ নিরামিষাহার । এটা ক্ষুধারই নিয়ম — তাই এই-ই প্রকৃতি । হজরত রসুল কি কোথাও ব’লে গেছেন, তোমরা খোদার নামে প্রাণওয়ালা — যা’ দের সুখ-দুঃখ, অনুকুল-প্রতিকূল,উচিত-অনুচিত বোধ ও প্রয়োজন-মত চলনার বিবেক আছে, মৃত্যুকে যা’রা ভয় ক’রে শিউরে উঠে, এই আমাদের মতই হাড়-রক্ত-মাংসওয়ালা — প্রাণীদিগকে হত্যা ক’রে খেয়ে ফেল– তোমাদের ধর্ম খুব অটুট হ’য়ে থাকুক ?

তিনি কারও বেদনাই সইতে পারতেন না — দুঃখবেদনাবিদ্ধ দেখলেই তিনি আকুল হ’য়ে উঠতেন তক্ষুনই, তা’ নিরাকরণের জন্য — নিরাকরণ না ক’রে যেন নিরস্তই হ’তে পারতেন না । অন্যের বেদনা অনুভব করতেন তাঁ’র নিজের ব’লে — এই তো ছিল তাঁ’র চরিত্রে জাজ্বল্যমান হ’য়ে ফুটে ।

“কোরবাণী” কথার মানে হত্যা — এ আমার কিছুতেই মনে হয় না ; মনে হয় নিবেদন, মনে হয় উৎসর্গ — আর তা’ সব চেয়ে যিনি আমার প্রিয়, দুনিয়ায় যাঁ’কে অত্যন্তভাবেই পছন্দ করি, ভালবাসি — তাঁকে নিবেদন করতে ইচ্ছা হয় — আর ক’রেও হয় মহাসুখ, মহাতৃপ্তি — অন্তঃকরণে ফুটে ওঠে যেন মহাসন্দীপনায় ! নিবেদন ক’রে কেন তাঁকে দিতে ইচ্ছে করছে — এই চিন্তাতেই যেন অন্তঃকরণটা অমনতর হ’য়ে ওঠে । মনে হয় — নিবেদন ক’রে, তাঁ’কে দিয়ে আমি যেন আরো প্রাণবান্ হ’য়ে উঠলাম, যা’কে দিলাম সেও যেন কেন, নিবেদনের উদ্দেশ্যানুপ্রাণনে — প্রাণবান, চেতন, সাড়াশীল হ’য়ে উঠল ! বধ বা হত্যার চিন্তাই তো এখানে নাই — বিশেষতঃ যেখানে ইসলাম is the attitude of Dharma !

হতে পারে — অত্যন্ত lower order of Bedouins class, যা’রা ডাকাতি-ফাকাতি করত, শিশ্নোদরপরায়ণ মাংসাশী-প্রকৃতি, যা’রা ঐ প্রবৃত্তিকে অবহেলা ক’রে, বাঁচা-বাড়ার উৎস-আদর্শে ঈশ্বরালিঙ্গগণ-প্রয়াসী-ইসলামকে –গ্রহণ করতে নারাজ, তা’দিগকে ঐ বীভৎস মরণ-আকূতিপূর্ণ মাংসলোলুপপতা হ’তে নিবৃত্ত করবার জন্য নীচ ব’লে নিন্দা ক’রেই হয়ত তিনি কোথাও sanction দিতে পারেন এই ভরসায় — এমনতর অবস্থার ভিতর-দিয়ে ঐ বীভৎস-খাদক প্রবৃত্তিগুলি নিরসন হ’য়ে যেতে পারে ! আমি আপ্রাণ চেঁচিয়ে বলতে পারি হজরত রসুল কখনও অমনতর প্রাণীহত্যার উপদেশ দেননি !

–(ইসলাম প্রসঙ্গে)–

।।………………………………………………………………………।।

“কোরবাণী” কথাটি আসিয়াছে আরবী ‘কুরবান’ হইতে । “কুরবান” মানে উৎসর্গ, বলি । আবার, বলি মানে দান । “তন, মন,ধন কর কুরবাণী” অর্থাৎ কায়,মন, ধন পরমেশ্বরের জন্য উৎসর্গ কর । এই আত্মোৎসর্গ বা আত্ম-বলিদানই প্রকৃত কোরবাণী ।

… “এসলামের পূর্ব্বকাল পর্য্যন্ত আরবদেশে “আতীরা” ও “ফারা” নামক দুই শ্রেনীর পশুবলি-উৎসর্গ প্রথা প্রচলিত ছিল ।… সে-সময় পশু-বলিদানই প্রধান ধর্মকার্য্য বলিয়া বিবেচিত হইত” ।

তাই, হজরত বর্ব্বর আরবদিগের ঐ প্রথানুসারেই তাহাদের সংস্কারকে উলঙ্ঘন না করিয়া পশু-ভক্ষণের কথা বলিতে বাধ্য হইয়াছিলেন বটে — তবে তাহা ঈশ্বরকে নিবেদন করিয়া লইতে হইবে ।

কিন্তু তৎপরেই কোরাণে স্পষ্ট আছে —

“আল্লার নিকট তাহার মাংস ও তাহার রক্ত কখন পৌঁছে না বা তিনি ইচ্ছা করেন না ।” বরং তোমরা অসৎকর্ম হইতে নিজেকে রক্ষা করা ইহাই তিনি ইচ্ছা করেন । তিনি আমাদের অধীনে থাকিয়া কার্য্যনির্ব্বাহের জন্য পশুদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন — সেজন্য তোমরা খোদার বহূ প্রশংসা করিবে এবং ঐ সমস্ত নিরীহ পশুর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া তোমরা খোদার নিকট নম্র ও নিরীহ হইতে শিক্ষালাভ করিবে । এই সৎপথ-প্রাপ্তির অর্থাৎ সৎশিক্ষারর জন্যই খোদা এই ব্যবস্থা করিয়াছেন । যাহারা অন্যের মঙ্গল সাধন করে, তাহাদের মঙ্গল করিয়া থাকেন “। (কোরাণ–২২ মজ ৩৭ র, ৫)

নিজ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

।। জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ।।

নিবেদনে—তপন দাস

************************

প্রোটোপ্লাজম্ (জীবনের মূলীভূত উৎপাদন )-এর Psycho-physio chemical evolution ( মানস শারীর রাসায়নিক বিবর্তন) থেকেই নানাপ্রকার জীবের আবির্ভাব। টিকে থাকার তাগিদ জীব মাত্রেরই আছে। যে-পরিবেশে টিকে থাকবার জন্য যেমন দৈহিক ও মানসিক গঠন প্রয়োজন, তেমনতর দৈহিক ও মানসিক গঠন উদ্ভিন্ন করে তোলার প্রয়াস প্রতিটি জীবের ভিতর দেখা যায়। এইভাবে জীবের প্রকৃতি বদলায়। যারা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না বা পরিবেশকে বাঁচার উপযোগী ক’রে আয়ত্বে আনতে পারে না, তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

(সূত্র : নিজ জীবন প্রসঙ্গে, পৃঃ ১০১)

  ।। ইষ্টের চেয়ে থাকলে আপন,

ছিন্ন-ভিন্ন তার জীবন।।

নিবেদনে—তপন দাস

***********************

আলোচনা প্রসঙ্গের সংকলক শ্রীযুক্ত প্রফুল্ল কুমার দাস মহাশয়ের মাতৃদেবী উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করেছেন। প্রফুল্লদা তাতে শোকে মুহ্যমান হ’য়ে পড়েছেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাকে নিয়ে বৈকালে আশ্রমের ( হিমাইতপুর) নাট্যমণ্ডপে গিয়ে বসেছেন। সঙ্গে আছেন কেষ্টদা (ঋত্বিগাচার্য্য), সরোজিনী মা।

শ্রীশ্রীঠাকুর—প্রফুল্লদার প্রতি ( মমতাসিক্ত চোখে ও কণ্ঠে ) — কলকাতায় প্রথমে যখন খবর পেলি তখন তোর কী মনে হ’ল?

প্রফুল্লদা—বেলেঘাটায় একটা সৎসঙ্গ অধিবেশনে রওনা হবার মুখে খবর পেলাম, আপনি আজ রাতেই আশ্রমে রওনা হতে বলে দিয়েছেন। এটুকু শুনেই মনে হল—মা বোধহয় নেই। …. সমস্ত শরীর থর্-থর্ করে কাঁপতে লাগল — বুক ভেঙে কান্না আসছিল, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। ……… তারপর সব জানলাম।

শ্রীশ্রীঠাকুর—আমি আশ্রমে আসতে বলেছি তাতে তোর মায়ের খারাপ কিছু হয়েছে .…… হঠাৎ ও কথা ভাবতে গেলি কেন?

প্রফুল্লদা—তা জানি না, ক’দিন থেকেই মনে হচ্ছিল, মা’কে বোধ হয় বেশীদিন রাখতে পারব না।

শ্রীশ্রীঠাকুর—অমনি হয়। অমঙ্গলের কথা মনে ডাকে। বিশেষতঃ ভালবাসার জনের অমঙ্গল আসার আগে মনে যেন কেমন একটা ছায়া পড়ে।

প্রফুল্লদা— ঠাকুর! আমি কেবল ভাবছি মা’র অধোগতি হবে, যা কষ্ট পেলেন। কী কষ্টে গেলেন। কী প্রায়শ্চিত্ত করলে .…. মা’র সৎগতি হয় ?

শ্রীশ্রীঠাকুর—সে তো কষ্টের দরুণ যায়নি। আমার প্রতি টান ছাপিয়ে ছিল ওর জায়ের (সদ্যমৃত) প্রতি টান। আমার প্রতি টান থাকলে আমাকে কী খাওয়াবে…তাই নিয়ে উদ্ব্যস্ত হ’য়ে অন্যকথা ভুলে যেত। ঐযে ছড়ায় আছে— “ইষ্টের চেয়ে থাকলে আপন, ছিন্ন ভিন্ন তার জীবন”—এ একেবারে তাই হয়ে গেল। ক’দিন আগে আমাকে কথা দিয়েও কথা রক্ষা করল না— আমি তার মধ্যে কত weak হয়ে গিয়েছিলাম। …. সন্তান যদি কৃতী ….. ইষ্টস্বাৰ্থ প্ৰতিষ্ঠাপ্রাণ হয়, তাতে ত্রিকোটি কুল উদ্ধার হয়। মা’র উদ্ধার, মার সদগতি, মা’র অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত তো সাধারণ কথা ।….জীবিত বা মৃত তাদের সব চাইতে বেশ উপকার করা যায় এই ভাবে চ’লে — অবস্থা যদি সত্যিকার পারস্পরিক প্রীতি থাকে।

যে গেছে সে তো গেছে, আমি তো তোর আছি।

সর্ব্ব ধর্ম্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ

অহং ত্বাং সৰ্ব্বপাপেভ্য মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।

(সূত্র : নিজ জীবন প্রসঙ্গে, পৃঃ ১৬২-১৬৩/আঃ প্রঃ ৫ম খণ্ড)

“সাধনা বলতেই আমি বুঝি ইষ্টনিষ্ঠ হয়ে সত্তাসম্বর্দ্ধনী আত্মনিয়ন্ত্রণী শক্তিলাভ ও তার ইষ্টার্থী বিনিয়োগ।” (নিজ জীবন প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা ৯৩)

।। এত হিংসা কেন ।।

।। এত হিংসা কেন ।।

নিবেদনে—তপন দাস

***************************

ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে, বাংলাভাষায় রচিত বিখ্যাত গানের কলি, “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য” নস্টালজিয়ার সিড়ি বেয়ে যাঁদের স্মৃতি অধিকার করে আছে, সেইসব বুদ্ধিজীবিরা, সমাজ-বিজ্ঞানীরা, কি জবাব দেবেন পশ্চিমবঙ্গের নোংরা রাজনীতি কেন্দ্রিক হিংসা, নারী-নির্যাতন, মৃত্যুর খবর শুনে! কতটা বোধ-বিপর্য্যয় হলে “পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যার” পবিত্র নীতিকে পাশ কাটিয়ে নীতিহীন রাজনীতির ক্ষমতা দখলে রাখার জন্য বিরোধী মতবাদীদের হত্যা পর্যন্ত করতে পারে! আবার যার প্রমাণ পাওয়া গেল সমাগত পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে! যা’ সংশ্লিষ্ট “সত্যমেব জয়তে” সম্বলিত সীলমোহরের আধিকারিকদের পরিহাস করে যেন বলতে চাইছে, তোমরা কতখানি সৎ তোমাদের বিবেকের কাছে একবার জিগ্যেস করে দেখো তো!

** হিংসার উৎপত্তি **

বুদ্ধিজীবিগণ, সমাজবিজ্ঞানীরা, মনোবিদেরা এর কি ব্যাখ্যা দেবেন জানিনা, তবে যুগত্রাতা বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র হিংসার কারণ প্রসঙ্গে বলছেন, অহঙ্কার থেকে হিংসার উৎপত্তি। “অহঙ্কার আসক্তি এনে দেয় ; আসক্তি এনে দেয় স্বার্থবুদ্ধি ; স্বার্থবুদ্ধি আনে কাম ; কাম হতেই ক্রোধের উৎপত্তি ; আর, ক্রোধ থেকেই আসে হিংসা।’’ তাহলে বোঝা গেল, হিংসার মূল কারণ অহঙ্কার। অহঙ্কারের উৎপত্তি প্রবৃত্তি-পরায়ণতা থেকে। আর সেই প্রবৃত্তি-পরায়ণতার চালক লোভ, কাম, ক্রোধ, মদ, মোহ ও মাৎসর্য্য নামের ষড়রিপু, দেহরথের ৬টা ঘোড়ার লাগাম, দেহরথের সারথী ইষ্টগুরুর হাতে সঁপে দিতে পারলে একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। আর সেই ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন দিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। আমি অক্রোধী, আমি অমানী, আমি নিরলস … ইত্যাদি মন্ত্রে “স্বতঃ-অনুজ্ঞা”-র নিত্য অনুশীলনের বিধানের মাধ্যমে। হিংসাকে প্রতিরোধ করার জন্য এর চাইতে উপযুক্ত কোন নিদান আছে কি-না আমার জানা নেই।

যুগ-বিধায়ক বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র “প্রাচ্য-প্রতীচ্য নিয়ন্ত্রণে বর্ণাশ্রমানুশাসকম্ আর্য্য চিরায়নম্।” সূত্র-মন্ত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্তরে এক হিংসামুক্ত সুবিন্যস্ত পরমরাষ্ট্রিক সমবায় গঠন করার সূত্র দিলেন।সেই অমোঘ বিধানকে পাশ কাটিয়ে হিংসার প্রতিবিধানের জন্য থানা, পুলিশ, মিলিটারী, কোর্ট, সংশোধনাগার প্রভৃতির ব্যবস্থা করেও হিংসা দমন করতে পারছেন না রাষ্ট্র পরিচালকেরা। তাই যদি পারত তাহলে, জন-প্রতিনিধি হয়ে দেশ-সেবকের অধিকার অর্জনের মাধ্যম, নির্বাচনের ন্যায় একটা সরল প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে আমাদের হিংসা এবং হিংসার পরিণতি মৃত্যুর মিছিল দেখতে হতো না! এ কেমন রাজনীতি? এ কেমন গণতন্ত্র ? ছিঃ!

* * *

যুগ-বিধায়ক বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বিধান অনুযায়ী হিংসাকে দূর করতে হলে ভক্তির চাষ দিতে হবে। ভক্তির সংজ্ঞায় তিনি বলছেন, ‘‘সৎ-এ নিরবচ্ছিন্ন সংলগ্ন থাকার চেষ্টাকেই ভক্তি বলে।’’ তাহলে সৎ-এ নিরবচ্ছিন্ন সংলগ্ন থাকার চেষ্টা করার জন্য ভাবী পিতামাতাকে সদগুরুর আদর্শ গ্রহণ করতে হবে। তারপর পরমপিতা প্রদত্ত দিব্য বিবাহ-সংস্কারে সংস্কৃত হয়ে শুদ্ধাত্মাকে আকর্ষণ করে প্রহ্লাদের ন্যায় দিব্য ভক্ত সন্তানের জন্ম দিতে হবে। ভারতের নিজস্ব সংবিধান কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এর সমর্থন আছে। বর্তমানের চিকিৎসা বিজ্ঞানও এর সমর্থন করেছে। সুস্থ দম্পতির সুস্থ দাম্পত্য জীবনের মাধ্যমে সুস্থ মানবের জন্ম দেওয়ার বিধান দিয়ে। এ ব্যতীত জন্মগত দুরারোগ্য শারিরীক এবং মানসিক ব্যাধি প্রতিরোধের অন্য কোন চিকিৎসা নেই। (Ref. DAVIDSON’S PRACTICE OF MEDICINE/Genetic Factor of Disease)

রাষ্ট্রের অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার বোর্ডের কর্ণধারেরা বিশ্বস্ত, সুস্থ পে-ডিগ্রীড কুকুরের, ঘোড়ার জন্ম নিয়ে গবেষণা করলেও মানুষের বেলায় উদাসীন। একুশ বছরের ছেলে আর আঠারো বছরের মেয়ে হলেই হলো। বংশ, বর্ণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা—কোন কিছুই না দেখে স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্টের সাহায্যে বিয়ে করতে পারবে, আবার বনিবনা না হলে ডিভোর্সও করতে পারবে! এখন তো আবার বিয়ে না করেও লিভ-টুগেদার আইনের সাহায্যে সন্তানের মা হতে পারা যায়। যার দৃষ্টান্ত লোকসভার সদস্যা নুসরত জাহান। রাষ্ট্রের জন-প্রতিনিধিরা যদি সুস্থ দাম্পত্যের প্রজনন বিজ্ঞানকে অসম্মান করতে পারেন, সেখানে সাধারণ নাগরিকগণ আরো বেশি সুযোগ পেয়ে যাবে লাগামহীন যৌন-জীবন যাপন করার! পরমপিতার অশেষ করুণায় আমাদের গ্রামীন ভারতবর্ষের তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষগুলো এখনো কোন-না-কোনভাবে ভারতীয় আর্য্যকৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা, পিতামাতায় ভক্তি রেখে বিবাহ সংস্কারের অনুশাসন মেনে চলছে বলে প্রিয়জনের দ্বারা প্রিয়জনদের হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা সমাজে বিস্তার লাভ করতে পারছে না। তবে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি এখনই ভারতীয় আর্য্যকৃষ্টিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুরুত্ব না দেয়, স্বভাববিধ্বংসী প্রতিলোম জাতকদের জন্ম বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে অচিরেই হিংসা আমন্ত্রিত হবে ঘরে ঘরে!

হিংসা প্রতিরোধের জন্য যুগ-বিধায়ক শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র একেবারে সমস্যার মূলে হাত দিয়ে বললেন, “ভক্তি এনে দেয় জ্ঞান ; জ্ঞানেই সর্বভূতে আত্মবোধ হয় ; সর্বভূতে আত্মবোধ হলেই আসে অহিংসা ; আর, অহিংসা হতেই প্রেম। তুমি যতটুকু যে-কোন একটির অধিকারী হবে, ততটুকু সমস্তগুলির অধিকারী হবে।’’

একেবারে অঙ্কের হিসেব। আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছার ‘ছোট-আমি’-টার অহঙ্কারের লাগামটাকে যদি ভক্তির মুঠো দিয়ে কষে না ধরা যায় তাহলে ধাপে-ধাপে হিংসার আশ্রয়ে পৌঁছে যাবে। যার পরিণতি অস্বাভাবিক মৃত্যু। আর যদি জীবন নামক রথের চালক ছ’-টা ঘোড়ার (ষড়রিপু) লাগাম জীবন-রথের সারথি স্বরূপ ইষ্টগুরুর হাতে সমর্পণ করা যায়, তাহলে, সরল প্রাণ, মধুর বচন, আর বুকভরা প্রেমের ডালি দিয়ে সবাইকে আপন করে নেওয়া যায়। একটা পিপীলিকারও ব্যথা নিরাকরণের জন্য প্রাণ কাঁদে।

আবার যে হিংসা মৃত্যুর দ্যোতক তাকে শক্ত হাতে দমন করতে হলে হিংসা দিয়েই করতে হবে। হিংসাকে হিংসা দ্বারা জয় করার নাম অহিংসা। যেমন দুষ্টক্ষত বা গ্যাংগ্রীন থেকে শরীরকে বাঁচাতে হলে আক্রান্ত অংশটিকে কেটে বাদ দিতে হয়। বাদ না দিলে দেহকে বাঁচান যায় না। তেমনি সমাজ রক্ষা, রাষ্ট্র রক্ষা করতে হলে অনুরূপ নীতির অনুসরণ না করতে পারলে সমাজ-রাষ্ট্রের অঙ্গে পচন ধরে যাবে, রাষ্ট্রের সত্তাটাই মারা পড়বে।

আর্য্য ভারতের মা কালী শুম্ভ-নিশুম্ভকে, মা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করে, শ্রীরামচন্দ্র রাবনকে বধ করে ওই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। অযথা কাউকে হত্যা করেন নি। অযথা কাউকে হত্যা না করে পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণ মামা কংসের পাঠান অসুর-রাক্ষস নামক সত্তাহিংস জিঘাংসা বৃত্তিধারীদের হত্যা করেছিলেন। অপকৌশলী অসৎ সাম্রাজ্যবাদী কংসকে হত্যা করে, উগ্রসেনকে কারাগার থেকে মুক্ত করে তাঁকে পুণরায় রাজ্যে অভিষিক্ত করেছিলেন। ধর্মপথভ্রষ্ট অসৎ আগ্রাসনী জরাসন্ধকে হত্যা করে জরাসন্ধের পুত্র সহদেবকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়েছিলেন। সব হিংসার মূল উৎপাটন করে, এক পরম রাষ্ট্রীক সমবায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধ সংগঠিত করে জীবনবাদের জয়গান গেয়েছিলেন। ভবিষ্যত প্রজন্মকে জীবনবাদী হবার জন্য উপহার দিয়ে গেলেন শ্রীমদ্ভবদ্গীতা। আমাদের রাষ্ট্রীয় স্তোস্ত্র “বন্দে মাতরম্” ধ্বনির উৎস শ্রীমদ্ভবদ্গীতা। একদা শ্রীমদ্ভবদ্গীতা গ্রন্থকে আদর্শ মেনে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছিল। সেসব মহান ইতিহাস ভুলে গণতান্ত্রিক পথে রাজনীতি করতে গিয়ে হিংসাশ্রয়ী হয়ে আমরা যদি ভারতমাতার সন্তানদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলি, ভারতমাতা সেই অপমান কতদিন মুখ বুঁজে সহ্য করবেন?

আমরা আবার গীতা গ্রন্থের স্রষ্টা পার্থসারথী শ্রীকৃষ্ণের আশ্রয়ে ফিরে যাব। শ্রীকৃষ্ণ পরবর্তী বহির্ভারতের বুদ্ধদেব, যীশুখ্রীষ্ট, হজরত রসুল প্রমুখ পুরুষোত্তমগণও আর্য্য ভারতীয় ওই শ্বাশ্বত নীতির অনুসরণ করেছেন মানব সভ্যতাকে বাঁচাতে। তাঁরা আগ্রাসন করতে, ধর্মান্তকরণ করতে, অযথা কাউকে হিংসা করতে কোথাও কি বলেছেন? তবে কেন এত হিংসা? কেন এত জিঘাংসা? ওই হিংস্র জিঘাংসাকে যদি কঠোর হাতে দমন করতে এগিয়ে না আসেন জীবনপিয়াসী শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তথা রাষ্ট্র নায়কেরা, তাহলে মানবতার অপমৃত্যুর কালো ছায়া মানব সভ্যতার অঙ্গে ক্রমে ক্রমে গ্যাংগ্রীন উৎপাদন করবে নিকট ভবিষ্যতে। অসৎ নিরোধে তৎপর না হয়ে, অসৎকে প্রশ্রয় দিয়ে রাষ্ট্রের পবিত্র মন্ত্র “সত্যমেব জয়তে” সম্বলিত সীলমোহরের আধিকারিক হওয়াটা যেমন ভণ্ডামি, তেমনই অসৎ নিরোধে উদাসীন থেকে সৎসঙ্গী সেজে ভক্ত হওয়াটাও কিন্তু ভণ্ডামী! সকলের কথা বলতে পারব না, সেই দিক দিয়ে বিচার করতে গেলে আমি নিজে কিন্তু ভণ্ড। ভক্ত হতে গেলে ঠাকুরত্বকে জাগাতে হবে চরিত্রে। সেটা যখন জাগাতে ব্যর্থ হয়েছি, তাহলে আমি ভণ্ড ছাড়া আর কি! তাই ভণ্ডামি ত্যাগ করে আমাকেও গুটি কেটে খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে পড়তে হবে, পরিস্থিতিকে সামাল দিতে। পরিস্থিতিকে এড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারব না।

ইষ্টভরণ, পিতৃপোষণ

পরিস্থিতির উন্নয়ন,

এ না ক’রে যাই করিস্ না

অধঃপাতেই তোর চলন। ২ ।

(অনুশ্রুতি, ১ম খণ্ড)

ইষ্টপ্রোক্ত উদ্ধৃত বাণীর অধঃপতন থেকে ব্যক্তিসত্তাকে, সংঘ-সত্তাকে বাঁচাতে হলে অসৎ-নিরোধে তৎপর হতেই হবে। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র “ব্যক্তি-দম্পতি-গৃহ-সমাজ-রাষ্ট্র উদ্ধার”-কল্পে, যজন-যাজন-ইষ্টভৃতি-স্বস্ত্যয়ণী প্রবর্তন করছেন। সেকথা বিস্মরণ হলে ইষ্টাদর্শের অপলাপ করা হবে। জয়গুরু! বন্দে পুরুষোত্তমম্!

AARYA MAHASABHA

** রাজনীতি বলে তায়/পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যায়/সংহতি আনে যায়। **
।।  প্রসঙ্গ : আর্য্য মহাসভা গঠন  ।।
নিবেদনে—তপন দাস
————————————————-

        সবিনয় নিবেদন,

[ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসন ক্ষমতা অধিকার করার জন্য অনেক রাজনৈতিক দল থাকা সত্ত্বেও “আর্য্য মহাসভা” নামের রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রয়োজন হলো কেন, তার সমর্থনে আমার বক্তব্য।]

গণপ্রজাতন্ত্রী আধুনিক ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভের ধর্মচক্র  আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ধর্মকে রক্ষা করে চলার কর্তব্যকে। আমাদের রাষ্ট্রীয় মন্ত্র ‘সত্যমেব জয়তে’ স্মরণ করিয়ে দেয় উপনিষদীয় আচার্য্য অনুসরণের শাশ্বত অবলম্বনকে। রাষ্ট্রের কর্ণধার রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রীবর্গ প্রত্যেকেই ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করে ঈশ্বরের প্রতিভূ জীবগণের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হয়। ঈশ্বরের প্রতিনিধি স্বরূপ জাগতিক ন্যায়দণ্ডধারী বিচারকেরা ধর্মাধিকরণ পরিচয়ে বন্দিত। বিচারালয়কে বলা হয় ন্যায়ালয় বা ধর্মস্থান।
ভারতীয় অনুশাসনের সাম, দান, ন্যায়, দণ্ড, নীতি ও ভেদ-এর রাজধর্ম রক্ষার পবিত্র কর্তব্যে যা’তে এতটুকু অন্যায়, অধর্ম প্রবেশ করতে না পারে তার জন্যই ওইসব মহাভারতীয় নীতির অনুসরণ। বিধিবৎ প্রকৃষ্ট-জাতক সৃষ্টি করে প্রজা পালনের স্বার্থেই ওই অনুশাসনকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেই প্রজাপালনের পবিত্র দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাজনৈতিক দলেরা। সেই সুবাদে রাজনৈতিক দলের জন-প্রতিনিধিরা নিজেদের দেশসেবক বলে পরিচয় দেন।

দেশের সেবা করতে হলে প্রথমেই দেশের জনগণের জৈবিক তাগিদ পূরণের জন্য আর কিছু না হোক, অন্ন , বস্ত্র, বাসস্থানের যোগান দিতে হবে। আর তারজন্য প্রথমেই প্রয়োজন বিশুদ্ধ, সুস্থ একটা পরিবেশ। দেশসেবকেরা বিষয়টি নিয়ে যদি ভাবতেন তাহলে সত্যের পরিপন্থী অসত্য, অন্যায়, অধর্ম প্রশ্রয় পেত না। সবুজায়ন বিনষ্ট করে নগরায়নের বাড়বাড়ন্ত হতে পারতো না!

প্রাথমিকভাবে বায়ু, জল, মাটি, সূর্যালোক প্রভৃতি অজৈব উপাদানের উপর আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। শুধু মানুষ নয়, পরিবেশের উদ্ভিদ থেকে প্রাণী সকলের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা ওই অজৈব উপাদান বা পঞ্চ মহাভূতের উপর নির্ভরশীল। তাহলে দেশসেবার প্রথম কাজ হবে অসৎ নিরোধী তৎপরতার সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখা। তারপর পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যার অনুশাসন মেনে নানাভাষা, নানামত, নানা পরিধানের মানুষের বৈশিষ্ট্য টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা। মহান ভারতের রাজর্ষি জনক যে নিয়মে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন (সূত্র : মহাভারত, বনপর্ব)। ঠিক সেইভাবে অসৎ নিরোধী তৎপরতার সাথে  রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হবে।   তথাপি “মেরা ভারত  মহান।” শ্লোগানে  বিশ্বাসী  ভারতীয় শাসন সংহিতা বা সংবিধান ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সম্প্রদায় নিরপেক্ষ ধর্মপ্রাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ না করে, ধর্ম এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়কে এক করে ফেলে ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদ’,––অর্থাৎ রাষ্ট্র ধর্মের অনুবর্তী নয়’-এর মতবাদকে প্রতিষ্ঠা দেয়, তখন কি মনে হয় না যে, আমরা জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েও এক পরস্পর বিরোধী আচরণ করে চলেছি !
শাস্ত্র বা বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, যে নীতি-বিধি পদার্থের অস্তিত্ব রক্ষার সহায়ক তাই তো ধর্ম। অথবা বলা যায়, পদার্থের স্বকীয়তা ধারণ করে রাখে যা’ তাই ধর্ম। ধর্ম পালন করলেই পদার্থ টিঁকে থাকবে, নচেৎ থাকবে না। সংসদ প্রকাশিত ইংরেজী অভিধানে ধর্মের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘It is an action, one is bound to do.’ সেই ধর্মের আবার পক্ষ আর নিরপেক্ষ কি? ঈশ্বর যেমন এক এবং অদ্বিতীয়, ধর্মও তেমনই এক অদ্বিতীয়। এর কোন প্রকার হয় না।
      বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যিক অজৈব উপকরণ বায়ু, জল, মাটি ইত্যাদির যদি ধর্ম থাকতে পারে, এবং তা’ যদি বিজ্ঞানের বইতে পাঠ্য হতে পারে, তাহলে মানুষের কি ধর্ম নেই? মনুষ্যত্ব প্রকাশের মাধ্যমেই তো মানুষ ধার্মিকতার পরিচয় দেয়। মানুষের মনুষ্যত্বের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার নীতিবিধি-সমন্বিত ভারতের নিজস্ব সংহিতাগুলোর বিধানসমূহ ভারতীয় শাসনতন্ত্রের সংহিতায় স্থান পাবে না কেন, প্রজাদের শিক্ষা দিতে পাঠ্য করা হবে না কেন?
বর্তমান যুগ-পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কথিত ধর্মের যুগান্তকারী সংজ্ঞা ‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে/ধর্ম বলে জানিস তাকে। ধর্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে/সম্প্রদায়টা ধর্ম না-রে।’ ওই সম্প্রদায় নিরপেক্ষ সমন্বয় বার্তাবহ বাণীকে গুরুত্ব না দিয়ে ধর্মের নামে, ভারতীয় সংহিতার নীতি বহির্ভূত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রবৃত্তি পরায়ণতার আস্ফালনকে, কতগুলো অনিত্য, অসার, পৌত্তলিক কু-সংস্কারকে যদি ‘ধর্ম’ নামে প্রতিষ্ঠা দিতে চাই, তা’ কি বিচক্ষণতার পরিচায়ক হবে, না ভারতবর্ষের কৃষ্টির পরিপূরক হবে? ওই ভুলের বোঝা কি আমাদের চিরদিন বইতে হবে? আমাদের বুদ্ধি, বোধ কি নিরেটই থেকে যাবে?

রাষ্ট্রের সৃষ্টিই তো প্রজাদের অধর্ম বা দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে ধার্মিক, অর্থাৎ সু-নীতি পরায়ণ করে তোলার জন্য। সেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলো যদি ওই মহান কর্তব্য ভুলে তার প্রজাবর্গকে, তাদের পিতৃ-পিতামহের আদর্শ অনুসারী ধর্ম-পরায়ণ, কৃষ্টি-পরায়ণ হতে উৎসাহ না দিয়ে, প্রবৃত্তি-পরায়ণতায় উৎসাহ দেয়, সেটা ভারতবর্ষের জাতীয় উত্তরাধিকারত্বের অস্তিত্বকে বিপন্ন করার বার্তা ভিন্ন আর কিছু নয়।
‘‘প্রজা মানেই হচ্ছে—
প্রকৃষ্টরূপে জাত—
সর্ব্বসম্ভাব্য উদ্বর্দ্ধনী সার্থকতায় ;
আর প্রকৃষ্ট জন্ম পেতে হলেই চাই—
প্রজনন পরিশুদ্ধি—
সর্ব্ব-সম্ভাব্যতার বৈধানিক সংস্থিতিতে. …. ’’
(‘সম্বিতী’ গ্রন্থ থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বাণী)
মূণ্ডক উপনিষদের পবিত্র মন্ত্র ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শকে সম্বল করে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট গণ প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের যাত্রা সুরু হলেও ‘‘Of the people, by the people, for the people—জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।’’-এর লক্ষ্যে রচিত কতগুলো বিধিবদ্ধ নিয়ম, শাসন সংহিতা বা সংবিধান ১৯৪৯ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী স্বীকৃতি লাভ করে, যে দিনটাকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

‘প্রজা’ শব্দের অর্থ প্রকৃষ্ট জাতক। আর তন্ত্র মানে কতগুলো বিধিবদ্ধ নিয়ম বা system।
প্রজাতন্ত্রের মর্মার্থ হচ্ছে, যে তন্ত্র বা system মেনে আদর্শ প্রজা নির্মাণ, পালন, পোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষায় প্রযত্নশীল থেকে পরম রাষ্ট্রিক সমবায়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা যায়। ভারতের ব্রহ্মসূত্র, মহাকাব্য, বেদ, উপনিষদ, সংহিতা, আদর্শপুরুষ শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ বলে যা কিছু বর্তমান,—সবকিছুই ওই ‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।
সত্য মানে অস্তিত্ব। যার অস্তিত্ব আছে যার বিকাশ আছে তাই সত্য (real)। ঋষি প্রদর্শিত এই সত্যের পথই আর্য্য ভারতবর্ষের মূলধন। আমাদের আদর্শ ছিল– ‘আত্মানং বিদ্ধি’, নিজেকে জানো, know thyself, ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু, মাতৃবৎ পরদারেষু, লোষ্ট্রবৎ পরদ্রব্যেষু।’ সকলকে নিজসত্তার প্রতীক মনে কর, মেয়েদের নিজের মায়ের প্রতিরূপ ভেবে শ্রদ্ধা কর, অন্যের জিনিসকে মাটির ঢেলার মত দ্যাখ। ‘মা গৃধ’, লোভ কর না। তথাপি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রজাগণ কেন সত্যভ্রষ্ট হচ্ছে, ভেবে দেখার প্রয়োজন নেই?
এর উত্তর রয়েছে ভারতের নিজস্ব অর্থশাস্ত্র কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে।
‘‘সুখস্য মূলম্ ধর্মম্,
ধর্মস্য মূলম্ রাষ্ট্রম্,
রাষ্ট্রস্য মূলম্ অর্থম্,
অর্থস্য মূলম্ ইন্দ্রিয়-বিজয়ম্,
ইন্দ্রিয়-বিজয়স্য মূলম্ জ্ঞানবৃদ্ধসেবয়া,
জ্ঞানবৃদ্ধসেবয়া বিজ্ঞানম্।।“
অর্থাৎ, সুখের মূলে ধর্ম। ধর্মের মূলে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের মূলে অর্থ । (পুরুষার্থের চতুর্বর্গ—বর্ণাশ্রম এবং চতুরাশ্রমধর্ম পালন করে পরমার্থ লাভের বিষযে বলা হয়ছে ।) ইন্দ্রিয়জয়ী না হলে পরমার্থ লাভ হয় না । ইন্দ্রিয়জয়ী হতে হলে সদগুরুর সারূপ্য লাভ করতে হবে। সদগুরুর দীক্ষা নিয়ে সেইভাবে চলতে হবে। তা হলেই বিশেষ জ্ঞান লাভ হবে ।
উক্ত বিধি পালন করে প্রকৃষ্ট জাতক বা ‘প্রজা’ সৃষ্টির প্রবহমানতাকে রক্ষা করে চলাই ছিল আর্য্য ভারতের আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্য।
গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন ভারতবর্ষ ১৯৪৯ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী ‘সত্যমেব জয়তে’র আদর্শকে মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, যাকে আমরা আজও রাষ্ট্রের পবিত্র মন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছি। তথাপি ওইসব বিধিকে আড়াল করে  প্রবৃত্তি-পরিপোষিত শিক্ষায় প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের প্রজাদের শিক্ষিত করতে চাইছি। ফলে সন্ত্রাসবাদ, ভ্রষ্টাচার, যৌন-ব্যভিচার ক্রমবর্দ্ধমান। এর কারণ ‘সত্যমেব জয়তে’ কে বাস্তবে মূর্ত করে তোলার মত কোন ইন্দ্রিয়জয়ী সৎপুরুষের জীবন্ত আদর্শ অনুসরণ করছে না রাষ্ট্র। ফলে দেশে মহানগরের বাড়বাড়ন্ত হলেও মনুষ্যত্বের পরিচয় সম্পন্ন ‘পিতামাতার সুজননের সুসন্তান, সন্তানের সুমাতা-সুপিতা, সমাজের সুবন্ধু, রাষ্ট্রের সুনাগরিক’ এমন মহান নাগরিকের সংখ্যা ক্রমশঃ যেন অবলুপ্তির পথে।
তাই তো বর্তমান সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানবৃদ্ধ পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সভ্যতাকে সংকট থেকে মুক্ত করতে নিদান দিলেন :
“শাসন-সংস্থা যেমনই হোক,
যাতেই মাথা ঘামাও না,
যৌন-ব্যাপার শুদ্ধ না হলে
দেশের জীবন টিঁকবে না।” (অনুশ্রুতি)
‘সত্যমেব জয়তে’-এর আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের প্রবহমানতা টিঁকিয়ে রাখতে হলে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে আদর্শ প্রজা সৃষ্টির মাধ্যম, সুবিবাহ ও সুপ্রজননের ওপর।       
তাই প্রকৃত অর্থে প্রজাতন্ত্রকে বাস্তবায়িত করতে আর্য্য মহাসভা নামের রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করার প্রয়োজন আছে। বর্তমান রাজনৈতিক  দলের সাথে সচেতন  ব্যক্তি যারা যুক্ত আছেন তারা কিন্তু পার্টির  সব দুর্নীতি  মেনে নিতে পারেন না। তাদের পথ দেখাতে  ত্রাতার  ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন আমার  গুরুদেবের একটা বাণী। “রাজনীতি বলে তায়/পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যায়/সংহতি আনে যায়।” যে নীতি সকলের অভাব পূরণ করে, সবাইকে অভীষ্ট মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় পোষণ দিয়ে সব্বাইকে প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ করে সংহতির  প্রতিষ্ঠা করতে  সমর্থ, সেই নীতির নাম রাজনীতি।
সকলের অভাব পূরণ যিনি বা যারা করবেন তাদের বৈশিষ্ট্যপালী হতে হবে। বৈশিষ্ট্য মানে বিশিষ্টতা। ওই বিশিষ্টতার পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা সংহতির প্রতিষ্ঠা যিনি করতে পারবেন তিনি হতে পারেন রাজনীতিবিদ। একজন গোপালক বা রাখাল বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের গোরু—ষাড়, বলদ, গাভী, দামড়া, বকনা নামের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের গোরুর পাল নিয়ে মাঠে চড়াতে যায়। একটা ছোট লাঠি বা পাচনের সাহায্যে সে গোরুর পালকে পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা সংহত রেখে আবার  গোধূলি বেলায় গোয়ালে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তেমনি একজন চাষী তার বিভিন্ন জমির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য  মেনে ভূমিকে কর্ষণ করেন বা চাষ দেন। জমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ‘জো’ বুঝে বীজ বপন  করেন, চারা রোপন করেন। তারপর উপযুক্ত জলসেচ, সার, কীটনাশক, পাহারা দিয়ে পূরণ, পোষণ, প্রীতিচর্য্যা দ্বারা ফসল উৎপাদন  করেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতে, বৈশিষ্ট্য মানে—তদনুপাতিক organic adjustment (বৈধানিক বিন্যাস)। তার আবার (group) গুচ্ছ আছে। এইগুলিকে বলা হয় বর্ণ, এর কোনটাই আমরা নষ্ট করতে চাই না। নষ্ট করা মানে যুগ যুগ ধরে, তিল তিল করে, যা গড়ে উঠেছে তা হারান। ন্যাংড়া আম আছে, ফজলি আম আছে আরো কত রকমের আম আছে। এর একটা জাত যদি নষ্ট করে ফেলি তাহলে তা’ আর ফিরে পাব না—হারাব চিরতরে। সেকি ভালো? ফজলি আমের মধ্যে তো আর ন্যাংড়া আমের স্বাদ পাব না। তাই যেন আমরা বুঝে চলি।  (আলোচনা প্রসঙ্গে, ১৬শ খণ্ড, পৃঃ ১০৯)

আমাদের ভারতের গ্রামীন অর্থনীতি কৃষি  ও গোপালনের উপর নির্ভরশীল। ভালো কৃষকেরা কখনোই  যেমন খুশি তেমনভাবে, নিজের খেয়ালখুশি মত চাষ করেন না। সরকারী  কৃষি বিভাগের পরামর্শ মেনে জমি অনুযায়ী উন্নত জাতের বীজ বপন করেন, চারা রোপন করেন। গোপালন ক্ষেত্রেও  তাই। সরকারী পশু পালন বিভাগের বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মেনে গাভীর জাতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সম-বিপরীত উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ দিয়ে উন্নত জাতের সুস্থ, সবল বাচ্চা উৎপাদন করেন।
আমরাও দৈনন্দিন জীবন-যাপনে সকলেই কিছু-না-কিছু বৈশিষ্ট্যের পালন-পোষণ  করেই থাকি। সচেতন ব্যক্তি মাত্রেই বাজার থেকে ভালো জাতের বা কোয়ালিটির আলু, বেগুন, পটল, মুলো, আম,  চাল, ডাল, চা কিনতে অভ্যস্ত।  এমন কোন  সুস্থ মানুষ নেই যে  উদারতার নামে হিমসাগর আমের দাম দিয়ে আঁশযুক্ত টোকো আঁটিসার আম কিনে  আনবেন। মিনিকীট, বাঁশকাঠি, গোবিন্দভোগ, দেরাদুন রাইসের দাম দিয়ে রেশন দোকানে প্রদত্ত মোটা চাল কিনে আনবেন।
এ থেকে প্রমাণিত হলো গাছপালা, পশুপাখি সবকিছুর জাত, বর্ণ আছে। জীব বিজ্ঞানের পুস্তকেও জাতি, প্রজাতি, বর্ণ, গোত্র-এর উল্লেখ আছে। তাহলে মানুষের কি নেই?  অবশ্যই আছে।  মানুষ তো সব জাতহীন হয়ে যায় নি! তবে হ্যাঁ, জাতের নামে বজ্জাতি চলছে—শিডিউলড, আন-শিডিউলড, ট্রাইব নিয়ে ধান্দাবাজি করতে গিয়ে সহজাত-সংস্কারের বৈশিষ্ট্যটাকে নাকাল হতে  হচ্ছে ! অন্যায়, অধর্ম করে, অন্যের বৃত্তি হরণ করে টাকা উপার্জন করতে গিয়ে এক অসম অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করে চলেছি। অর্থ অনর্থ সৃষ্টি করছে!

মানুষের জাত বা সহজাত সংস্কার এবং তাদের জৈবিক তাগিদগুলো প্রবৃত্তির কবলে পড়ে মনুষ্যত্বের অপলাপী কর্মে লিপ্ত যাতে না হতে পারে, বিধিবৎ নীতি প্রণয়ণ করে বিহিত ব্যবস্থায় মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষা করা, রাজনীতির নির্দিষ্ট কর্ম।—সে বিষয়ে উদাসীন রাজনৈতিক জন প্রতিনিধি গণ !
তত‍ঃ কিম্ । তাহলে করণীয় কি।
নৃতাত্ত্বিক গঠনের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী মানুষকে আল্পাইন, ব্রাকিসেফাল, মেডিটেরিয়ান, মঙ্গোলয়েড, নর্ডিক, নিগ্রোয়েড প্রভৃতি নামে শ্রেণী বিভাজন করা হয়েছে।  প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সহজাত সংস্কার গুণ ও কর্মভিত্তিক বর্ণাশ্রম বিভাজনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন আর্য্য ঋষিরা।  শাস্ত্রে গুণ এবং কর্ম দেখে বর্ণ নিরূপণ করার বিধান রয়েছে। সত্ত্ব গুণে বিপ্র। সত্ত্ব মিশ্রিত রজোগুণে ক্ষত্রিয়। রজোমিশ্রিত তমোগুণে বৈশ্য এবং তমোগুণাধিকারে শূদ্র চিহ্নিত করা হয়েছিল। এবং তদনুযায়ী কর্ম নির্ধারিত হয়েছিল। প্রাকৃতিক নিয়মে সকলেই স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান অধিকার  করে আছে।
এ বিষয়ে একটা সুন্দর ছড়া আছে।
“শূদ্রই তো জাতির চাকা
বৈশ্য জোগায় দেশের টাকা,
ক্ষত্রিয়েরা  রাজার জাত
সবার পূরণ বিপ্র ধাত।

আরো বিস্তারিত ভাবে বললেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
” …… আর্য্য জাতির uphill motion-এর (উর্ধগামী গতির) acceleration (ত্বরান্বিত করা)-ই হ’চ্ছে front-(সম্মুখে) ব্রাহ্মণ আর back-এ (পিছনে) শূদ্র। চাতুর্বর্ণ্য বিভাগ কতকটা আমাদের body system-এর (শরীর বিধানের) মতন। শূদ্র হ’চ্ছে এই whole system-এর (সমুদয় বিধানের) carrier (বাহক) এবং supporter (সহায়ক), যা’র উপর ভর দিয়ে এই সমাজদেহ চলছে। বৈশ্যদের function (কর্তব্য) হ’ল সমাজদেহকে সুস্থ রাখা by the supply of proper nutrition and food (যথোপযুক্ত পুষ্টি এবং খাদ্য সরবরাহ দ্বারা)।  বৈশ্যশক্তি এই function discharge (কর্তব্য সম্পাদন) করতে যেদিন পরাঙ্মুখ হ’ল, সেদিন এই সমাজদেহ ভেঙ্গে পড়লো। Stomach (পাকস্থলী) যদি boycott (অসহযোগ) করে, আমাদের body-system-এর (শরীর বিধানের) যে অবস্থা হয় তাই হ’ল। এই বৈশ্যশক্তি যদি আবার জাগে এবং legs, heart ও brain-কে (পা, হৃৎপিন্ড ও মস্তিষ্ককে) proper nutrition supply করে (উপযুক্ত পুষ্টি যোগায়), তবে আবার সমাজদেহ জেগে উঠবে। Body system-এর মধ্যে heart (হৃৎপিন্ড) যেমন, সমাজদেহের মধ্যে ক্ষত্রিয় তেমন। Heart-এর মধ্যে দু’রকম cells (কোষ) আছেঃ (১) white cells (সাদা কোষ) (২) Red cells (লাল কোষ)। Red cells-এর (লাল কোষের) কাজ হ’চ্ছে body-কে fit (কার্যক্ষম) রাখা এবং maintain (পরিপোষণ) করা by the proper distribution of red blood (লাল রক্ত উপযুক্ত ভাবে বিতরণ দ্বারা); এবং white cells-এর (সাদা কোষের) কাজ হ’চ্ছে body-কে protect (রক্ষা) করা। ক্ষত্রিয়ত্বের মধ্যে এই দু’টি function (কার্য) আছে; একটি সমাজদেহকে fit (কার্যক্ষম) রাখা ও maintain (প্রতিপালন) করা, আর একটি disease-এর(রোগের) হাত থেকে protect(রক্ষা) করা। কিন্তু এই দুই blood-এর supply (যোগান) নির্ভর করছে stomach-এর (পাকস্থলীর) উপর। সমাজদেহের brain (মস্তিষ্ক) হ’চ্ছেন ব্রাহ্মণ (বিপ্র), যাঁদের working (কার্যতা) নির্ভর করছে ক্ষত্রিয়শক্তি বৈশ্যশক্তি এবং শূদ্রশক্তির উপর। তাঁরা যেমন-তেমন এই তিন শক্তির নিকট support and help (সাহায্য ও সহানুভূতি) পা’চ্ছেন, তেমন-তেমন এই তিনকে regulate, control (নিয়মিত ও আয়ত্ত) করতে পারছেন। এই চারিশক্তির মধ্যে কেহই ছোট-বড় নয়। একটা harmony (সমন্বয়) ও co-ordination-এর (সমবায়ের) যোগে এদের মধ্যে একযোগে একতানে কাজ হ’চ্ছে। কিন্তু body এর মধ্যে brain-এর স্থান যেমন সর্বোচ্চ এবং সর্ব উচ্চে থাকাটা legs, stomach ও heart-এর existence-এর পক্ষে নিতান্ত দরকার, তেমন ব্রাহ্মণকে উচ্চ place দেওয়াতে, যে উচ্চতা তাঁ’র মধ্যে inherent (স্বাভাবিক) হ’য়ে আছে, অন্যান্য বর্ণ চলতে পারছে ঠিকমত তাঁরই guidance-এ (নির্দেশে)। Head-কে বড় স্বীকার করা যেমন body-র অন্যান্য অঙ্গের পক্ষে লজ্জার নয়, বরং পরম গৌরবের, তেমনি অন্যান্য বর্ণের পক্ষে ব্রাহ্মণকে বড় ব’লে মানা তাঁদের বাঁচা-বাড়ার পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। Superior (শ্রেয়)-এর উপর শ্রদ্ধা রে’খে যদি তুমি সমাজকে পুনর্গঠন করতে লেগে যাও,তবে সে সমাজ টিঁকবে-তার growth (বৃদ্ধি) হবে healthy.” (ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃঃ-৬৮-৬৯)

উপরোক্ত বাণী থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, বর্ণাশ্রমের বিন্যস্ত বিভাজন আমাদের শরীর বিধানেও বিদ্যমান। বর্ণাশ্রমানুগ বিধান অনুযায়ী শূদ্র বর্ণ শ্রমশিল্প , কারিগরি বিদ্যার সেবার মাধ্যমে সব বর্ণকে সাহায্য করবেন। শরীর বিধানে আমাদের পদযুগল দেহটাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায়  তাই পদযুগলকে শূদ্র  বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বৈশ্যরা কৃষি ও বাণিজ্যের সেবা দ্বারা সকলের উদরপূর্তি করছেন। সেই উদরকে  বয়ে  বেড়াচ্ছে জানু বা জঙ্ঘা। তাই জঙ্ঘা  বৈশ্যত্বের প্রতীক। ক্ষত্রিয়রা বাহুবল দ্বারা অসৎ নিরোধ করে সমাজকে রক্ষা করেন। শরীর বিধানে বাহু আমাদের দেহটাকে বিপদ-আপদ  থেকে আগলায়, ক্ষত থেকে ত্রাণ  করে, তাই বাহুকে ক্ষত্রিয় বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বিপ্র বর্ণ বোধ ও বোধির পরামর্শ দিয়ে সকল বর্ণকে বর্ণধর্ম পালন করার শিক্ষা দেয়, বর্ণানুগ কর্মে উৎসাহিত করে বিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের মস্তিষ্ক বিবেক, বিচার-বুদ্ধি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমগ্র দেহটাকে পরিচালনা করে, তাই মাথাকে বিপ্র বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এইভাবে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিন্যস্ত মেলবন্ধনে দেহটাকে সুস্থভাবে পরিচালিত  করতে সাহায্য করে। ছোটবড়ো কেউ নয়। যে যার বৈশিষ্ট্যে শ্রেষ্ঠ। ওই শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়মকে অগ্রাহ্য করে কেউ যদি মাথার কাজ পা-কে দিয়ে, পায়ের  কাজ মাথাকে দিয়ে করাতে যায় তাহলে দেহটাই রক্ষা করা যাবে না। তেমনি বিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থা রক্ষার স্বার্থে আর্য্য  ঋষিরা প্রতিটি বর্ণের জন্য নির্দিষ্ট কর্ম ও আইডেনটিটি বা স্মারক চিহ্নের বিধান দিয়েছেন।  শ্বেত বর্ণে বিপ্র, লোহিত বর্ণে ক্ষত্রিয়, পীত বর্ণে বৈশ্য এবং নীল বর্ণে শূদ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই জীবনীয়  বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ করার করার বিধির নাম ধর্ম। ধর্মকে রক্ষা করার জন্য রাজনীতি। শ্রীমদ্ভগবতগীতা যার প্রকৃষ্ট  উদাহরণ।  বর্ণাশ্রম বিধায়িত বিন্যস্ত সমাজের ওই চারটি বর্ণের চিহ্ন শ্বেত, লোহিত, পীত ও নীল। বর্তমান পুরুষোত্তম  যাকে আর্য্যকৃষ্টির স্মারক পতাকা হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন।—সেই পতাকার অনুসরণে আমরা দলীয় পতাকা  নির্বাচন করেছি।

।। ‘আর্য্য’ শব্দের  বিশেষত্ব ।।
‘আর্য্য’ শব্দটি গুণবাচক। যাঁরা বর্ণাশ্রম, চতুরাশ্রম পরিপূরণী দশবিধ সংস্কারে সংস্কৃত হতেন তাঁদেরই আর্য্য অভিধায় ভূষিত করা হতো । তাঁরাই ক্রমে আর্য্য জাতিভুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমান যুগধর্মে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যেমন সম্বোধনে ‘স্যর’, ‘ম্যাডাম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেসময় সদাচারী বর্ণাশ্রমানুগজীবন যাপন কারীদের উদ্দেশ্যে ‘আর্য্য’, ‘আর্য্যপুত্র’, ‘আর্য্যা’ ইত্যাদি সম্বোধনসূচক শব্দ ব্যবহৃত হতো। এই ব্যবস্থা সকলের জন্য, এখানে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। এ বিষয়ে বর্তমান পুরুষোত্তম এক  যুগান্তকারী বিধান দিলেন।
মঙ্গোলীয় নিগ্রো যারা
দ্রাবিড়ী কোল ম্লেচ্ছাবধি
আর্য্যীকৃত হলেই তারা
আর্য্যদেরই সুসন্ততি।
“পঞ্চবর্হি যা’রা স্বীকার করে, আর সপ্তার্চ্চি অনুসরণ করে, তারা যেই হোক আর যা’ই হোক– আর্য্য বা আর্য্যীকৃত । ৬০১ ।
(শাশ্বতী অখণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৭)
     পঞ্চবর্হিঃ
১। একমেবাদ্বিতীয়ং শরণম্।
২। পূর্ব্বেষামাপূরয়িতারঃ প্রবুদ্ধা ঋষয় শরণম্।
৩। তদ্বর্ত্মানুবর্ত্তিনঃ পিতরঃ শরণম্।
৪। সত্তানুগুণা বর্ণাশ্রমাঃ শরণম্।
৫। পূর্ব্বাপূরকো বর্ত্তমানঃ পুরুষোত্তমঃ শরণম্ ।
   এতদেবার্য্যায়ণম্, এষ এব সদ্ধর্ম্মঃ,
   এতদেব শাশ্বতং শরণ্যম্।’’
১। এক অদ্বিতীয়ের শরণ লইতেছি।
২। পূর্ব্বপূরণকারী প্রবুদ্ধ ঋষিগণের শরণ লইতেছি।
৩। তাঁহাদের পথ অনুসরণকারী পিতৃপুরুষগণের শরণ লইতেছি।
৪। অস্তিত্বের গুণপরিপোষক বর্ণাশ্রমের শরণ লইতেছি।
৫। পূর্ব্ব-পূরণকারী বর্ত্তমান পুরুষোত্তমের শরণ লইতেছি।
ইহাই আর্য্যপথ, ইহাই সদ্ধর্ম্ম, আর ইহাই চিরন্তন শরণযোগ্য।
“আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেল সেইদিন যেদিন থেকে আমরা পঞ্চবর্হির মূল নির্দ্দেশ অবজ্ঞা করতে শুরু করলাম। তখন থেকে আমরা অপরের  খোরাক হলাম কিন্তু নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখে পরকে আপন ক’রে নেবার সামর্থ্য হারিয়ে ফেললাম।”
(আঃ প্রঃ ১১। ১০০)

      সপ্তার্চ্চিঃ
১। নোপাস্যমন্যদ্ ব্রহ্মণো ব্রহ্মৈকমেবাদ্বিতীয়ম্।
২। তথাগতাস্তদ্বার্ত্তিকা অভেদাঃ।
৩। তথাগতাগ্র্যোহি বর্ত্তমানঃ পুরুষোত্তমঃ
পূর্ব্বেষামাপূরয়িতা বিশিষ্ট-বিশেষ বিগ্রহঃ।
৪। তদনুকূলশাসনং হ্যনুসর্ত্তব্যন্নেতরৎ।
৫। শিষ্টাপ্তবেদপিতৃপরলোকদেবাঃ শ্রদ্ধেয়া নাপোহ্যাঃ।
৬। সদাচারা বর্ণাশ্রমানুগজীবনবর্দ্ধনা নিতং পালনীয়াঃ।
৭। বিহিতসবর্ণানুলোমাচারাঃ পরমোৎকর্ষ হেতবঃ
স্বভাবপরিদ্ধংসিনস্তু প্রতিলোমাচারাঃ।’’
১। ব্রহ্ম ভিন্ন আর কেহ উপাস্য নহে, ব্রহ্ম এক–অদ্বিতীয়।
২। তথাগত তাঁর বার্ত্তাবহগণ অভিন্ন।
৩। তথাগতগণের অগ্রণী বর্ত্তমান পুরুষোত্তম, পূর্ব্ব-পূর্ব্বগণের পূরণকারী বিশিষ্ট বিশেষ বিগ্রহ।
৪। তাঁহার অনুকূল শাসনই অনুসরণীয়—তাহা ভিন্ন অন্য কিছু অনুসরণীয় নহে। এই
৫। ঋষি-অনুশাসিত প্রামাণ্য জ্ঞান, পিতৃপুরুষ, পরলোক, দেবতাগণ শ্রদ্ধেয়— অবহেলার যোগ্য নহে।
৬। বর্ণাশ্রমের অনুকূল বাঁচাবাড়ার পরিপোষক সদাচার-সমূহ-নিত্যপালনীয়।
৭। বিহিত সবর্ণ ও অনুলোমক্রমিক (বিবাহাদি) আচারসমূহ পরম উৎকর্ষের কারণ— প্রতিলোম-আচার স্বভাব-ধ্বংসকারী।

শ্রীশ্রীঠাকুর সম্বিতী গ্রন্থে বলছেন—
মতবাদ যাই হোক না,—
আর, যে-কোন সম্প্রদায়ই হোক,
যা’ মুখ্যতঃ ‘পঞ্চবর্হিঃ’ ও ‘সপ্তার্চ্চিঃ’কে
স্বীকার করেনিকো—
কোন-না-কোন রকমে,—
তা’ কখনও অনুসরণ করতে যেও না,
তা’ কিন্তু জঘন্য—অসম্পূর্ণ,
সত্তা-সম্বর্দ্ধনার পরিপন্থী তা’;
আর, ঐ ‘পঞ্চবর্হিঃ’ ও ‘সপ্তার্চ্চিঃ’ই হ’চ্ছে
সেই রাজপথ—
যা’কে স্বীকার ও গ্রহণ করে চললে
ক্রমশঃই তুমি সার্থকতায় সমুন্নত হ’তে পার। ২৩৪
এই বাণী বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকে মনুষ্যত্বে উত্তরণের পথ দেখিয়েছে। এখন মানা, না-মানা প্রবৃত্তি-প্রেমীদের নিজস্ব ব্যাপার!

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাস্তব উদাহরণঃ
“ধর্ম্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে
সম্প্রদায়টা ধর্ম্ম না রে।।”
আমি বুঝিনা–কোন হিন্দু শুচিশুদ্ধভাবে মসজিদে যেয়ে প্রার্থনা করতে পারবে না কেন, আবার একজন সদাচারী মুসলমান হিন্দুর প্রার্থনা-মন্দিরে বসে প্রার্থনা করতে পারবে না কেন ! ভগবান মানুষকে তার language (ভাষা) দিয়ে চেনেন না, তিনি চেনেন তাকে তার feeling (বোধ) ও activity (কর্ম্ম) দিয়ে। (আঃ প্রঃ ৯ম খণ্ড)
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন—হজরত যীশু, হজরত মহম্মদ আমাদেরও prophet (প্রেরিতপুরুষ)। আর্য্যধারা যদি জীবন্ত থাকত, তা’হলে হজরত যীশু, হজরত মহম্মদ হয়তো একাদশ অবতার, দ্বাদশ অবতার ব’লে পরিগণিত হ’তেন। Anti-Biblism (বাইবেল-বিরোধী), Anti-Quranism (কোরাণ-বিরোধী), Anti-Vedism (বেদ-বিরোধী)-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তার নিরাকরণ করতে হবে। শাক্ত বিপ্র এবং বৈষ্ণব বিপ্র-পরিবারে যেমন বিয়ে-সাদির কোন নিষেধ নেই—সৌর বিপ্র ও গাণপত্য বিপ্রে যেমন বিয়ে চলতে পারে, ইষ্ট, কৃষ্টি ও পিতৃপুরুষের ঐতিহ্যবাহী রসুল-ভক্ত বিপ্র, বুদ্ধভক্ত বিপ্র, খ্রীষ্টভক্ত বিপ্রের সঙ্গেও তেমনি বিধিমাফিক বিয়ে-থাওয়া হ’তে পারে—এতে কোন বাধা নেই। কারণ, স্বধর্ম্ম ও কৃষ্টি-নিষ্ঠ থেকে যে-কোন পূরয়মাণ মহাপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধানতি নিয়ে চলা ধর্ম্মের পরিপন্থী তো নয়ই বরং পরিপোষক। তবে প্রত্যেকটি বিয়ের ব্যাপারে খুব হিসাব ক’রে চলতে হবে, যাতে কোন রকমের ব্যত্যয়ী কিছু বা প্রতিলোম-সংস্রব না ঘটে। (আলোচনা প্রসঙ্গে ১ম খণ্ড, ২। ৭। ১৯৪০)
পরিশেষে বলতে চাই, “সত্যমেব জয়তে”-এর সীলমোহর এর অধিকারী হতে চাওয়া “আর্য্য মহাসভা” পার্টিসহ সকল দেশসেবক পার্টির   সদস্যদের আবশ্যিক পালনীয় প্রাথমিক বিষয়সমূহ— অভক্ষ্যভোজী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুনাদি তামসিক আহার করা যাবে না। অগম্যাগামী হওয়া যাবে না। অর্থাৎ  প্রতিলোম, সগোত্র এবং সপিণ্ড সম্বন্ধীয়দের সাথে অবিধি পূর্বক ধর্মবিরুদ্ধ বিবাহের মাধ্যমে কামাচার করা যাবে না। শারিরীক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সদাচার পালন করতে হবে। অসৎ পথ বর্জন করতে হবে। কদাচারী প্রদত্ত আহার ও পানীয় গ্রহণ করা যাবে না।
আমাদের জীবধর্মের এক আবশ্যিক জৈবিক তাগিদ হলো আহার বা খাদ্য। যদিও ব্যাপক অর্থে আহার মানে আহরণ। যার মধ্যে সবকিছুই আছে। খাওয়া-দাওয়া, শোয়া-বসা, চলাফেরা, কথাবার্তা, কাজকর্ম, তথাকথিত প্রেম-ভালবাসা, বিয়ে করা, বাবা-মা হওয়া ইত্যাদি। আমাদের উপনিষদের ঋষিরা ওই সবগুলোকে একত্রিত করে ‘আহার’ নামকরণ করে বললেন, ‘‘আহারশুদ্ধৌ সত্তাশুদ্ধিঃ, সত্তাশুদ্ধৌ ধ্রুবাস্মৃতিঃ …… ’’—অর্থাৎ জীবন ধারণের নিমিত্ত আহরণগুলো শুদ্ধ হলে সত্তা শুদ্ধি হয়, সত্তা শুদ্ধি হলে স্মৃতি নিশ্চল হয়। স্মৃতি নিশ্চল হলে জাতিস্মর হওয়া যায়। জীবনভূমির এপার-ওপার নিরীক্ষণ করা যায়। যারা দেশসেবক হবেন, তারা যদি আদর্শ চলন-চরিত্র দিয়ে আত্মশুদ্ধির পথে চলতে অভ্যস্ত না হন, দেশের নাগরিকদের কোন সম্পদের উপহার দেবেন ?  তাই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বিশুদ্ধ চলন-চরিত্রের ওপর নির্ভর  করছে  ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। এবং ওই  দৃষ্টান্তই  ভারতকে  মহান ভারতের শিরোপায় অধিষ্ঠিত করবে ভবিষ্যতে। এ বিষয়ে জীবন পিয়াসী সকল মানুষকে ভেবে দেখতে হবে। জয়গুরু। বন্দে পুরুষোত্তমম্!
নমস্কার ও ধন্যবাদসহ—